ধর্ষণের শাস্তি ক্রসফায়ার! by আমীন আল রশীদ
কিছু
বিষয়ে আমরা খুব স্ববিরোধী। যেমন আমরা ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের মতো বিনা
বিচারে হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করি, আবার শিশু ধর্ষণ বা এরকম ন্যক্কারজনক
কোনও ঘটনা ঘটলে প্রকাশ্যেই বলি, 'ওকে (অপরাধীকে) ক্রসফায়ারে দেওয়া উচিত'।
আমরা দেশে সামরিক শাসন এলে বা সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতা
নিলে অনেকেই তার সমলোচনা করি, কিন্তু যখন রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হই তখন
বলি, এই জাতির জন্য সেনাবাহিনীই ভালো। এমনকি যখন ট্রাফিক পুলিশ যানজট ও সড়ক
ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়, তখনও আমরা রাস্তায় সেনাবাহিনী নামানোর দাবি
তুলি। কারণ সেনাবাহিনীর ওপর আমাদের এক অন্যরকম আস্থা আছে।
সম্প্রতি পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কক্সবাজারে চার বছরের শিশু ধর্ষণ মামলার এক আসামি গুলিতে নিহত হয়েছেন। র্যাব বলছে, বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হয়েছেন। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার মানে দেশের মানুষ জানে। এ জাতীয় ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, সেই ভাষাও মানুষের মুখস্থ। র্যাব বা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি এবং তারপর পাল্টা গুলিতে আসামির মৃত্যু–এই ‘স্ক্রিপ্ট’ এখন ক্লিশে। কিন্তু তারপরও নির্মম বাস্তবতা হলো, এ জাতীয় মৃত্যুর পক্ষে একটি বড় জনমত তৈরি হয়ে গেছে। বিশেষ করে জঙ্গি দমন, সুন্দরবনে দস্যু নিধন ইত্যাদি কারণে।
আমরা সব সময়ই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলি। তো দৃষ্টান্তমূলক বলতে আসলে কী বোঝায়? আইনে যে অপরাধের যে শাস্তির কথা বলা আছে, তার বাইরে গিয়ে ভিন্ন কিছু করার সুযোগ আছে। সেটি কি আইনের লঙ্ঘন হবে না? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ এমন মন্তব্য করেন, ধর্ষণের শাস্তি হওয়া উচিত ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়া। শাস্তি হিসেবে এটি নির্মম। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু এটি কি আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুমোদন করে? সৌদি আরবের মতো শরিয়া আইনের দেশে এরকম শাস্তি হতে পারে। সেখান চুরি করলে হাত কাটা, খুন করলে প্রকাশ্যে গলা কাটা আইনসিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে এ ধরনের শাস্তির অনুমোদন নেই। কিন্তু মানুষ চায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এ কারণে চায়, যাতে ওই শাস্তির ভয়াবহতা দেখে ভবিষ্যতে কেউ ধর্ষণের মতো অপরাধ করার সাহস না পায়। সে কারণে যখন ক্রসফায়ারে (বস্তুত গুলিতে) ধর্ষণ মামলার কোনও আসামির মৃত্যু হয়, তারও পক্ষে কিছু জনমত তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যাকে এভাবে মারা হলো বা এভাবে যার মৃত্যু হলো, আদালতে কি তার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে? যদি আদালতের এই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে একজন মানুষকে কথিত অস্ত্র উদ্ধারের নামে গুলি করে মেরে ফেলা হয় সেটি দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন হয় কিনা?
ক্রসফায়ারের পক্ষে সবচেয়ে বড় যে যুক্তিটি দেওয়া হয় তা হলো, দুর্ধর্ষ অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া যায় না। অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। কিন্তু তারা যে অপরাধী তা সবাই জানে। ফলে এই যুক্তিতে এরকম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো বৈধতা পায়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ‘বিচারবহির্ভূত’ শব্দটি মানতে নারাজ। তাদের যুক্তি, যদি এসব মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যা দেওয়া হয় তাহলে বিচারিক হত্যা কোনটি? হত্যা, সেটি বিচারিক কিংবা বিচারবহির্ভূত কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ নয়। বরং শব্দটা হবে বিচার। অর্থাৎ একজন লোক যদি অপরাধী হন, প্রচলিত আইন মেনে তার বিচার হবে। সেই বিচারে যদি তার মৃত্যুদণ্ড হয়, সেটিকে বলা হবে শাস্তি। এটি কোনও অর্থেই হত্যা নয়।
সমস্যা অন্য জায়গায়; তা হলো, আমরা যখন একজন দুর্ধর্ষ অপরাধী, খুনি বা ধর্ষককে বিনা বিচারে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলার পক্ষে কথা বলি, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকেও টাকার জন্য বা অন্য কোনও ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থে মেরে ফেলা জায়েজ হয়ে যায়। এযাবৎ যত লোক বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাই কি দুর্ধর্ষ অপরাধী? তাদের মধ্যে নিরপরাধ মানুষ কি নেই? আপনি ১০০ জন অপরাধীকে মেরে ফেলার পরে যদি একজন নিরীহ মানুষকেও মারেন, সেটি অনেক বড় অপরাধ। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুলে বহু লোককে এভাবে খুন করা হয়নি? ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া হয়নি? যে র্যাব সদস্যরা এই কাজ করেছেন তাদের বিচার হয়েছে আজ পর্যন্ত? উল্টো লিমনের পরিবারের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছিলো এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও গণমাধ্যমের অব্যাহত চাপের মুখে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপে সেই মামলা থেকে লিমন ও তার দিনমজুর বাবা মুক্তি পান। মানবাধিকার কমিশন ও গণমাধ্যম সোচ্চার না থাকলে এখন লিমন ও তার পরিবারকে জেলে থাকতে হতো। সৌভাগ্য যে সে এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে হাঁটে।
আমরা যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বেআইনি কাজকে সমর্থন দিই, তখন তারা আরও দশটি বেআইনি কাজ করার সাহস পায় এবং তখন আর মানুষের কিছু বলার থাকে না। একজন ধর্ষককে (যদিও প্রমাণিত নয়) ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার সংবাদ আপাতদৃষ্টিতে সাধুবাদযোগ্য মনে করা হলেও, এটির প্রভাব সুদূরপ্রসারি। ধরে নিচ্ছি নিহত ব্যক্তি সত্যিই ধর্ষক। কিন্তু সেটি আদালতে প্রমাণিত হয়নি। অপরাধ প্রমাণের আগে যদি আপনি কাউকে শাস্তি দেন, তখন আপনি নিজেই অপরাধী। আবার অভিযুক্ত লোকটি ধর্ষক হলেও প্রচলিত আইনেই বিচারের সুযোগ ছিল। বিচারক যদি মনে করতেন যে অপরাধটি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ড দিতেন। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই যখন একজন লোককে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে, সেটি সম্পূর্ণই আইনের শাসনের পরিপন্থি।
এখান সমস্যা আরেকটা আছে। তা হলো আমাদের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এবং ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত। অনেক বড় বড় অপরাধী আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের জঙ্গি তৎপরায় জড়িয়ে পড়ে, এমন খবরও এসেছে। অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তা ঘুষ খেয়ে বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে দুর্বল রিপোর্ট দেন, যাতে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। ফলে ক্ষমতাবান অভিযুক্তরা বেরিয়ে যায়। এ কারণেও অনেকে ক্রসফায়ারে মৃত্যুকে সমর্থন করেন। কিন্তু এটিই কি সমাধান?
আমাদের বিচার ব্যবস্থার ফাঁকফোকর আছে বলে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য অসৎ বলে আমরা একটি বেআইনি কাজকে দিনের পর দিন সমর্থন দিয়ে যাব? বিচারিক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো কীভাবে দূর করা যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার না বানিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হোক, দেশের অপরাধ ৮০ শতাংশ কমে যাবে এক বছরের মধ্যে। কিন্তু এর জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, তা দেশের কোনও দলের আছে? ক্ষমতায় যারাই যায়, তারাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজের মতো ব্যবহার করে। সুতরাং সেই বাহিনী যখন অন্য কোনও বেআইনি কাজ করে, তার প্রতিবাদ করা কিংবা তার শাস্তি দেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। থাকে না বলেই খুব কম ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধের শাস্তি পায়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা। সেটিও গণমাধ্যমে খুব ফলাও করে না এলে র্যাবের একজন সদস্যও গ্রেফতার হতেন কিনা সন্দেহ।
সুতরাং সাত খুন হোক কিংবা ধর্ষণ–কাউকেই বিনা বিচারে মেরে ফেলা সমর্থনযোগ্য নয়। এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড সমর্থন করার অর্থ হলো বিচারহীনতাকে সমর্থন করা। আইনের শাসনের পথ কণ্টকাকীর্ণ করা। যদি ক্রসফায়ারেই অপরাধীর বিচার করা হবে তাহলে আর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রেখে লাভ কী?
আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এ জাতীয় মৃত্যুর শুরুটা হয়েছিল ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর মাধ্যমে। তখন যৌথবাহিনীর অভিযানে ৫৭ জন নিহত হয়। পরে এসবের বৈধতা দেওয়ার জন্য আইন করে বলা হয়েছিল, এই ৫৭ জনের ব্যাপারে কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। বলা হয়, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাতে কি অপরাধ কমেছে? সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এ জাতীয় ঘটনার পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু সেসব দেশে অপরাধ যে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, তা বলা যাবে না। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এভাবে হত্যার লাইসেন্স দিলে তাদের পেশাদারিত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তারা মোটা অংকের টাকা নেয়—এরকম কথা অসংখ্যবার শোনা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে, তা সে অপরাধী হোক কিংবা নিরপরাধ, তাতে রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো ভেঙে পড়ে। সমাজের ভেতরে বর্বরতা ও সহিংসতা বাড়তে থাকে।
লেখক: সাংবাদিক
সম্প্রতি পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কক্সবাজারে চার বছরের শিশু ধর্ষণ মামলার এক আসামি গুলিতে নিহত হয়েছেন। র্যাব বলছে, বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হয়েছেন। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার মানে দেশের মানুষ জানে। এ জাতীয় ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, সেই ভাষাও মানুষের মুখস্থ। র্যাব বা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি এবং তারপর পাল্টা গুলিতে আসামির মৃত্যু–এই ‘স্ক্রিপ্ট’ এখন ক্লিশে। কিন্তু তারপরও নির্মম বাস্তবতা হলো, এ জাতীয় মৃত্যুর পক্ষে একটি বড় জনমত তৈরি হয়ে গেছে। বিশেষ করে জঙ্গি দমন, সুন্দরবনে দস্যু নিধন ইত্যাদি কারণে।
আমরা সব সময়ই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলি। তো দৃষ্টান্তমূলক বলতে আসলে কী বোঝায়? আইনে যে অপরাধের যে শাস্তির কথা বলা আছে, তার বাইরে গিয়ে ভিন্ন কিছু করার সুযোগ আছে। সেটি কি আইনের লঙ্ঘন হবে না? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ এমন মন্তব্য করেন, ধর্ষণের শাস্তি হওয়া উচিত ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়া। শাস্তি হিসেবে এটি নির্মম। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু এটি কি আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুমোদন করে? সৌদি আরবের মতো শরিয়া আইনের দেশে এরকম শাস্তি হতে পারে। সেখান চুরি করলে হাত কাটা, খুন করলে প্রকাশ্যে গলা কাটা আইনসিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে এ ধরনের শাস্তির অনুমোদন নেই। কিন্তু মানুষ চায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এ কারণে চায়, যাতে ওই শাস্তির ভয়াবহতা দেখে ভবিষ্যতে কেউ ধর্ষণের মতো অপরাধ করার সাহস না পায়। সে কারণে যখন ক্রসফায়ারে (বস্তুত গুলিতে) ধর্ষণ মামলার কোনও আসামির মৃত্যু হয়, তারও পক্ষে কিছু জনমত তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যাকে এভাবে মারা হলো বা এভাবে যার মৃত্যু হলো, আদালতে কি তার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে? যদি আদালতের এই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে একজন মানুষকে কথিত অস্ত্র উদ্ধারের নামে গুলি করে মেরে ফেলা হয় সেটি দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন হয় কিনা?
ক্রসফায়ারের পক্ষে সবচেয়ে বড় যে যুক্তিটি দেওয়া হয় তা হলো, দুর্ধর্ষ অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া যায় না। অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। কিন্তু তারা যে অপরাধী তা সবাই জানে। ফলে এই যুক্তিতে এরকম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো বৈধতা পায়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ‘বিচারবহির্ভূত’ শব্দটি মানতে নারাজ। তাদের যুক্তি, যদি এসব মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যা দেওয়া হয় তাহলে বিচারিক হত্যা কোনটি? হত্যা, সেটি বিচারিক কিংবা বিচারবহির্ভূত কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ নয়। বরং শব্দটা হবে বিচার। অর্থাৎ একজন লোক যদি অপরাধী হন, প্রচলিত আইন মেনে তার বিচার হবে। সেই বিচারে যদি তার মৃত্যুদণ্ড হয়, সেটিকে বলা হবে শাস্তি। এটি কোনও অর্থেই হত্যা নয়।
সমস্যা অন্য জায়গায়; তা হলো, আমরা যখন একজন দুর্ধর্ষ অপরাধী, খুনি বা ধর্ষককে বিনা বিচারে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলার পক্ষে কথা বলি, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকেও টাকার জন্য বা অন্য কোনও ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থে মেরে ফেলা জায়েজ হয়ে যায়। এযাবৎ যত লোক বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাই কি দুর্ধর্ষ অপরাধী? তাদের মধ্যে নিরপরাধ মানুষ কি নেই? আপনি ১০০ জন অপরাধীকে মেরে ফেলার পরে যদি একজন নিরীহ মানুষকেও মারেন, সেটি অনেক বড় অপরাধ। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুলে বহু লোককে এভাবে খুন করা হয়নি? ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া হয়নি? যে র্যাব সদস্যরা এই কাজ করেছেন তাদের বিচার হয়েছে আজ পর্যন্ত? উল্টো লিমনের পরিবারের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছিলো এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও গণমাধ্যমের অব্যাহত চাপের মুখে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপে সেই মামলা থেকে লিমন ও তার দিনমজুর বাবা মুক্তি পান। মানবাধিকার কমিশন ও গণমাধ্যম সোচ্চার না থাকলে এখন লিমন ও তার পরিবারকে জেলে থাকতে হতো। সৌভাগ্য যে সে এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে হাঁটে।
আমরা যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বেআইনি কাজকে সমর্থন দিই, তখন তারা আরও দশটি বেআইনি কাজ করার সাহস পায় এবং তখন আর মানুষের কিছু বলার থাকে না। একজন ধর্ষককে (যদিও প্রমাণিত নয়) ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার সংবাদ আপাতদৃষ্টিতে সাধুবাদযোগ্য মনে করা হলেও, এটির প্রভাব সুদূরপ্রসারি। ধরে নিচ্ছি নিহত ব্যক্তি সত্যিই ধর্ষক। কিন্তু সেটি আদালতে প্রমাণিত হয়নি। অপরাধ প্রমাণের আগে যদি আপনি কাউকে শাস্তি দেন, তখন আপনি নিজেই অপরাধী। আবার অভিযুক্ত লোকটি ধর্ষক হলেও প্রচলিত আইনেই বিচারের সুযোগ ছিল। বিচারক যদি মনে করতেন যে অপরাধটি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ড দিতেন। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই যখন একজন লোককে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে, সেটি সম্পূর্ণই আইনের শাসনের পরিপন্থি।
এখান সমস্যা আরেকটা আছে। তা হলো আমাদের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এবং ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত। অনেক বড় বড় অপরাধী আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের জঙ্গি তৎপরায় জড়িয়ে পড়ে, এমন খবরও এসেছে। অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তা ঘুষ খেয়ে বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে দুর্বল রিপোর্ট দেন, যাতে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। ফলে ক্ষমতাবান অভিযুক্তরা বেরিয়ে যায়। এ কারণেও অনেকে ক্রসফায়ারে মৃত্যুকে সমর্থন করেন। কিন্তু এটিই কি সমাধান?
আমাদের বিচার ব্যবস্থার ফাঁকফোকর আছে বলে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য অসৎ বলে আমরা একটি বেআইনি কাজকে দিনের পর দিন সমর্থন দিয়ে যাব? বিচারিক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো কীভাবে দূর করা যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার না বানিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হোক, দেশের অপরাধ ৮০ শতাংশ কমে যাবে এক বছরের মধ্যে। কিন্তু এর জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, তা দেশের কোনও দলের আছে? ক্ষমতায় যারাই যায়, তারাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজের মতো ব্যবহার করে। সুতরাং সেই বাহিনী যখন অন্য কোনও বেআইনি কাজ করে, তার প্রতিবাদ করা কিংবা তার শাস্তি দেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। থাকে না বলেই খুব কম ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধের শাস্তি পায়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা। সেটিও গণমাধ্যমে খুব ফলাও করে না এলে র্যাবের একজন সদস্যও গ্রেফতার হতেন কিনা সন্দেহ।
সুতরাং সাত খুন হোক কিংবা ধর্ষণ–কাউকেই বিনা বিচারে মেরে ফেলা সমর্থনযোগ্য নয়। এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড সমর্থন করার অর্থ হলো বিচারহীনতাকে সমর্থন করা। আইনের শাসনের পথ কণ্টকাকীর্ণ করা। যদি ক্রসফায়ারেই অপরাধীর বিচার করা হবে তাহলে আর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রেখে লাভ কী?
আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এ জাতীয় মৃত্যুর শুরুটা হয়েছিল ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর মাধ্যমে। তখন যৌথবাহিনীর অভিযানে ৫৭ জন নিহত হয়। পরে এসবের বৈধতা দেওয়ার জন্য আইন করে বলা হয়েছিল, এই ৫৭ জনের ব্যাপারে কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। বলা হয়, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাতে কি অপরাধ কমেছে? সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এ জাতীয় ঘটনার পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু সেসব দেশে অপরাধ যে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, তা বলা যাবে না। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এভাবে হত্যার লাইসেন্স দিলে তাদের পেশাদারিত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তারা মোটা অংকের টাকা নেয়—এরকম কথা অসংখ্যবার শোনা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে, তা সে অপরাধী হোক কিংবা নিরপরাধ, তাতে রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো ভেঙে পড়ে। সমাজের ভেতরে বর্বরতা ও সহিংসতা বাড়তে থাকে।
লেখক: সাংবাদিক
No comments