শ্মশানও কি বাদ যাবে না? by গওহার নঈম ওয়ারা
নদীর
বালু, পাথর, খাল ও নদীপাড়ের মাটি, পাহাড়-টিলা হাপিস করতে করতে এখন
শ্মশান-গোরস্থানে হাত পড়েছে। জুয়াড়িদের এমন হয় সঙ্গে আনা টাকাপয়সা,
বিড়ি-সিগারেট শেষ হয়ে গেলে পোড়া বিড়ি-সিগারেটের খণ্ডিত অংশে আগুন দিয়ে
সুখটান দেয়। কিছুই ফেলার নয়, বাদ দেওয়া যাবে না কিছুই। টেকসই উন্নয়নের
লক্ষ্যে যেমন বলা হয় কাউকে পেছনে ফেলে নয়! জমিখোর-মাটিখোর এখন সেই একইভাবে
সামাজিক ভূমি, দেবোত্তর সম্পত্তি কিছুই বাদ দিতে রাজি নয়। ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদের এসব লাগোয়া জমির পত্তনি নিয়ে এবং একসনা লিজ নিয়ে, কখনোবা সঠিক
বা বেঠিক পথে দলিল তৈরি করে তারপর আস্তে-ধীরে গ্রাসের কাজ চলছে প্রায় সারা
দেশে। কোথাও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এসব দখল-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে
সোচ্চার হচ্ছে, দাবিনামা, মানববন্ধন, ধরনা, আন্দোলন করে সফল হচ্ছে।
স্থিতাবস্থার কাগজ আদেশ পাচ্ছে, কোথাও দেরি হয়ে যাচ্ছে-আদেশের কাগজ হাতে
পাওয়ার আগেই জবরদখলের প্রক্রিয়া রাতারাতি শেষ করছে জমিখোর-ভূমিখোরদের দল।
রায়ের অবিকল নকল পেতে যে দেশে বছর কেটে যায়, সেখানে উচিত সিদ্ধান্ত, উচিত
জায়গায় পৌঁছানোর আগেই কেল্লাফতে করার সব উপাচার সাঙ্গ করার লোকের অভাব নেই।
বিলম্বিত নকল নিয়ে ঘাটে ঘাটে ফিরতে হয় বাদীকে। যাদের সংগঠন নেই, দল-দালালি
নেই, তাদের সামাজিক ভূমি রক্ষা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সাতক্ষীরার
আশাশুনি উপজেলার কুল্ল্যা ইউনিয়নের বেতনা নদীর ধারে ‘মুচিপোঁতা’ শ্মশানের
মাটি জোর করে কেটে নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটার মালিকেরা। ‘মুচিপোঁতা’ নামকরণ থেকে
বোঝা যায়, এই শ্মশান বা সমাধিক্ষেত্র তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু
সম্প্রদায়ের-চর্মকার বা কথ্য ভাষায় যাদের মুচি বলি, তাদের মরদেহ রক্ষার
জায়গা।
প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো এই সমাধিক্ষেত্রটি তৎকালীন জমিদারেরা
তাদের পালকি বাহক এবং চটি জুতা বা ধামা-কাঠা (বেতের পাত্র), কুলা, ঝাড়ু
তৈরিতে নিয়োজিত কাহার সম্প্রদায়ের মরদেহ রক্ষার জন্য পাঁচ বিঘা জমি
নির্দিষ্ট করে দেয়। বুধহাটা ঋষিপাড়া শ্মশান কমিটির সভাপতি বাবুল দাস ও
সাধারণ সম্পাদক কার্তিক দাস সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শ্মশানের উত্তর দিকের
১ একর ১০ শতাংশ জমি জনৈক আনোয়ার হোসেন (বলা বাহুল্য বড় রাজনৈতিক পরিচিতিও
আছে তাঁর) প্রশাসনের কাছ থেকে একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে জমির শ্রেণি পরিবর্তন
করে, সেখানে ভাঙার (উঁচু জায়গা) পরিবর্তে জলাশয় বানানোর জন্য ভাটার মালিকের
কাছে মাটি বিক্রি শুরু করেন। ১০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে ভাটায় নিয়ে যাওয়ায়
ঋষি বা চর্মকার সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মৃতদেহ সৎকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বর্ষায় সেটা বন্ধই হয়ে যাবে। বলে রাখা ভালো, ঋষি সম্প্রদায় মূলধারার সনাতন
ধর্মাবলম্বীদের মতো মৃতদেহ দাহ করে না। তারা সাধারণত মাটির নিচে সমাধিস্থ
করে। মাটি কাটার প্রক্রিয়ায় অনেক সমাধিস্থ দেহের কঙ্কাল এবং হাড়গোড় উঠে
এলেও মাটি কাটা বন্ধ হয়নি। আশার কথা, ঋষি সম্প্রদায় একজোট হয়েছে এবং
আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। আন্দোলনের মুখে কুল্ল্যা ইউনিয়নের ভূমি
কর্মকর্তা গত ২৮ জানুয়ারি মাটি কাটার কাজ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে
আশাশুনির সহকারী ভূমি কমিশনারের দেওয়া একসনা বন্দোবস্ত এখনো বহাল আছে।
প্রায় একই ধরনের খবর এসেছে উখিয়া থেকে। সেখানকার বৌদ্ধ শ্মশানের জমি জবরদখল
করে মাটি কেটে বিক্রি এবং খেতখামার বানানোর অভিযোগ উঠেছে। উখিয়া উপজেলার
হলদিয়া পালং ইউনিয়নের পশ্চিম মরিচ্যাপালং সর্বজনীন বৌদ্ধ শ্মশানের মাটি
কেটে রাস্তা নির্মাণ এবং শ্মশানের ওপর বেগুন চাষের ভয়ংকর খবর উদ্বেগকে আরও
বাড়িয়ে দেয়। শ্মশান কমিটির সভাপতি বাবুলাল বড়ুয়া বাদী হয়ে উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দাখিল করেছেন। এই শ্মশানটিও প্রায় দুই শ বছরের
পুরোনো। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এই শ্মশান উদ্ধারের জন্য অন্যান্য ধর্মীয়
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় একজোট হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক রাস্তার কাজ
স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুখানপুকুরী
ইউনিয়নের তরুকপোতা বাজারে শ্মশানের জমি দখল করে রাতারাতি দোকানঘর নির্মাণের
অভিযোগ উঠেছে। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডল ইউনিয়নের মালতিবাড়ি
গ্রামের শ্মশানে লাশের সৎকার বন্ধ করে দিয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যাগুরু
সম্প্রদায়ের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা। এই গ্রামের বর্মণবাড়ির লোকজন তাদের ২৬
শতাংশ জমি দেবোত্তর ঘোষণা করে শ্মশানের নামে ছেড়ে দেয়। বছরখানেক আগে
জমিদানকারী যুধিষ্ঠির বর্মণ ভারতে চলে গেলে স্থানীয় সামাদ মোক্তার শ্মশানের
জমির দখল নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। যুধিষ্ঠিরের বড় বোন চিন্তামনি বড়ই
দুশ্চিন্তায় আছেন, ‘গ্রামোত মরা পুড়বার জায়গা নাই, মইলে পুড়বে কোঠে?
হামরাগুলা তো কিছু কবার সাহস পাই না।’ নেত্রকোনার সদর উপজেলার বাংলা
ইউনিয়নের বাংলা গ্রামের শ্মশানঘাটটি সম্প্রতি বেদখল হয়ে গেছে। শ্মশান
হারিয়ে মানুষজন এখন দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতায় স্বাক্ষর করে তা ফিরে পেতে
চেষ্টা করছে। শুধু যে গ্রামেগঞ্জের কোনাকাঞ্চিতে এ রকম অনাচার চলছে তা নয়।
বরিশালের বানারীপাড়ার পৌর এলাকায় (৪ নম্বর ওয়ার্ড) শ্মশানের জায়গা দখল করে
বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করার অভিযোগ উঠেছে। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জেএল ৪২
নম্বর মৌজায় ১৯২ নম্বর খতিয়ানের ৬১৪ ও ৬১৫ নম্বর দাগের ১৩ শতক জমি
শ্মশানের নামে রেকর্ড করা। এই সম্পত্তির একাংশ দখল করে নির্মাণকাজ শুরু
করেছেন জনৈক মোজাম্মেল হোসেন। প্রশাসন জানিয়েছে, জমির রেকর্ডপত্র
যাচাই-বাছাই করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে, শ্মশান
এলাকায় যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য বানারীপাড়ার পুলিশকে
নির্দেশ দেওয়া আছে। সব ধর্মের মানুষ যাতে নির্ভয়ে নিজেদের ধর্মচর্চা করতে
পারে, সেটা নিশ্চিত করা একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য।
গণতন্ত্র আছে কি নেই, তার স্বাস্থ্য খারাপ না ভালো, তাকে নিবিড় পরিচর্যায়
বা আইসিইউতে রাখতে হবে কি না-এই সবকিছু মাপার কতিপয় পরিমাপক আছে। তার একটি
গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক হচ্ছে যারা সংখ্যায় কম, তারা কেমন আছে। তাদের পরিসর
বা স্পেস কি সংকুচিত হচ্ছে, না তারা নির্ভয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছে।
আমাদের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কি আমাদের দিকে আস্থার নজরে তাকায়, না সব সময়
কোনো কিছু হারানোর ভয়ে থাকে। তাদের অভয় দিতে না পারলে এই স্বাধীনতার মানে
কী?
গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments