ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ: সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে নয় by উৎপল রায়
ঐতিহাসিক।
যুগান্তকারী রায়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের
হাতে ন্যস্ত করা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায়
দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল গতকাল
সর্বসম্মতিক্রমে খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে
হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে কিছু শব্দচয়ন বাদ দেয়ার (এক্সপাঞ্জ) কথা বলা
হয় রায়ে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত আপিল
বিভাগের সাত বিচারকের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গতকাল এ রায় দেন। বেঞ্চের অন্য
বিচারকগণ হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা
সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী,
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। সর্বোচ্চ
আদালতের এ রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ হিসেবেই বহাল রইলো। একই সঙ্গে
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে রইলো না। এখন থেকে এ
ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রয়োগ করতে পারবে। গতকাল আপিল বিভাগের
ঘোষিত এ রায়কে যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আইনজীবীরা।
অন্যদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল
কাদের জানান, পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হবে। তবে,
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগের এই রায়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
এর আগে গত ১লা জুন আপিলের শুনানি শেষে রায় যে কোনদিন ঘোষণা করা হবে মর্মে
তা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিল আপিল বিভাগ।
‘সরকার বনাম অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও অন্যান্য’ শীর্ষক আলোচিত এই মামলার রায়ের জন্য সোমবার (গতকাল) এটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ১ নম্বর ক্রমিকে ছিল। এমনিতে সকাল ৯টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিচারকরা এজলাসে বসেন সোয়া ১ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় পর। এর আগেই আপিল বিভাগের ১ নম্বর এজলাস কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সকাল ১০টা ২৫ মিনিট। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারক এজলাসে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। আদালত তখন জনাকীর্ণ। পিনপতন নীরবতা। আলোচিত এই রায় শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন সংশ্লিষ্ট মামলায় শুনানিতে অংশ নেয়া রাষ্ট্র ও রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী, অ্যামিকাস কিউরিগন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীরা। সকাল ১০টা ২৭ মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। মাত্র ১ মিনিটের পঠিত রায়ে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ (শব্দচয়ণ) এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করার রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।
৭২-এর ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন কীভাবে সংবিধান পরিপন্থি হয়- প্রশ্ন আইনমন্ত্রীর
১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন কীভাবে সংবিধান পরিপন্থি হয়- এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। একই সঙ্গে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি। গতকাল আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জাতীয় সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হলো কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রায়ে বিচারকগণ শুধু আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়া পর্যন্ত এই কথার জবাব দেয়া যাবে না। তবে, আমার কাছে সব সময় প্রশ্ন থাকবে যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যেটা ছিল, সেটা সামরিক সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আনার পর তা আবার সংসদ পুনঃস্থাপন করে। এখন সেটা কীভাবে সংবিধানের পরিপন্থি হয়- আমি সেটা বুঝতে পারছি না। আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যে কথাগুলো বলা আছে, সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও উন্নত দেশগুলোতে সে বিষয়গুলো আছে। তিনি বলেন, আমি পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করবো। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর আমরা কী করব, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পরই আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব। প্রয়াত সঙ্গীতজ্ঞ করুণাময় গোস্বামীর মরদেহে শ্রদ্ধা জ্ঞাপণ শেষে গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা জানান।
এই রায় ঐতিহাসিক: মনজিল মোরসেদ
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল চেয়ে করা রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ গতকাল আপিল বিভাগের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। এই রায়ের মাধ্যমে স্বাধীনতার চার দশক পর বিচার বিভাগের জন্য আরেকটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। মানুষ মনে করে সংসদের মাধ্যমে যদি বিচারকদের অপসারণ করা হতো তাহলে বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতো না। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতো। তিনি বলেন, আইনটি করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হয়েছিল, এখন আপিল বিভাগের রায়ের ফলে সেটি বেআইনি, অকার্যকর ও বাতিল হয়ে গেল। এই রায়ের ফলে আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের কোন বিরোধ হবেনা উল্লেখ করে মনজিল মোরসেদ বলেন, এটি একদমই হবে না। কারণ, আমাদের সংবিধানে বলা আছে উচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটিই চূড়ান্ত। তাই এখানে সংসদ, সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের বিরোধের কোন সুযোগ নেই। সংবিধানেই বলা আছে যে আপিল বিভাগ কোন রায় দিলে সেটি মানতে হবে।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল জরুরি ছিল: ড. শাহদীন মালিক
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেয়া রায় প্রত্যাশিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। একই সঙ্গে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা জরুরি ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় ড. শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, ১০ জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে নয়জনই মতামত দিয়েছিলেন যে, হাইকোর্টের রায় সঠিক ছিল। এ কারণে আমার প্রত্যাশা ছিল হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকবে। তিনি বলেন, ক্ষমতার পৃথককরণের যে নীতি সংবিধান ধারণ করে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের কেউ কারও ওপর সরাসরি কর্তৃত্ব করবে না। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছিল। তাই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথককরণের স্বার্থে এই সংশোধনী বাতিল করা জরুরি ছিল। সংসদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে বলে জানান এই মামলায় ইন্টারভেনার হিসেবে শুনানিতে অংশ নেয়া সংসদ সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আদালতের রায় সবার জন্য শিরোধার্য। সর্বোচ্চ আদালতের রায় সবাইকে মানতে হবে। তবে আপিল বিভাগের এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করবে। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রয়েছে।
মামলার পূর্বাপর
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত করা হয়। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করেন। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী উচ্চ আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানের কোনো পরিবর্তন করেনি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাস করে সরকার। পরে ২২শে সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংবিধানের এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। শুনানি শেষে ওই বছরের ৯ই নভেম্বর রুল জারি করে হাইকোর্ট। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ই মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। রায়ে হাইকোর্ট উল্লেখ করেন সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ ‘ইতিহাসের দুর্ঘটনা’। হাইকোর্টের এই রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন উত্তাপ ছড়ায়। এমনকি সংসদে ওয়াক আউটের ঘটনাও ঘটে। হাইকোর্টের এই রায়কে ‘সংবিধান পরিপন্থি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। হাইকোর্টের এই রায় আপিলে টিকবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ওই বছরের ১১ই আগস্ট হাইকোর্টের ১৬৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা ও মতামত দেয়ার জন্য গত ৮ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ১২ জন সিনিয়র আইনজীবীর (অ্যামিকাস কিউরি) নাম ঘোষণা করা হয়। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যাদের নাম ঘোষণা করা হয় তারা হলেন, টিএইচ খান, এম আমীর-উল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এএফ হাসান আরিফ, আজমালুল হোসেন কিউসি, শফিক আহমেদ, আবদুল ওয়াদুদ ভূইয়া, এমআই ফারুকী, এজে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম কামাল। গত ৮ই মে আপিলের শুনানি শুরু হলে আপিলের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এর শুনানি নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বাকবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটে। গত ৮ই মে এ বিষয়ে আপিলের শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিটকারিদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তার মতামত ও যুক্তি উপস্থাপন করেন। আর এ মামলায় ইন্টারভেনার হিসেবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। গত ২৪শে মে থেকে ৩০শে মে পর্যন্ত ১০ জন সিনিয়র আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে এ বিষয়ে তাদের মতামত আদালতে উপস্থাপন করেন। সিনিয়র আইনজীবী রফিক-উল হক ও শফিক আহমেদ শুনানিতে অংশ নেননি। শুনানিতে অংশ নেয়া ১০ অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে ৯জনই ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের যৌক্তিকতা তুলে তা বাতিলের পক্ষে মত দেন। শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে তার মতামত তুলে ধরেন। মোট ১১ কার্যদিবসে শুনানি শেষ হয়।
‘সরকার বনাম অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও অন্যান্য’ শীর্ষক আলোচিত এই মামলার রায়ের জন্য সোমবার (গতকাল) এটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ১ নম্বর ক্রমিকে ছিল। এমনিতে সকাল ৯টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিচারকরা এজলাসে বসেন সোয়া ১ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় পর। এর আগেই আপিল বিভাগের ১ নম্বর এজলাস কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সকাল ১০টা ২৫ মিনিট। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারক এজলাসে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। আদালত তখন জনাকীর্ণ। পিনপতন নীরবতা। আলোচিত এই রায় শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন সংশ্লিষ্ট মামলায় শুনানিতে অংশ নেয়া রাষ্ট্র ও রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী, অ্যামিকাস কিউরিগন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীরা। সকাল ১০টা ২৭ মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। মাত্র ১ মিনিটের পঠিত রায়ে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ (শব্দচয়ণ) এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করার রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।
৭২-এর ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন কীভাবে সংবিধান পরিপন্থি হয়- প্রশ্ন আইনমন্ত্রীর
১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন কীভাবে সংবিধান পরিপন্থি হয়- এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। একই সঙ্গে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি। গতকাল আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জাতীয় সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হলো কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রায়ে বিচারকগণ শুধু আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়া পর্যন্ত এই কথার জবাব দেয়া যাবে না। তবে, আমার কাছে সব সময় প্রশ্ন থাকবে যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যেটা ছিল, সেটা সামরিক সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আনার পর তা আবার সংসদ পুনঃস্থাপন করে। এখন সেটা কীভাবে সংবিধানের পরিপন্থি হয়- আমি সেটা বুঝতে পারছি না। আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যে কথাগুলো বলা আছে, সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও উন্নত দেশগুলোতে সে বিষয়গুলো আছে। তিনি বলেন, আমি পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করবো। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর আমরা কী করব, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পরই আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব। প্রয়াত সঙ্গীতজ্ঞ করুণাময় গোস্বামীর মরদেহে শ্রদ্ধা জ্ঞাপণ শেষে গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা জানান।
এই রায় ঐতিহাসিক: মনজিল মোরসেদ
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল চেয়ে করা রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ গতকাল আপিল বিভাগের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। এই রায়ের মাধ্যমে স্বাধীনতার চার দশক পর বিচার বিভাগের জন্য আরেকটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। মানুষ মনে করে সংসদের মাধ্যমে যদি বিচারকদের অপসারণ করা হতো তাহলে বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতো না। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতো। তিনি বলেন, আইনটি করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হয়েছিল, এখন আপিল বিভাগের রায়ের ফলে সেটি বেআইনি, অকার্যকর ও বাতিল হয়ে গেল। এই রায়ের ফলে আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের কোন বিরোধ হবেনা উল্লেখ করে মনজিল মোরসেদ বলেন, এটি একদমই হবে না। কারণ, আমাদের সংবিধানে বলা আছে উচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটিই চূড়ান্ত। তাই এখানে সংসদ, সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের বিরোধের কোন সুযোগ নেই। সংবিধানেই বলা আছে যে আপিল বিভাগ কোন রায় দিলে সেটি মানতে হবে।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল জরুরি ছিল: ড. শাহদীন মালিক
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেয়া রায় প্রত্যাশিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। একই সঙ্গে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা জরুরি ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় ড. শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, ১০ জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে নয়জনই মতামত দিয়েছিলেন যে, হাইকোর্টের রায় সঠিক ছিল। এ কারণে আমার প্রত্যাশা ছিল হাইকোর্টের রায়ই বহাল থাকবে। তিনি বলেন, ক্ষমতার পৃথককরণের যে নীতি সংবিধান ধারণ করে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের কেউ কারও ওপর সরাসরি কর্তৃত্ব করবে না। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছিল। তাই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথককরণের স্বার্থে এই সংশোধনী বাতিল করা জরুরি ছিল। সংসদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে বলে জানান এই মামলায় ইন্টারভেনার হিসেবে শুনানিতে অংশ নেয়া সংসদ সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আদালতের রায় সবার জন্য শিরোধার্য। সর্বোচ্চ আদালতের রায় সবাইকে মানতে হবে। তবে আপিল বিভাগের এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করবে। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রয়েছে।
মামলার পূর্বাপর
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত করা হয়। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করেন। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী উচ্চ আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানের কোনো পরিবর্তন করেনি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাস করে সরকার। পরে ২২শে সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংবিধানের এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। শুনানি শেষে ওই বছরের ৯ই নভেম্বর রুল জারি করে হাইকোর্ট। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ই মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। রায়ে হাইকোর্ট উল্লেখ করেন সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ ‘ইতিহাসের দুর্ঘটনা’। হাইকোর্টের এই রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন উত্তাপ ছড়ায়। এমনকি সংসদে ওয়াক আউটের ঘটনাও ঘটে। হাইকোর্টের এই রায়কে ‘সংবিধান পরিপন্থি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। হাইকোর্টের এই রায় আপিলে টিকবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ওই বছরের ১১ই আগস্ট হাইকোর্টের ১৬৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা ও মতামত দেয়ার জন্য গত ৮ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ১২ জন সিনিয়র আইনজীবীর (অ্যামিকাস কিউরি) নাম ঘোষণা করা হয়। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যাদের নাম ঘোষণা করা হয় তারা হলেন, টিএইচ খান, এম আমীর-উল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এএফ হাসান আরিফ, আজমালুল হোসেন কিউসি, শফিক আহমেদ, আবদুল ওয়াদুদ ভূইয়া, এমআই ফারুকী, এজে মোহাম্মদ আলী, ফিদা এম কামাল। গত ৮ই মে আপিলের শুনানি শুরু হলে আপিলের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এর শুনানি নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বাকবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটে। গত ৮ই মে এ বিষয়ে আপিলের শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিটকারিদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তার মতামত ও যুক্তি উপস্থাপন করেন। আর এ মামলায় ইন্টারভেনার হিসেবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। গত ২৪শে মে থেকে ৩০শে মে পর্যন্ত ১০ জন সিনিয়র আইনজীবী অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে এ বিষয়ে তাদের মতামত আদালতে উপস্থাপন করেন। সিনিয়র আইনজীবী রফিক-উল হক ও শফিক আহমেদ শুনানিতে অংশ নেননি। শুনানিতে অংশ নেয়া ১০ অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে ৯জনই ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের যৌক্তিকতা তুলে তা বাতিলের পক্ষে মত দেন। শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে তার মতামত তুলে ধরেন। মোট ১১ কার্যদিবসে শুনানি শেষ হয়।
No comments