তৈরি পোশাক শিল্পে স্বয়ংক্রিয় রোবটের হানা
ঢাকার
মোহাম্মদি ফ্যাশন সোয়েটার্স লিমিটেডের কারখানা। অনবরত কালো সোয়েটার বুনন
করে চলছে ১৭৩টি জার্মানিতে নির্মিত মেশিন। পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন কয়েক ডজন
কর্মী। মাঝেমাঝে মেশিন পরিষ্কার করছেন কর্মীরা। কিন্তু এর বাইরে করার মতো
তাদের কোনো কাজ নেই বললেই চলে।
কয়েক বছর আগের তুলনায় এই পরিবর্তনকে বড়ই বলতে হবে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা করে এই সোয়েটার বুননের কাজ করতো কয়েকশ’ শ্রমিক।
কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকেই মোহাম্মদি গ্রুপের মালিকগোষ্ঠী কর্মী ছাঁটাই শুরু করলেন। তাদের পরিবর্তে এই কাজ করতে লাগলো মেশিন। গত বছর নাগাদ দেখা গেল বুননের পুরো কাজই করছে স্বয়ংক্রিয় মেশিন।
এইচঅ্যান্ডঅ্যাম ও জারার মতো পশ্চিমা ব্রান্ডের জন্য সোয়েটার বানায় মোহাম্মদি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেন, ‘নিজেদেরকে শ্লথ করার বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রয়োগ না করার কোনো কারণ দেখি না।’ তিনি জানান, প্রায় পাঁচশ’ শ্রমিককে ছাঁটাই করে মেশিন বসানো হয়েছে তার কারখানায়। কিনতে পারেন আরও মেশিন।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে এই স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশনের প্রভাব নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের একটি প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের শিরোনামেই বলে দেয়া আছে সবকিছু। ‘দ্য রোবটস আর কামিং ফর গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স। দ্যট’স গুড ফর দ্য ইউএস, ব্যাড ফর পুর কান্ট্রিজ’ (গার্মেন্ট শ্রমিকদের হটাতে আসছে রোবট। এটা আমেরিকার জন্য ভালো, কিন্তু গরীব দেশগুলোর জন্য খারাপ।)
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বল্পমজুরির শ্রমিকরাও অটোমেশনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নন। কারণ, এখন মেশিন ও রোবট এমন সব শিল্পে পৌঁছে গেছে, যেগুলোকে আগে অটোমেশনের ধরাছোঁয়ার বাইরে ভাবা হতো। তৈরি পোশাক শিল্প কিন্তু গাড়ি বা ইলেক্ট্রনিকস নির্মান শিল্পের মতো নয়। ফলে এই শিল্প অটোমেশন থেকে সুরক্ষিত বলে মনে হতো। কাপড় নিয়ে যেকোনো কাজই বেশ কঠিন। ফলে মেশিনের চেয়ে মানুষের হাতেই এসব কাজ ভালো হতো। এছাড়া বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও চীনে এই শিল্পে এত বেশি সস্তা মজুরির শ্রমিক কাজ করতো যে, তৈরি পোশাক কারখানায় স্বয়ংক্রিয়তার ছোঁয়া আনার তাগিদ অত বোধ হতো না।
কিন্তু শ্রমিকের ব্যয় বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও। অপরদিকে প্রযুক্তি এত অগ্রসর হচ্ছে যে, মেশিনও এখন অনেক কঠিন কাজ করতে শিখে গেছে। নরম কাপড়ের ওপর কাজ করা, পকেট সেলাই করা, প্যান্টে বেল্ট লুপ যুক্ত করার মতো কাজ এখন মেশিন দিয়ে করা সম্ভব। ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের অর্থনীতিই উলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বহু গরিব দেশের (বিশেষ করে এশিয়ার) অর্থনীতিতে এই শিল্পই প্রধান ভূমিকা রেখে আসছে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি গবেষণায় অনুমান করা হয়, অটোমেশন যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে এশিয়ার কিছু দেশে বস্ত্র, বয়ন ও তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট উৎপাদন খাতের ৮০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থান হারিয়ে যাবে।
আমেরিকার প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’র এমআইটি ইনিশিয়েটিভ অন দ্য ডিজিটাল ইকোনমি’র পরিচালক এরিক ব্রায়ানজোলফসন বলেন, ‘আমি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ে চিন্তিত। এই অটোমেশন বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এসব দেশ।’ কারণ, দরিদ্র দেশে অবস্থিত কারখানায় পুনরাবৃত্তিমূলক যেসব কাজ শ্রমিকরা করতো এতদিন, তা করা শিখছে রোবট। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে বেশিরভাগ চাকরি পেতে হলে খুবই উচ্চমানের দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। এসব জায়গায় উন্নত দেশগুলোই ভালো করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সমস্যার রূপ পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন, বাংলাদেশে যে হারে শ্রমিক বাড়ছে, সেই হিসাবে তাল মেলাতে হলে প্রতি বছর ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে দেশটিকে। আর এক্ষেত্রে বস্ত্রখাতই সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, গার্মেন্ট ও বস্ত্র খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সংখ্যা বছরপ্রতি ৬০ হাজারে নেমে এসেছে। অথচ, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্তও প্রতি বছর ৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এই শিল্প। সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই শিল্পের বড় অংশ মৌলিক বস্ত্র উৎপাদন খাতে ইতিমধ্যেই কর্মসংস্থান কমা শুরু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের তৈরি পোশাক উৎপাদন কিন্তু কমেনি, বরং বাড়ছে ক্রমাগত। স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অটোমেশনই শ্রমিকদের স্থান পূরন করছে। ফলে কমছে না উৎপাদন। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যভাগে, বাংলাদেশের বার্ষিক তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ১৯.৫ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এই সময়ে চাকরি বেড়েছে মাত্র ৪.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আপনি যদি তরুণদেরকে উৎপাদনশীল কর্মে সম্পৃক্ত করাতে না পারেন, তারা কিছু একটা করবে। আর তারা যা করবে সেটা হয়তো সামাজিকভাবে সুখকর হবে না। সমাজের জন্য এটা একটা টাইম বোমা।’
তবে অটোমেশনের উপকারী দিক অবশ্যই আছে। কিন্তু তা শুধু ধনী দেশগুলোর জন্য। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি হওয়ায়, জিন্স ও অন্যান্য ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ পণ্যের দাম আরও সস্তা হবে। এমনকি তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন খাতের কিছু অংশ ফের চলে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সহ ব্যয়বহুল শ্রমবাজারে।
পোশাক কারখানার জন্য বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় মেশিন তৈরি করে আমেরিকার আটলান্টা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার অটোমেশন। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তাদের ‘সিউবোট’ বা সেলাই করার মেশিন আগামী মাসেই ব্যবহৃত হবে আরকানসাসের লিটল রকে অবস্থিত চীনের বস্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠান তিনইয়ুয়ান গার্মেন্টসের একটি কারখানায়। বিশ্ববিখ্যাত জুতো ও ক্রীড়া পোশাক তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস সম্প্রতি জার্মানিতে ‘স্পিডফ্যাক্টরি’ একটি জুতা কারখানা খুলেছে। এই কারখানায় স্বল্প মজুরির শ্রমিক নয়, ব্যবহৃত হবে কম্পিউটার চালিত স্বয়ংক্রিয় বুনন প্রযুক্তি।
অটোমেশনে উন্নয়ন দেশগুলো সুবিধা পেলেও, কপাল পুড়ছে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র্য দেশের শ্রমিকদের। নাজমা আক্তার নামে বাংলাদেশের একজন ইউনিয়ন নেতা বলেন, অটোমেশনের ফলে যেই টাকা বেঁচে যাচ্ছে, তার কারণেই কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি অগ্রাহ্য করার সাহস পাচ্ছেন। তিনি একটি সাম্প্রতিক ঘটনা উদ্ধৃত করে বলেন, একটি কারখানায় বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করলে, মালিকরা হুমকি দেন যে, তাদের পরিকল্পনামত কাজ না করলে, তারা স্রেফ স্বয়ংক্রিয় মেশিন নিয়ে আসবেন। সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট নাজমা আক্তার আরও বলেন, ‘যেসব কারখানায় আগে ৩০০ শ্রমিক ছিল এখন সেগুলোতে ১০০ জন হয়তো আছে।’
কিন্তু দেশের বড় বড় পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায়, অটোমেশনের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া তাদের বিকল্প কিছু করার নেই।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে বাংলাদেশে, তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তার ওপর বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতের খরচ পোশাকের দাম বৃদ্ধি করে পোষানোর চেষ্টা হলেও, সস্তা ফ্যাশনে অভ্যস্ত ক্রেতারা তা মানেননি। তার ওপর, সস্তা মজুরির শ্রমিক সমেত নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর আবির্ভাবও বাংলাদেশের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
জারা সহ বড় ফ্যাশন ব্রান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে বাংলাদেশের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি প্রধান নির্বাহী মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘আপনি যদি নিজেকে না পাল্টান, তাহলে আপনি পুরো ব্যবসাই হারাবেন।’ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তার বহুতলা কারখানায় ব্যবহার করা হয় স্পেনে নির্মিত ফিনিশিং মেশিন। এই মেশিন দেড় ডলারেই পাওয়া যায়। এই মেশিনের মাধ্যমে জিন্সের মধ্যে নজরকাড়া ছিদ্র সৃষ্টি করা যায়। পাশের কারখানায় কয়েক ডজন শ্রমিক এই কাজ করেন। অথচ, তাদের সবার চেয়ে অনেক নিখুঁতভাবে একই পরিমাণ কাজ করে দেয় এই মেশিন। মোস্তাফিজ আরও বলেন, ফিনিশিং দিতে গিয়ে যেসব জিন্স নষ্ট হয়, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেলাই করে দেয়ার জন্য তার কারখানায় আছে আরও ৪টি মেশিন। একটি মেশিন যে পরিমাণ সেলাই করতে পারে, তা ম্যানুয়ালি করতে লাগে ১২ জন মানুষ। তিনি বলেন, ‘মেশিন সবই করতে পারে। আপনি শুধু একে নির্দেশনা দেবেন।’ অটোমেশনের ফলে শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছে, এই অভিযোগ শুনতে অভ্যস্ত তিনি। তার মন্তব্য, ‘আমরা যদি ব্যবসাই বাঁচাতে না পারি, তাহলে বেতন আসবে কোথা থেকে?’
অটোমেশনের ফলে বাংলাদেশ এখনও সস্তা মূল্যে পোশাক রপ্তানি করতে পারছে। প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে তুলতে পারছে অন্যান্য দেশের সঙ্গে। যেমন, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ছেলেদের ট্রাউজারের দাম বাংলাদেশের কারখানায় ১২ শতাংশ কমে গেছে। মার্কিন উপাত্ত ব্যবহার করে এই তথ্য দিলেন পেনসিলভানিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক আনার।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে এক সাবেক গার্মেন্ট শ্রমিকের কাহিনীও তুলে দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ আবদুল হালিম (৪১) নামে ওই শ্রমিক গত বছর চাকরি হারান। দায়ী সেই মেশিন! পরে কিছুদিন অন্য চাকরি খুঁজলেও, অবশেষে রিকসা চালানো শুরু করেছেন তিনি।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের জন্য সমাধান হতে পারে তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে গিয়ে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা। যাতে করে উৎপাদন খাতের শ্রমিকরা এ ধরণের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কবলে পড়ে কর্মবিহীন থাকতে হয়। অন্য দেশগুলো এই পথে সফল হয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটাই। অন্য বিকল্প খাতেও এখন অটোমেশন চলছে। মোহাম্মদি গ্রুপের রুবানা হক বলেন, ‘আমরা শুধু এই গার্মেন্টসটাই করেছি, আর কিছু না। এখান থেকে কই যাবো আমরা?’
কয়েক বছর আগের তুলনায় এই পরিবর্তনকে বড়ই বলতে হবে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা করে এই সোয়েটার বুননের কাজ করতো কয়েকশ’ শ্রমিক।
কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকেই মোহাম্মদি গ্রুপের মালিকগোষ্ঠী কর্মী ছাঁটাই শুরু করলেন। তাদের পরিবর্তে এই কাজ করতে লাগলো মেশিন। গত বছর নাগাদ দেখা গেল বুননের পুরো কাজই করছে স্বয়ংক্রিয় মেশিন।
এইচঅ্যান্ডঅ্যাম ও জারার মতো পশ্চিমা ব্রান্ডের জন্য সোয়েটার বানায় মোহাম্মদি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেন, ‘নিজেদেরকে শ্লথ করার বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রয়োগ না করার কোনো কারণ দেখি না।’ তিনি জানান, প্রায় পাঁচশ’ শ্রমিককে ছাঁটাই করে মেশিন বসানো হয়েছে তার কারখানায়। কিনতে পারেন আরও মেশিন।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে এই স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশনের প্রভাব নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের একটি প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের শিরোনামেই বলে দেয়া আছে সবকিছু। ‘দ্য রোবটস আর কামিং ফর গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স। দ্যট’স গুড ফর দ্য ইউএস, ব্যাড ফর পুর কান্ট্রিজ’ (গার্মেন্ট শ্রমিকদের হটাতে আসছে রোবট। এটা আমেরিকার জন্য ভালো, কিন্তু গরীব দেশগুলোর জন্য খারাপ।)
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বল্পমজুরির শ্রমিকরাও অটোমেশনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নন। কারণ, এখন মেশিন ও রোবট এমন সব শিল্পে পৌঁছে গেছে, যেগুলোকে আগে অটোমেশনের ধরাছোঁয়ার বাইরে ভাবা হতো। তৈরি পোশাক শিল্প কিন্তু গাড়ি বা ইলেক্ট্রনিকস নির্মান শিল্পের মতো নয়। ফলে এই শিল্প অটোমেশন থেকে সুরক্ষিত বলে মনে হতো। কাপড় নিয়ে যেকোনো কাজই বেশ কঠিন। ফলে মেশিনের চেয়ে মানুষের হাতেই এসব কাজ ভালো হতো। এছাড়া বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও চীনে এই শিল্পে এত বেশি সস্তা মজুরির শ্রমিক কাজ করতো যে, তৈরি পোশাক কারখানায় স্বয়ংক্রিয়তার ছোঁয়া আনার তাগিদ অত বোধ হতো না।
কিন্তু শ্রমিকের ব্যয় বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও। অপরদিকে প্রযুক্তি এত অগ্রসর হচ্ছে যে, মেশিনও এখন অনেক কঠিন কাজ করতে শিখে গেছে। নরম কাপড়ের ওপর কাজ করা, পকেট সেলাই করা, প্যান্টে বেল্ট লুপ যুক্ত করার মতো কাজ এখন মেশিন দিয়ে করা সম্ভব। ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের অর্থনীতিই উলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বহু গরিব দেশের (বিশেষ করে এশিয়ার) অর্থনীতিতে এই শিল্পই প্রধান ভূমিকা রেখে আসছে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি গবেষণায় অনুমান করা হয়, অটোমেশন যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে এশিয়ার কিছু দেশে বস্ত্র, বয়ন ও তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট উৎপাদন খাতের ৮০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থান হারিয়ে যাবে।
আমেরিকার প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’র এমআইটি ইনিশিয়েটিভ অন দ্য ডিজিটাল ইকোনমি’র পরিচালক এরিক ব্রায়ানজোলফসন বলেন, ‘আমি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ে চিন্তিত। এই অটোমেশন বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এসব দেশ।’ কারণ, দরিদ্র দেশে অবস্থিত কারখানায় পুনরাবৃত্তিমূলক যেসব কাজ শ্রমিকরা করতো এতদিন, তা করা শিখছে রোবট। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে বেশিরভাগ চাকরি পেতে হলে খুবই উচ্চমানের দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। এসব জায়গায় উন্নত দেশগুলোই ভালো করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সমস্যার রূপ পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন, বাংলাদেশে যে হারে শ্রমিক বাড়ছে, সেই হিসাবে তাল মেলাতে হলে প্রতি বছর ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে দেশটিকে। আর এক্ষেত্রে বস্ত্রখাতই সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, গার্মেন্ট ও বস্ত্র খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সংখ্যা বছরপ্রতি ৬০ হাজারে নেমে এসেছে। অথচ, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্তও প্রতি বছর ৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এই শিল্প। সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই শিল্পের বড় অংশ মৌলিক বস্ত্র উৎপাদন খাতে ইতিমধ্যেই কর্মসংস্থান কমা শুরু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের তৈরি পোশাক উৎপাদন কিন্তু কমেনি, বরং বাড়ছে ক্রমাগত। স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অটোমেশনই শ্রমিকদের স্থান পূরন করছে। ফলে কমছে না উৎপাদন। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যভাগে, বাংলাদেশের বার্ষিক তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ১৯.৫ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এই সময়ে চাকরি বেড়েছে মাত্র ৪.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আপনি যদি তরুণদেরকে উৎপাদনশীল কর্মে সম্পৃক্ত করাতে না পারেন, তারা কিছু একটা করবে। আর তারা যা করবে সেটা হয়তো সামাজিকভাবে সুখকর হবে না। সমাজের জন্য এটা একটা টাইম বোমা।’
তবে অটোমেশনের উপকারী দিক অবশ্যই আছে। কিন্তু তা শুধু ধনী দেশগুলোর জন্য। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি হওয়ায়, জিন্স ও অন্যান্য ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ পণ্যের দাম আরও সস্তা হবে। এমনকি তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন খাতের কিছু অংশ ফের চলে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সহ ব্যয়বহুল শ্রমবাজারে।
পোশাক কারখানার জন্য বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় মেশিন তৈরি করে আমেরিকার আটলান্টা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার অটোমেশন। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তাদের ‘সিউবোট’ বা সেলাই করার মেশিন আগামী মাসেই ব্যবহৃত হবে আরকানসাসের লিটল রকে অবস্থিত চীনের বস্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠান তিনইয়ুয়ান গার্মেন্টসের একটি কারখানায়। বিশ্ববিখ্যাত জুতো ও ক্রীড়া পোশাক তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস সম্প্রতি জার্মানিতে ‘স্পিডফ্যাক্টরি’ একটি জুতা কারখানা খুলেছে। এই কারখানায় স্বল্প মজুরির শ্রমিক নয়, ব্যবহৃত হবে কম্পিউটার চালিত স্বয়ংক্রিয় বুনন প্রযুক্তি।
অটোমেশনে উন্নয়ন দেশগুলো সুবিধা পেলেও, কপাল পুড়ছে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র্য দেশের শ্রমিকদের। নাজমা আক্তার নামে বাংলাদেশের একজন ইউনিয়ন নেতা বলেন, অটোমেশনের ফলে যেই টাকা বেঁচে যাচ্ছে, তার কারণেই কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি অগ্রাহ্য করার সাহস পাচ্ছেন। তিনি একটি সাম্প্রতিক ঘটনা উদ্ধৃত করে বলেন, একটি কারখানায় বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করলে, মালিকরা হুমকি দেন যে, তাদের পরিকল্পনামত কাজ না করলে, তারা স্রেফ স্বয়ংক্রিয় মেশিন নিয়ে আসবেন। সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট নাজমা আক্তার আরও বলেন, ‘যেসব কারখানায় আগে ৩০০ শ্রমিক ছিল এখন সেগুলোতে ১০০ জন হয়তো আছে।’
কিন্তু দেশের বড় বড় পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায়, অটোমেশনের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া তাদের বিকল্প কিছু করার নেই।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে বাংলাদেশে, তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তার ওপর বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতের খরচ পোশাকের দাম বৃদ্ধি করে পোষানোর চেষ্টা হলেও, সস্তা ফ্যাশনে অভ্যস্ত ক্রেতারা তা মানেননি। তার ওপর, সস্তা মজুরির শ্রমিক সমেত নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর আবির্ভাবও বাংলাদেশের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
জারা সহ বড় ফ্যাশন ব্রান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে বাংলাদেশের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি প্রধান নির্বাহী মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘আপনি যদি নিজেকে না পাল্টান, তাহলে আপনি পুরো ব্যবসাই হারাবেন।’ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তার বহুতলা কারখানায় ব্যবহার করা হয় স্পেনে নির্মিত ফিনিশিং মেশিন। এই মেশিন দেড় ডলারেই পাওয়া যায়। এই মেশিনের মাধ্যমে জিন্সের মধ্যে নজরকাড়া ছিদ্র সৃষ্টি করা যায়। পাশের কারখানায় কয়েক ডজন শ্রমিক এই কাজ করেন। অথচ, তাদের সবার চেয়ে অনেক নিখুঁতভাবে একই পরিমাণ কাজ করে দেয় এই মেশিন। মোস্তাফিজ আরও বলেন, ফিনিশিং দিতে গিয়ে যেসব জিন্স নষ্ট হয়, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেলাই করে দেয়ার জন্য তার কারখানায় আছে আরও ৪টি মেশিন। একটি মেশিন যে পরিমাণ সেলাই করতে পারে, তা ম্যানুয়ালি করতে লাগে ১২ জন মানুষ। তিনি বলেন, ‘মেশিন সবই করতে পারে। আপনি শুধু একে নির্দেশনা দেবেন।’ অটোমেশনের ফলে শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছে, এই অভিযোগ শুনতে অভ্যস্ত তিনি। তার মন্তব্য, ‘আমরা যদি ব্যবসাই বাঁচাতে না পারি, তাহলে বেতন আসবে কোথা থেকে?’
অটোমেশনের ফলে বাংলাদেশ এখনও সস্তা মূল্যে পোশাক রপ্তানি করতে পারছে। প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে তুলতে পারছে অন্যান্য দেশের সঙ্গে। যেমন, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ছেলেদের ট্রাউজারের দাম বাংলাদেশের কারখানায় ১২ শতাংশ কমে গেছে। মার্কিন উপাত্ত ব্যবহার করে এই তথ্য দিলেন পেনসিলভানিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক আনার।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে এক সাবেক গার্মেন্ট শ্রমিকের কাহিনীও তুলে দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ আবদুল হালিম (৪১) নামে ওই শ্রমিক গত বছর চাকরি হারান। দায়ী সেই মেশিন! পরে কিছুদিন অন্য চাকরি খুঁজলেও, অবশেষে রিকসা চালানো শুরু করেছেন তিনি।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের জন্য সমাধান হতে পারে তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে গিয়ে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা। যাতে করে উৎপাদন খাতের শ্রমিকরা এ ধরণের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কবলে পড়ে কর্মবিহীন থাকতে হয়। অন্য দেশগুলো এই পথে সফল হয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটাই। অন্য বিকল্প খাতেও এখন অটোমেশন চলছে। মোহাম্মদি গ্রুপের রুবানা হক বলেন, ‘আমরা শুধু এই গার্মেন্টসটাই করেছি, আর কিছু না। এখান থেকে কই যাবো আমরা?’
No comments