এবার তুরস্ক-সিরিয়া যুদ্ধ! by আহমেদ বায়েজীদ
আফরিনে
এবার পরস্পরের মুখোমুখী দাঁড়াতে যাচ্ছে সিরিয়া ও তুরস্ক। কুর্দিপন্থী
ওয়াইপিজি মিলিশিয়াদের দমন করতে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ আফরিনে অভিযান
চালাচ্ছে তুরস্কের সেনাবাহিনী। এ সপ্তাহের মাঝামাঝি কুর্দিদের সহায়তা করতে
অঞ্চলটিতে প্রবেশ করেছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত একটি
মিলিশিয়া গোষ্ঠীর কয়েক ডজন যোদ্ধা (সেনাবাহিনী নয়)। ফলে আফরিন এখন
সিরিয়া-তুরস্ক যুদ্ধের ক্ষেত্র হওয়ার আশঙ্কার মুখে। তেমন কিছু হলে সেখানে
রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে সেটি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কারণ সিরিয়ায় এখন
পরাশক্তিগুলোর মধ্যে রাশিয়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আফরিনে কুর্দিপন্থী পিপলস
প্রটেকশন ইউনিট বা ওয়াইপিজির বিরুদ্ধে গত মাসে অভিযান শুরু করেছে তুরস্ক।
ওয়াইপিজিকে নিষিদ্ধঘোষিত কুর্দিস্থান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকের অংশ
হিসেবে দেখে আঙ্কারা। অনেক দিন ধরেই তুরস্কের অভ্যন্তর ধ্বংসাত্মক ও
রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে পিকেকে। খোদ রাজধানী আঙ্কারাতেও
দেখা গেছে তাদের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা। আফরিনে তুর্কি সীমান্ত এলাকায় ওয়াইপিজি
একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করতে চলেছে বলে জানতে পারার পরই সেখানে
অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় তুরস্ক। আঙ্কারা চাইছে, তার সীমান্তের কাছে কুর্দি
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এ বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়াকে আঁতুড় ঘরেই শেষ করে দিতে। এ
লক্ষ্যে তারা অভিযান শুরু করেছে গত মাসে। আফরিন এলাকাটি সিরিয়ার ভূখণ্ড
হলেও ২০১২ সাল থেকে সেটি সিরীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিভিন্ন সময়
বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল আফরিন। বর্তমানে এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ
ওয়াইপিজি মিলিশিয়া গোষ্ঠীর হাতে। এই অঞ্চল থেকে আইএসকে তাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছে ওয়াইপিজি। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত সিরিয়ার বিদ্রোহী
জোটেরও অংশ ছিল এ গোষ্ঠিটি। তুরস্কও এই জোটকে সমর্থন দিয়েছে পুরো
গৃহযুদ্ধের সময়টাতে। কিন্তু নিজের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে ওঠাতেই
ওয়াইপিজিকে আর বাড়তে দিতে চাইছে না প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের
সরকার। আফরিনে তুরস্কের অভিযান শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই কুর্দিদের প্রতি
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পরোক্ষ সহযোগিতার খবর আসতে থাকে।
সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকা দিয়ে কুর্দি বিদ্রোহীদের অবাধ চলাচল ও তাদের রসদ
সরবরাহের জন্য সরকার নিয়ন্ত্রিত রুট ব্যবহার এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এরপর
তুরস্কের সেনাবাহিনীর আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে দামেস্কের সহযোগিতাও
চায় কুর্দিরা। তবে তাতে সরাসরি কোনো সায় দেয়নি বাশার আল আসাদ। এ সপ্তাহের
মাঝামাঝিতে কুর্দি সূত্রগুলো থেকে জানানো হয় বাশার সরকারের সাথে কুর্দিদের
সমঝোতার কথা। বুধবার প্রকাশ হয় এলাকাটিতে বাশারপন্থী মিলিশিয়াদের আগমনের
খবর। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে মিলিশিয়াদের আফরিন যাত্রার ভিডিও দেখানো
হয়। আর এরই মধ্য দিয়ে নতুন মোড় নেয় আফরিন যুদ্ধ। মিলিশিয়াদের কনভয় লক্ষ্য
করে কিছু হুঁশিয়ারিমূলক কামানের গোলা নিক্ষেপ করেছে তুর্কি সৈন্যরা। ফলে
এটি এখন তুর্কি-সিরিয়া যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন দামেস্ককে। বলেছেন,
‘আফরিনে আমাদের অগ্রযাত্রা কেউ ঠেকাতে পারবে না’। কয়েক দিনের মধ্যেই আফরিন
শহর ঘিরে ফেলা হবে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। এতদিন বাশার সরকারের বিরুদ্ধে
লড়াই করা কুর্দিদের হঠাৎ কেন তারাই সহযোগিতা করতে চাইছে সেটি একটি রহস্য।
আবার তুরস্ককের বিরুদ্ধে সিরিয়া যুদ্ধে অবর্তীর্ণ হলে সেখানে রাশিয়ার
ভূমিকা কী হবে সেটিও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আফরিনে যে রাশিয়ার সম্মতি
নিয়েই তুর্কি অভিযান চলাচ্ছে সেটি সবার জানা। ওই এলাকায় অনেক দিন ধরে
রাশিয়ার পর্যবেক্ষক মোতায়েন ছিল। তুরস্কের অভিযানের আগমুহূর্তে তারা
পর্যবেক্ষকদের সরিয়ে নেয়। তাছাড়া সিরিয়ার আকাশ পথও এখন পুরোপুরি রাশিয়ার
নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের সম্মতি ছাড়া কোনো মতেই সেখানে তুর্কি অভিযান চালানো
সম্ভব হতো না। সাম্প্রতিক সময়ে মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্ক উন্নয়নের ফলাফল
হিসেবে এই সমঝোতাকে দেখা হচ্ছে। তুরস্কও সোচিতে রাশিয়ার উদ্যোগে আয়োজিত
সিরীয় শান্তি সংলাপে সমর্থন দিয়েছে।
ফলে তুরস্ক-রাশিয়া এ বোঝাপড়া পরস্পরের
স্বার্থে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, সিরিয়া যদি
তুরস্কের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে নতুন করে জটিলতা তৈরি হবে এ যুদ্ধে।
বাশার সরকারের সবচেয়ে বড় মিত্র রাশিয়া। সাত বছরের প্রবল গৃহযুদ্ধের মুখে
বাশারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে একমাত্র রাশিয়া। সরাসরি তারা যুদ্ধ করেছে
সরকারের পক্ষ নিয়ে; কিন্তু সেই যুদ্ধ ছিল বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর বিপক্ষে।
তুরস্কের বিপক্ষে যুদ্ধ হলে তারা কি বাশারের পক্ষে অবস্থান নেবে?
বিশ্বরাজনীতির সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহগুলোর দিকে চোখ রাখলে সেটি হবে না বলেই
মনে হচ্ছে। মার্কিন বলয় থেকে বের হয়ে আসা তুরস্ককে কাছে টানতে মরিয়া
রাশিয়া। তা ছাড়া তুরস্ক এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ন্যাটো সদস্য দেশটির সাথে তাই হয়তো বিবাদে জড়াবে না
মস্কো। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে তুরস্কের সাথে
সম্পর্কের বিকল্প নেই ভ্লাদিমির পুতিন সরকারের জন্য। আবার বাশার সরকারও
তাদের খুব ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাৎক্ষণিকভাবে আফরিন ইস্যুর সর্বশেষ পরিস্থিতি
নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ক্রেমলিন। আবার অনেক সামরিক বিশ্লেষক মনে করছেন,
আফরিনে মিলিশিয়া যোদ্ধা পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে চান বাশার আল আসাদ।
গৃহযুদ্ধের পর তার সরকারের যা পরিস্থিতি তাতে সেনা পাঠিয়ে তুরস্কের সাথে
যুদ্ধে জড়াতে চাইবেন না তিনি। তা ছাড়া দেশীয় বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ আর
ন্যাটো সদস্য তুরস্কের সাথে যুদ্ধ এক কথা নয়। এজন্য বড় মূল্য দিতে হতে পারে
বাশারকে। তাই এ ঘটনা ঠিক কোন দিকে মোড় নেবে সেটি বুঝতে হলে অপেক্ষা করতে
হবে আরো কিছু দিন।
No comments