বনানী ট্র্যাজেডি: মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে তাদের বাঁচার অপেক্ষা by কাফি কামাল
ভবনে
হঠাৎ আগুন। প্রতিটি ফ্লোরে নানা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়গুলো দারুণ
কর্মব্যস্ত তখন। আগুনের ধোঁয়ার সঙ্গে মৃত্যু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ভবনজুড়ে।
ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। বন্ধ হয়ে আসছে স্বাভাবিক
শ্বাস-প্রশ্বাস। আগুনের তীব্রতায় নিচে নেমে আসতে পারছেন না সিঁড়ি বেয়ে।
প্রতিমুহূর্তে উত্তাপ বাড়ছে ভবনের। উপরের দিকের ফ্লোরগুলোতে অবস্থানকারীরা
নিঃশ্বাস নিতে আর সাহায্যের আকুতি জানাতে জানালার কাঁচ ভেঙেছেন।
কাঁচভাঙা জানালা দিয়ে হাত নাড়িয়ে আর চিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন। জীবনের আকুতি নিয়ে বাড়ানো হাতগুলো অনেক উপরে। ভবনের ১০ম তলা থেকে উপরে। কিন্তু উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়া লোকজন নিচে রাস্তায়। সাহায্য করতে না পেরে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়া অনেকেই দোয়া করছিলেন উপরের দিকে হাত তুলে। আর আটকে পড়ারা তখন স্বজনদের কাছে ফোন করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহায্য চাইছেন।
ভবনটির ৬ থেকে ৯ তলায় তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছানোর আগেই উদ্ধার কাজে যুক্ত হন আশেপাশের বিভিন্ন অফিসের লোকজন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পৌঁছানোর পর তাদের চেষ্টা ছিল প্রাণান্তকর। তারা আটকে পড়াদের আশ্বস্ত করছেন। উঁচু ফ্লোরগুলোতে আটকে পড়াদের উদ্ধারে পাঠানো হচ্ছে ক্রেন লেডার (যন্ত্রচালিত মই)। কিন্তু সে লেডার কাছাকাছি গিয়েও উদ্ধার করতে পারছেন না।
দুয়েকজন ভাগ্যবান লেডারের সাহায্যে উদ্ধার পেলেও অন্যদের ভাগ্য তখনও দোদুল্যমান। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না দীর্ঘ সময়ে। ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য নিচ থেকে পাঠানো হচ্ছে ভেজা টাওয়াল। আতঙ্কে কেউ ভবনের উপরের ফ্লোরের দিকে ছুটছেন। কেউ কেউ চেষ্টা করছেন পাশের ভবনে যাবার। অনেকেই নিচে নেমেছেন উঁচু ভবনে ঝুলে থাকা ক্যাবল বেয়ে। জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ নিচে লাফিয়ে পড়ছেন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ উৎসুক জনতার চোখের সামনে তারা আহত হচ্ছেন। অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করছেন।
এভাবেই বিভীষিকাময় পরিবেশে মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের অপেক্ষায় কাটাতে হয়েছে উদ্ধারের আশায়। উদ্ধার পেতে যখন আটকে পড়ারা হাত নাড়াচ্ছেন তখন নিচে অপেক্ষারত স্বজনসহ উৎসুকদের অশ্রুতে ভিজছে কপোল। চারদিকে তখন কেবলই বাঁচার আকুতি। বাঁচানোর তাগিদ। এমন দৃশ্য ছিল বনানীর ১৭ নম্বর রোডের বহুতল ভবন এফআর টাওয়ারের। আতঙ্ক কেবল আগুন লাগা এফআর টাওয়ারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বন্ধ করে দেয়া হয় আশেপাশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় বিদ্যুৎসহ জরুরি সেবার সংযোগ।
এক পর্যায়ে দমকল কর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ভবনের উপর থেকে বালি, গ্যাস ও পানি দিয়ে বিমান বাহিনী ও নিচ থেকে সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ শুরু করেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতার কাজই করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কিন্তু এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়ার তীব্রতার কথা বলেছেন তাদেরই একজন। এক উদ্ধারকর্মী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি। আর এই ধোঁয়ার কারণে ব্যাঘাত ঘটছে উদ্ধারে। উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি অগ্নিদগ্ধ ও আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন প্রভা হেলথ নামে একটি সংস্থার কর্মীরা।
প্রভা হেলথের কর্মকর্তা ফয়সাল রহমান বলেন, ‘এখানে আমরা সাতজন ডাক্তার, ১৪ জন নার্স ও ২০ জন সাপোর্ট স্টাফ আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছি।’ আগুন লাগার পরপরই নিজের ফেসবুকে পোস্ট দেন ওই ভবনে কর্মরত একজন মডেল ও অভিনেতা। তার নাম রিপন আহমেদ। তিনি ওই ভবনের লিফটে আটকে পড়েছেন উল্লেখ করে লেখেন- ‘আগুন, আগুন। হতে পারে এটা আমার লাস্ট (শেষ) পোস্ট। আমি এফআর টাওয়ারের লিফট ১৩’তে আছি। ক্ষমা করে দিয়েন।’ প্রথম পোস্টের এক ঘণ্টা পরে রিপন আরেকটি পোস্টে লেখেন- ‘মাফ করে দিয়েন। লিফট ১৩ বনানী এফআর টাওয়ার।’ পরে জানা গেছে, বিকালের দিকে দমকল বাহিনীর সদস্যরা রিপনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।
এফআর টাওয়ারের ভেতর থেকে নিজের ফেসবুকে একটি ভিডিও আপলোড করেন সেজুতি স্বর্ণা নামে একজন। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ফ্লোরে অবস্থানরত সবাই নাকে-মুখে কাপড় চেপে ধরে হাঁটছেন, ভেতরটা ধোঁয়ায় পুরোটাই অন্ধকার। এ সময় তিনি সাহায্য চেয়ে বলছিলেন- ‘আমাদের সিঁড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। সিঁড়ি না পাঠালে আমরা ধোঁয়ায় মারা যাবো।’
পাশের ভবনে কর্মরত একজন জানান, বাঁচার আকুতি নিয়ে অনেকেই নিচে নামছিলেন ঝুলন্ত ক্যাবল বেয়ে। এভাবেই নিচে নামছিলেন এক তরুণী। কয়েক ফুট নামার পরপরই হাত ফসকে পড়ে যান নিচের এক ভবনের এসির ওপর। ভাগ্যক্রমে ক্যাবল ধরে ঝুলে রইলেন তিনি। সেখানে ক্যাবল ধরে ঝুলে থাকা আরেকজন লোক সেই তরুণীকে নামতে সাহায্য করলেন। কিছুক্ষণ বাদে এক তরুণ একইভাবে নামছিলেন। আগুনের লেলিহান শিখা তার খুব পাশেই যেন। কয়েক সেকেন্ড বাদেই হাজার হাজার মানুষ ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠলেন। হাজারো মানুষের চোখের সামনেই ৮তলা উঁচুতেই কয়েক পাক খেয়ে নিচে পড়ে গেলেন সেই তরুণ।
বনানীর সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহ সহযোগিতা করছেন এফআর ভবন থেকে নামানো আহতদের উদ্ধার তৎপরতায়। ভবনটিতে তখন আটকে পড়েছিলেন তারই চাচাতো ভাই সুমন হোসেন। উদ্ধার তৎপরতায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি কাঁদছিলেন চিৎকার করে। বলছিলেন- ‘আল্লাহ তুমি তাদের বাঁচিয়ে দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই ওদের। কতগুলো মানুষ ভেতরে তা আমরা জানি না। বাঁচার জন্য অনেক মানুষ হাত বাড়াচ্ছেন। তাদের তুমি নিচে নামার ব্যবস্থা করো।’
এফআর টাওয়ারের ১২ তলায় ডাট গ্রুপে কাজ করতেন আইটি ইঞ্জিনিয়ার ফাহাদ ইবনে কবীর। আগুন লাগার পরপরই ফাহাদ তার মাকে ফোন দিয়ে বলেছেন- ‘ভেতরে আগুনের ধোঁয়ায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি দম নিতে পারছি না।’ ছেলের ফোন পেয়েই সেখানে ছুটে যান তার মা ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে ছেলের ফোনালাপের কথা বলে আর্তনাদ করছিলেন, আর ছেলের জন্য দোয়া করছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন- ‘ছেলের সঙ্গে এক ঘণ্টা আগে আমার কথা হয়েছে। এখন মোবাইল নম্বর বন্ধ পাচ্ছি।’
দুপুরে এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর ওই ভবনে কর্মরত হাসনাইন আহমেদ রিপন বাঁচার আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে দুটি পোস্ট দেন। প্রথম পোস্টে তিনি লেখেন- ‘আগুন আগুন, এটা শেষ পোস্ট হতে পারে। প্লিজ ফরগিভ মি (এফআর টাওয়ার লিফট ১৩)।’ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন কক্ষের ভেতরের সেলফিসহ দ্বিতীয় পোস্টে তিনি আপনজনদের বিদায় জানিয়ে লেখেন- ‘মা, মিনা, মিলন, আপু, ফাহিম ভাই সবাই আমারে মাফ করে দিস। আগুন এফআর টাওয়ার, লিফট ১৩।’ তবে ভাগ্যক্রমে উদ্ধার পেয়েছেন তিনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ক্রেন লেডারের মাধ্যমে যাদের উদ্ধার করেছেন তাদের একজন রিপন। রিপনের বন্ধুরা ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, উদ্ধারের পর বর্তমানে ইউনাইটেড হাসপাতালে চলছে তার চিকিৎসা।
রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারের নিরাপত্তা প্রহরী জাহাঙ্গীর আলম ২২তলা ভবনের ছাদে অবস্থান করছিলেন। যেখানে এ ভবনের নিরাপত্তা প্রহরীদের থাকার জায়গা। ডিউটি না থাকায় ছাদেই ছিলেন তিনি। আগুন লাগার কথা জেনেই নিচে নামার চেষ্টা করলেও নবম তলায় পৌঁছে তীব্র গরম আর ধোঁয়ায় বাধাগ্রস্ত হন। পরে ছাদে ফিরে গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে চলে যান লাগোয়া পাশের বিল্ডিংয়ে। জাহাঙ্গীর বলেছেন- ‘সাত ও আট তলায় আগুন লাগছে বইল্যা মনে হয়। পরে এইটা নয়তলায় গিয়া লাগে।’
এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছিলেন হাবিবুর রহমান নামে একজন। কারণ সেখানে ২০তলায় কাশেম গ্রুপে কর্মরত ছিলেন তার ফুফাতো ভাই আহসান হাবিব। তার মোবাইলটি ছিল বন্ধ। এক অজানা আশঙ্কায় ছটফট করছিলেন তিনি। এমন সময় হঠাৎ করেই সুস্থ অবস্থায় তার সামনে এসে দাঁড়ায় আহসান হাবিব। ভাইকে অক্ষত পেয়ে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাবিবুর। অফিসের বাইরে থাকায় তিনি নিরাপদ থাকলেও তার সহকর্মীদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি। আহসান হাবিব জানান, ‘বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অফিসের কাজে তাকে পাঠানো হয় বাংলামোটরে। অগ্নিকাণ্ডের সময় বাইরে থাকায় তিনি বিপদমুক্ত আছেন।’
টাওয়ারে স্ক্যান ওয়্যার নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন মির্জা আতিকুর রহমান। অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ঘটনাস্থলে ছুটে যান তার স্ত্রী অ্যানি আক্তার পলি। সেখানে তার খোঁজ না পেয়ে আর্তনাদ করছিলেন পলি। পরে তিনি স্বামীর খোঁজে ছুটে যান কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।
আগুনের উত্তাপ ও ধোঁয়ার তীব্রতা যখন ক্রমেই বাড়ছিল তখন জীবন বাঁচাতে ভবন থেকে লাফ দেন রেজাউল আহমেদ নামে একজন। নিচে পড়ে হাত-পা ভেঙে যাওয়া রেজাউল বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রেজাউলের মামাশ্বশুর জনি সাংবাদিকদের জানান, ‘যখন আগুন বাড়তে থাকে, তখন রেজাউল ওইখান থেকে লাফ দেন। হাসপাতালে নেয়ার পর জ্ঞান ফিরলে রেজাউল আমাকে জানায়, এমুন গরম হইছে আমি আর টিকতে পারছিলাম না। তাই লাফ দিছি।’
এফআর টাওয়ারের ১৪তলায় মিকা সিকিউরিটিস লি. কোম্পানিতে কাজ করতেন লালমনিরহাটের পাটগ্রামের আবু বকর সিদ্দিক বাচ্চুর ছেলে আবির। আগুন লাগার পর মোবাইলে একবার যোগাযোগ করতে পারলেও পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি। আবিরের ফোনটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তার চাচা সাংবাদিক শিমুল রহমান।
অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন ডিএইচএল-এর ডেলিভারিম্যান সুজন সরকার। যখন আগুন লেগেছে তখন তিনি নিচে মোটরসাইকেল পার্ক করে এফআর টাওয়ারের ৮ম তলার একটি অফিসে যেতে লিফটে উঠছিলেন। ঠিক এমন সময় লিফট থেকে বেরিয়ে একজন তাকে বলেন, উপরে আগুন লেগেছে। সেটা শুনেই তিনি ভবন থেকে বেরিয়ে আসেন।
অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন ১২ তলায় ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডের সেলস ম্যানেজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ফারুক। উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলেও শরীরের ৯০ভাগ পুড়ে যাওয়া ফারুককে বাঁচাতে পারেননি চিকিৎসকরা। হাসপাতালে গিয়ে ফারুককে শনাক্ত করেন তার বন্ধু ও পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম রাজু। তিনি সাংবাদিকদের জানান, ফারুক ডেমরা এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। ফেসবুক প্রোফাইলে ছোট্ট কন্যাকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে যে ছবিটি দিয়েছিলেন সেটাই এখন ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
কাঁচভাঙা জানালা দিয়ে হাত নাড়িয়ে আর চিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন। জীবনের আকুতি নিয়ে বাড়ানো হাতগুলো অনেক উপরে। ভবনের ১০ম তলা থেকে উপরে। কিন্তু উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়া লোকজন নিচে রাস্তায়। সাহায্য করতে না পেরে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়া অনেকেই দোয়া করছিলেন উপরের দিকে হাত তুলে। আর আটকে পড়ারা তখন স্বজনদের কাছে ফোন করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহায্য চাইছেন।
ভবনটির ৬ থেকে ৯ তলায় তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছানোর আগেই উদ্ধার কাজে যুক্ত হন আশেপাশের বিভিন্ন অফিসের লোকজন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পৌঁছানোর পর তাদের চেষ্টা ছিল প্রাণান্তকর। তারা আটকে পড়াদের আশ্বস্ত করছেন। উঁচু ফ্লোরগুলোতে আটকে পড়াদের উদ্ধারে পাঠানো হচ্ছে ক্রেন লেডার (যন্ত্রচালিত মই)। কিন্তু সে লেডার কাছাকাছি গিয়েও উদ্ধার করতে পারছেন না।
দুয়েকজন ভাগ্যবান লেডারের সাহায্যে উদ্ধার পেলেও অন্যদের ভাগ্য তখনও দোদুল্যমান। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না দীর্ঘ সময়ে। ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য নিচ থেকে পাঠানো হচ্ছে ভেজা টাওয়াল। আতঙ্কে কেউ ভবনের উপরের ফ্লোরের দিকে ছুটছেন। কেউ কেউ চেষ্টা করছেন পাশের ভবনে যাবার। অনেকেই নিচে নেমেছেন উঁচু ভবনে ঝুলে থাকা ক্যাবল বেয়ে। জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ নিচে লাফিয়ে পড়ছেন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ উৎসুক জনতার চোখের সামনে তারা আহত হচ্ছেন। অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করছেন।
এভাবেই বিভীষিকাময় পরিবেশে মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের অপেক্ষায় কাটাতে হয়েছে উদ্ধারের আশায়। উদ্ধার পেতে যখন আটকে পড়ারা হাত নাড়াচ্ছেন তখন নিচে অপেক্ষারত স্বজনসহ উৎসুকদের অশ্রুতে ভিজছে কপোল। চারদিকে তখন কেবলই বাঁচার আকুতি। বাঁচানোর তাগিদ। এমন দৃশ্য ছিল বনানীর ১৭ নম্বর রোডের বহুতল ভবন এফআর টাওয়ারের। আতঙ্ক কেবল আগুন লাগা এফআর টাওয়ারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বন্ধ করে দেয়া হয় আশেপাশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় বিদ্যুৎসহ জরুরি সেবার সংযোগ।
এক পর্যায়ে দমকল কর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ভবনের উপর থেকে বালি, গ্যাস ও পানি দিয়ে বিমান বাহিনী ও নিচ থেকে সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ শুরু করেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতার কাজই করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কিন্তু এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়ার তীব্রতার কথা বলেছেন তাদেরই একজন। এক উদ্ধারকর্মী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি। আর এই ধোঁয়ার কারণে ব্যাঘাত ঘটছে উদ্ধারে। উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি অগ্নিদগ্ধ ও আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন প্রভা হেলথ নামে একটি সংস্থার কর্মীরা।
প্রভা হেলথের কর্মকর্তা ফয়সাল রহমান বলেন, ‘এখানে আমরা সাতজন ডাক্তার, ১৪ জন নার্স ও ২০ জন সাপোর্ট স্টাফ আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছি।’ আগুন লাগার পরপরই নিজের ফেসবুকে পোস্ট দেন ওই ভবনে কর্মরত একজন মডেল ও অভিনেতা। তার নাম রিপন আহমেদ। তিনি ওই ভবনের লিফটে আটকে পড়েছেন উল্লেখ করে লেখেন- ‘আগুন, আগুন। হতে পারে এটা আমার লাস্ট (শেষ) পোস্ট। আমি এফআর টাওয়ারের লিফট ১৩’তে আছি। ক্ষমা করে দিয়েন।’ প্রথম পোস্টের এক ঘণ্টা পরে রিপন আরেকটি পোস্টে লেখেন- ‘মাফ করে দিয়েন। লিফট ১৩ বনানী এফআর টাওয়ার।’ পরে জানা গেছে, বিকালের দিকে দমকল বাহিনীর সদস্যরা রিপনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।
এফআর টাওয়ারের ভেতর থেকে নিজের ফেসবুকে একটি ভিডিও আপলোড করেন সেজুতি স্বর্ণা নামে একজন। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ফ্লোরে অবস্থানরত সবাই নাকে-মুখে কাপড় চেপে ধরে হাঁটছেন, ভেতরটা ধোঁয়ায় পুরোটাই অন্ধকার। এ সময় তিনি সাহায্য চেয়ে বলছিলেন- ‘আমাদের সিঁড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। সিঁড়ি না পাঠালে আমরা ধোঁয়ায় মারা যাবো।’
পাশের ভবনে কর্মরত একজন জানান, বাঁচার আকুতি নিয়ে অনেকেই নিচে নামছিলেন ঝুলন্ত ক্যাবল বেয়ে। এভাবেই নিচে নামছিলেন এক তরুণী। কয়েক ফুট নামার পরপরই হাত ফসকে পড়ে যান নিচের এক ভবনের এসির ওপর। ভাগ্যক্রমে ক্যাবল ধরে ঝুলে রইলেন তিনি। সেখানে ক্যাবল ধরে ঝুলে থাকা আরেকজন লোক সেই তরুণীকে নামতে সাহায্য করলেন। কিছুক্ষণ বাদে এক তরুণ একইভাবে নামছিলেন। আগুনের লেলিহান শিখা তার খুব পাশেই যেন। কয়েক সেকেন্ড বাদেই হাজার হাজার মানুষ ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠলেন। হাজারো মানুষের চোখের সামনেই ৮তলা উঁচুতেই কয়েক পাক খেয়ে নিচে পড়ে গেলেন সেই তরুণ।
বনানীর সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহ সহযোগিতা করছেন এফআর ভবন থেকে নামানো আহতদের উদ্ধার তৎপরতায়। ভবনটিতে তখন আটকে পড়েছিলেন তারই চাচাতো ভাই সুমন হোসেন। উদ্ধার তৎপরতায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি কাঁদছিলেন চিৎকার করে। বলছিলেন- ‘আল্লাহ তুমি তাদের বাঁচিয়ে দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই ওদের। কতগুলো মানুষ ভেতরে তা আমরা জানি না। বাঁচার জন্য অনেক মানুষ হাত বাড়াচ্ছেন। তাদের তুমি নিচে নামার ব্যবস্থা করো।’
এফআর টাওয়ারের ১২ তলায় ডাট গ্রুপে কাজ করতেন আইটি ইঞ্জিনিয়ার ফাহাদ ইবনে কবীর। আগুন লাগার পরপরই ফাহাদ তার মাকে ফোন দিয়ে বলেছেন- ‘ভেতরে আগুনের ধোঁয়ায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি দম নিতে পারছি না।’ ছেলের ফোন পেয়েই সেখানে ছুটে যান তার মা ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে ছেলের ফোনালাপের কথা বলে আর্তনাদ করছিলেন, আর ছেলের জন্য দোয়া করছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন- ‘ছেলের সঙ্গে এক ঘণ্টা আগে আমার কথা হয়েছে। এখন মোবাইল নম্বর বন্ধ পাচ্ছি।’
দুপুরে এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর ওই ভবনে কর্মরত হাসনাইন আহমেদ রিপন বাঁচার আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে দুটি পোস্ট দেন। প্রথম পোস্টে তিনি লেখেন- ‘আগুন আগুন, এটা শেষ পোস্ট হতে পারে। প্লিজ ফরগিভ মি (এফআর টাওয়ার লিফট ১৩)।’ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন কক্ষের ভেতরের সেলফিসহ দ্বিতীয় পোস্টে তিনি আপনজনদের বিদায় জানিয়ে লেখেন- ‘মা, মিনা, মিলন, আপু, ফাহিম ভাই সবাই আমারে মাফ করে দিস। আগুন এফআর টাওয়ার, লিফট ১৩।’ তবে ভাগ্যক্রমে উদ্ধার পেয়েছেন তিনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ক্রেন লেডারের মাধ্যমে যাদের উদ্ধার করেছেন তাদের একজন রিপন। রিপনের বন্ধুরা ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, উদ্ধারের পর বর্তমানে ইউনাইটেড হাসপাতালে চলছে তার চিকিৎসা।
রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারের নিরাপত্তা প্রহরী জাহাঙ্গীর আলম ২২তলা ভবনের ছাদে অবস্থান করছিলেন। যেখানে এ ভবনের নিরাপত্তা প্রহরীদের থাকার জায়গা। ডিউটি না থাকায় ছাদেই ছিলেন তিনি। আগুন লাগার কথা জেনেই নিচে নামার চেষ্টা করলেও নবম তলায় পৌঁছে তীব্র গরম আর ধোঁয়ায় বাধাগ্রস্ত হন। পরে ছাদে ফিরে গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে চলে যান লাগোয়া পাশের বিল্ডিংয়ে। জাহাঙ্গীর বলেছেন- ‘সাত ও আট তলায় আগুন লাগছে বইল্যা মনে হয়। পরে এইটা নয়তলায় গিয়া লাগে।’
এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছিলেন হাবিবুর রহমান নামে একজন। কারণ সেখানে ২০তলায় কাশেম গ্রুপে কর্মরত ছিলেন তার ফুফাতো ভাই আহসান হাবিব। তার মোবাইলটি ছিল বন্ধ। এক অজানা আশঙ্কায় ছটফট করছিলেন তিনি। এমন সময় হঠাৎ করেই সুস্থ অবস্থায় তার সামনে এসে দাঁড়ায় আহসান হাবিব। ভাইকে অক্ষত পেয়ে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাবিবুর। অফিসের বাইরে থাকায় তিনি নিরাপদ থাকলেও তার সহকর্মীদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি। আহসান হাবিব জানান, ‘বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অফিসের কাজে তাকে পাঠানো হয় বাংলামোটরে। অগ্নিকাণ্ডের সময় বাইরে থাকায় তিনি বিপদমুক্ত আছেন।’
টাওয়ারে স্ক্যান ওয়্যার নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন মির্জা আতিকুর রহমান। অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ঘটনাস্থলে ছুটে যান তার স্ত্রী অ্যানি আক্তার পলি। সেখানে তার খোঁজ না পেয়ে আর্তনাদ করছিলেন পলি। পরে তিনি স্বামীর খোঁজে ছুটে যান কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।
আগুনের উত্তাপ ও ধোঁয়ার তীব্রতা যখন ক্রমেই বাড়ছিল তখন জীবন বাঁচাতে ভবন থেকে লাফ দেন রেজাউল আহমেদ নামে একজন। নিচে পড়ে হাত-পা ভেঙে যাওয়া রেজাউল বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রেজাউলের মামাশ্বশুর জনি সাংবাদিকদের জানান, ‘যখন আগুন বাড়তে থাকে, তখন রেজাউল ওইখান থেকে লাফ দেন। হাসপাতালে নেয়ার পর জ্ঞান ফিরলে রেজাউল আমাকে জানায়, এমুন গরম হইছে আমি আর টিকতে পারছিলাম না। তাই লাফ দিছি।’
এফআর টাওয়ারের ১৪তলায় মিকা সিকিউরিটিস লি. কোম্পানিতে কাজ করতেন লালমনিরহাটের পাটগ্রামের আবু বকর সিদ্দিক বাচ্চুর ছেলে আবির। আগুন লাগার পর মোবাইলে একবার যোগাযোগ করতে পারলেও পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি। আবিরের ফোনটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তার চাচা সাংবাদিক শিমুল রহমান।
অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন ডিএইচএল-এর ডেলিভারিম্যান সুজন সরকার। যখন আগুন লেগেছে তখন তিনি নিচে মোটরসাইকেল পার্ক করে এফআর টাওয়ারের ৮ম তলার একটি অফিসে যেতে লিফটে উঠছিলেন। ঠিক এমন সময় লিফট থেকে বেরিয়ে একজন তাকে বলেন, উপরে আগুন লেগেছে। সেটা শুনেই তিনি ভবন থেকে বেরিয়ে আসেন।
অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন ১২ তলায় ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডের সেলস ম্যানেজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ফারুক। উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলেও শরীরের ৯০ভাগ পুড়ে যাওয়া ফারুককে বাঁচাতে পারেননি চিকিৎসকরা। হাসপাতালে গিয়ে ফারুককে শনাক্ত করেন তার বন্ধু ও পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম রাজু। তিনি সাংবাদিকদের জানান, ফারুক ডেমরা এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। ফেসবুক প্রোফাইলে ছোট্ট কন্যাকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে যে ছবিটি দিয়েছিলেন সেটাই এখন ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
No comments