সংস্কৃতির দূষণ by তুষার আবদুল্লাহ
তুষার আবদুল্লাহ |
বাংলা
নববর্ষ বরণে বাণিজ্যের প্রজাপতি উড়ছে দশক দুই ধরে। প্রজাপতির পাখার রঙ
ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। ধীরে ধীরে সর্বজনীন এই উৎসবের প্রতীক হয়ে উঠেছে লাল-সাদা।
যার পিড়ানের রঙে লাল-সাদা নেই, তার যেন অধিকার নেই উৎসবে যোগ দেওয়ার।
পোশাককে ঘিরে বড় বাজার তৈরি হয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে অলঙ্কার, খাবার। উৎসবটি
গ্রামীণ। কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের উৎসব। এই উৎসবের আচারগুলো বাঙালির
আবহমানকালের। বাঙালির অভ্যাসের বাইরে গ্রামীণ উৎসবে কোনও উপকরণ যোগ হয়নি।
পান্তা-ইলিশ নিয়ে নগরবাসীর যে হা-পিত্যেস, তার সঙ্গে গ্রামের গৃহস্তের কোনও
সম্পর্ক ছিল না। কৃষক পরিবার কখনও বর্ষবরণে পান্তা ইলিশ খায়নি। তার
পরিধানে সেদিন ওঠেনি নতুন পিরান। লাল-সাদা রঙ তো অনেক দূর ভাবনা। নগরে
মানুষ এসেছে রোজগারে। ফেলে এসেছে তার গ্রামের জীবন। সেই স্মৃতি থেকেই
নাগরিক মানুষেরা শহরে বর্ষবরণ আয়োজন করে। অভ্যাসের চৈত্রকে, সংক্রান্তিকে,
বৈশাখকে নিজের মতো করে শহুরে বানানো হয়েছে। বিচ্ছিন্ন মানুষদের গানের সুরে
বৃক্ষতলে জড়ো করার প্রয়াস। গ্রামের বটতলার মেলা গ্রাম ছেড়ে এসেছে শহরের সাজ
পোশাক পরেই। নগর মানুষ গ্রামীণ মনটাকে বদলে ফেলতে চায়নি। নতুন রঙ, পোশাক
বদলে দিতে পারেনি মনের রঙ। তাই এই উৎসবকে তারা গ্রামের ঢঙেই সব ধর্মের
মানুষের করতে সফল হয়েছে। উৎসব হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। একথা এখন স্বীকার না করে
উপায় নেই মুসলমান, সনাতন, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান উৎসবগুলোর চেয়ে
বর্ষবরণ উদযাপন নিয়ে বাঙালির উন্মাদনা কম নেই। যদি বাণিজ্যিক অঙ্ক মেলাই,
দেখবো এই উৎসবে কেনাকাটার পরিমাণও অন্য উৎসব গুলোকে অতিক্রমের পর্যায়ে
রয়েছে।
বাণিজ্যের কর্কট রোগ আছে। এই রোগ সংস্কৃতিতে অর্থাৎ মানুষের অভ্যাস চট করে বদলে দেয়। বাড়িয়ে দেয় ভোগের তাড়না। বর্ষবরণ উৎসব এখন পণ্য উৎপাদক ও বাজারজাতকারীদের জন্য একটি মোক্ষম লগ্ন হয়ে উঠেছে। তারা বাঙালিকে একপ্রকার বুঝিয়ে ফেলতে পেরেছে কী কী পরিধান না করলে, জিভে চেখে না দেখলে তাদের পক্ষে ষোলআনা বাঙালি হওয়া সম্ভব নয়। কৃষকের ঘর যে উৎসবের আঁতুড় ঘর, সেই কৃষকও নিজের বটতলার আড়ংয়ের কথা ভুলে গিয়ে লোভাতুর হয়ে তাকিয়ে থাকে নগর থেকে আসা পসরার দিকে। মাটির সানকি, পুতুল, ঘোড়া, হাতির কথা ভুলে সে চমকে ওঠে রকমারি যান্ত্রিক পসরায়। নিজ ঘরে মাটির পুতুল সরিয়ে সেই যন্ত্রকে আলগোছে জায়গা করে দিচ্ছে। উৎসবে এখন নাগরিক জৌলুস।
সংস্কৃতিকে প্রবাহমান নদীর সঙ্গে তুলনা করেন অনেকে। উজান থেকে জল নেমে আসবে,তার সঙ্গে খড়কুটো ভেসে আসবে সঙ্গে। আবার ভেসেও যাবে সেই খড়কুটো। আমাদের সংস্কৃতিতে বরাবরই এমন খড়কুটো ভাসতে দেখা গেছে। আবার সেগুলো ভাসতে ভাসতে চলে গেছে দূর সমুদ্দুরে। তবে এখনকার অবস্থা যেন ভিন্ন। ঠিক বাংলাদেশের নদীর মতোই। নাব্য কমে গেছে। নদী প্রবাহমান না থাকায় খড়কুটো পচে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলেছে। কমে গেছে আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা। নগর মানুষের চলন-বলন যদি দেখে,যদি তাকাই নগরের মধ্যবিত্তের দিকে, উচ্চবিত্তের দেয়াল টপকে চোখ যদি যায় অন্দরে, নগরে যারা বুদ্ধিজীবী বলে আওয়াজ তুলছেন, তাদের দিকে যদি কান পাতি দেখতে পাবো কেমন সংস্কৃতি ও রুচির সংকটে পড়েছি আমরা। একপ্রকার রুচির দূষণে আছি। আমাদের নদী যেমন দূষিত হয়ে পড়েছে। তেমনি সংস্কৃতিও। সেদিন সংবাদপত্রের পাতার সঙ্গে একটি লিফলেট ঢুকে পড়লো বাড়িতে। রঙিন লিফলেটে জানান হয়েছে ঢাকার একটি গ্যালারিতে বৈশাখী মেলা ১৪২৫ আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে যে পণ্য সুলভ হবে বলে তালিকা তুলে দেওয়া হয়েছে, সেখানে রয়েছে–‘জুয়েলারি, কসমেটিক্স, ইন্ডিয়ান ড্রেস, পাকিস্তানি ড্রেস, ক্যাটালগ ড্রেস, শাড়ি, কুর্তি, লেহেঙ্গা,ব্যাগ, জুতা, হিজাব ও আরও ফ্যাশনেবল এক্সসোরিজ’। সংস্কৃতির দূষণের কথা যে বললাম, এই ফর্দে দূষণের কোনও ‘কণা’ কি দেখতে পেলেন? জানি না ১৪২৫ উদযাপনে আমরা প্রবহমান সংস্কৃতিকে কতটা দূষণমুক্ত রাখতে পারবো বা কতটা দূষিত করবো।
বাণিজ্যের কর্কট রোগ আছে। এই রোগ সংস্কৃতিতে অর্থাৎ মানুষের অভ্যাস চট করে বদলে দেয়। বাড়িয়ে দেয় ভোগের তাড়না। বর্ষবরণ উৎসব এখন পণ্য উৎপাদক ও বাজারজাতকারীদের জন্য একটি মোক্ষম লগ্ন হয়ে উঠেছে। তারা বাঙালিকে একপ্রকার বুঝিয়ে ফেলতে পেরেছে কী কী পরিধান না করলে, জিভে চেখে না দেখলে তাদের পক্ষে ষোলআনা বাঙালি হওয়া সম্ভব নয়। কৃষকের ঘর যে উৎসবের আঁতুড় ঘর, সেই কৃষকও নিজের বটতলার আড়ংয়ের কথা ভুলে গিয়ে লোভাতুর হয়ে তাকিয়ে থাকে নগর থেকে আসা পসরার দিকে। মাটির সানকি, পুতুল, ঘোড়া, হাতির কথা ভুলে সে চমকে ওঠে রকমারি যান্ত্রিক পসরায়। নিজ ঘরে মাটির পুতুল সরিয়ে সেই যন্ত্রকে আলগোছে জায়গা করে দিচ্ছে। উৎসবে এখন নাগরিক জৌলুস।
সংস্কৃতিকে প্রবাহমান নদীর সঙ্গে তুলনা করেন অনেকে। উজান থেকে জল নেমে আসবে,তার সঙ্গে খড়কুটো ভেসে আসবে সঙ্গে। আবার ভেসেও যাবে সেই খড়কুটো। আমাদের সংস্কৃতিতে বরাবরই এমন খড়কুটো ভাসতে দেখা গেছে। আবার সেগুলো ভাসতে ভাসতে চলে গেছে দূর সমুদ্দুরে। তবে এখনকার অবস্থা যেন ভিন্ন। ঠিক বাংলাদেশের নদীর মতোই। নাব্য কমে গেছে। নদী প্রবাহমান না থাকায় খড়কুটো পচে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলেছে। কমে গেছে আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা। নগর মানুষের চলন-বলন যদি দেখে,যদি তাকাই নগরের মধ্যবিত্তের দিকে, উচ্চবিত্তের দেয়াল টপকে চোখ যদি যায় অন্দরে, নগরে যারা বুদ্ধিজীবী বলে আওয়াজ তুলছেন, তাদের দিকে যদি কান পাতি দেখতে পাবো কেমন সংস্কৃতি ও রুচির সংকটে পড়েছি আমরা। একপ্রকার রুচির দূষণে আছি। আমাদের নদী যেমন দূষিত হয়ে পড়েছে। তেমনি সংস্কৃতিও। সেদিন সংবাদপত্রের পাতার সঙ্গে একটি লিফলেট ঢুকে পড়লো বাড়িতে। রঙিন লিফলেটে জানান হয়েছে ঢাকার একটি গ্যালারিতে বৈশাখী মেলা ১৪২৫ আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে যে পণ্য সুলভ হবে বলে তালিকা তুলে দেওয়া হয়েছে, সেখানে রয়েছে–‘জুয়েলারি, কসমেটিক্স, ইন্ডিয়ান ড্রেস, পাকিস্তানি ড্রেস, ক্যাটালগ ড্রেস, শাড়ি, কুর্তি, লেহেঙ্গা,ব্যাগ, জুতা, হিজাব ও আরও ফ্যাশনেবল এক্সসোরিজ’। সংস্কৃতির দূষণের কথা যে বললাম, এই ফর্দে দূষণের কোনও ‘কণা’ কি দেখতে পেলেন? জানি না ১৪২৫ উদযাপনে আমরা প্রবহমান সংস্কৃতিকে কতটা দূষণমুক্ত রাখতে পারবো বা কতটা দূষিত করবো।
No comments