আসুন, বিয়ের খরচ কমাই by রোকেয়া রহমান
গত
মাসের ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার খড়িয়ালা গ্রামের মিজান মিয়া
তাঁর সহকর্মীদের দিয়ে গ্রামেরই এক শিশুকে অপহরণ করান। মুক্তিপণ হিসেবে
চাওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা। দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ আদায়ও হয়। কিন্তু
অপহরণকারীদের চিনে ফেলায় শিশুটিকে হত্যা করা হয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর
অনুযায়ী, ব্যাগ তৈরির কারখানার শ্রমিক মিজান মিয়ার বিয়ে সম্প্রতি ঠিক
হয়েছিল। বিয়ের খরচ জোগানোর জন্য তঁার হাতে কোনো টাকা ছিল না। তাই টাকা
জোগাড়ের জন্য শিশু অপহরণের বুদ্ধি আঁটেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে গত বছরের
এপ্রিল মাসে। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার মুনিষগাঁও গ্রামে আবদুল কাফি
তুষার নামের তিন বছরের এক শিশুকে অপহরণ করেন একই গ্রামের সাজু মিয়া। এরপর
তিনি মুঠোফোনে তুষারের বাবার কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। কিন্তু
তুষারের বাবা থানায় অপহরণ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। বিষয়টি
টের পেয়ে সাজু মিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা তুষারকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। সাজু
মিয়ারও বিয়ে ঠিক হয়েছিল দীর্ঘদিনের প্রেমিকার সঙ্গে। কিন্তু বিয়ে করার মতো
টাকা তাঁর কাছে ছিল না। তাই শিশু অপহরণ করে টাকা জোগাড়ের পরিকল্পনা করেন
তিনি। কী ভয়ংকর ব্যাপার! শুধু বিয়ের টাকা জোগাড়ের জন্য শিশু অপহরণের কথা
আমরা ভাবতে না পারলেও এমনটাই ঘটেছে। মিজান মিয়া ও সাজুর এই অপকর্মের জন্য
পরোক্ষভাবে হলেও আমাদের দেশের বিয়ের রীতি ও আচার–অনুষ্ঠান দায়ী। আমাদের
দেশে বিয়ে মানেই বিশাল খরচ। বরপক্ষ-কনেপক্ষ উভয়কেই এই খরচের বোঝা বহন করতে
হয়। বিয়ে হয় দুটি মানুষের মধ্যে। অথচ সে জন্য কত যে অনুষ্ঠান, কত যে আচার।
বাগ্দান বা পানচিনি, গায়েহলুদ, বিয়ে, বউভাত। হালে আবার সংযোজন হয়েছে
সংগীত। হিন্দি সিরিয়াল দেখে অনেকেই আজকাল সংগীতের আয়োজন করছেন। প্রতিটি
অনুষ্ঠানে খরচ হয় ব্যাপক। শুধু কি খাওয়া-দাওয়া? নাচ-গান, কনের পোশাক, বরের
পোশাকের পাশাপাশি সাজসজ্জা, গয়না, আনুষঙ্গিক আরও কত–কী। আর এসব করতে গিয়ে
কত মানুষ যে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বিশেষ করে দরিদ্র
মানুষেরা। কেউ ঋণ করছেন, কেউ ভিটেমাটি বিক্রি করছেন। আর মিজান মিয়া ও সাজু
মিয়ার মতো লোকেরা শিশু অপহরণ ও হত্যার মতো ভয়ংকর অপরাধ করছেন। সম্প্রতি
আমার এক পরিচিত মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে । ফারহানা (ছদ্মনাম) নামের মেয়েটি
পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আগামী পয়লা বৈশাখ তাঁর বিয়ে।
কিন্তু তাঁর মন
খুবই খারাপ। কারণ, তাঁর বিয়েটা সে অর্থে জাঁকজমকভাবে হচ্ছে না। কদিন আগেই
তাঁর এক বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে। কত কিছুই না হয়েছে সেই বিয়েতে। পানচিনি থেকে
শুরু করে প্রতিটি অনুষ্ঠান হয়েছে। কত সাজসজ্জা, আর কত যে খাবারদাবারের
আয়োজন ছিল। কিন্তু ফারহানার বিয়েতে সেসব কিছুই হচ্ছে না। ছোট করে
গায়েহলুদের একটি অনুষ্ঠান হবে। আর বরপক্ষ ও কনেপক্ষ মিলে যৌথভাবে একটি
অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। ফারহানার বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের
হিসাবরক্ষক । বেতন যা পান তাতে এই দুর্মূল্যের বাজারে বাসাভাড়া, সংসার খরচ ও
ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ বাদ দিয়ে তাঁর হাতে বিশেষ কিছুই থাকে না।
সংসারের খরচ বাঁচিয়ে যেটুকু টাকা তিনি জমিয়েছিলেন, তা দিয়ে মেয়ের বিয়েতে এর
চেয়ে বেশি আয়োজন করা সম্ভব না। আগে পানচিনি, গায়েহলুদের অনুষ্ঠান শুধু
শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন গ্রামের বিয়েশাদিতেও এসব অনুষ্ঠান হচ্ছে।
একজনের দেখাদেখি আরেকজনও খরচ করছেন। এ যেন প্রতিযোগিতা। সামাজিক মর্যাদা
রক্ষার প্রতিযোগিতা। সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিয়ের টাকা জোগাড় করতে
না পেরে বহু ছেলেমেয়ের দেরি করে বিয়ে হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন
মেয়ের বাবা-মা বা অভিভাবকেরা। বিয়ের নানা অনুষ্ঠানে তো খরচ করতেই হয়,
পাশাপাশি দিতে হয় বরপক্ষকে যৌতুক, যা তঁাদের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়ায়।
আসলে এখন সময় হয়েছে এটা নিয়ে নতুন করে ভাবার। একটি বিয়েতে এতগুলো অনুষ্ঠান
করার তো কোনো প্রয়োজন নেই। পানচিনি অনুষ্ঠানের কি আদৌ কোনো দরকার আছে?
গায়েহলুদ না দিলে তো বিয়েটা অবৈধ হয়ে যাচ্ছে না। কেন বিয়েতে শত শত মানুষকে
দাওয়াত দিতে হবে? বিয়েতে কেন কনেকে সোনার গয়নাই পরতে হবে। সোনার গয়না ছাড়া
কি বিয়ে হতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু ঠুনকো সামাজিক মর্যাদা রক্ষা
করতে গিয়ে সবাইকে এই বিপুল খরচের বোঝা বহন করতে হচ্ছে। বিয়ের খরচটা
প্রত্যেকের সাধ্যের মধ্যে রাখা উচিত। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা একটি অনুষ্ঠানে
সীমাবদ্ধ রাখার চিন্তা করতে হবে। এ জন্য সামাজিক উদ্যোগ জরুরি।
আপনাকে-আমাকেই এগিয়ে আসতে হবে।
রোকেয়া রহমান সাংবাদিক
রোকেয়া রহমান সাংবাদিক
No comments