ঊর্ধ্বলোকে সংযোগ পাওয়ার পথ -মওলানা রুমির মসনবি শরিফ by ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
তুমি
দুনিয়াপূজার রোগে আক্রান্ত। তাই মন বাজে চিন্তার আখড়া। জীবনটা চলে যাচ্ছে
অর্থহীন কাজের পেছনে। কাজেই তোমাকে সংযমের জীবন বেছে নিতে হবে। চিন্তা ও
কর্মে শয়তানি মন্ত্রণা সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। নচেৎ তা হবে তোমার আত্মিক ও
নৈতিক জীবনের জন্য বিষ-জহর-হলাহল। ডায়াবেটিস রোগীর দেহে মিষ্টান্ন খাবার
মরণ ডেকে আনে। নফসের রোগে আক্রান্ত রুহে ভোগ বিলাসিতা, শয়তানি চিন্তামগ্নতা
রুহানি মৃত্যু ঘটায়।
মওলানা রুমি (রহ.) এর জীবনদর্শনের মূলকথা, আধ্যাত্মিক স্বাদে হৃদয় পরিতৃপ্ত কর আর যে দেশ থেকে এসেছ সে দেশে ফিরে যেতে উড়াল দাও। মওলানার কাছে একজন প্রশ্ন করে, সে দেশ কোথায়? কীভাবে উড়াল দেব এই জগৎ ছেড়ে? মওলানা বলেন, তোমার প্রশ্নের জবাব আমি হাকিম সানায়ির ভাষায় দিতে চাই।
গর রা’হ রওয়ী রা’হ বরত বগুশা’য়ন্দ
ওয়ার নীস্ত শওয়ী বে হাস্তিয়ত বেগ্রা’য়ন্দ
যদি সম্মুখে এগিয়ে চল তোমার জন্য রাস্তা খুলে দেবে
যদি ‘অস্তিত্বহীন’ হতে পার ‘অস্তিত্ব’ তোমায় দেওয়া হবে।
সেই দেশে যাওয়ার পথ খুঁজে পেতে হলে সম্মুখে এগিয়ে চলো। দেখবে, তোমার পথের বাধা একেক করে সরে যাচ্ছে। রাস্তা খুলে যাবে। নিজেকে তার কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে অস্তিত্বহীন হয়ে যাও। তোমাকে মানবিক গুণাবলিতে সজ্জিত নতুন জীবন দেওয়া হবে। তার দিকে এগিয়ে নেওয়া হবে। আল্লাহ তো বলেছেন, ‘আর যারা আমার পথে প্রাণান্ত সাধনা করে, জিহাদ করে, তাদের অবশ্যই আমার পথগুলোয় পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্র্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)।
তুমি পথ খুঁজে না পাওয়ার কারণ হলো, তোমার হুঁশজ্ঞান, চিন্তা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছ। আজেবাজে অনর্থক চিন্তায় ও কাজে নিজেকে মহাব্যস্ত করে রেখেছ। তোমার অস্তিত্বের বাগানে জ্ঞানবুদ্ধির যে পানি আছে, তা কাঁটাগুল্মের শিকড় চুষে নিচ্ছে। অনর্থক বিষয়, আজেবাজে চিন্তা, সৎ-উদ্দেশ্যহীন তৎপরতা কাঁটাগুল্মস্বরূপ। এগুলো তোমার জ্ঞানের বুদ্ধিমত্তার রস চুষে খাচ্ছে। ভোগ-বিলাসিতা, আত্মপূজা ও অহঙ্কারের নানা অনুষঙ্গের পেছনে তোমার ধ্যান-জ্ঞান, চেষ্টা ও সাধনা উজাড় হচ্ছে। ফলে তোমার অস্তিত্বের ভালো গুণ, উপাদেয় উপকারী বীজ ও চারাগাছ, তোমার জ্ঞানবুদ্ধির পানি দ্বারা সিঞ্চিত হতে পারছে না।
তোমার গোটা অস্তিত্ব শস্যক্ষেতের মতো। এখানে আগাছা আছে, ভালো ফল-ফুলের চারাগাছও আছে। বাজে বাতিল চিন্তা ও কর্মের আগাছা, যদি শস্যক্ষেতের পানি চুষে নেয়, আসল চারাগাছ তো পানি পাবে না। কাজেই ভালো ফল কীভাবে আশা করতে পার? তুমি আল্লাহর কথা নিত্যস্মরণ রেখে অস্তিত্বের চারাগাছে পানি দাও। অন্তরের জমি জিকির ও ফিকিরে তরতাজা রাখ। চোখ-কান খাড়া রেখে ক্ষেতের যত আগাছা শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেল।
বাগানের পানি আগাছার জন্য হারাম আর চারাগাছের জন্য হালাল- এই পার্থক্যটুকু তোমাকে বুঝতে হবে। বাগানের পানি মানে আকল বুদ্ধি, হুঁশজ্ঞান, যা তোমাকে দেওয়া আল্লাহর নেয়ামত। এ নেয়ামতের সদ্ব্যবহার কর, হক আদায় কর, কদর কর, যথাস্থানে কাজে লাগাও। এটি হালাল। অযথা অপাত্রে অপব্যবহার করা হারাম।
নে‘মতে হক রা’ বে জা’ন ও আকল দেহ
না বে তাবএ পুর যহীর ও পুর গেরেহ
আল্লাহর নেয়ামত উৎসর্র্গ কর প্রাণ ও আকলের কাজে
রোগশোকের আখড়া দেহের সেবায় উজাড় কর না তাকে।
তোমার রূহের উন্নয়নের কাজে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত ব্যবহার কর, কেবল দেহের সেবায় ব্যয় করলে তা হবে ‘উলু বনে মুক্তা ছড়ানো’। চোখের শোভা ও জ্যোতির জন্য আমরা সুরমা মাখি। এই সুরমা যদি চোখের পরিবর্তে কানে ঢাল, কী অবস্থা হবে? কেউ যদি বুঝতে পারে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে তাহলে সংযম অবলম্বন করতেই হবে। চিনি ও মিষ্টান্ন পরিহার করে চলতে হবে। তুমি দুনিয়াপূজার রোগে আক্রান্ত। তাই মন বাজে চিন্তার আখড়া। জীবনটা চলে যাচ্ছে অর্থহীন কাজের পেছনে। কাজেই তোমাকে সংযমের জীবন বেছে নিতে হবে। চিন্তা ও কর্মে শয়তানি মন্ত্রণা সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। নচেৎ তা হবে তোমার আত্মিক ও নৈতিক জীবনের জন্য বিষ-জহর-হলাহল। ডায়াবেটিস রোগীর দেহে মিষ্টান্ন খাবার মরণ ডেকে আনে। নফসের রোগে আক্রান্ত রুহে ভোগ বিলাসিতা, শয়তানি চিন্তামগ্নতা রুহানি মৃত্যু ঘটায়।
হে সাধক! তোমার অস্তিত্বের জমিনে দুই ধরনের গাছ আছে, দেখতে একই রকম সবুজাভ লিকলিকে। এক রকম চারাগাছ ফুলের বা ফলের, আরেক রকম চারাগাছ আগাছার। আগাছার শিকড় বিস্তৃত দোজখের আগুন ও ধোঁয়া থেকে। আর ফল-ফুলের চারাগাছের গোড়া সাত আসমানের উপরে। দূর থেকে মনে হবে, খামার বাড়িতে উভয় চারাগাছে সবুজের সমারোহ জেগেছে। যদি আগাছা আর চারাগাছের মাঝে ফারাক করতে না পার, জীবন বৃথা যাবে। ফারাক করতে চাইলে চোখ মেলে তাকাতে হবে। এই তাকানো বাহ্যদৃষ্টিতে নয়। কারণ, বাহ্যইন্দ্রিয়ের চোখ সাধারণত ভুল দেখে। যেমন অনেক দূরে হলে দেখে না, চোখের একেবারে কাছে ধরলেও দেখা যায় না। তাই তোমাকে দিলের চোখ খুলতে হবে। দিব্যদৃষ্টি খুলতে হলে তোমাকে আসতে হবে যিনি প্রাণের প্রাণ তার কাছে।
আগন্তুক প্রশ্ন করে, কীভাবে আসব? আমাকে যে জড়িয়ে ধরেছে দুনিয়ার সহায় সম্পদ, নামধাম, পদবি খ্যাতির মোহ? মওলানা রুমি বলেন, দৌড় দাও, তাহলে ছিঁড়ে যাবে দুনিয়ার বাঁধন। তারপরের প্রশ্ন, দৌড় কীভাবে দেব? মওলানা বাতলে দিচ্ছেন-
গর যুলায়খা বস্ত দরহা’ হার তরফ
ইয়াফত ইউসুফ হাম যে জুম্বিশ মুনসারাফ
জুলায়খা যদিও বন্ধ করেছিল সবদিক থেকে দরজা
ইউসুফ চেষ্টার দৌড়ে পেয়েছিল বাঁচবার আশ্রয় রাস্তা।
মওলানা এখানে কোরআন মজিদে বর্ণিত হজরত ইউসুফ (আ.) এর জীবনের একটি ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। সৎভাইরা খেলার নাম করে বাবা ইয়াকুব (আ.) এর কাছ থেকে ইউসুফকে মাঠে নিয়ে পরিত্যক্ত কুয়ায় নিক্ষেপ করেছিল। একটি বাণিজ্য কাফেলা যাত্রাবিরতিকালে কুয়ার পানি সংগ্রহে গিয়ে ফুটফুটে বালক ইউসুফকে পেয়ে মিসরের দাস বাজারে বিক্রি করে। পাল্লার একদিকে স্বর্ণ অন্যদিকে ইউসুফের ওজনে ইউসুফকে খরিদ করেন প্রধানমন্ত্রী আজিজ। রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলে আজিজপতœী জুলায়খা আসক্ত হয়ে পড়ে অনিন্দ্য সুন্দর ইউসুফের প্রতি। জুলায়খা ইউসুফের কাছে বারবার প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়। মনিবের ঘরে অসহায় ইউসুফকে একদিন জুলায়খা নানা ছলে অন্দর মহলে আটকায়। শাহী মহলের সব দরজায় তালা লাগায়। তারপর নিজেকে নিবেদন করে ইউসুফের কাছে। কোথাও ছিদ্রপথ পর্যন্ত ছিল না স্বপ্নপুরীতে। হঠাৎ ইউসুফ দৌড় দেন প্রেমাসক্ত জুলায়খার হাত থেকে বাঁচার জন্য। তখই দেখেন, তালা খোলা, দরজা মেলা, পালানোর রাস্তা সম্মুখে। কারণ, ইউসুফ তাওয়াক্কুল করেছিল আল্লাহর ওপর, তারপর চেষ্টার বদৌলতে জুলায়খার ফুসলানোর বাঁধনমুক্ত হতে পেরেছেন আল্লাহর সাহায্যে।
তুমিও যদি দেখ, দুনিয়ার বাঁধন থেকে মুক্তির পথ খোলা নেই, ফাঁকফোকর দেখা যায় না পালানোর, তাহলে ইউসুফের মতো বিচলিত হয়ে তাঁর আশ্রয় পেতে দৌড় দাও। মন থেকে বল, আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিমÑ ‘আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান হতে।’ তখন তোমার সামনেও খুলে যাবে মুক্তির পথ। খুলে যাবে ওই জগতের তালা। দেখবে, দরজা খোলা। তোমাকে তখন এমন জায়গায় নিয়ে যাবে, যার কোনো নাম-ঠিকানা নেই।
মওলানা এখন প্রশ্ন করেন, এই যে দুনিয়াতে এসেছ, জান কি কোত্থেকে এসেছ? তুমি হকিকতের এক বিশাল জগতে ছিলে। সেখান থেকে জড় জগত, উদ্ভিদ জগতের পথপরিক্রমা শেষে পরীক্ষার জন্য নেমে এসেছ পার্থিব জগতে, দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চে, সমাজে, সংসারে।
তো যে জা’য়ী আ’মাদী ওয়ায মাওতনী
আ’মদন রা’ রা’হ দানী হীচ নয়ী
তুমি এসেছে এমন অঞ্চল হতে এমন এক দেশ ছেড়ে
কীভাবে এখানে, নিশ্চয়ই জান না, এসেছ কোন পথে।
তুমি আগে ছিলে অন্য দেশের নাগরিক। বাস করতে এমন এলাকায়, যার পরিচয় এখন তোমার মনে নেই। কোন পথে এখানে এসেছ তাও অচেনা।
সেই আদি নিবাসের কথা বা আসার পথের কথা তোমার এখন মনে নেই। তাই বলে সেই দেশ ও পথের অস্তিত্বই নেই- এমন কথা তুমি বিশ্বাস কর না। কাজেই তোমাকে যে পথে, যে দেশে যাওয়ার জন্য বলছি তা তুমি চিন না বলে বলতে পার না যে, সেই দেশ ও পথের অস্তিত্ব নেই।
মওলানা আরও বলেন, সেই দেশ সেই ঠিকানার কথা তো আমি আগেই বলেছি।
মা যে বা’লা’য়ীম ও বা’লা’ মী রওয়ীম
মা’ যে উ য়ীম ও বে সূয়ে উ রওয়ীম
আমরা সেই ঊর্ধ্বলোকের, যাব সেই ঊর্ধ্বপানে
এসেছি যেখান থেকে ফিরে যাব তার সন্নিধানে।
ইন ওয়াতান মিসরো ইরাকো ও শা’ম নীস্ত
ইন ওয়াতান জা’য়ী স্ত কূ রা’ না’ম নীস্ত
এই দেশ বলতে মিসর সিরিয়া ও ইরাক নয়
এই দেশ এমন জায়গা, যার নাম-ঠিকানা নেই।
(এই বয়েত দুটি নিকলসন সংকলনে নেই)
সে জগতের একটু পরিচয় নাও। রাতে নিদ্রায় স্বপ্নের জগতে তুমি বিচরণ কর বিশাল প্রান্তরে। বল তো, স্বপ্নের জগতের বিশাল ভুবন কোথায় আছে, তার পথঘাট কোন দিকে? নিশ্চয়ই জান না। হকিকতের জগতের বাস্তবতা স্বপ্নের বিশাল ভুবনের সঙ্গে তুলনা করে বোঝার সাধনা কর। এই বুঝে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্যÑ
তো বেবন্দ অ’ন চশমো খোদ তসলীম কুন
খেশ রা বীনী দর অ’ন শহরে কুহুন
তুমি বন্ধ করো এই চোখ সঁপে দাও নিজেকে
তখন দেখবে নিজেই উপস্থিত সেই পুরোনো দেশে।
দুনিয়ার চাকচিক্য, ভোগ, মোহ, দম্ভ আরও যতকিছু হকিকতের পথে ডাকাত সেজে আছে সব বন্ধন ছিন্ন করে তার দিকে ছুটে যাও, নিজেকে তাঁর কাছে সঁপে দিয়ে বল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’, ‘আমরা তো একান্ত আল্লাহরই এবং নিশ্চিতই আমরা তাঁর কাছে ফিরে যাব।’ (সূরা বাকারা : ১৫৬)।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১০৮৪-১১১৮)
মওলানা রুমি (রহ.) এর জীবনদর্শনের মূলকথা, আধ্যাত্মিক স্বাদে হৃদয় পরিতৃপ্ত কর আর যে দেশ থেকে এসেছ সে দেশে ফিরে যেতে উড়াল দাও। মওলানার কাছে একজন প্রশ্ন করে, সে দেশ কোথায়? কীভাবে উড়াল দেব এই জগৎ ছেড়ে? মওলানা বলেন, তোমার প্রশ্নের জবাব আমি হাকিম সানায়ির ভাষায় দিতে চাই।
গর রা’হ রওয়ী রা’হ বরত বগুশা’য়ন্দ
ওয়ার নীস্ত শওয়ী বে হাস্তিয়ত বেগ্রা’য়ন্দ
যদি সম্মুখে এগিয়ে চল তোমার জন্য রাস্তা খুলে দেবে
যদি ‘অস্তিত্বহীন’ হতে পার ‘অস্তিত্ব’ তোমায় দেওয়া হবে।
সেই দেশে যাওয়ার পথ খুঁজে পেতে হলে সম্মুখে এগিয়ে চলো। দেখবে, তোমার পথের বাধা একেক করে সরে যাচ্ছে। রাস্তা খুলে যাবে। নিজেকে তার কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে অস্তিত্বহীন হয়ে যাও। তোমাকে মানবিক গুণাবলিতে সজ্জিত নতুন জীবন দেওয়া হবে। তার দিকে এগিয়ে নেওয়া হবে। আল্লাহ তো বলেছেন, ‘আর যারা আমার পথে প্রাণান্ত সাধনা করে, জিহাদ করে, তাদের অবশ্যই আমার পথগুলোয় পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্র্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)।
তুমি পথ খুঁজে না পাওয়ার কারণ হলো, তোমার হুঁশজ্ঞান, চিন্তা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছ। আজেবাজে অনর্থক চিন্তায় ও কাজে নিজেকে মহাব্যস্ত করে রেখেছ। তোমার অস্তিত্বের বাগানে জ্ঞানবুদ্ধির যে পানি আছে, তা কাঁটাগুল্মের শিকড় চুষে নিচ্ছে। অনর্থক বিষয়, আজেবাজে চিন্তা, সৎ-উদ্দেশ্যহীন তৎপরতা কাঁটাগুল্মস্বরূপ। এগুলো তোমার জ্ঞানের বুদ্ধিমত্তার রস চুষে খাচ্ছে। ভোগ-বিলাসিতা, আত্মপূজা ও অহঙ্কারের নানা অনুষঙ্গের পেছনে তোমার ধ্যান-জ্ঞান, চেষ্টা ও সাধনা উজাড় হচ্ছে। ফলে তোমার অস্তিত্বের ভালো গুণ, উপাদেয় উপকারী বীজ ও চারাগাছ, তোমার জ্ঞানবুদ্ধির পানি দ্বারা সিঞ্চিত হতে পারছে না।
তোমার গোটা অস্তিত্ব শস্যক্ষেতের মতো। এখানে আগাছা আছে, ভালো ফল-ফুলের চারাগাছও আছে। বাজে বাতিল চিন্তা ও কর্মের আগাছা, যদি শস্যক্ষেতের পানি চুষে নেয়, আসল চারাগাছ তো পানি পাবে না। কাজেই ভালো ফল কীভাবে আশা করতে পার? তুমি আল্লাহর কথা নিত্যস্মরণ রেখে অস্তিত্বের চারাগাছে পানি দাও। অন্তরের জমি জিকির ও ফিকিরে তরতাজা রাখ। চোখ-কান খাড়া রেখে ক্ষেতের যত আগাছা শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেল।
বাগানের পানি আগাছার জন্য হারাম আর চারাগাছের জন্য হালাল- এই পার্থক্যটুকু তোমাকে বুঝতে হবে। বাগানের পানি মানে আকল বুদ্ধি, হুঁশজ্ঞান, যা তোমাকে দেওয়া আল্লাহর নেয়ামত। এ নেয়ামতের সদ্ব্যবহার কর, হক আদায় কর, কদর কর, যথাস্থানে কাজে লাগাও। এটি হালাল। অযথা অপাত্রে অপব্যবহার করা হারাম।
নে‘মতে হক রা’ বে জা’ন ও আকল দেহ
না বে তাবএ পুর যহীর ও পুর গেরেহ
আল্লাহর নেয়ামত উৎসর্র্গ কর প্রাণ ও আকলের কাজে
রোগশোকের আখড়া দেহের সেবায় উজাড় কর না তাকে।
তোমার রূহের উন্নয়নের কাজে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত ব্যবহার কর, কেবল দেহের সেবায় ব্যয় করলে তা হবে ‘উলু বনে মুক্তা ছড়ানো’। চোখের শোভা ও জ্যোতির জন্য আমরা সুরমা মাখি। এই সুরমা যদি চোখের পরিবর্তে কানে ঢাল, কী অবস্থা হবে? কেউ যদি বুঝতে পারে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে তাহলে সংযম অবলম্বন করতেই হবে। চিনি ও মিষ্টান্ন পরিহার করে চলতে হবে। তুমি দুনিয়াপূজার রোগে আক্রান্ত। তাই মন বাজে চিন্তার আখড়া। জীবনটা চলে যাচ্ছে অর্থহীন কাজের পেছনে। কাজেই তোমাকে সংযমের জীবন বেছে নিতে হবে। চিন্তা ও কর্মে শয়তানি মন্ত্রণা সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। নচেৎ তা হবে তোমার আত্মিক ও নৈতিক জীবনের জন্য বিষ-জহর-হলাহল। ডায়াবেটিস রোগীর দেহে মিষ্টান্ন খাবার মরণ ডেকে আনে। নফসের রোগে আক্রান্ত রুহে ভোগ বিলাসিতা, শয়তানি চিন্তামগ্নতা রুহানি মৃত্যু ঘটায়।
হে সাধক! তোমার অস্তিত্বের জমিনে দুই ধরনের গাছ আছে, দেখতে একই রকম সবুজাভ লিকলিকে। এক রকম চারাগাছ ফুলের বা ফলের, আরেক রকম চারাগাছ আগাছার। আগাছার শিকড় বিস্তৃত দোজখের আগুন ও ধোঁয়া থেকে। আর ফল-ফুলের চারাগাছের গোড়া সাত আসমানের উপরে। দূর থেকে মনে হবে, খামার বাড়িতে উভয় চারাগাছে সবুজের সমারোহ জেগেছে। যদি আগাছা আর চারাগাছের মাঝে ফারাক করতে না পার, জীবন বৃথা যাবে। ফারাক করতে চাইলে চোখ মেলে তাকাতে হবে। এই তাকানো বাহ্যদৃষ্টিতে নয়। কারণ, বাহ্যইন্দ্রিয়ের চোখ সাধারণত ভুল দেখে। যেমন অনেক দূরে হলে দেখে না, চোখের একেবারে কাছে ধরলেও দেখা যায় না। তাই তোমাকে দিলের চোখ খুলতে হবে। দিব্যদৃষ্টি খুলতে হলে তোমাকে আসতে হবে যিনি প্রাণের প্রাণ তার কাছে।
আগন্তুক প্রশ্ন করে, কীভাবে আসব? আমাকে যে জড়িয়ে ধরেছে দুনিয়ার সহায় সম্পদ, নামধাম, পদবি খ্যাতির মোহ? মওলানা রুমি বলেন, দৌড় দাও, তাহলে ছিঁড়ে যাবে দুনিয়ার বাঁধন। তারপরের প্রশ্ন, দৌড় কীভাবে দেব? মওলানা বাতলে দিচ্ছেন-
গর যুলায়খা বস্ত দরহা’ হার তরফ
ইয়াফত ইউসুফ হাম যে জুম্বিশ মুনসারাফ
জুলায়খা যদিও বন্ধ করেছিল সবদিক থেকে দরজা
ইউসুফ চেষ্টার দৌড়ে পেয়েছিল বাঁচবার আশ্রয় রাস্তা।
মওলানা এখানে কোরআন মজিদে বর্ণিত হজরত ইউসুফ (আ.) এর জীবনের একটি ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। সৎভাইরা খেলার নাম করে বাবা ইয়াকুব (আ.) এর কাছ থেকে ইউসুফকে মাঠে নিয়ে পরিত্যক্ত কুয়ায় নিক্ষেপ করেছিল। একটি বাণিজ্য কাফেলা যাত্রাবিরতিকালে কুয়ার পানি সংগ্রহে গিয়ে ফুটফুটে বালক ইউসুফকে পেয়ে মিসরের দাস বাজারে বিক্রি করে। পাল্লার একদিকে স্বর্ণ অন্যদিকে ইউসুফের ওজনে ইউসুফকে খরিদ করেন প্রধানমন্ত্রী আজিজ। রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলে আজিজপতœী জুলায়খা আসক্ত হয়ে পড়ে অনিন্দ্য সুন্দর ইউসুফের প্রতি। জুলায়খা ইউসুফের কাছে বারবার প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়। মনিবের ঘরে অসহায় ইউসুফকে একদিন জুলায়খা নানা ছলে অন্দর মহলে আটকায়। শাহী মহলের সব দরজায় তালা লাগায়। তারপর নিজেকে নিবেদন করে ইউসুফের কাছে। কোথাও ছিদ্রপথ পর্যন্ত ছিল না স্বপ্নপুরীতে। হঠাৎ ইউসুফ দৌড় দেন প্রেমাসক্ত জুলায়খার হাত থেকে বাঁচার জন্য। তখই দেখেন, তালা খোলা, দরজা মেলা, পালানোর রাস্তা সম্মুখে। কারণ, ইউসুফ তাওয়াক্কুল করেছিল আল্লাহর ওপর, তারপর চেষ্টার বদৌলতে জুলায়খার ফুসলানোর বাঁধনমুক্ত হতে পেরেছেন আল্লাহর সাহায্যে।
তুমিও যদি দেখ, দুনিয়ার বাঁধন থেকে মুক্তির পথ খোলা নেই, ফাঁকফোকর দেখা যায় না পালানোর, তাহলে ইউসুফের মতো বিচলিত হয়ে তাঁর আশ্রয় পেতে দৌড় দাও। মন থেকে বল, আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিমÑ ‘আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান হতে।’ তখন তোমার সামনেও খুলে যাবে মুক্তির পথ। খুলে যাবে ওই জগতের তালা। দেখবে, দরজা খোলা। তোমাকে তখন এমন জায়গায় নিয়ে যাবে, যার কোনো নাম-ঠিকানা নেই।
মওলানা এখন প্রশ্ন করেন, এই যে দুনিয়াতে এসেছ, জান কি কোত্থেকে এসেছ? তুমি হকিকতের এক বিশাল জগতে ছিলে। সেখান থেকে জড় জগত, উদ্ভিদ জগতের পথপরিক্রমা শেষে পরীক্ষার জন্য নেমে এসেছ পার্থিব জগতে, দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চে, সমাজে, সংসারে।
তো যে জা’য়ী আ’মাদী ওয়ায মাওতনী
আ’মদন রা’ রা’হ দানী হীচ নয়ী
তুমি এসেছে এমন অঞ্চল হতে এমন এক দেশ ছেড়ে
কীভাবে এখানে, নিশ্চয়ই জান না, এসেছ কোন পথে।
তুমি আগে ছিলে অন্য দেশের নাগরিক। বাস করতে এমন এলাকায়, যার পরিচয় এখন তোমার মনে নেই। কোন পথে এখানে এসেছ তাও অচেনা।
সেই আদি নিবাসের কথা বা আসার পথের কথা তোমার এখন মনে নেই। তাই বলে সেই দেশ ও পথের অস্তিত্বই নেই- এমন কথা তুমি বিশ্বাস কর না। কাজেই তোমাকে যে পথে, যে দেশে যাওয়ার জন্য বলছি তা তুমি চিন না বলে বলতে পার না যে, সেই দেশ ও পথের অস্তিত্ব নেই।
মওলানা আরও বলেন, সেই দেশ সেই ঠিকানার কথা তো আমি আগেই বলেছি।
মা যে বা’লা’য়ীম ও বা’লা’ মী রওয়ীম
মা’ যে উ য়ীম ও বে সূয়ে উ রওয়ীম
আমরা সেই ঊর্ধ্বলোকের, যাব সেই ঊর্ধ্বপানে
এসেছি যেখান থেকে ফিরে যাব তার সন্নিধানে।
ইন ওয়াতান মিসরো ইরাকো ও শা’ম নীস্ত
ইন ওয়াতান জা’য়ী স্ত কূ রা’ না’ম নীস্ত
এই দেশ বলতে মিসর সিরিয়া ও ইরাক নয়
এই দেশ এমন জায়গা, যার নাম-ঠিকানা নেই।
(এই বয়েত দুটি নিকলসন সংকলনে নেই)
সে জগতের একটু পরিচয় নাও। রাতে নিদ্রায় স্বপ্নের জগতে তুমি বিচরণ কর বিশাল প্রান্তরে। বল তো, স্বপ্নের জগতের বিশাল ভুবন কোথায় আছে, তার পথঘাট কোন দিকে? নিশ্চয়ই জান না। হকিকতের জগতের বাস্তবতা স্বপ্নের বিশাল ভুবনের সঙ্গে তুলনা করে বোঝার সাধনা কর। এই বুঝে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্যÑ
তো বেবন্দ অ’ন চশমো খোদ তসলীম কুন
খেশ রা বীনী দর অ’ন শহরে কুহুন
তুমি বন্ধ করো এই চোখ সঁপে দাও নিজেকে
তখন দেখবে নিজেই উপস্থিত সেই পুরোনো দেশে।
দুনিয়ার চাকচিক্য, ভোগ, মোহ, দম্ভ আরও যতকিছু হকিকতের পথে ডাকাত সেজে আছে সব বন্ধন ছিন্ন করে তার দিকে ছুটে যাও, নিজেকে তাঁর কাছে সঁপে দিয়ে বল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’, ‘আমরা তো একান্ত আল্লাহরই এবং নিশ্চিতই আমরা তাঁর কাছে ফিরে যাব।’ (সূরা বাকারা : ১৫৬)।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১০৮৪-১১১৮)
No comments