বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কেন তিস্তাচুক্তি দরকার?
বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে তা হলো- তিস্তা নদী
থেকে প্রায় ৪৮ ভাগ পানি বাংলাদেশকে ছেড়ে দেয়া। যদিও বাংলাদেশি দৈনিক ডেইলি
স্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী এবারের সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি কোনো
এজেন্ডায় নেই। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা (জিবিএম) নদী ব্যবস্থার বাইরে
ভারত-বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম আন্তঃসীমান্ত নদী হলো তিস্তা। জিবিএম
এলাকার মোট ক্যাচমেন্ট এলাকা হচ্ছে প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার।
ভারতীয় রাজ্য সিকিমে তিস্তার উৎপত্তি। নদীটির দৈর্ঘ্য ৪১৪ কিমি.। এর মধ্যে
১৫১ কিমি. সিকিমে, পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে গেছে ১৪২ কিমি. এবং বাংলাদেশের
মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে আরো ১২১ কিমি.। বাংলাদেশে নদীটি মূলত পাঁচটি
উত্তরাঞ্চলীয় জেলাকে প্রভাবিত করেছে। এগুলো হচ্ছে- গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম,
লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং রংপুর। তিস্তা বিষয়ে ২০০৩ সালের এশিয়া
ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ফ্ল্যাড প্লেইন এলাকা হিসেবে বাংলাদেশের মোট
আবাদি জমির প্রায় ১৪ ভাগ কাভার করেছে তিস্তা। এবং তা দেশটির জনসংখ্যার
প্রায় ৭.৩ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য সরাসরি জীবিকার ব্যবস্থা করেছে।
বিরোধের উৎপত্তি কোথায়?
ঐতিহাসিকভাবে এই নদী নিয়ে বিরোধের শেকড় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বাউন্ডারি কমিশনের রিপোর্টে। ১৯৪৭ সালে স্যার সিরিল রেডক্লিফ-এর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সীমানা চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে এটি গঠিত হয়েছিল। বাউন্ডারি কমিশনের কাছে দেয়া রিপোর্টে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলা দাবি করেছিল। আর তাদের যুক্তি ছল এই জেলাগুলো তিস্তা নদী ব্যবস্থার অন্তর্গত এলাকায় অবস্থিত। এটা ভাবা হয়েছিল যে, ওই দুটি জেলা করতলগত হলে তিস্তা নদীর ওপরে ভবিষ্যতে জলবিদ্যুৎ স্থাপন করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের স্বার্থ সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার সদস্যরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা তাদের উভয়ের প্রতিবেদনে দুই জেলার ওপর তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চূড়ান্ত ঘোষণায় যাতে আঞ্চলিক জনসংখ্যাতাত্ত্বিক গঠন, প্রশাসনিক বিবেচনা এবং অন্যান্য বিষয় (রেলপথ, নদীপথ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায়) গুরুত্ব পায় তা আশা করা হয়েছিল। বাউন্ডারি কমিশন তিস্তা ক্যাচমেন্টের উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতকে দিয়েছিল। দার্জিলিং জলপাইগুড়ির উল্লেখযোগ্য এলাকা ভারতকে দিয়ে দেয়ার প্রধান কারণ ছিল, এই দুটি জেলাই ছিল অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই সময় দার্জিলিং-এর মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২.৪২ ভাগ এবং জলপাইগুড়ির ২৩.০২ ভাগ। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ তাদের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে ‘অন্যান্য বিষয়’ বিবেচনায় নিয়েছিল।
পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ থাকার দিনগুলোতে পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও পূর্বপাকিস্তানের মধ্যে কোনো গুরুতর আলোচনা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সার্বভৌম অভ্যুদয়ের পরে ভারত ও বাংলাদেশ তাদের আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ১৯৭২ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। তারা তাদের আলোচনার গোড়ার বছরগুলোতে উভয় দেশের পানি বিষয়ক আমলাদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ ছিল, গঙ্গার পানি ভাগাভাগি কেমন হবে তা নিয়ে। সেই সঙ্গে আরো ছিল ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ এবং ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা থেকে পানির হিস্যা বণ্টন। যদিও দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন আলোচনায় এসেছে কিন্তু সে আলোচনায় গতি লাভ করেছে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানি চুক্তি সম্পাদনের পরে।
১৯৮৩ সালের একটি অ্যাডহক চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ তিস্তার পানি প্রবাহের ৩৬ শতাংশ এবং ভারত ৩৯ শতাংশ এবং বাদবাকি ২৫ শতাংশ অবণ্টিত অবস্থায় ছিল। গঙ্গা চুক্তির পরে অন্যান্য নদীর পানি পর্যালোচনা করতে জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্ট গঠিত হলো। ২০০০ সালে তিস্তা বিষয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থানের খসড়া পেশ করেছিল। ২০১০ সালে এর চূড়ান্ত খসড়া ভারত ও বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছিল। ২০১১ সালে ভারতের প্রধামন্ত্রী মনমোহন সিং বংলাদেশ সফরকালে দুদেশের মধ্যে চুক্তির বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তিনি তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিলেন, তিনি চুক্তির বিরোধিতা করেন। এমনকি নরেন্দ্র মোদির সরকারও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তির বিষয়টি মেনে নেয়। কিন্তু মমতা মেনে নেননি। ২০১৫ সালে মোদির ঢাকার সফরকালে দুদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তির দলিল বিনিময়কালে ব্যানার্জী তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। কিন্তু তিস্তা নদীর বণ্টন বিষয়ে তিনি নীরবতা পালন করেন।
চলমান ইস্যু
ভারতের সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীয় সরকারকে যদিও যেকোনো আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রশ্নে চুক্তিতে পৌঁছাতে ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু ক্যাচমেন্ট এলাকার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা তা করতে পারে না।
এখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানির হিস্যা বণ্টনের শতকরা হিসাব নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর মনে বিভ্রান্তি জন্মেছে। তিস্তা বিষয়ক নতুন চুক্তি গ্রহণ করতে না পারার দিক থেকে এটা অন্যতম কারণ। এই সমঝোতা বলছে, বাংলাদেশ ৪৮ ভাগ পানি পাবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, রূপক ভট্টাচার্য লিখেছেন, মমতা ব্যানার্জী ২০১১ সালে বিশ্বাস করেছিলেন যে, প্রস্তাবিত চুক্তির আওতায় ২৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ পাবে ৩৩ হাজার কিউসেক। মমতা বলেছেন, বাংলাদেশকে এত বেশি পরিমাণ পানি দিলে তাঁর রাজ্যের পাঁচটি জেলার সেচ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এগুলো হচ্ছে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ ও উত্তর দিনাজপুর এবং দার্জিলিং। এগুলো তাঁর রাজ্যের দরিদ্রতম এলাকাগুলোর অন্যতম।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পানিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট আকারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে তা পেশ করেছিলেন। এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। তবে এই বিষয়ে রুদ্র’র একাডেমিক লেখালেখি ইতিমধ্যে সুবিদিত। ২০০৩ সালে দি ইকোলজিস্ট এশিয়ায় প্রকাশিত নিবন্ধে জলপাইগুড়ি জেলায় তিস্তা বাঁধপ্রকল্প এবং দার্জিলিং জেলায় ন্যাশনাল হাইড্রো পাওয়ার করপোরেশনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বৃহৎ প্রকল্পের বিষয়ে তার মনোভাব সমালোচনামূলক। তিনি লিখেছেন, ‘চরপড়া একটি বড় সমস্যা। এবং প্রকল্পগুলোর যে সামর্থ্য স্থির করা হয়েছিল তা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। এবং তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গোটা প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রিজার্ভার থেকে পানি উধাও হয়ে যাচ্ছে। খালগুলো থেকে পানি নিঃশেষিত হচ্ছে। এরফলে প্রকল্প পরিকল্পনার সময় কমান্ড এলাকায় যে ধরনের পানি থাকার কথা ছিল, তা থেকে প্রান্তিক ভূমি বঞ্চিত হচ্ছে। ড্যামগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা বন্যার প্রকোপ কমাবে। কিন্তু ভরা মৌসুমে বাড়তি পানি ছেড়ে দিয়ে বিরাট বন্যা তৈরি করা হচ্ছে।’ রুদ্র তার নিবন্ধে প্রস্তাবিত বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে তিস্তার উপরে চাপ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তার কথায়, ‘এটা করা হলে সেচ কাজে নদীর পানি বেশি ব্যবহার করা সম্ভব হবে।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে এটা অনুমান করা হচ্ছে যে, বর্ষা মৌসুমে সম্ভবত ৬৫/৩৫ কিংবা ৬০/৪০ ভাগ এবং শুকনো (যখন পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ এবং বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল খরা দেখা দেয়) মৌসুমে ৭০/৩০ অনুপাতে ভাগ করা হবে। অনুপাতের এ ভিত্তি অবশ্য বাংলাদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ তিস্তা থেকে তাদের প্রয়োজন পড়ে মূলত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে সব থেকে শুষ্ক পরিস্থিতিতে। তবে তিস্তায় মার্চ এবং এপ্রিলের মধ্যে পরিস্থিতি সবথেকে খারাপ রূপ নেয়, যখন তিস্তার পানি প্রবাহ প্রায়শ পাঁচ হাজার কিউসেক থেকে এক হাজার কিউসেকে নেমে আসে।
উভয় দেশের সরকারের জন্য তিস্তা বিষয়ে একটি সফল সমাধানে পৌঁছানোকে রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় মনে করা হয়।
২৯শে মার্চের দি ওয়্যারের সৌজন্যে।
বিরোধের উৎপত্তি কোথায়?
ঐতিহাসিকভাবে এই নদী নিয়ে বিরোধের শেকড় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বাউন্ডারি কমিশনের রিপোর্টে। ১৯৪৭ সালে স্যার সিরিল রেডক্লিফ-এর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সীমানা চিহ্নিতকরণের লক্ষ্যে এটি গঠিত হয়েছিল। বাউন্ডারি কমিশনের কাছে দেয়া রিপোর্টে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলা দাবি করেছিল। আর তাদের যুক্তি ছল এই জেলাগুলো তিস্তা নদী ব্যবস্থার অন্তর্গত এলাকায় অবস্থিত। এটা ভাবা হয়েছিল যে, ওই দুটি জেলা করতলগত হলে তিস্তা নদীর ওপরে ভবিষ্যতে জলবিদ্যুৎ স্থাপন করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের স্বার্থ সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার সদস্যরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা তাদের উভয়ের প্রতিবেদনে দুই জেলার ওপর তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চূড়ান্ত ঘোষণায় যাতে আঞ্চলিক জনসংখ্যাতাত্ত্বিক গঠন, প্রশাসনিক বিবেচনা এবং অন্যান্য বিষয় (রেলপথ, নদীপথ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায়) গুরুত্ব পায় তা আশা করা হয়েছিল। বাউন্ডারি কমিশন তিস্তা ক্যাচমেন্টের উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতকে দিয়েছিল। দার্জিলিং জলপাইগুড়ির উল্লেখযোগ্য এলাকা ভারতকে দিয়ে দেয়ার প্রধান কারণ ছিল, এই দুটি জেলাই ছিল অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই সময় দার্জিলিং-এর মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২.৪২ ভাগ এবং জলপাইগুড়ির ২৩.০২ ভাগ। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ তাদের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে ‘অন্যান্য বিষয়’ বিবেচনায় নিয়েছিল।
পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ থাকার দিনগুলোতে পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও পূর্বপাকিস্তানের মধ্যে কোনো গুরুতর আলোচনা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সার্বভৌম অভ্যুদয়ের পরে ভারত ও বাংলাদেশ তাদের আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ১৯৭২ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। তারা তাদের আলোচনার গোড়ার বছরগুলোতে উভয় দেশের পানি বিষয়ক আমলাদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ ছিল, গঙ্গার পানি ভাগাভাগি কেমন হবে তা নিয়ে। সেই সঙ্গে আরো ছিল ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ এবং ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা থেকে পানির হিস্যা বণ্টন। যদিও দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন আলোচনায় এসেছে কিন্তু সে আলোচনায় গতি লাভ করেছে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানি চুক্তি সম্পাদনের পরে।
১৯৮৩ সালের একটি অ্যাডহক চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ তিস্তার পানি প্রবাহের ৩৬ শতাংশ এবং ভারত ৩৯ শতাংশ এবং বাদবাকি ২৫ শতাংশ অবণ্টিত অবস্থায় ছিল। গঙ্গা চুক্তির পরে অন্যান্য নদীর পানি পর্যালোচনা করতে জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্ট গঠিত হলো। ২০০০ সালে তিস্তা বিষয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থানের খসড়া পেশ করেছিল। ২০১০ সালে এর চূড়ান্ত খসড়া ভারত ও বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছিল। ২০১১ সালে ভারতের প্রধামন্ত্রী মনমোহন সিং বংলাদেশ সফরকালে দুদেশের মধ্যে চুক্তির বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তিনি তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিলেন, তিনি চুক্তির বিরোধিতা করেন। এমনকি নরেন্দ্র মোদির সরকারও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার চুক্তির বিষয়টি মেনে নেয়। কিন্তু মমতা মেনে নেননি। ২০১৫ সালে মোদির ঢাকার সফরকালে দুদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তির দলিল বিনিময়কালে ব্যানার্জী তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। কিন্তু তিস্তা নদীর বণ্টন বিষয়ে তিনি নীরবতা পালন করেন।
চলমান ইস্যু
ভারতের সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীয় সরকারকে যদিও যেকোনো আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রশ্নে চুক্তিতে পৌঁছাতে ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু ক্যাচমেন্ট এলাকার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা তা করতে পারে না।
এখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানির হিস্যা বণ্টনের শতকরা হিসাব নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর মনে বিভ্রান্তি জন্মেছে। তিস্তা বিষয়ক নতুন চুক্তি গ্রহণ করতে না পারার দিক থেকে এটা অন্যতম কারণ। এই সমঝোতা বলছে, বাংলাদেশ ৪৮ ভাগ পানি পাবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, রূপক ভট্টাচার্য লিখেছেন, মমতা ব্যানার্জী ২০১১ সালে বিশ্বাস করেছিলেন যে, প্রস্তাবিত চুক্তির আওতায় ২৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ পাবে ৩৩ হাজার কিউসেক। মমতা বলেছেন, বাংলাদেশকে এত বেশি পরিমাণ পানি দিলে তাঁর রাজ্যের পাঁচটি জেলার সেচ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এগুলো হচ্ছে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ ও উত্তর দিনাজপুর এবং দার্জিলিং। এগুলো তাঁর রাজ্যের দরিদ্রতম এলাকাগুলোর অন্যতম।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পানিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট আকারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে তা পেশ করেছিলেন। এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। তবে এই বিষয়ে রুদ্র’র একাডেমিক লেখালেখি ইতিমধ্যে সুবিদিত। ২০০৩ সালে দি ইকোলজিস্ট এশিয়ায় প্রকাশিত নিবন্ধে জলপাইগুড়ি জেলায় তিস্তা বাঁধপ্রকল্প এবং দার্জিলিং জেলায় ন্যাশনাল হাইড্রো পাওয়ার করপোরেশনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বৃহৎ প্রকল্পের বিষয়ে তার মনোভাব সমালোচনামূলক। তিনি লিখেছেন, ‘চরপড়া একটি বড় সমস্যা। এবং প্রকল্পগুলোর যে সামর্থ্য স্থির করা হয়েছিল তা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। এবং তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গোটা প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রিজার্ভার থেকে পানি উধাও হয়ে যাচ্ছে। খালগুলো থেকে পানি নিঃশেষিত হচ্ছে। এরফলে প্রকল্প পরিকল্পনার সময় কমান্ড এলাকায় যে ধরনের পানি থাকার কথা ছিল, তা থেকে প্রান্তিক ভূমি বঞ্চিত হচ্ছে। ড্যামগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা বন্যার প্রকোপ কমাবে। কিন্তু ভরা মৌসুমে বাড়তি পানি ছেড়ে দিয়ে বিরাট বন্যা তৈরি করা হচ্ছে।’ রুদ্র তার নিবন্ধে প্রস্তাবিত বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে তিস্তার উপরে চাপ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তার কথায়, ‘এটা করা হলে সেচ কাজে নদীর পানি বেশি ব্যবহার করা সম্ভব হবে।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে এটা অনুমান করা হচ্ছে যে, বর্ষা মৌসুমে সম্ভবত ৬৫/৩৫ কিংবা ৬০/৪০ ভাগ এবং শুকনো (যখন পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ এবং বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল খরা দেখা দেয়) মৌসুমে ৭০/৩০ অনুপাতে ভাগ করা হবে। অনুপাতের এ ভিত্তি অবশ্য বাংলাদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ তিস্তা থেকে তাদের প্রয়োজন পড়ে মূলত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে সব থেকে শুষ্ক পরিস্থিতিতে। তবে তিস্তায় মার্চ এবং এপ্রিলের মধ্যে পরিস্থিতি সবথেকে খারাপ রূপ নেয়, যখন তিস্তার পানি প্রবাহ প্রায়শ পাঁচ হাজার কিউসেক থেকে এক হাজার কিউসেকে নেমে আসে।
উভয় দেশের সরকারের জন্য তিস্তা বিষয়ে একটি সফল সমাধানে পৌঁছানোকে রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় মনে করা হয়।
২৯শে মার্চের দি ওয়্যারের সৌজন্যে।
No comments