ঢাকায় গাড়ি চোরের ৫০ সিন্ডিকেট by শুভ্র দেব
রাজধানী
ঢাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গাড়ি চুরির অর্ধশতাধিক চক্র। বেপরোয়া এসব চক্রের
সদস্যরা প্রকাশ্য দিনের আলোতে চুরি করে নিয়ে যায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা,
প্রাইভেট কার, জিপসহ অন্যান্য গাড়ি। রাতে তারা হয়ে উঠে আরো ভয়ঙ্কর। বেপরোয়া
গাড়ি চোর চক্রের সদস্যরা প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হয়।
তবে মূল হোতারা থাকে অধরা। তাই এসব হোতারাই চক্রের সদস্যদের জামিনে মুক্ত
করে আনে। জামিনে বের হয়ে ফের তারা একই কাজে জড়িয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন,
ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি চুরি হয়।
এসব চুরির ঘটনায় থানায় অভিযোগের সংখ্যা নিতান্তই কম। হয়রানির অভিযোগে ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ করেন না। চক্রের সদস্যরা মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে টাকার বিনিময়ে তারা গাড়ি মুক্ত করে নিয়ে আসে।
গোয়েন্দা তথ্য ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী ও আশেপাশের এলাকায় গাড়ি চোর চক্রের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কানা শহীদ, শ্যামপুরের ফারুক, স্বপন, আসলাম, সবুজ, জনি, হোসেন, আবুল, মিন্টু, শিপন, ইয়াকুব, শাহাজাহান, আলমগীর, সেন্টু, লাল মিয়া, কামাল, মাসুম, গিয়াস, লোকমান, শাহীন, ফেরদৌস, আলী, আলম, ফরিদ, টঙ্গির মজিবুর, আকতার মোল্লা, রনি, জাহিদ, ইদ্রিস, মামুন, রিয়াজ, আজমত, মোস্তফা, রফিক, লিংকন, মুন্না, সালাম, হাশেম, মনোয়ার, রইছ, নুর হোসেন, জলিল, হাফিজ, রহমত, কাশেম অন্যতম। তারা প্রত্যেকেই এক একটি চক্রের সর্দার হিসাবেই পরিচিত। এসব চক্র ছাড়াও আরো নামে বেনামে আরো একাধিক হোতা রয়েছে। প্রতি সর্দারের অধীনে আবার ২০ থেকে ২৫ জন করে সদস্য থাকেন। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কাজ থাকে।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, চক্রটি সাধারণত চারটি ধাপে তাদের কাজ করে। প্রথম ধাপে থাকে চক্রের প্রধান হোতা যাদের বলা হয় সর্দার। তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে চক্র নিয়ন্ত্রণ করেন। চক্রের কেউ গ্রেপ্তার হলে তাদের জামিনে মুক্ত করা। নিজস্ব সোর্স মারফত তথ্য সংগ্রহ, আয়ের টাকা ভাগভাটোয়ারা, এলাকা নিয়ন্ত্রণ, গ্যারেজ ভাড়া, বিক্রি, চক্রে নতুন সদস্য নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দায়িত্ব বণ্টনের কাজ করা। দ্বিতীয় ধাপে থাকে মিডিয়া বা মধ্যস্থতাকারী। তাদের কাজ হলো চুরি করে আনা গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে ফিরিয়ে দিতে মিডিয়া হিসাবে কাজ করা। আর মাঠপর্যায়ে গাড়ি চুরির কাজে থাকেন আরো কিছু সদস্য।
যেভাবে চুরি হয় গাড়ি: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) কাছে আটক গাড়ি চোররা বিভিন্ন সময় গাড়ি চুরির বর্ণনা দিয়েছে। চক্রের সদস্যরা খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ওই সময় সড়কে জনসমাগম কম থাকায় তারা এই সময়টাকে বেছে নেয়। গোয়েন্দারা বলছেন সম্প্রতি যেসব গাড়ি চুরি হচ্ছে তার বেশির ভাগই সিএনজি। বিভিন্ন এলাকার চা বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সিএনজি চালকদের ফাঁদে পেলে তারা গাড়ি চুরি করে। চক্রের সদস্যরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। প্রতিটি চক্রের মাঠ পর্যায়ে ৫/৭ জন সদস্য কাজ করে। তাদের মধ্যে একজন গ্যারেজ থেকে চালক সেজে সিএনজি ভাড়া নেয়। অন্য সিএনজি চালকদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে তারা যাত্রী অথবা চালক সেজে গল্প করে। চক্রের সদস্যরা টার্গেটকৃত চালককে চায়ের দাওয়াত করে। ওই চালক রাজি হলে তাকে নিয়ে অন্যরা বিভিন্ন রকম গল্প করে সময় কাটায়। আর এই সুযোগেই চক্রের অন্য সদস্যরা চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক কিছু মিশিয়ে খাইয়ে দেয়।
চা পর্ব শেষ হলে চক্রের সদস্যরা কোথাও যাওয়ার জন্য ভুক্তভোগী চালককে ভাড়া করে। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন ওই চালকের ঝিমুনি আসে তখন কৌশলে কিছু কেনার উদ্দেশ্য তারা সিএনজি থামিয়ে আরো সময় নষ্ট করে। ততক্ষণে চেতনা হারিয়ে ফেলে ওই চালক। আর চক্রের সদস্যরা তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে সিএনজি নিয়ে চম্পট দেয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সর্দাররা সুবিধাজনক বিভিন্ন এলাকায় আগে থেকেই গ্যারেজ ভাড়া করে রাখেন। ধরা পড়ার ভয়ে তারা একাধিক এলাকায় গ্যারেজ ভাড়া করেন। শুধু ঢাকার ভেতরে নয় গাজীপুর, নরসিংদি, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় গ্যারেজ ভাড়া করেন সর্দাররা। চুরি করা গাড়ি সরাসরি এসব গ্যারেজে নেয়া হয়। কিছু কিছু গ্যারেজের মালিকের সঙ্গে সর্দারদের চুক্তি থাকে। পরে চক্রের মধ্যস্থতাকারীরা সিএনজিতে থাকা কাগজপত্র থেকে তথ্য নিয়ে মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক্ষেত্রে মালিককে থানা পুলিশের ঝামেলা যাতে না করে সেজন্য সতর্ক করে দেয়।
আর গাড়ির কন্ডিশন বুঝে মালিকের কাছে টাকার পরিমাণ বলা হয়। এরপর শুরু হয় দর কষাকষি। সাধারণত চুরি হওয়া সিএনজি ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। বিকাশে অথবা রকেটে টাকা পাওয়ার পর ফিরিয়ে দেয়া হয় গাড়ি। আবার অনেক সময় এসব গাড়ির নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে ভুয়া নম্বর প্লেট ও কাগজপত্র তৈরি করে বিক্রি করে দেয়া হয় মফস্বল এলাকায়। চুরি করা গাড়ি মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অথবা বিক্রি করে যে আয় হয় তার ভাগ সবাইকে দেয়া হয়। এ ছাড়া ওই টাকা থেকে একটি অংশ সর্দাররা রেখে দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যদি কোন চোর ধরা পড়ে তবে সেই টাকা দিয়ে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করা হয়।
ভুক্তভোগী গাড়ি চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চক্রের সদস্যরা নকল চাবি তৈরি করে তাদের সঙ্গে রাখে। কিছু কিছু চাবি দিয়ে একাধিক গাড়ির লক খোলা যায়। চক্রের সদস্যদের কাছেও একাধিক চাবি থাকে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রো চুরির ক্ষেত্রে তারা এসব নকল চাবি ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে তারা আগে থেকেই গাড়ি টার্গেট করে রাখে। অনেক দিন নজরদারির পর তারা মিশনে নামে। এ ছাড়া রাতের আঁধারে যাত্রী সেজে গাড়ি চোরেরা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যায়। সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে চালককে মারধর আবার কখনও হত্যা করে গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
গোয়েন্দাসূত্র বলছে, গাড়ি চুরির অভিযোগে প্রায়ই অনেক চোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এসব চোরের বেশির ভাগই ছিঁচকে চোর। তাদের উপরে আরো কয়েকটি ধাপ থাকে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে তারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্যমতে অনেক সময় অভিযান চালিয়ে সর্দারদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। কারণ চক্রের কেউ গ্রেপ্তার হলে সে খবর পেয়ে সর্দাররা গা-ঢাকা দেয়। আড়ালে আবডালে থেকেই আবার গ্রেপ্তারকৃতদের জামিনে মুক্ত করে আনে। পাশাপাশি সর্দাররা নতুন নতুন সদস্য নিয়োগ দেয়। এতে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব গাড়ি চোরদের অনেক সময় শনাক্ত করতে পারেন না। চলতি বছরের ১৯শে জানুয়ারি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিম গাড়ি চোর চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন- মো. অলী (২৩), তানভীর ইসলাম (২৪), নুর মোহাম্মদ (৩৭), মো. তাইজুউদ্দিন (৪৫), মো. জাকির (৪৫) ও মো. শিপলু (৩০)।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন মানবজমিনকে বলেন, সিএনজি চুরির ঘটনা এখন অহরহ। ঢাকা মেট্রো এলাকায় নম্বর প্লেটসহ সিএনজির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। কোনোভাবে একটা সিএনজি চুরি করে নিয়ে গেলে মালিক সেটা লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক সময় চুরি করে তাদের গ্যারেজ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হচ্ছে না। যাওয়ার পথেই অনেক সময় মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা টাকার বিনিময়ে সিএনজি বুঝিয়ে দেয়। সাকলায়েন বলেন, ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগ সময় পুলিশকে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন না।
গাড়ি চোর চক্রের কবলে পড়ে অনেক গাড়ি চালকের মৃত্যু হচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে এক সিএনজি চালকের মরদেহ উদ্ধার করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। এ ঘটনায় পরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের একটি টিম মো. লিটন ও মো. জসিম নামের দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। ডিবি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা দিয়েছে সিএনজি চালকের কাছ থেকে গাড়ি চুরির ভয়ঙ্কর তথ্য। তারা জানিয়েছে, ঘটনার দিন তারা আগারগাঁওয়ের বাণিজ্যমেলা এলাকা থেকে সিএনজি ভাড়া করে ফার্মগেট এলাকায় যায়। রাস্তায় যানজট থাকায় তারা সিএনচি চালকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। একপর্যায়ে তারা ফার্মগেট নেমে ওই চালককে চা খাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এ সময় চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে তারা চালককে খাইয়ে দেয়। তার কিছুক্ষণ পর চালক অসুস্থতা বোধ করে। তখন তারাই তাকে হাসপাতালে নেয়ার উদ্দেশ্য ওই সিএনজিতে তুলে রওনা দেয়। মানিক মিয়া এভিনিউতে যাওয়ার পর তারা ওই চালক মারা গেলে তাকে ফেলে দিয়ে তারা সিএনজি নিয়ে চলে যায়।
গাড়ি চোরের গুরু কানা শহীদ: কানা শহীদ পেশায় এক সময় সিএনজি চালক ছিলেন। একটি দুর্ঘটনায় তার চোখ নষ্ট হয়ে তাকে সবাই কানা শহীদ নামেই ডাকে। এরপর থেকে সিএনজি চালানো ছেড়ে দিয়ে তিনি নামেন সিএনজি চুরিতে। প্রথম দিকে একা একাই চুরি করতেন। বর্তমানে তিনি সিএনজি চালকদের জন্য এক আতঙ্ক। ঢাকার অনেক থানায় তার নামে গাড়ি চুরির একাধিক মামলা রয়েছে। বেশ আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে ফের গাড়ি চুরির কাজ শুরু করে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে এখন সে চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি চুরির কাজে জড়িত থেকে কানা শহীদ কোটি টাকার মালিক হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম মানবজমিনকে বলেন, গাড়ি চোরদের ধরার জন্য নিয়মিতই আমাদের অভিযান চলে। তারপরও ডিজিটাল নম্বর প্লেটবিহীন সিএনজি মোটরসাইকেল চুরি অব্যাহত আছে। ফলে একদিকে ডিজিটাল নম্বর প্লেট না থাকতে চুরি বাড়ছে আবার সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি গাড়ি চোর চক্রের পুরো নেটওয়ার্ক ধরার জন্য। কারণ যখন অভিযান চালানো হয় তখন চক্রের সবাইকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। যারা ধরা পড়ে তারা জামিনে বের হয়ে এসে আবার নতুন চক্র গড়ে তুলে। এছাড়া যাদেরকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না তারা চক্রে নতুন সদস্য নিয়োগ দেয়।
এসব চুরির ঘটনায় থানায় অভিযোগের সংখ্যা নিতান্তই কম। হয়রানির অভিযোগে ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ করেন না। চক্রের সদস্যরা মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে টাকার বিনিময়ে তারা গাড়ি মুক্ত করে নিয়ে আসে।
গোয়েন্দা তথ্য ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী ও আশেপাশের এলাকায় গাড়ি চোর চক্রের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কানা শহীদ, শ্যামপুরের ফারুক, স্বপন, আসলাম, সবুজ, জনি, হোসেন, আবুল, মিন্টু, শিপন, ইয়াকুব, শাহাজাহান, আলমগীর, সেন্টু, লাল মিয়া, কামাল, মাসুম, গিয়াস, লোকমান, শাহীন, ফেরদৌস, আলী, আলম, ফরিদ, টঙ্গির মজিবুর, আকতার মোল্লা, রনি, জাহিদ, ইদ্রিস, মামুন, রিয়াজ, আজমত, মোস্তফা, রফিক, লিংকন, মুন্না, সালাম, হাশেম, মনোয়ার, রইছ, নুর হোসেন, জলিল, হাফিজ, রহমত, কাশেম অন্যতম। তারা প্রত্যেকেই এক একটি চক্রের সর্দার হিসাবেই পরিচিত। এসব চক্র ছাড়াও আরো নামে বেনামে আরো একাধিক হোতা রয়েছে। প্রতি সর্দারের অধীনে আবার ২০ থেকে ২৫ জন করে সদস্য থাকেন। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কাজ থাকে।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, চক্রটি সাধারণত চারটি ধাপে তাদের কাজ করে। প্রথম ধাপে থাকে চক্রের প্রধান হোতা যাদের বলা হয় সর্দার। তার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে চক্র নিয়ন্ত্রণ করেন। চক্রের কেউ গ্রেপ্তার হলে তাদের জামিনে মুক্ত করা। নিজস্ব সোর্স মারফত তথ্য সংগ্রহ, আয়ের টাকা ভাগভাটোয়ারা, এলাকা নিয়ন্ত্রণ, গ্যারেজ ভাড়া, বিক্রি, চক্রে নতুন সদস্য নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দায়িত্ব বণ্টনের কাজ করা। দ্বিতীয় ধাপে থাকে মিডিয়া বা মধ্যস্থতাকারী। তাদের কাজ হলো চুরি করে আনা গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে ফিরিয়ে দিতে মিডিয়া হিসাবে কাজ করা। আর মাঠপর্যায়ে গাড়ি চুরির কাজে থাকেন আরো কিছু সদস্য।
যেভাবে চুরি হয় গাড়ি: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) কাছে আটক গাড়ি চোররা বিভিন্ন সময় গাড়ি চুরির বর্ণনা দিয়েছে। চক্রের সদস্যরা খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ওই সময় সড়কে জনসমাগম কম থাকায় তারা এই সময়টাকে বেছে নেয়। গোয়েন্দারা বলছেন সম্প্রতি যেসব গাড়ি চুরি হচ্ছে তার বেশির ভাগই সিএনজি। বিভিন্ন এলাকার চা বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সিএনজি চালকদের ফাঁদে পেলে তারা গাড়ি চুরি করে। চক্রের সদস্যরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। প্রতিটি চক্রের মাঠ পর্যায়ে ৫/৭ জন সদস্য কাজ করে। তাদের মধ্যে একজন গ্যারেজ থেকে চালক সেজে সিএনজি ভাড়া নেয়। অন্য সিএনজি চালকদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে তারা যাত্রী অথবা চালক সেজে গল্প করে। চক্রের সদস্যরা টার্গেটকৃত চালককে চায়ের দাওয়াত করে। ওই চালক রাজি হলে তাকে নিয়ে অন্যরা বিভিন্ন রকম গল্প করে সময় কাটায়। আর এই সুযোগেই চক্রের অন্য সদস্যরা চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক কিছু মিশিয়ে খাইয়ে দেয়।
চা পর্ব শেষ হলে চক্রের সদস্যরা কোথাও যাওয়ার জন্য ভুক্তভোগী চালককে ভাড়া করে। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন ওই চালকের ঝিমুনি আসে তখন কৌশলে কিছু কেনার উদ্দেশ্য তারা সিএনজি থামিয়ে আরো সময় নষ্ট করে। ততক্ষণে চেতনা হারিয়ে ফেলে ওই চালক। আর চক্রের সদস্যরা তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে সিএনজি নিয়ে চম্পট দেয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সর্দাররা সুবিধাজনক বিভিন্ন এলাকায় আগে থেকেই গ্যারেজ ভাড়া করে রাখেন। ধরা পড়ার ভয়ে তারা একাধিক এলাকায় গ্যারেজ ভাড়া করেন। শুধু ঢাকার ভেতরে নয় গাজীপুর, নরসিংদি, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় গ্যারেজ ভাড়া করেন সর্দাররা। চুরি করা গাড়ি সরাসরি এসব গ্যারেজে নেয়া হয়। কিছু কিছু গ্যারেজের মালিকের সঙ্গে সর্দারদের চুক্তি থাকে। পরে চক্রের মধ্যস্থতাকারীরা সিএনজিতে থাকা কাগজপত্র থেকে তথ্য নিয়ে মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক্ষেত্রে মালিককে থানা পুলিশের ঝামেলা যাতে না করে সেজন্য সতর্ক করে দেয়।
আর গাড়ির কন্ডিশন বুঝে মালিকের কাছে টাকার পরিমাণ বলা হয়। এরপর শুরু হয় দর কষাকষি। সাধারণত চুরি হওয়া সিএনজি ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। বিকাশে অথবা রকেটে টাকা পাওয়ার পর ফিরিয়ে দেয়া হয় গাড়ি। আবার অনেক সময় এসব গাড়ির নম্বর প্লেট পরিবর্তন করে ভুয়া নম্বর প্লেট ও কাগজপত্র তৈরি করে বিক্রি করে দেয়া হয় মফস্বল এলাকায়। চুরি করা গাড়ি মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অথবা বিক্রি করে যে আয় হয় তার ভাগ সবাইকে দেয়া হয়। এ ছাড়া ওই টাকা থেকে একটি অংশ সর্দাররা রেখে দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যদি কোন চোর ধরা পড়ে তবে সেই টাকা দিয়ে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করা হয়।
ভুক্তভোগী গাড়ি চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চক্রের সদস্যরা নকল চাবি তৈরি করে তাদের সঙ্গে রাখে। কিছু কিছু চাবি দিয়ে একাধিক গাড়ির লক খোলা যায়। চক্রের সদস্যদের কাছেও একাধিক চাবি থাকে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রো চুরির ক্ষেত্রে তারা এসব নকল চাবি ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে তারা আগে থেকেই গাড়ি টার্গেট করে রাখে। অনেক দিন নজরদারির পর তারা মিশনে নামে। এ ছাড়া রাতের আঁধারে যাত্রী সেজে গাড়ি চোরেরা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যায়। সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে চালককে মারধর আবার কখনও হত্যা করে গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
গোয়েন্দাসূত্র বলছে, গাড়ি চুরির অভিযোগে প্রায়ই অনেক চোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এসব চোরের বেশির ভাগই ছিঁচকে চোর। তাদের উপরে আরো কয়েকটি ধাপ থাকে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে তারা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্যমতে অনেক সময় অভিযান চালিয়ে সর্দারদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। কারণ চক্রের কেউ গ্রেপ্তার হলে সে খবর পেয়ে সর্দাররা গা-ঢাকা দেয়। আড়ালে আবডালে থেকেই আবার গ্রেপ্তারকৃতদের জামিনে মুক্ত করে আনে। পাশাপাশি সর্দাররা নতুন নতুন সদস্য নিয়োগ দেয়। এতে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব গাড়ি চোরদের অনেক সময় শনাক্ত করতে পারেন না। চলতি বছরের ১৯শে জানুয়ারি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিম গাড়ি চোর চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন- মো. অলী (২৩), তানভীর ইসলাম (২৪), নুর মোহাম্মদ (৩৭), মো. তাইজুউদ্দিন (৪৫), মো. জাকির (৪৫) ও মো. শিপলু (৩০)।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন মানবজমিনকে বলেন, সিএনজি চুরির ঘটনা এখন অহরহ। ঢাকা মেট্রো এলাকায় নম্বর প্লেটসহ সিএনজির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। কোনোভাবে একটা সিএনজি চুরি করে নিয়ে গেলে মালিক সেটা লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক সময় চুরি করে তাদের গ্যারেজ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হচ্ছে না। যাওয়ার পথেই অনেক সময় মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা টাকার বিনিময়ে সিএনজি বুঝিয়ে দেয়। সাকলায়েন বলেন, ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগ সময় পুলিশকে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন না।
গাড়ি চোর চক্রের কবলে পড়ে অনেক গাড়ি চালকের মৃত্যু হচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে এক সিএনজি চালকের মরদেহ উদ্ধার করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। এ ঘটনায় পরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের একটি টিম মো. লিটন ও মো. জসিম নামের দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। ডিবি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা দিয়েছে সিএনজি চালকের কাছ থেকে গাড়ি চুরির ভয়ঙ্কর তথ্য। তারা জানিয়েছে, ঘটনার দিন তারা আগারগাঁওয়ের বাণিজ্যমেলা এলাকা থেকে সিএনজি ভাড়া করে ফার্মগেট এলাকায় যায়। রাস্তায় যানজট থাকায় তারা সিএনচি চালকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। একপর্যায়ে তারা ফার্মগেট নেমে ওই চালককে চা খাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এ সময় চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে তারা চালককে খাইয়ে দেয়। তার কিছুক্ষণ পর চালক অসুস্থতা বোধ করে। তখন তারাই তাকে হাসপাতালে নেয়ার উদ্দেশ্য ওই সিএনজিতে তুলে রওনা দেয়। মানিক মিয়া এভিনিউতে যাওয়ার পর তারা ওই চালক মারা গেলে তাকে ফেলে দিয়ে তারা সিএনজি নিয়ে চলে যায়।
গাড়ি চোরের গুরু কানা শহীদ: কানা শহীদ পেশায় এক সময় সিএনজি চালক ছিলেন। একটি দুর্ঘটনায় তার চোখ নষ্ট হয়ে তাকে সবাই কানা শহীদ নামেই ডাকে। এরপর থেকে সিএনজি চালানো ছেড়ে দিয়ে তিনি নামেন সিএনজি চুরিতে। প্রথম দিকে একা একাই চুরি করতেন। বর্তমানে তিনি সিএনজি চালকদের জন্য এক আতঙ্ক। ঢাকার অনেক থানায় তার নামে গাড়ি চুরির একাধিক মামলা রয়েছে। বেশ আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে ফের গাড়ি চুরির কাজ শুরু করে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে এখন সে চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি চুরির কাজে জড়িত থেকে কানা শহীদ কোটি টাকার মালিক হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম মানবজমিনকে বলেন, গাড়ি চোরদের ধরার জন্য নিয়মিতই আমাদের অভিযান চলে। তারপরও ডিজিটাল নম্বর প্লেটবিহীন সিএনজি মোটরসাইকেল চুরি অব্যাহত আছে। ফলে একদিকে ডিজিটাল নম্বর প্লেট না থাকতে চুরি বাড়ছে আবার সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি গাড়ি চোর চক্রের পুরো নেটওয়ার্ক ধরার জন্য। কারণ যখন অভিযান চালানো হয় তখন চক্রের সবাইকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। যারা ধরা পড়ে তারা জামিনে বের হয়ে এসে আবার নতুন চক্র গড়ে তুলে। এছাড়া যাদেরকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না তারা চক্রে নতুন সদস্য নিয়োগ দেয়।
No comments