নেশার ভয়ঙ্কর জগতে শিশুরাও by এনা হাসান
আমার
ছেলে আকিব (ছদ্মনাম) ক্লাস এইটে পড়ছে। পড়াশুনায় খুব ভালো। সব বন্ধুদের
প্রিয়। সবার সঙ্গে সহজে মিশে যায়। আমি আর ওর বাবা চাকরিজীবী হওয়ার কারণে
ছেলেটাকে খুব বেশি সময় দিতে পারতাম না। তারপরও আকিবের কোনো অভিযোগ ছিল না।
সারাদিন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমাদের বিচ্ছেদের পর আকিব বদলে যেতে শুরু করে। সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একা থাকা। কথা কম বলা আর বললেও অল্পতেই রেগে যাওয়া। কিছুটা খিটখিটে মেজাজের। রাত জেগে থাকা। পড়াশুনায় দিন দিন পিছিয়ে পড়তে শুরু করলো। একদিন ওর টেবিল গোছাতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম বিভিন্ন জায়গায় ফয়েল কাগজ। এই কাগজ কেন এখানে কারণ জানতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততদিনে আমার ছেলেটা নেশার জগতে হারিয়ে গেছে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন একজন মা। যে ছেলের এখন পড়াশুনা নিয়ে দিন কাটানোর কথা ছিল সে এখন দিন পার করছে নিরাময় কেন্দ্রে।
ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা ফার্মগেট। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর এই এলাকা। এখানে স্বস্তির খোঁজে অনেকেই যান আনোয়ারা উদ্যানে। যদিও সেখানে স্বস্তির বদলে মিলে অস্বস্তি। কারণ পার্ক হিসেবে এখানে সবুজের ছায়া থাকার কথা থাকলেও নেই তার রেশ। ময়লা আবর্জনা, অবৈধ বসতিতে পূর্ণ পুরো পার্ক এলাকা। পার্কের ভেতরে প্রবেশের শুরুতেই চোখে পড়বে কিশোর তরুণদের কয়েকটি দল। ভুল করে ভেবে বসবেন না তারা কাজ শেষে গল্প বা আড্ডায় মেতে আছে। একটু কাছে গেলেই বুঝা যায় আসল চিত্র। গোল হয়ে বসে থাকা এই কিশোররা মেতে আছে গাঁজার নেশায়। ছোট ছোট এই শিশু-কিশোররা ভাগাভাগি করে খাচ্ছে গাঁজা, ড্যান্ডি। পার্কের ভেতরেই কথা হলো জাহিদের সঙ্গে। দশ বারো বছরের এই শিশুর সঙ্গে কথা বলেই জানা গেল অনেক কথা। তার মতে সে এইসব নেশায় না জড়ালেও এসব ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে। সে বলে যায়, ‘পার্কে এখন তো কিছুই দেখেন নাই। রাইতে আইলে আরো পোলাপান দেখতে পাইবেন। সন্ধ্যা থাইক্যা এখানে বসে আসল গাঞ্জার আসর। পার্কের ভিতরে রাত হইলে এইগুলান পাওন যায়। আপনি প্রিন্সের পাশের ঐ চিপায়ও এইগুলান পাইবেন, অইহানে এক বেটা এসে এইগুলান বেঁচে। রাসেল, কালাম আরো কয়ডা ছেলে অইহানে খায়। আমার লগে অরা গাড়ির হেলপারি করে। শুধু গাঞ্জা না বাবা, ড্যান্ডি ফেন্সিও খায়। হেরা সারাদিন গাড়ি চালায়। তিন চার শ’ টাহা পায়। অইগুলা দিয়াই এইগুলান কিনে। এই ধরেন দুইডা পুরির দাম পড়ে ৪০০ টাহা। এইডা দিয়াই রাইত কাভার।’
জাহিদের বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া গেল রাতের পার্কের চিত্রটায়। মাদক কেনাবেচার হিড়িক পড়ে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। ক্রেতার তালিকায় রয়েছে তরুণ ও কিশোররা। সংখ্যায় কম হলেও তালিকায় আছে শিশুরাও। শুধু ফার্মগেট না, রাজধানীর কাওরান বাজার রেলগেট এলাকা, মহাখালী ব্রিজের নিচে, মোহাম্মদপুর শহীদ পার্ক মাঠ, জেনেভা ক্যামপ এলাকা, কমলাপুর রেলস্টেশন, গাবতলী বাস টার্মিনাল, সদরঘাট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাসের বিভিন্ন স্থানে সরজমিন দেখা মিলে শিশু-কিশোররা বিভিন্ন মাদক গ্রহণ করছে। এসব এলাকায় মাদক বিক্রেতারা সক্রিয় হওয়ায় অনেকটা সহজেই পাওয়া যাচ্ছে নেশাজাত পণ্য।
বাংলাদেশ শিশু ফোরামের তথ্য অনুসারে, আমাদের দেশে মোট পথশিশু-কিশোর সংখ্যা ১০ লাখের উপর। এই পথশিশুদের মধ্যে ৮০ শতাংশই মাদকাসক্ত। আর এই মাদকাসক্তির কারণে এইসব শিশুরা বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি সহ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কাজে। একটা কিশোর যখন মাদক সেবন শুরু করে তখন সে ধীরে ধীরে তার সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবন থেকে সরে আসে। আর হারিয়ে যেতে শুরু করে নেশার অন্ধকার জগতে। ২০১৩ সালের ১৬ই আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের বাসায় কিশোরী ঐশীর হাতে খুন হয় তার বাবা-মা পুলিশের বিশেষ শাখার উপ-পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান এবং স্বপ্না রহমান। এরআগে ঐশী জড়িয়ে পড়েছিলো নেশার জগতে। ২০১৬ সালে মাদক আইনে মামলা হয়েছে ৬২ হাজার ২৬৮টি এবং ২০১৭ সালে এর আগের বছরের তুলনায় মামলা বেড়েছে ২৫ হাজারের বেশি।
সাইকোলজিস্ট বিলকিস খানমের মতে, শিশু- কিশোরদের মাদক থেকে বিরত রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তার পরিবার এবং পরিবেশ। সাধারণত সাইকোলজিক্যাল ডিস্টার্বেন্স, কৌতূহলের এবং পরিবেশগত কারণে কিশোররা মাদকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদেরকে মাদক থেকে দূরে রাখার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে পরিবারকে, পরিবারের সদস্যদের। প্রায়ই আমরা দেখি একজন যখন মাদক গ্রহণ করে তখন পরিবারের সদস্যরা তাকে মানসিকভাবে সাহায্য করার বদলে কটু কথা শোনায়। এতে করে সেই শিশুটা আরো মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে নিজেকে একা মনে করে। এসময় সে মাদক গ্রহণ করে যা তাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও শান্তি দেয় কিন্তু ক্রমশ মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। সুতরাং পরিবারের সদস্যদের যথাসম্ভব মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরকে সময় দিতে হবে। তার সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমে তাকে বুঝাতে হবে এই খারাপ সময়ে সে একা নয়। একটা শিশুকে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানোর আগে পরিবারের উচিত তাকে মাদক থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। এছাড়া বাবা-মায়ের উচিত তার সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ ব্যবহার করা, তাদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া, কোথায় কী করছে, তার বন্ধুদের সমপর্কে জানা, মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা এবং এগুলো থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়া।
সারাদিন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমাদের বিচ্ছেদের পর আকিব বদলে যেতে শুরু করে। সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একা থাকা। কথা কম বলা আর বললেও অল্পতেই রেগে যাওয়া। কিছুটা খিটখিটে মেজাজের। রাত জেগে থাকা। পড়াশুনায় দিন দিন পিছিয়ে পড়তে শুরু করলো। একদিন ওর টেবিল গোছাতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম বিভিন্ন জায়গায় ফয়েল কাগজ। এই কাগজ কেন এখানে কারণ জানতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততদিনে আমার ছেলেটা নেশার জগতে হারিয়ে গেছে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন একজন মা। যে ছেলের এখন পড়াশুনা নিয়ে দিন কাটানোর কথা ছিল সে এখন দিন পার করছে নিরাময় কেন্দ্রে।
ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা ফার্মগেট। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর এই এলাকা। এখানে স্বস্তির খোঁজে অনেকেই যান আনোয়ারা উদ্যানে। যদিও সেখানে স্বস্তির বদলে মিলে অস্বস্তি। কারণ পার্ক হিসেবে এখানে সবুজের ছায়া থাকার কথা থাকলেও নেই তার রেশ। ময়লা আবর্জনা, অবৈধ বসতিতে পূর্ণ পুরো পার্ক এলাকা। পার্কের ভেতরে প্রবেশের শুরুতেই চোখে পড়বে কিশোর তরুণদের কয়েকটি দল। ভুল করে ভেবে বসবেন না তারা কাজ শেষে গল্প বা আড্ডায় মেতে আছে। একটু কাছে গেলেই বুঝা যায় আসল চিত্র। গোল হয়ে বসে থাকা এই কিশোররা মেতে আছে গাঁজার নেশায়। ছোট ছোট এই শিশু-কিশোররা ভাগাভাগি করে খাচ্ছে গাঁজা, ড্যান্ডি। পার্কের ভেতরেই কথা হলো জাহিদের সঙ্গে। দশ বারো বছরের এই শিশুর সঙ্গে কথা বলেই জানা গেল অনেক কথা। তার মতে সে এইসব নেশায় না জড়ালেও এসব ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে। সে বলে যায়, ‘পার্কে এখন তো কিছুই দেখেন নাই। রাইতে আইলে আরো পোলাপান দেখতে পাইবেন। সন্ধ্যা থাইক্যা এখানে বসে আসল গাঞ্জার আসর। পার্কের ভিতরে রাত হইলে এইগুলান পাওন যায়। আপনি প্রিন্সের পাশের ঐ চিপায়ও এইগুলান পাইবেন, অইহানে এক বেটা এসে এইগুলান বেঁচে। রাসেল, কালাম আরো কয়ডা ছেলে অইহানে খায়। আমার লগে অরা গাড়ির হেলপারি করে। শুধু গাঞ্জা না বাবা, ড্যান্ডি ফেন্সিও খায়। হেরা সারাদিন গাড়ি চালায়। তিন চার শ’ টাহা পায়। অইগুলা দিয়াই এইগুলান কিনে। এই ধরেন দুইডা পুরির দাম পড়ে ৪০০ টাহা। এইডা দিয়াই রাইত কাভার।’
জাহিদের বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া গেল রাতের পার্কের চিত্রটায়। মাদক কেনাবেচার হিড়িক পড়ে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। ক্রেতার তালিকায় রয়েছে তরুণ ও কিশোররা। সংখ্যায় কম হলেও তালিকায় আছে শিশুরাও। শুধু ফার্মগেট না, রাজধানীর কাওরান বাজার রেলগেট এলাকা, মহাখালী ব্রিজের নিচে, মোহাম্মদপুর শহীদ পার্ক মাঠ, জেনেভা ক্যামপ এলাকা, কমলাপুর রেলস্টেশন, গাবতলী বাস টার্মিনাল, সদরঘাট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাসের বিভিন্ন স্থানে সরজমিন দেখা মিলে শিশু-কিশোররা বিভিন্ন মাদক গ্রহণ করছে। এসব এলাকায় মাদক বিক্রেতারা সক্রিয় হওয়ায় অনেকটা সহজেই পাওয়া যাচ্ছে নেশাজাত পণ্য।
বাংলাদেশ শিশু ফোরামের তথ্য অনুসারে, আমাদের দেশে মোট পথশিশু-কিশোর সংখ্যা ১০ লাখের উপর। এই পথশিশুদের মধ্যে ৮০ শতাংশই মাদকাসক্ত। আর এই মাদকাসক্তির কারণে এইসব শিশুরা বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি সহ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কাজে। একটা কিশোর যখন মাদক সেবন শুরু করে তখন সে ধীরে ধীরে তার সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবন থেকে সরে আসে। আর হারিয়ে যেতে শুরু করে নেশার অন্ধকার জগতে। ২০১৩ সালের ১৬ই আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের বাসায় কিশোরী ঐশীর হাতে খুন হয় তার বাবা-মা পুলিশের বিশেষ শাখার উপ-পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান এবং স্বপ্না রহমান। এরআগে ঐশী জড়িয়ে পড়েছিলো নেশার জগতে। ২০১৬ সালে মাদক আইনে মামলা হয়েছে ৬২ হাজার ২৬৮টি এবং ২০১৭ সালে এর আগের বছরের তুলনায় মামলা বেড়েছে ২৫ হাজারের বেশি।
সাইকোলজিস্ট বিলকিস খানমের মতে, শিশু- কিশোরদের মাদক থেকে বিরত রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তার পরিবার এবং পরিবেশ। সাধারণত সাইকোলজিক্যাল ডিস্টার্বেন্স, কৌতূহলের এবং পরিবেশগত কারণে কিশোররা মাদকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদেরকে মাদক থেকে দূরে রাখার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে পরিবারকে, পরিবারের সদস্যদের। প্রায়ই আমরা দেখি একজন যখন মাদক গ্রহণ করে তখন পরিবারের সদস্যরা তাকে মানসিকভাবে সাহায্য করার বদলে কটু কথা শোনায়। এতে করে সেই শিশুটা আরো মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে নিজেকে একা মনে করে। এসময় সে মাদক গ্রহণ করে যা তাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও শান্তি দেয় কিন্তু ক্রমশ মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। সুতরাং পরিবারের সদস্যদের যথাসম্ভব মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরকে সময় দিতে হবে। তার সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমে তাকে বুঝাতে হবে এই খারাপ সময়ে সে একা নয়। একটা শিশুকে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানোর আগে পরিবারের উচিত তাকে মাদক থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। এছাড়া বাবা-মায়ের উচিত তার সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ ব্যবহার করা, তাদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া, কোথায় কী করছে, তার বন্ধুদের সমপর্কে জানা, মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা এবং এগুলো থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়া।
No comments