যৌন অপরাধের মহামারি জোরালো প্রতিবাদ নেই by মরিয়ম চম্পা
বাড়ছে
ধর্ষণ। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশু-বৃদ্ধারাও।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন চরম নৈতিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, বিচারহীনতার
কারণেই ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। একই সঙ্গে সমাজে জোরালো প্রতিবাদ না হওয়ায় এ
ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ।
২০১৭ সালে প্রতিদিন গড়ে তিনজনেরও বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। চলতি বছরেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
গত ৮ই এপ্রিল দিনাজপুরের বীরগঞ্জে মোবাইলফোনে পরিচয়ের পর বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলে এক কিশোরীকে ডেকে এনে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৬ই এপ্রিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় স্বামীকে ঘরে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মামলার পর দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৫ই এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে ১৩ বছরের এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এক প্রতিবন্ধীকে ধর্ষণের অভিযোগে স্বপন নামের এক যুবককে আটক করে শাহ্বাগ থানা পুলিশ।
২রা এপ্রিল সাভারের ভাকুর্তার চাইরা গুদারাঘাট এলাকায় এক বাকপ্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ করে চার যুবক। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করেছে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ডাঙ্গাপড়া এলাকার এক কিশোরীকে ৬ মাস ধরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে ওই কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা। এ ঘটনায় ৩রা এপ্রিল কিশোরীর মা বাদী হয়ে ধর্ষকসহ চারজনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেছেন। ১লা এপ্রিল চট্টগ্রামের বাঁশখালী ইকোপার্কে এক স্কুলছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষিতার চিৎকারে উপস্থিত পর্যটক ও বন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় পুলিশ তিন ধর্ষককে গ্রেপ্তার করেছে। একইদিনে লক্ষ্মীপুরে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে এক শিক্ষককে আটক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিসংখ্যান গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ নির্ভর। এর বাইরের চিত্র আরো ভয়াবহ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন দু’জন। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ২১ নারীর ওপর।
গত সাড়ে ৫ বছরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সারা দেশে ধর্ষণের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। তাদের দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সাড়ে ৫ বছরে দেশে ৫ হাজার ২৪৮টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) বলছে, গত ৬ মাসে ১৪১ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে আর গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৩ নারী। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জেলায়। ঢাকায় ২৫টি, চট্টগ্রামে এবং নারায়ণগঞ্জে ৯টি করে, খুলনায় ৬টি এবং যশোর ও সিলেটে ৫টি করে।
আসকের ভিন্ন এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি ২০৫ নারী লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বাকি চার বছরের মধ্যে ২০১২ সালে ১৮৩ জন, ২০১৩ সালে ১২০, ২০১৪ সালে ১১৫, ২০১৬ সালে ১৩৮ এবং ২০১৭ সালে ১৫১ জন লাঞ্ছনার শিকার হন। ২০১৮ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯ নারী লাঞ্ছনার শিকার হন। এ ছাড়া যৌন হায়রানির কারণে এ পর্যন্ত ৪৬ জন মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯, ২০১৪ সালে ১৯৯, ২০১৫ সালে ৫২১, ২০১৬ সালে ৪৪৬ এবং ২০১৭ তে ৫৯৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ২৮ শিশুকে হত্যা এবং ৪৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস শহীদ মাহমুদ বলেন, ২০১৭ সালে ৫৯৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যার মধ্যে ৭০ শিশু গণধর্ষিত হয়েছে। ৪৪ প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ২২ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং সাত জন ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়াও ৭২ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৭ সালে ৫১ শিশু ইভটিজিং এবং ৯০ শিশু যৌন নিপীড়ন-হয়রানির শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ২৫ শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। সেইসঙ্গে অব্যাহতভাবে বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতকালে বখাটেদের উৎপাত এবং পর্নোগ্রাফির শিকারের ঘটনা। ২০১৭ সালে বখাটেদের হাতে লাঞ্ছনা, মারধর এমনকি হামলায় জখম হয়েছে ৬২ শিশু এবং প্রতিবাদ বা প্রতিহত করতে গিয়ে বখাটেদের হামলায় আহত হয়েছে ৫০-এর বেশি অভিভাবক।
২০১৬ সালে ৩৫৮৯ শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, যার মধ্যে ১৪৪১ শিশু অপমৃত্যু এবং ৬৮৬ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যেটা ২০১৭ সালে সামগ্রিকভাবে শিশু নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ, যার মধ্যে শিশু অপমৃত্যু এবং যৌন নির্যাতন বেড়েছে যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ৩০ দশমিক ৩২ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেন, নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এর সংখ্যাগত ও মাত্রাগত পরিবর্তন হয়েছে। নারীকে আক্রমণের ধরন আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। ব্লেড দিয়ে পোশাক কেটে দেয়া বা গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দেয়াসহ বিভিন্ন ভাবে তা প্রকাশ পাচ্ছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, ধর্ষণের যে প্রতিবাদ নেই এটা বলা যাবে না। প্রতিবাদ আছে। তবে সেটা কনটিনিউয়াস প্রসেসে না হওয়ায় খুব একটা জোরালো দেখায় না। কারণ ধর্ষণের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে একটার পর একটা ঘটেই যাচ্ছে। প্রথম একটি ঘটনা নিয়ে যখন ভিক্টিম ও সাধারণ মানুষ ভয়েস রেইস করে তার রেস কাটতে না কাটতে আবার নতুন কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে চাপ ও ক্ষোভ থাকলেও সেটা তারা অনুকূল পরিবেশের অভাবে প্রকাশ করতে পারে না। ফলে আন্দোলন, বিচার কার্যক্রম, গ্রেপ্তার, সবকিছুতেই ঢিলেঢালা ভাব দেখা যায় এবং ভিক্টিম সঠিক বিচার পায় না। কখনো কখনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবে দোষীরা পার পেয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ধর্ষণের প্রতিবাদ হচ্ছে। তবে ধর্ষণটা হচ্ছে অনেকটা ক্ষমতাহীনদের উপর ক্ষমতাসীনদের শক্তি খাটানোর মতো। ধর্ষণ বন্ধে বিচারিক তদন্ত প্রক্রিয়ায় মধ্যে কোনো সমস্যা আছে কি না এবং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে কেমন আইনি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। ধর্ষণের প্রতিবাদটা শুরুতে হলেও শেষ পর্যন্ত আর থাকে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। এক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ বা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল বলেন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেভাবে আইন হয়েছে যে, শিশু ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি হচ্ছে ধর্ষককে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসি দেয়া। একইভাবে বাংলাদেশেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ব্লাস্ট-এ কর্মরত আইনজীবী শারমিন আক্তার বলেন, ধর্ষণের বিষয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদ থাকলেও পাবলিকলি সেটা নেই। অনেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইলেও সাহস পায় না। সাধারণ মেয়েরা রাস্তায় না নামলেও ইদানীং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ধর্ষণ নামক ব্যাধি দূর করার জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টা বেশি দরকার তা হলো পারিবারিক শিক্ষা। শিশু বয়স থেকেই যদি নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে পারিবারিক শিক্ষায় উদ্বদ্ধ করা হয় তাহলে হয়তো ধর্ষণ বহুলাংশে কমে আসবে।
২০১৭ সালে প্রতিদিন গড়ে তিনজনেরও বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। চলতি বছরেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
গত ৮ই এপ্রিল দিনাজপুরের বীরগঞ্জে মোবাইলফোনে পরিচয়ের পর বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলে এক কিশোরীকে ডেকে এনে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৬ই এপ্রিল ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় স্বামীকে ঘরে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মামলার পর দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৫ই এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে ১৩ বছরের এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এক প্রতিবন্ধীকে ধর্ষণের অভিযোগে স্বপন নামের এক যুবককে আটক করে শাহ্বাগ থানা পুলিশ।
২রা এপ্রিল সাভারের ভাকুর্তার চাইরা গুদারাঘাট এলাকায় এক বাকপ্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ করে চার যুবক। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করেছে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ডাঙ্গাপড়া এলাকার এক কিশোরীকে ৬ মাস ধরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে ওই কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা। এ ঘটনায় ৩রা এপ্রিল কিশোরীর মা বাদী হয়ে ধর্ষকসহ চারজনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেছেন। ১লা এপ্রিল চট্টগ্রামের বাঁশখালী ইকোপার্কে এক স্কুলছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষিতার চিৎকারে উপস্থিত পর্যটক ও বন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় পুলিশ তিন ধর্ষককে গ্রেপ্তার করেছে। একইদিনে লক্ষ্মীপুরে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে এক শিক্ষককে আটক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিসংখ্যান গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ নির্ভর। এর বাইরের চিত্র আরো ভয়াবহ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন দু’জন। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ২১ নারীর ওপর।
গত সাড়ে ৫ বছরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সারা দেশে ধর্ষণের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। তাদের দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সাড়ে ৫ বছরে দেশে ৫ হাজার ২৪৮টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) বলছে, গত ৬ মাসে ১৪১ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে আর গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৩ নারী। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জেলায়। ঢাকায় ২৫টি, চট্টগ্রামে এবং নারায়ণগঞ্জে ৯টি করে, খুলনায় ৬টি এবং যশোর ও সিলেটে ৫টি করে।
আসকের ভিন্ন এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি ২০৫ নারী লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বাকি চার বছরের মধ্যে ২০১২ সালে ১৮৩ জন, ২০১৩ সালে ১২০, ২০১৪ সালে ১১৫, ২০১৬ সালে ১৩৮ এবং ২০১৭ সালে ১৫১ জন লাঞ্ছনার শিকার হন। ২০১৮ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯ নারী লাঞ্ছনার শিকার হন। এ ছাড়া যৌন হায়রানির কারণে এ পর্যন্ত ৪৬ জন মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯, ২০১৪ সালে ১৯৯, ২০১৫ সালে ৫২১, ২০১৬ সালে ৪৪৬ এবং ২০১৭ তে ৫৯৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ২৮ শিশুকে হত্যা এবং ৪৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস শহীদ মাহমুদ বলেন, ২০১৭ সালে ৫৯৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যার মধ্যে ৭০ শিশু গণধর্ষিত হয়েছে। ৪৪ প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ২২ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং সাত জন ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়াও ৭২ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৭ সালে ৫১ শিশু ইভটিজিং এবং ৯০ শিশু যৌন নিপীড়ন-হয়রানির শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ২৫ শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। সেইসঙ্গে অব্যাহতভাবে বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতকালে বখাটেদের উৎপাত এবং পর্নোগ্রাফির শিকারের ঘটনা। ২০১৭ সালে বখাটেদের হাতে লাঞ্ছনা, মারধর এমনকি হামলায় জখম হয়েছে ৬২ শিশু এবং প্রতিবাদ বা প্রতিহত করতে গিয়ে বখাটেদের হামলায় আহত হয়েছে ৫০-এর বেশি অভিভাবক।
২০১৬ সালে ৩৫৮৯ শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, যার মধ্যে ১৪৪১ শিশু অপমৃত্যু এবং ৬৮৬ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যেটা ২০১৭ সালে সামগ্রিকভাবে শিশু নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ, যার মধ্যে শিশু অপমৃত্যু এবং যৌন নির্যাতন বেড়েছে যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ৩০ দশমিক ৩২ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেন, নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এর সংখ্যাগত ও মাত্রাগত পরিবর্তন হয়েছে। নারীকে আক্রমণের ধরন আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। ব্লেড দিয়ে পোশাক কেটে দেয়া বা গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দেয়াসহ বিভিন্ন ভাবে তা প্রকাশ পাচ্ছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী ও মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, ধর্ষণের যে প্রতিবাদ নেই এটা বলা যাবে না। প্রতিবাদ আছে। তবে সেটা কনটিনিউয়াস প্রসেসে না হওয়ায় খুব একটা জোরালো দেখায় না। কারণ ধর্ষণের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে একটার পর একটা ঘটেই যাচ্ছে। প্রথম একটি ঘটনা নিয়ে যখন ভিক্টিম ও সাধারণ মানুষ ভয়েস রেইস করে তার রেস কাটতে না কাটতে আবার নতুন কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে চাপ ও ক্ষোভ থাকলেও সেটা তারা অনুকূল পরিবেশের অভাবে প্রকাশ করতে পারে না। ফলে আন্দোলন, বিচার কার্যক্রম, গ্রেপ্তার, সবকিছুতেই ঢিলেঢালা ভাব দেখা যায় এবং ভিক্টিম সঠিক বিচার পায় না। কখনো কখনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবে দোষীরা পার পেয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ধর্ষণের প্রতিবাদ হচ্ছে। তবে ধর্ষণটা হচ্ছে অনেকটা ক্ষমতাহীনদের উপর ক্ষমতাসীনদের শক্তি খাটানোর মতো। ধর্ষণ বন্ধে বিচারিক তদন্ত প্রক্রিয়ায় মধ্যে কোনো সমস্যা আছে কি না এবং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে কেমন আইনি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। ধর্ষণের প্রতিবাদটা শুরুতে হলেও শেষ পর্যন্ত আর থাকে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। এক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ বা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল বলেন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেভাবে আইন হয়েছে যে, শিশু ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি হচ্ছে ধর্ষককে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসি দেয়া। একইভাবে বাংলাদেশেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ব্লাস্ট-এ কর্মরত আইনজীবী শারমিন আক্তার বলেন, ধর্ষণের বিষয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদ থাকলেও পাবলিকলি সেটা নেই। অনেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইলেও সাহস পায় না। সাধারণ মেয়েরা রাস্তায় না নামলেও ইদানীং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ধর্ষণ নামক ব্যাধি দূর করার জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টা বেশি দরকার তা হলো পারিবারিক শিক্ষা। শিশু বয়স থেকেই যদি নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে পারিবারিক শিক্ষায় উদ্বদ্ধ করা হয় তাহলে হয়তো ধর্ষণ বহুলাংশে কমে আসবে।
No comments