একটি বিমান দুর্ঘটনা ও একজন জাকির হোসেন by নজরুল ইসলাম খোকন
সোমবার
থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের মূলধারার প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম আর
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নেপালে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের এভিয়েশন হিস্ট্রির
অন্যতম বেদনাদায়ক ট্রাজেডি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। সেটি করারই কথা।
ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা একদিকে যেমন সর্বব্যাপি শোক ছড়িয়েছে,
অন্যদিকে জন্ম দিয়েছে হাজার হাজার নতুন নতুন এভিয়েশন এক্সপার্ট! যারা নানা
রকম চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্ঘটনাটি নিয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরে
প্রতিভার জানান দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। সে যাই হোক, ইউএস-বাংলার বিমান
দুর্ঘটনায় ২৫ জন নেপালি আর ২৬ জন বাংলাদেশীর নির্মম প্রাণহানীর পাশাপাশি ১০
জন বাংলাদেশীর অলৌকিকভাবে বেঁচে থাকার সংবাদটিও এখন আর কারো অজানা নয়। একই
সঙ্গে ঘটনার তিন দিন পর রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসার খবরটিও আশা করি সবাই এরই মধ্যে
জেনেছেন। আরেকটি খবর জেনে আপনারা খুশি হবেন আশা করি, নেপালে হাসপাতালে
চিকিৎসাধীন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মূমূর্ষু আহত বাংলাদেশীদের
চিকিৎসার্থে একটি মেডিক্যাল টিম পাঠানোর ঘোষণাও ঘটনার তিন দিন পর পাওয়া
গেছে!
দুর্ঘটনাতো দুর্ঘটনাই, সেটি বাস-ট্রাক, নসিমন- করিমন, উড়োজাহাজ কিংবা সামুদ্রিক জাহাজ যেটিই হোক না কেন। দুর্ঘটনা মানেই প্রাণহানী, আহতদের আর্তনাদ, স্বজনদের আহাজারি। বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতো বিগত কয়েক বছরে মৃত্যুফাঁদের কুখ্যাতি অর্জন করেছে। দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে কমিটি হয়, ময়না তদন্ত হয় তাতে হতাহত কিংবা তাদের স্বজন পরিজনদের আখেরে খুব একটা লাভ হয় বলে মনে হয় না। বিমান দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের স্বজনরা অবশ্য শান্তনা অনুভব করতে পারেন এই ভেবে যে , বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার কারণে তারা আর যাই হোক অন্তত সরকারের তরফ থেকে একটি রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা পেয়েছেন যেটি বাস ট্রাক কিংবা অন্য দুর্ঘটনায় ইতিপূর্বে অর্ধশতাধিক প্রাণহানির পরও তাদের স্বজনরা পান নি। এমনকি রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যুও বিমান দুর্ঘটনায় ২৫ জনের প্রাণহানির তুলনায় কিছুই না। বিমান মানেই অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার, আভিজাত্যের ব্যাপার। একটি প্লেনের দাম অনেক টাকা, যারা চড়েন তারাও কম-বেশী পয়সাওয়ালা। সমাজে তাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, শ্রমিক, দিনমজুর যারা পরের দেশ থেকে রেমিটেন্স এনে দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন তাদের মৃত্যু তাই সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে অতটা গুরুত্ব বহন করে না যতটা পরের দেশে টাকা খরচ করনেওয়ালারা পেয়ে থাকেন।
যাই হোক, ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনার দিন সকালেই জাকির হোসেন নামের এক যুবকের কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংবাদ অনলাইন পোর্টালগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদটির খানিকটা প্রথম আলো থেকে তুলে ধরতে চাই, ‘যেদিন গ্রেপ্তার হইল সেদিনও আমার ভাই সুস্থ। তারে তিন দিন রিমান্ডে নিল। এরপর ২ দিনও টিকলো না ভাই আমার। কী এমন করল তারা।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের করিডরে কেঁদেকেটে একটা প্রশ্নই বারবার আউড়ে যাচ্ছিলেন সুলতানা রাজিয়া। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কেউ কোন উত্তর দেয় নি। কয়েক হাত দূরেই সুলতানার বড় ভাই জাকির হোসেনের লাশটা একটা ট্রলির ওপর সাদা চাদরে মোড়ানো অবস্থায় রাখা। কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় সোমবার সকালে মৃত্যু হয় তার। ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সহসভাপতি ও তেজগাও থানা ছাত্রদলের ভারপাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন ৬ মার্চ বিএনপি’র মানবববন্ধন কর্মসূচী শেষে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন। সেদিনই শাহবাগ থানায় জাকিরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে বিশষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশকে হত্যার চেষ্টা সহ বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামীদের কাছ থেকে সাতটি বাঁশের লাঠি, ছয়টি ইটের ভাঙ্গা টুকরা ও ২৫ টি কাচের টুকরো পাওয়া যায় বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
মামলার গ্রাউন্ড বেশ জটিল এবং শক্ত বলেই মনে হচ্ছে! আর এমন একটি মামলাতেই ৩ দিনের রিমান্ডের ধকল সামলাতে পারেনি এমন একটি ছেলেকে যে, কে বলেছে রাজনীতি করতে! যে দেশে মানববন্ধনের অপরাধে গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে মৃত্যু বরণ করতে হয়, সে দেশে রাজনীতি করার খায়েশ আশা করি আর কোন জাকির হোসেনের হবে না! কথা সেটা নয়, এই জাকির হোসেনের ২ টি মেয়ে আছে, যাদের একজনের বয়স বছর দুই হবে, অন্যজনের ৭ কি ৮। সকালে অফিসে ঢুকেই মেসেঞ্জারে এক পরম শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের পাঠানো একটি ছবি দেখে প্রথমে বুঝতে পারি নি। পরে যখন বুঝতে পারলাম তখন এই লেখাটি লেখার জন্য তাগিদ অনুভব করলাম। যদিও লেখাটি পুরোপুরিই অর্থহীন সেটি আমি জানি। অন্ধের দেশে চশমা বিক্রির এই বৃথা চেষ্টা শুধুই নিজের বিবেকের কাছ থেকে মুক্তির জন্য।
বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক আর একই দিনে রাষ্ট্রীয় হত্যার শিকার জাকিরের জন্য কে লিখবে শোকগাথা? সেই প্রশ্ন নির্লজ্জ এই জাতির বিবেকের কাছে একদিন কি করবে না, বেচারা জাকিরের ছোট বাচ্চা দুটি?? আমরা যারা টেলিভিশনের পর্দায় সারাদিন বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের আহাজারির দৃশ্য প্রচার করি তাদের কাছে একবারের জন্যও কি মনে হয় নি জাকিরের পরিবার বাদ থাক অন্তত তার নিষ্পাপ বাচ্চা দুটির অবস্থাটি কি সেটি প্রচার করা ?
নজরুল ইসলাম খোকন
ঢাকা
১৫ মার্চ ২০১৮।
দুর্ঘটনাতো দুর্ঘটনাই, সেটি বাস-ট্রাক, নসিমন- করিমন, উড়োজাহাজ কিংবা সামুদ্রিক জাহাজ যেটিই হোক না কেন। দুর্ঘটনা মানেই প্রাণহানী, আহতদের আর্তনাদ, স্বজনদের আহাজারি। বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতো বিগত কয়েক বছরে মৃত্যুফাঁদের কুখ্যাতি অর্জন করেছে। দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে কমিটি হয়, ময়না তদন্ত হয় তাতে হতাহত কিংবা তাদের স্বজন পরিজনদের আখেরে খুব একটা লাভ হয় বলে মনে হয় না। বিমান দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের স্বজনরা অবশ্য শান্তনা অনুভব করতে পারেন এই ভেবে যে , বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার কারণে তারা আর যাই হোক অন্তত সরকারের তরফ থেকে একটি রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা পেয়েছেন যেটি বাস ট্রাক কিংবা অন্য দুর্ঘটনায় ইতিপূর্বে অর্ধশতাধিক প্রাণহানির পরও তাদের স্বজনরা পান নি। এমনকি রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যুও বিমান দুর্ঘটনায় ২৫ জনের প্রাণহানির তুলনায় কিছুই না। বিমান মানেই অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার, আভিজাত্যের ব্যাপার। একটি প্লেনের দাম অনেক টাকা, যারা চড়েন তারাও কম-বেশী পয়সাওয়ালা। সমাজে তাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, শ্রমিক, দিনমজুর যারা পরের দেশ থেকে রেমিটেন্স এনে দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন তাদের মৃত্যু তাই সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে অতটা গুরুত্ব বহন করে না যতটা পরের দেশে টাকা খরচ করনেওয়ালারা পেয়ে থাকেন।
যাই হোক, ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনার দিন সকালেই জাকির হোসেন নামের এক যুবকের কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংবাদ অনলাইন পোর্টালগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদটির খানিকটা প্রথম আলো থেকে তুলে ধরতে চাই, ‘যেদিন গ্রেপ্তার হইল সেদিনও আমার ভাই সুস্থ। তারে তিন দিন রিমান্ডে নিল। এরপর ২ দিনও টিকলো না ভাই আমার। কী এমন করল তারা।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের করিডরে কেঁদেকেটে একটা প্রশ্নই বারবার আউড়ে যাচ্ছিলেন সুলতানা রাজিয়া। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কেউ কোন উত্তর দেয় নি। কয়েক হাত দূরেই সুলতানার বড় ভাই জাকির হোসেনের লাশটা একটা ট্রলির ওপর সাদা চাদরে মোড়ানো অবস্থায় রাখা। কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় সোমবার সকালে মৃত্যু হয় তার। ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সহসভাপতি ও তেজগাও থানা ছাত্রদলের ভারপাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন ৬ মার্চ বিএনপি’র মানবববন্ধন কর্মসূচী শেষে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন। সেদিনই শাহবাগ থানায় জাকিরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে বিশষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশকে হত্যার চেষ্টা সহ বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামীদের কাছ থেকে সাতটি বাঁশের লাঠি, ছয়টি ইটের ভাঙ্গা টুকরা ও ২৫ টি কাচের টুকরো পাওয়া যায় বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
মামলার গ্রাউন্ড বেশ জটিল এবং শক্ত বলেই মনে হচ্ছে! আর এমন একটি মামলাতেই ৩ দিনের রিমান্ডের ধকল সামলাতে পারেনি এমন একটি ছেলেকে যে, কে বলেছে রাজনীতি করতে! যে দেশে মানববন্ধনের অপরাধে গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে মৃত্যু বরণ করতে হয়, সে দেশে রাজনীতি করার খায়েশ আশা করি আর কোন জাকির হোসেনের হবে না! কথা সেটা নয়, এই জাকির হোসেনের ২ টি মেয়ে আছে, যাদের একজনের বয়স বছর দুই হবে, অন্যজনের ৭ কি ৮। সকালে অফিসে ঢুকেই মেসেঞ্জারে এক পরম শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের পাঠানো একটি ছবি দেখে প্রথমে বুঝতে পারি নি। পরে যখন বুঝতে পারলাম তখন এই লেখাটি লেখার জন্য তাগিদ অনুভব করলাম। যদিও লেখাটি পুরোপুরিই অর্থহীন সেটি আমি জানি। অন্ধের দেশে চশমা বিক্রির এই বৃথা চেষ্টা শুধুই নিজের বিবেকের কাছ থেকে মুক্তির জন্য।
বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক আর একই দিনে রাষ্ট্রীয় হত্যার শিকার জাকিরের জন্য কে লিখবে শোকগাথা? সেই প্রশ্ন নির্লজ্জ এই জাতির বিবেকের কাছে একদিন কি করবে না, বেচারা জাকিরের ছোট বাচ্চা দুটি?? আমরা যারা টেলিভিশনের পর্দায় সারাদিন বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের আহাজারির দৃশ্য প্রচার করি তাদের কাছে একবারের জন্যও কি মনে হয় নি জাকিরের পরিবার বাদ থাক অন্তত তার নিষ্পাপ বাচ্চা দুটির অবস্থাটি কি সেটি প্রচার করা ?
নজরুল ইসলাম খোকন
ঢাকা
১৫ মার্চ ২০১৮।
No comments