বাবাকে খুঁজছে ছোট্ট তিন শিশু
বেডরুমে
বসে চার মাস বয়সী নুবাইদকে আদর করছিলেন নুরুল আলম নুরু। অন্য দুই সন্তান
উম্মে হাবিবা (১০) আর নাইমুলও (৪) খুনসুটি করছিল বাবার সঙ্গে। অবুঝ এই তিন
শিশু কি জানত এই দিনটিই হবে বাবার সঙ্গে তাদের আদর ভাগাভাগির শেষ দিন।
নুরুল আলমই কি জানতেন পরম আরাধ্য সন্তানদের সঙ্গে এটিই তার শেষ দেখা।
বুধবার রাত তখন প্রায় ১২টা। কড়া নাড়ার শব্দে পাশের কক্ষ থেকে উঠে গিয়ে দরজা
খুলে দেন নুরুল আলমের ভাগ্নে রাশেদ। ভেবেছিলেন, বাসার ডিসলাইনের সমস্যা,
হয়তো ক্যাবল আপারেটরদের কেউ এসেছেন। কিন্তু দরজা খুলেই দেখেন পুলিশের পোশাক
পরা কয়েকজন, মুখোশধারী একজনসহ ১০-১২ জন। জানতে চান কেন এসেছেন। কথা শুনে
উঠে আসেন নুরু। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই এক ‘পুলিশ’ সদস্য হাতকড়া পরিয়ে
দেন।
বলেন, আমাদের সঙ্গে চলেন। দোতলা ভবনের নিচতলার বাসা থেকে দ্রুত তাকে
একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় তারা। বাবাকে তুলে নিয়ে যেতে দেখে
কেঁদে উঠে বড় সন্তান উন্মে হাবিবা। কিন্তু সেই কান্না ‘পুলিশ’ সদস্যদের মন
গলাতে পারেনি। পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে খবর আসে নুরুল আলমের হাত-পা বাঁধা
লাশ উদ্ধার হয়েছে তার গ্রামের বাড়ি রাউজানের নোয়ানাপাড়া ইউনিয়নের নিকটবর্তী
বাগোয়ান ইউনিয়নে কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে। পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়ার ১২
ঘণ্টা পর নুরুর এমন মৃত্যুর খবরে পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। একই সঙ্গে
নুরুল আলমের ছোট ছোট তিন শিশুসন্তানের জীবনেও নেমে আসে অন্ধকার। এতিম হয়ে
যায় তারা। নুরুর বড় সন্তান উম্মে হাবিবা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তার ছোট ভাই
নাইমুল এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। আর চার মাস বয়সী নুবাইদ বাবা কী জিনিস এখনও
বোঝে না। শুক্রবার চকবাজার থানার চন্দনপুরার বাসায় গিয়ে দেখা যায় স্বজনদের
ভিড়। স্ত্রী উম্মে কাউসার বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। বড় মেয়ে উম্মে হাবিবাও
পুরোপুরি বুঝে ওঠেনি। আর দুই অবোধ শিশু তো জানেই না কী হয়েছে তাদের বাসায়।
তারা বারবার বাবার খোঁজ করছে। বাসায় কেন এত লোকজন তা জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু
তাদের বাবা যে আর নেই- এই নির্দয় কথাটি কেউই শোনাতে পারছে না তাদের। নুরুর
ভাগ্নে রাশেদ বলেন, রাতে বাসা থেকে মামাকে তুলে নেয়ার পর তারা সব জায়গায়
ফোন করেছি। থানায় ফোন করেছি। পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন করেছি। বিএনপির নেতাদের
কাছে ফোন করেছি।
মামাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা
জানতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাই। ভেবেছিলাম হয়তো থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। রাজনৈতিক
কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে, পরদিন আদালতে চালান দেবেন। কিন্তু এভাবে হত্যা
করে লাশ নদীতে ফেলে দেবে কখনও ভাবিনি। ছোট ছোট মামাতো ভাইবোন- উন্মে
হাবিবা, নাইমুল আর নুবাইদার কী হবে? বারবার বাবার খোঁজ করছে তারা। তাদের
এখন কে দেখবে? নুরুল আলম নুরু ব্যবসা করতেন পাথরের। সিলেট থেকে পাথর নিয়ে
চট্টগ্রামে বিক্রি করতেন। ঢাকায়ও রয়েছে ব্যবসা। বেশির ভাগ সময় ব্যবসার কাজে
বাইরে থাকতেন। পাশাপাশি ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। তিন দিন আগে ঢাকা থেকে
আসেন নুরু। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নোংরা রাজনীতির খেলা যারা খেলছেন তারা কি এই
শিশুসন্তানদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাবেন কখনও?
No comments