মেডিকেল টেস্ট নিয়ে অরাজকতা- অলিখিত কমিশন চুক্তি, ৫০ শতাংশ যাচ্ছে চক্রের পকেটে by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
রাজধানীসহ
সারা দেশে মেডিকেল টেস্ট বা প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিভিন্ন
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গলাকাটা বাণিজ্য চলছে। এ নিয়ে দেশে নিয়মিত
অরাজকতা বিরাজ করছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর কোথাও কোথাও পরীক্ষা-নিরীক্ষার
মূল্য তালিকা টাঙানো থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালে তা চোখে পড়ে না। ফলে এতে
ফাঁদে পড়েন রোগী ও তার অভিভাবকরা। আর চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে সীমিত ও
মধ্য আয়ের মানুষকে রীতিমতো চরম হিমশিম খেতে হয়। কেউ কেউ বিপদ আপদে চিকিৎসা
খাতের জন্য সামান্য বাজেট বরাদ্দ রাখলেও অধিকাংশ সময়ই ব্যয় হয় বাজেটের
দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি।
চিকিৎসা বিজ্ঞান যত আধুনিক হচ্ছে ততই নানাবিধ পরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। আগের মতো রোগীর নাড়ি টিপে কিংবা লক্ষণ বিচার করে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয় না। বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধিকাংশই এখন একাধিক পরীক্ষা ব্যতিরেকে ওষুধ দিতে চান না। শতভাগ সঠিক রোগ নির্ণয় করতে হলে প্যাথলজি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ফলাফল জানা আবশ্যক।
আর এই সুযোগে দেশে রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানগুলো অলিখিত কমিশন চুক্তির মাধ্যমে রোগীদের পকেটশূন্য করছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে কমিশন ভিত্তিক বাণিজ্য গড়ে উঠার অভিযোগ অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে চিকিৎসা ব্যয়ের ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক, স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার পরিকল্পনা কর্মী, রিসিপশনিস্ট ও পেশাদার দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত নিয়ে টিআইবি’র এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডাক্তার ও দালালদের ১৫ থেকে ৫০ ভাগ কমিশন চুক্তি রয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চ মুনাফার জন্য বেসরকারি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোতে ব্যবসা চলছে, সেবা গ্রহীতাকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় হচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিধিমালা না থাকা এবং আইনের হালনাগাদ না হওয়াকেই স্বাস্থ্যখাতের এ সমস্যার জন্য দায়ী করা হয় প্রতিবেদনে। নিয়ন্ত্রণহীন ও নিম্নমানের বেসরকারি চিকিৎসা সেবায় আর্থিক ও স্বাস্থ্যজনিত ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। কমিশন ব্যবসা ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধের মাধ্যমে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত চিকিৎসকদের ‘কমিশন ব্যবসা’র কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকে। যেসব চিকিৎসক বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠান, তাদের একেকটি পরীক্ষার মোট চার্জের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ কমিশন দেয়া হয়। তাদের এই কমিশন প্রদান করে অতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করতেই বিভিন্ন পরীক্ষার চার্জ প্রকৃত খরচের চেয়ে অনেক গুণ বেশি নেয়া হয়।
বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ থেকে চারগুণ পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্বল মনিটরিং, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা এবং একশ্রেণির চিকিৎসকের ‘কমিশন বাণিজ্যের’ কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ সহজ-সরল নিরীহ মানুষগুলো এর শিকার হচ্ছেন। এতে করে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে রোগীর চিকিৎসা ব্যয়। নিয়ন্ত্রণহীন আকাশচুম্বি প্যাথলজি ফি’র কারণে মধ্যবিত্ত রোগীরা অনেক সময় বিনা চিকিৎসায় জটিল সব রোগে ভোগেন। সঠিক নীতিমালা প্রয়োগ করে এই প্যাথলজি ফির উচ্চমূল্য বন্ধ করে এটাকে একটি নির্দিষ্ট হারের আওতায় নিয়ে এলে সেবা নিতে হিমশিম খেতে হবে না রোগীদের। এমনই মন্তব্য রোগী ও তার স্বজনদের। তারা বলেন, সরকার সম্প্রতি হার্টের রিংয়ের দাম যেভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে, একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালের বিনিয়োগ চিন্তা করে একটি লাভ ধরিয়ে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষারও চার্জ নির্ধারণ করে দিতে পারে। এতে জনগণ বেশ উপকৃত হবে বলে রোগী ও তার স্বজনরা মন্তব্য করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত স্বাস্থ্যসেবার মূল্য সর্বশেষ গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১০ সালে। একই বছরের ২রা মার্চ এটি সংশোধন করে একটি পরিপত্র জারি করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। রোগীর সুবিধার্থে সব হাসপাতালে এটি প্রদর্শনের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকারি এই পরিপত্র সরকারি হাসপাতাল মানলেও বেসরকারি হাসপাতালে তার সমন্বয় নেই। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে তা চোখে পড়ে না। সবকিছু জানার পরও এই বিষয়ে রহস্যজনকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত আছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী, আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার জন্য চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে সিঙ্গেল ১১০ টাকা এবং ডাবল ২২০ টাকা। অথচ রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ পরীক্ষার জন্য চার্জ দিতে হয় ১৫শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা। ব্রেনের সিটি স্ক্যানের জন্য (ওষুধ ছাড়া) সরকার নির্ধারিত চার্জ ২ হাজার টাকা। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নেয়া হয় কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা।
সরকারি তালিকা অনুযায়ী এমআরআই ইনডিভিজুয়াল (পেইন) ৩ হাজার টাকা এবং কনট্রাস্ট ৪ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একজন রোগীর কাছ থেকে নেয়া হয় ৭ হাজার টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা। সরকার নির্ধারিত চেস্ট এক্স-রে চার্জ ২শ’ টাকা, এক্স-রে স্কাল ১৫০ টাকা। কিন্তু বেসরকারিতে এ চার্জ ৪৫০ টাকা থেকে ৫শ’ টাকা। একই ধরনের ব্যবধান দেখা গেছে, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে। টিসি, ডিসি, ইএসআর ও হিমোগ্লোবিন একত্রে সরকার নির্ধারিত চার্জ ১৫০ টাকা। এক্ষেত্রে রাজধানী নামিদামি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রগুলো ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা করে নেয়। সরকারিভাবে এইচবিএসএজি চার্জ ১৫০ টাকা। এ পরীক্ষা করাতে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভেদে নেয়া হয় ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা করে। ব্লাড ইউরিন ও স্টুল কালচারের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফি ২০০ টাকা। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নেয় ৬০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এভাবে ২৩টি ক্যাটাগরিতে মোট ৪৭০টি আইটেমের ফি বা চার্জ নির্ধারণ আছে ওই পরিপত্রে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নার্সিং হোম মিলে ২৩ হাজারের উপরে রয়েছে। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে এই সংখ্যা আরো বেশি হবে।
গেল বছরের আগস্ট মাসে জেসমিন বেগম খাবার গ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে দেশের একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। চিকিৎসক এক্স-রে বেরিয়াম মেল ফলো থ্রো এবং তলপেটের প্লেন এক্স-রে করার পরামর্শ দেন। এই পরীক্ষা দুটি তিনি ওই বছরের আগস্টের গোড়ার দিকে রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে করান। এতে খরচ পড়ে ২ হাজার ৩০০ টাকা। তিনি অভিযোগ করেন, এই পরীক্ষাগুলো সরকারি হাসপাতালে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় করানো হয়। অথচ তাকে দ্বিগুণ চার্জ গুনতে হলো। এই রোগী আরেকটি টেস্ট করান ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। পরীক্ষাটির নাম বেরিয়াম সোয়ালো ইসাফেগাস। এজন্য গুনতে হয়েছে ২০৫০ টাকা। এটি সরকারি হাসপাতালে ৫০০ টাকা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এই পরিপত্র সরকারি হাসপাতালের জন্য করা হলেও বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক-এর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ নির্ধারণের জন্য প্রক্রিয়া চলছে। খসড়া হয়েছে। আগামী মার্চের ১০ তারিখের মধ্যে সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক-সেন্টারকে অনলাইন ডাটাবেইজে আসতে হবে। সঠিক সংখ্যা গুনা হয়ে গেলেই নীতিমালাও হয়ে যাবে। এরপর ৫০ শতাংশ দুর্নীতি বন্ধ হবে বলে তিনি আশা করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞান যত আধুনিক হচ্ছে ততই নানাবিধ পরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। আগের মতো রোগীর নাড়ি টিপে কিংবা লক্ষণ বিচার করে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয় না। বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধিকাংশই এখন একাধিক পরীক্ষা ব্যতিরেকে ওষুধ দিতে চান না। শতভাগ সঠিক রোগ নির্ণয় করতে হলে প্যাথলজি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ফলাফল জানা আবশ্যক।
আর এই সুযোগে দেশে রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানগুলো অলিখিত কমিশন চুক্তির মাধ্যমে রোগীদের পকেটশূন্য করছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে কমিশন ভিত্তিক বাণিজ্য গড়ে উঠার অভিযোগ অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে চিকিৎসা ব্যয়ের ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক, স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার পরিকল্পনা কর্মী, রিসিপশনিস্ট ও পেশাদার দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত নিয়ে টিআইবি’র এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডাক্তার ও দালালদের ১৫ থেকে ৫০ ভাগ কমিশন চুক্তি রয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চ মুনাফার জন্য বেসরকারি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোতে ব্যবসা চলছে, সেবা গ্রহীতাকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় হচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিধিমালা না থাকা এবং আইনের হালনাগাদ না হওয়াকেই স্বাস্থ্যখাতের এ সমস্যার জন্য দায়ী করা হয় প্রতিবেদনে। নিয়ন্ত্রণহীন ও নিম্নমানের বেসরকারি চিকিৎসা সেবায় আর্থিক ও স্বাস্থ্যজনিত ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। কমিশন ব্যবসা ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধের মাধ্যমে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত চিকিৎসকদের ‘কমিশন ব্যবসা’র কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকে। যেসব চিকিৎসক বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠান, তাদের একেকটি পরীক্ষার মোট চার্জের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ কমিশন দেয়া হয়। তাদের এই কমিশন প্রদান করে অতিরিক্ত মুনাফা নিশ্চিত করতেই বিভিন্ন পরীক্ষার চার্জ প্রকৃত খরচের চেয়ে অনেক গুণ বেশি নেয়া হয়।
বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ থেকে চারগুণ পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্বল মনিটরিং, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা এবং একশ্রেণির চিকিৎসকের ‘কমিশন বাণিজ্যের’ কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ সহজ-সরল নিরীহ মানুষগুলো এর শিকার হচ্ছেন। এতে করে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে রোগীর চিকিৎসা ব্যয়। নিয়ন্ত্রণহীন আকাশচুম্বি প্যাথলজি ফি’র কারণে মধ্যবিত্ত রোগীরা অনেক সময় বিনা চিকিৎসায় জটিল সব রোগে ভোগেন। সঠিক নীতিমালা প্রয়োগ করে এই প্যাথলজি ফির উচ্চমূল্য বন্ধ করে এটাকে একটি নির্দিষ্ট হারের আওতায় নিয়ে এলে সেবা নিতে হিমশিম খেতে হবে না রোগীদের। এমনই মন্তব্য রোগী ও তার স্বজনদের। তারা বলেন, সরকার সম্প্রতি হার্টের রিংয়ের দাম যেভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে, একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালের বিনিয়োগ চিন্তা করে একটি লাভ ধরিয়ে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষারও চার্জ নির্ধারণ করে দিতে পারে। এতে জনগণ বেশ উপকৃত হবে বলে রোগী ও তার স্বজনরা মন্তব্য করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত স্বাস্থ্যসেবার মূল্য সর্বশেষ গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১০ সালে। একই বছরের ২রা মার্চ এটি সংশোধন করে একটি পরিপত্র জারি করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। রোগীর সুবিধার্থে সব হাসপাতালে এটি প্রদর্শনের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকারি এই পরিপত্র সরকারি হাসপাতাল মানলেও বেসরকারি হাসপাতালে তার সমন্বয় নেই। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে তা চোখে পড়ে না। সবকিছু জানার পরও এই বিষয়ে রহস্যজনকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত আছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী, আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার জন্য চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে সিঙ্গেল ১১০ টাকা এবং ডাবল ২২০ টাকা। অথচ রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ পরীক্ষার জন্য চার্জ দিতে হয় ১৫শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা। ব্রেনের সিটি স্ক্যানের জন্য (ওষুধ ছাড়া) সরকার নির্ধারিত চার্জ ২ হাজার টাকা। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নেয়া হয় কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা।
সরকারি তালিকা অনুযায়ী এমআরআই ইনডিভিজুয়াল (পেইন) ৩ হাজার টাকা এবং কনট্রাস্ট ৪ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একজন রোগীর কাছ থেকে নেয়া হয় ৭ হাজার টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা। সরকার নির্ধারিত চেস্ট এক্স-রে চার্জ ২শ’ টাকা, এক্স-রে স্কাল ১৫০ টাকা। কিন্তু বেসরকারিতে এ চার্জ ৪৫০ টাকা থেকে ৫শ’ টাকা। একই ধরনের ব্যবধান দেখা গেছে, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ক্ষেত্রে। টিসি, ডিসি, ইএসআর ও হিমোগ্লোবিন একত্রে সরকার নির্ধারিত চার্জ ১৫০ টাকা। এক্ষেত্রে রাজধানী নামিদামি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রগুলো ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা করে নেয়। সরকারিভাবে এইচবিএসএজি চার্জ ১৫০ টাকা। এ পরীক্ষা করাতে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভেদে নেয়া হয় ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা করে। ব্লাড ইউরিন ও স্টুল কালচারের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফি ২০০ টাকা। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নেয় ৬০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এভাবে ২৩টি ক্যাটাগরিতে মোট ৪৭০টি আইটেমের ফি বা চার্জ নির্ধারণ আছে ওই পরিপত্রে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নার্সিং হোম মিলে ২৩ হাজারের উপরে রয়েছে। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে এই সংখ্যা আরো বেশি হবে।
গেল বছরের আগস্ট মাসে জেসমিন বেগম খাবার গ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে দেশের একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। চিকিৎসক এক্স-রে বেরিয়াম মেল ফলো থ্রো এবং তলপেটের প্লেন এক্স-রে করার পরামর্শ দেন। এই পরীক্ষা দুটি তিনি ওই বছরের আগস্টের গোড়ার দিকে রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে করান। এতে খরচ পড়ে ২ হাজার ৩০০ টাকা। তিনি অভিযোগ করেন, এই পরীক্ষাগুলো সরকারি হাসপাতালে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায় করানো হয়। অথচ তাকে দ্বিগুণ চার্জ গুনতে হলো। এই রোগী আরেকটি টেস্ট করান ধানমন্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। পরীক্ষাটির নাম বেরিয়াম সোয়ালো ইসাফেগাস। এজন্য গুনতে হয়েছে ২০৫০ টাকা। এটি সরকারি হাসপাতালে ৫০০ টাকা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এই পরিপত্র সরকারি হাসপাতালের জন্য করা হলেও বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক-এর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ নির্ধারণের জন্য প্রক্রিয়া চলছে। খসড়া হয়েছে। আগামী মার্চের ১০ তারিখের মধ্যে সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক-সেন্টারকে অনলাইন ডাটাবেইজে আসতে হবে। সঠিক সংখ্যা গুনা হয়ে গেলেই নীতিমালাও হয়ে যাবে। এরপর ৫০ শতাংশ দুর্নীতি বন্ধ হবে বলে তিনি আশা করেন।
No comments