যেভাবে হত্যা করা হয় আবরারকে- ৭ দিনে কী বদলালো by শুভ্র দেব
বিইউপি’র
শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী হত্যার বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাত
দিনের আল্টিমেটাম শেষ হচ্ছে আজ। এই সাত দিনে কতটা পাল্টেছে ঢাকার সড়কের
চিত্র। দাবিই বা পূরণ হয়েছে কতটা। এর মূল্যায়ন করতে আজ বৈঠকে বসছেন বিইউপি
শিক্ষার্থী, ঢাকা উত্তরের মেয়র ও ডিএমপি কর্মকর্তারা। আন্দোলনকারী
শিক্ষার্থীরা বলছেন, দাবি পূরণে দৃশ্যমান কিছু অগ্রগতি দেখা গেছে। তবে
কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। এই সময়ে একই ধরনের কয়েকটি ঘটনা নতুন করে
আতঙ্ক তৈরি করেছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়
কার্যকর কিছু দেখতে চান তারা।
গত ১৯শে মার্চ আবরার নিহত হওয়ার পরই সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে নামেন বিইউপির শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন আশপাশের আরও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রথম দিন দিনভর বিক্ষোভ ও অবস্থানের পর দ্বিতীয় দিনে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর আরও কয়েকটি এলাকায়।
দিনভর বিক্ষোভ শেষে বিকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। বৈঠকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজ আবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন মেয়র ও পুলিশ কর্মকর্তারা। আন্দোলনের সময় আট দফা দাবি পেশ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। সাত দিনের মধ্যে এসব দাবি পূরণ বা ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিলেন শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে আবরার হত্যার মতো আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সড়কে। মিরপুরে একজনকে বাস চাপায় হত্যা করা হয়েছে। সিলেটে বাস থেকে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। কুমিল্লায় মারা গেছে আরও দুই শিক্ষার্থী। এসব ঘটনায় আতঙ্ক কিছুতেই কাটছে না।
শিক্ষার্থীদের আট দফা দাবির মধ্যে ছিল পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, প্রতি মাসে বাস চালকের লাইসেন্সসহ সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করতে হবে, আটক চালক ও সম্পৃক্ত সকলকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে, ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রুত সময়ের মধ্যে অপসারণ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সকল স্থানে আণ্ডার পাস, স্পিড ব্র্রেকার ও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে, সড়কে হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে সর্বোচ্চ আইনের আওতায় আনতে হবে, প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপ এবং যাত্রী ছাউনি করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই কয় দিনে অগ্রগতির মধ্যে আছে ঘাতক বাস চালক ও সহকারীকে গ্রেপ্তার, আবরার নিহত হওয়ার স্থানে তার নামেই ফুটওভার ব্রিজের ভিত্তি স্থাপন এবং বিশেষ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে রাজধানীতে অবৈধ যান ও চালকের বিরুদ্ধে অভিযান। এসব অভিযানে রাজধানীতে অবৈধ যান চলাচল কমেছে। তবে নির্ধারিত স্টপেজে বাস থামা ও যাত্রী উঠানোর নির্দেশনা এখনও মানা হচ্ছে না। গাড়িতে গাড়িতে রেষারেষির দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে নিয়মিত।
এছাড়া ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পথচারীদের মধ্যে নতুন কোনো সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রাজধানীতে শৃঙ্খলা আনতে ধানমন্ডি ও আজিমপুর এলাকায় গতকাল থেকে চক্রাকার বাস চলাচল শুরু হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তান রুটে নামানো হয়েছে বিআরটিসির দ্বিতল বাস। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ডিএমপির পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। পরিস্থিতি নিয়ে অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া নিজেই ছুটে বেড়াচ্ছেন নানা কর্মসূচিতে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা দৃশ্যমান হবে।
যেভাবে হত্যা করা হয় আবরারকে: অন্যান্য দিনের মতো ১৯শে মার্চ ভোরবেলা সদরঘাট থেকে গাজীপুরার উদ্দেশ্য রওনা দেয় সুপ্রভাত পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫ নম্বরের বাস। চালকের আসনে তখন ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। আর সঙ্গে ছিলেন কন্ডাক্টর মো. ইয়াসিন আরাফাত ও চালকের সহকারী মো. ইব্রাহিম। বাসটি গুলিস্তান, পল্টন, কাকরাইল, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, নতুন বাজার পর্যন্ত ঠিকঠাক যাচ্ছিল। কিন্তু শাহজাদপুর বাঁশতলা এলাকার পৌঁছার পর ঘটে বিপত্তি।
সেখানকার সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা মিরপুর আইডিয়াল গার্লস কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে চাপা দেন চালক সিরাজুল ইসলাম। মারাত্মকভাবে আহন হন ওই শিক্ষার্থী। এতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা জনতা ও ওই বাসের যাত্রীদের তোপের মুখে পড়েন চালক সিরাজুল। পরে ওই এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কাছে সিরাজুলকে সোপর্দ করেন উত্তেজিত যাত্রীরা। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল থেকে বাসটি নিয়ে রওনা দেয় চালকের সহকারী ইয়াসিন আরাফাত। তাড়াহুড়ো করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে গিয়ে তার ঠিক একটু সামনে নর্দ্দা এলাকায় ইয়াসিন চাপা দেয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিম কর্তৃক ঘাতক ওই বাসের চালক, কন্ডাক্টর, চালকের সহকারী আটকের পর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর আগে মঙ্গলবার ডিবির ওই টিম চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার একটি ইটভাটায় কন্ডাক্টর ইয়াসিনের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে গ্রেপ্তার করে। আর সহকারী মো. ইব্রাহিমকে মধ্য বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন।
ডিবির কাছে আটক ওই তিন ঘাতক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। বাতেন বলেন, আবরারকে চাপা দেয়ার পর প্রাথমিকভাবে সবাই ধরে নেয় সুপ্রভাত বাসের মূল চালক সিরাজুলই ঘাতক। কারণ চালক সিরাজ বাস চালিয়ে দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করেছে পুলিশের কাছে। কিন্তু ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে বের হয়ে আসে প্রকৃত রহস্য। শাহজাদপুর এলাকায় কলেজছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে চাপা দিয়ে আহত করার পর বেকায়দায় পড়ে তারা। উপস্থিত জনতা ও ওই বাসের যাত্রীরা চালক সিরাজুল ইসলামকে মারধর দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এ ছাড়া যাত্রীদের তোপের মুখে অসহায় হয়ে পড়েন বাসের কন্ডাক্টর ও চালকের সহকারী। উত্তেজিত জনতা বাসটি পুড়িয়ে বা ভাঙচুর করতে পারে এমন ভয়ে কন্ডাক্টর ইয়াসিন যোগাযোগ করেন মালিক ননী গোপাল সরকারের সঙ্গে। পরে ননী গোপালই জনতার হাত থেকে বাসটি বাঁচানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কন্ডাক্টর ইয়াসিনকে চালকের আসনে বসার নির্দেশ দেন। অথচ ইয়াসিনের ভারী যানবাহন চালানোর কোনো লাইসেন্সই ছিল না।
বাতেন বলেন, ইয়াসিন চালকের আসনে বসার পরপরই দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার চেষ্টা করে। এমন সময় নর্দ্দা এলাকায় এসে চাপা দেয় বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় আবরারের। এ সময় বাসটি রেখে পালিয়ে যায় ইয়াসিন ও ইব্রাহিম। পরে শাহজাদপুরে কলেজছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে মারাত্মক জখম ও আবরার নিহত হওয়ার ঘটনায় গুলশান থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়। আগে থেকে আটক সুপ্রভাত বাসের মূল চালক সিরাজুল ইসলামকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডে আনে পুলিশ। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তদন্তভার দেয়া হয়েছে ডিবির কাছে। চালক সিরাজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বের হয়ে আসে ঘটনার আদ্যোপান্ত। তিনি বলেন, দুটি মামলারই আলাদা আলাদা তদন্ত হচ্ছে। এবং ইয়াসিনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার পর আগামী এক মাসের মধ্যে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন দেয়া হবে। এ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন কন্ডাক্টর ইয়াসিনকে চালকের আসনে বসার নির্দেশদাতা ননী গোপাল সরকারকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
আবরার হত্যার ভিডিও প্রকাশ: বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে বাস চাপা দেয়ার একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। ভিডিও ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশ গেটের ঠিক উল্টো পাশের সড়কে ওই সময়টাতে যানবাহনের তেমন চাপ ছিল না। ফুটপাথ দিয়ে দুই চারজন পথচারী হেঁটে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখন বেপরোয়া গতির একটি বাস ধাক্কা দেয় আবরারকে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটে পড়ে আবরার। মাটিতে লুটে পড়ার পরও ঘাতক বাসের চালক বাস না থামিয়ে রাস্তার বাম পাশ থেকে দ্রুত গতিতে আবরারকে চাপা দিয়ে চলে যায় মাঝ সড়কে। ততক্ষণে রক্তাক্ত অবস্থায় মাঝ সড়কে পড়ে থাকে আবরারের নিথর দেহ। তার ঠিক কয়েক হাত দূরে পড়েছিল তার কাঁধের ব্যাগ। ঘাতক বাসটি তখনও পালানোর উদ্দেশ্যে আরো গতি বাড়িয়ে দেয়। ঘটনাটি সস্ত্রীক এক পথচারীর নজরে আসে। তিনিই প্রথম রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ি আটকিয়ে ছুটে যান আবরারের কাছে। তার কয়েক সেকেন্ড পরেই দুজন ট্রাফিক পুলিশকে ঘাতক বাসের পেছনে ছুটতে দেখা গেছে।
কন্ডাক্টর ও চালকের সহকারী সাত দিনের রিমান্ডে: বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী হত্যার আসামি সু-প্রভাত বাসের কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত ও চালকের সহকারী মো. ইব্রাহিমকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে ঘটনার আরো তদন্ত ও বাস মালিককে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছিন আহসান চৌধুরী সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শুনানিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে বলেন, বাসের কন্ডাক্টর ইয়াসিন বাসচাপা দিয়ে আবরারকে মেরে ফেলেন। ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য আসামিদের রিমান্ডে নেয়া জরুরি। এ সময় আসামি পক্ষের কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।
প্রসঙ্গত, গত ১৯শে মার্চ সকাল ৭টায় রাজধানীর প্রগতি সরণির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটের উল্টোপাশে সু-প্রভাত কোম্পানির একটি বাস চাপা দেয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহম্মেদ চৌধুরীকে। এ খবর ছড়িয়ে গেলে প্রতিবাদে নেমে সড়ক অবরোধ করে তার সহপাঠীরা। তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন থেকে তারা ৮ দফা দাবি জানায়। পরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের আশ্বাসে ঘরে ফিরে যায় শিক্ষার্থীরা। ঢাকার সড়কে আর সু-প্রভাত বাস চলবে না বলে জানান মেয়র। বাতিল করা হয় ওই বাসের রেজিস্ট্রেশন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৯শে জুলাই রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম ও আবদুল করিম রাজীব জাবালে নুর বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর নজিরবিহীন শিক্ষার্থী আন্দোলন হয় রাজধানীতে। যা পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় নিরাপদ সড়কের ৯ দফা দাবি তুলে শিক্ষার্থীরা। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয় ট্রাফিক পুলিশ ও সিটি করপোরেশন। তখন সড়কে দৃশ্যত কিছু শৃঙ্খলা ফিরলেও পরে ধীরে ধীরে তা ভেঙে পড়ে।
গত ১৯শে মার্চ আবরার নিহত হওয়ার পরই সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে নামেন বিইউপির শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন আশপাশের আরও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রথম দিন দিনভর বিক্ষোভ ও অবস্থানের পর দ্বিতীয় দিনে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর আরও কয়েকটি এলাকায়।
দিনভর বিক্ষোভ শেষে বিকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। বৈঠকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজ আবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন মেয়র ও পুলিশ কর্মকর্তারা। আন্দোলনের সময় আট দফা দাবি পেশ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। সাত দিনের মধ্যে এসব দাবি পূরণ বা ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিলেন শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে আবরার হত্যার মতো আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সড়কে। মিরপুরে একজনকে বাস চাপায় হত্যা করা হয়েছে। সিলেটে বাস থেকে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। কুমিল্লায় মারা গেছে আরও দুই শিক্ষার্থী। এসব ঘটনায় আতঙ্ক কিছুতেই কাটছে না।
শিক্ষার্থীদের আট দফা দাবির মধ্যে ছিল পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, প্রতি মাসে বাস চালকের লাইসেন্সসহ সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করতে হবে, আটক চালক ও সম্পৃক্ত সকলকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে, ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রুত সময়ের মধ্যে অপসারণ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সকল স্থানে আণ্ডার পাস, স্পিড ব্র্রেকার ও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে, সড়কে হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে সর্বোচ্চ আইনের আওতায় আনতে হবে, প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপ এবং যাত্রী ছাউনি করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই কয় দিনে অগ্রগতির মধ্যে আছে ঘাতক বাস চালক ও সহকারীকে গ্রেপ্তার, আবরার নিহত হওয়ার স্থানে তার নামেই ফুটওভার ব্রিজের ভিত্তি স্থাপন এবং বিশেষ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে রাজধানীতে অবৈধ যান ও চালকের বিরুদ্ধে অভিযান। এসব অভিযানে রাজধানীতে অবৈধ যান চলাচল কমেছে। তবে নির্ধারিত স্টপেজে বাস থামা ও যাত্রী উঠানোর নির্দেশনা এখনও মানা হচ্ছে না। গাড়িতে গাড়িতে রেষারেষির দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে নিয়মিত।
এছাড়া ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পথচারীদের মধ্যে নতুন কোনো সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে রাজধানীতে শৃঙ্খলা আনতে ধানমন্ডি ও আজিমপুর এলাকায় গতকাল থেকে চক্রাকার বাস চলাচল শুরু হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তান রুটে নামানো হয়েছে বিআরটিসির দ্বিতল বাস। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ডিএমপির পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। পরিস্থিতি নিয়ে অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া নিজেই ছুটে বেড়াচ্ছেন নানা কর্মসূচিতে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা দৃশ্যমান হবে।
যেভাবে হত্যা করা হয় আবরারকে: অন্যান্য দিনের মতো ১৯শে মার্চ ভোরবেলা সদরঘাট থেকে গাজীপুরার উদ্দেশ্য রওনা দেয় সুপ্রভাত পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫ নম্বরের বাস। চালকের আসনে তখন ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। আর সঙ্গে ছিলেন কন্ডাক্টর মো. ইয়াসিন আরাফাত ও চালকের সহকারী মো. ইব্রাহিম। বাসটি গুলিস্তান, পল্টন, কাকরাইল, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, নতুন বাজার পর্যন্ত ঠিকঠাক যাচ্ছিল। কিন্তু শাহজাদপুর বাঁশতলা এলাকার পৌঁছার পর ঘটে বিপত্তি।
সেখানকার সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা মিরপুর আইডিয়াল গার্লস কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে চাপা দেন চালক সিরাজুল ইসলাম। মারাত্মকভাবে আহন হন ওই শিক্ষার্থী। এতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা জনতা ও ওই বাসের যাত্রীদের তোপের মুখে পড়েন চালক সিরাজুল। পরে ওই এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কাছে সিরাজুলকে সোপর্দ করেন উত্তেজিত যাত্রীরা। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল থেকে বাসটি নিয়ে রওনা দেয় চালকের সহকারী ইয়াসিন আরাফাত। তাড়াহুড়ো করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে গিয়ে তার ঠিক একটু সামনে নর্দ্দা এলাকায় ইয়াসিন চাপা দেয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিম কর্তৃক ঘাতক ওই বাসের চালক, কন্ডাক্টর, চালকের সহকারী আটকের পর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর আগে মঙ্গলবার ডিবির ওই টিম চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার একটি ইটভাটায় কন্ডাক্টর ইয়াসিনের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে গ্রেপ্তার করে। আর সহকারী মো. ইব্রাহিমকে মধ্য বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন।
ডিবির কাছে আটক ওই তিন ঘাতক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। বাতেন বলেন, আবরারকে চাপা দেয়ার পর প্রাথমিকভাবে সবাই ধরে নেয় সুপ্রভাত বাসের মূল চালক সিরাজুলই ঘাতক। কারণ চালক সিরাজ বাস চালিয়ে দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করেছে পুলিশের কাছে। কিন্তু ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে বের হয়ে আসে প্রকৃত রহস্য। শাহজাদপুর এলাকায় কলেজছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে চাপা দিয়ে আহত করার পর বেকায়দায় পড়ে তারা। উপস্থিত জনতা ও ওই বাসের যাত্রীরা চালক সিরাজুল ইসলামকে মারধর দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এ ছাড়া যাত্রীদের তোপের মুখে অসহায় হয়ে পড়েন বাসের কন্ডাক্টর ও চালকের সহকারী। উত্তেজিত জনতা বাসটি পুড়িয়ে বা ভাঙচুর করতে পারে এমন ভয়ে কন্ডাক্টর ইয়াসিন যোগাযোগ করেন মালিক ননী গোপাল সরকারের সঙ্গে। পরে ননী গোপালই জনতার হাত থেকে বাসটি বাঁচানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কন্ডাক্টর ইয়াসিনকে চালকের আসনে বসার নির্দেশ দেন। অথচ ইয়াসিনের ভারী যানবাহন চালানোর কোনো লাইসেন্সই ছিল না।
বাতেন বলেন, ইয়াসিন চালকের আসনে বসার পরপরই দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার চেষ্টা করে। এমন সময় নর্দ্দা এলাকায় এসে চাপা দেয় বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় আবরারের। এ সময় বাসটি রেখে পালিয়ে যায় ইয়াসিন ও ইব্রাহিম। পরে শাহজাদপুরে কলেজছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে মারাত্মক জখম ও আবরার নিহত হওয়ার ঘটনায় গুলশান থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়। আগে থেকে আটক সুপ্রভাত বাসের মূল চালক সিরাজুল ইসলামকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডে আনে পুলিশ। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তদন্তভার দেয়া হয়েছে ডিবির কাছে। চালক সিরাজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বের হয়ে আসে ঘটনার আদ্যোপান্ত। তিনি বলেন, দুটি মামলারই আলাদা আলাদা তদন্ত হচ্ছে। এবং ইয়াসিনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার পর আগামী এক মাসের মধ্যে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন দেয়া হবে। এ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন কন্ডাক্টর ইয়াসিনকে চালকের আসনে বসার নির্দেশদাতা ননী গোপাল সরকারকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
আবরার হত্যার ভিডিও প্রকাশ: বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে বাস চাপা দেয়ার একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। ভিডিও ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেয়া হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশ গেটের ঠিক উল্টো পাশের সড়কে ওই সময়টাতে যানবাহনের তেমন চাপ ছিল না। ফুটপাথ দিয়ে দুই চারজন পথচারী হেঁটে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখন বেপরোয়া গতির একটি বাস ধাক্কা দেয় আবরারকে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটে পড়ে আবরার। মাটিতে লুটে পড়ার পরও ঘাতক বাসের চালক বাস না থামিয়ে রাস্তার বাম পাশ থেকে দ্রুত গতিতে আবরারকে চাপা দিয়ে চলে যায় মাঝ সড়কে। ততক্ষণে রক্তাক্ত অবস্থায় মাঝ সড়কে পড়ে থাকে আবরারের নিথর দেহ। তার ঠিক কয়েক হাত দূরে পড়েছিল তার কাঁধের ব্যাগ। ঘাতক বাসটি তখনও পালানোর উদ্দেশ্যে আরো গতি বাড়িয়ে দেয়। ঘটনাটি সস্ত্রীক এক পথচারীর নজরে আসে। তিনিই প্রথম রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ি আটকিয়ে ছুটে যান আবরারের কাছে। তার কয়েক সেকেন্ড পরেই দুজন ট্রাফিক পুলিশকে ঘাতক বাসের পেছনে ছুটতে দেখা গেছে।
কন্ডাক্টর ও চালকের সহকারী সাত দিনের রিমান্ডে: বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী হত্যার আসামি সু-প্রভাত বাসের কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত ও চালকের সহকারী মো. ইব্রাহিমকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে ঘটনার আরো তদন্ত ও বাস মালিককে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছিন আহসান চৌধুরী সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শুনানিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে বলেন, বাসের কন্ডাক্টর ইয়াসিন বাসচাপা দিয়ে আবরারকে মেরে ফেলেন। ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য আসামিদের রিমান্ডে নেয়া জরুরি। এ সময় আসামি পক্ষের কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।
প্রসঙ্গত, গত ১৯শে মার্চ সকাল ৭টায় রাজধানীর প্রগতি সরণির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটের উল্টোপাশে সু-প্রভাত কোম্পানির একটি বাস চাপা দেয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহম্মেদ চৌধুরীকে। এ খবর ছড়িয়ে গেলে প্রতিবাদে নেমে সড়ক অবরোধ করে তার সহপাঠীরা। তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন থেকে তারা ৮ দফা দাবি জানায়। পরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের আশ্বাসে ঘরে ফিরে যায় শিক্ষার্থীরা। ঢাকার সড়কে আর সু-প্রভাত বাস চলবে না বলে জানান মেয়র। বাতিল করা হয় ওই বাসের রেজিস্ট্রেশন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৯শে জুলাই রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম ও আবদুল করিম রাজীব জাবালে নুর বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর নজিরবিহীন শিক্ষার্থী আন্দোলন হয় রাজধানীতে। যা পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় নিরাপদ সড়কের ৯ দফা দাবি তুলে শিক্ষার্থীরা। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয় ট্রাফিক পুলিশ ও সিটি করপোরেশন। তখন সড়কে দৃশ্যত কিছু শৃঙ্খলা ফিরলেও পরে ধীরে ধীরে তা ভেঙে পড়ে।
No comments