বীরের মর্যাদায় সমাহিত আজাদ
লে.
কর্নেল আজাদ তার প্রিয় কর্মস্থল র্যাব সদর দফতরে এলেন দুপুর পৌনে ২টায়।
তখন সদর দফতরের সামনের খোলা চত্বর কানায় কানায় পূর্ণ। গাড়ি বারান্দার নিচে,
সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানাতে প্রস্তুত সশস্ত্র র্যাব সদস্যরা। পাশের
অস্থায়ী ছাউনির নিচে কয়েকশ’ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে। আজাদকে
বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স সদর দফতর চত্বরে ঢুকতেই এক জওয়ান সুউচ্চ কণ্ঠে দীর্ঘ
আওয়াজে বলে উঠলেন সাবধান। স্যার আসছেন। এভাবেই দীর্ঘদিনের কর্মস্থল র্যাব
সদর দফতরে ফিরলেন গোয়েন্দাপ্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। তবে এবার
এলেন চিরদিনের মতো বিদায় নিতে। শ্বেতশুভ্র কফিনে মোড়ানো লাশ হয়ে এলেন প্রিয়
কর্মস্থলে। কর্নেল আজাদকে বহনকারী বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স র্যাব সদর দফতরে
ঢোকে দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে। কিন্তু সকাল থেকেই তাকে সামরিক কায়দায় শ্রদ্ধা
জানানোর প্রস্তুতি চলছিল।
বেলা আড়াইটার দিকে র্যাব সদর দফতরে একে একে
উপস্থিত হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড. কামাল উদ্দীন আহমেদ, আইজিপি
শহীদুল হক, অতিরিক্ত আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর
আহমেদ ও র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল
আহসানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। বেলা ২টা ৪৭ মিনিটে অতিরিক্ত মহাপরিচালক
(অপারেশন্স) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে র্যাবের বিভিন্ন
ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আজাদের কফিন নামিয়ে আনেন। এরপর পর্যায়ক্রমে তার কফিনে
ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ কফিনে ফুল
দিতে গিয়ে আবেগ সংবরণ করতে পারেননি। তার দু’চোখ অশ্রুশিক্ত হয়ে ওঠে। কর্নেল
আজাদকে বহনকারী কফিনটি সেনাবাহিনী ও র্যাবের পতাকায় মোড়ানো ছিল। কফিনে
সশস্ত্র সালাম জানায় র্যাবের একটি সশস্ত্র দল। এ সময় বিউগলে করুণ সুর
বাজানো হয়। র্যাব সদর দফতরে দ্বিতীয় জানাজা শেষে সামরিক রীতি অনুযায়ী
কর্নেল আজাদের কফিনের ওপর তার নেমব্যাচ, র্যাংক ব্যাচ, মেডেল ও টুপি রাখা
হয়। এরপর কফিন নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর সামরিক কবরস্থানে। সেখানে আগে থেকেই
অপেক্ষায় ছিলেন তার কোর্সমেট, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও
উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা। কবরস্থান সংলগ্ন খোলা চত্বরে
সামরিক কায়দায় বিশেষভাবে সজ্জিত একটি কামানবাহী গাড়িতে কফিনটি রাখা হয়।
সেনা রেওয়াজ অনুযায়ী কফিনসহ গাড়িটি টেনে নিয়ে যান তার কোর্সমেটরা। এ সময়
তারা সবাই শোকের প্রতীক হিসেবে সেরিমোনিয়াল পোশাকের সঙ্গে কালো কাপড়ের আর্ম
ব্যান্ড পরেন। কবরে নামানোর আগে আরেক দফা সামরিক কায়দায় সালাম জানায় চৌকস
সেনা সদস্যদের সুসজ্জিত একটি দল। তারা পর পর তিনবার ফাঁকা গুলি (হলি ফায়ার)
ছোড়েন। এ সময় একসঙ্গে কয়েকটি চাইনিজ রাইফেলের ফায়ারিংয়ের আওয়াজে
কবরস্থানের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ফায়ারিং শেষ হলে বিউগলে করুণ
সুর বাজানো হয়। দাফনের প্রথমভাগে অংশ নেন পরিবারের সদস্য, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এরপর তার সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও গণমাধ্যকর্মীরা
দাফন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। দাফন শেষে সেনাবাহিনী প্রধানের পক্ষ থেকে
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মতিউর রহমান কবরে ফুল দিয়ে
শ্রদ্ধা জানান। এরপর মেজর জেনারেল মতিউর রহমান প্রয়াত কর্নেল আজাদের স্ত্রী
সুরাইয়া সুলতানার হাতে সেনাবাহিনীর পতাকা তুলে দেন। একইসঙ্গে র্যাবের
পতাকা তুলে দেন র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এরপর র্যাব, বাংলাদেশ
ক্রাইম রিপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকাস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সমিতির পক্ষ থেকে
তার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সবাই তার আত্মার শান্তি কামনা করে
মহান আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করেন। প্রসঙ্গত, গত ২৫ মার্চ সিলেটের
শিববাড়ির আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অংশ নেন লে. কর্নেল আজাদ।
শেষ
বিকালের দিকে একটি পরিত্যক্ত বোমা বিস্ফোরণে তিনি গুরুতর আহত হন। গুরুতর
অবস্থায় রাতে হেলিকপ্টারে করে তাকে ঢাকা সিএমএইচে আনা হয়। পরে উন্নত
চিকিৎসার জন্য ২৬ মার্চ রাত ৮টায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে
মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে তার অবস্থার কোনো
উন্নতি হয়নি। এরপর তাকে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায়
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
র্যাব সদর দফতর থেকে রাত ১টায় তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে গণমাধ্যমে
বার্তা পাঠানো হয়। এদিকে শুক্রবার দাফন শেষে এক প্রতিক্রিয়ায় র্যাব
মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ কতটা ভারি হতে
পারে আজ তিনি তা উপলব্ধি করতে পারছেন। কর্নেল আজাদকে হারানোর শোক কাটিয়ে
উঠতে তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চান। কর্নেল আজাদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী
র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান যুগান্তরকে
বলেন, গত সপ্তাহেই কর্নেল আজাদ ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ
করতে যান। আজাদ তাকে বলেন, ‘স্যার আপনি তো বিদেশে যাচ্ছেন। বাইরে থেকে এসে
দেখবেন আমি চলে গেছি। দোয়া করবেন স্যার। আমি ২৭ মার্চ বিজিবিতে জয়েন করব।’
ব্রিগেডিয়ার জিয়া অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, ‘অসময়ে আজাদের এমন চলে যাওয়া তিনি
কিছুতেই মানতে পারছেন না।’ বনানীর সামরিক কবরস্থানে দাফনের আগে জুমার
নামাজের পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে
সেনাপ্রধানসহ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা আজাদকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।
স্পিন্টারের
আঘাতেই মৃত্যু : মস্তিষ্কে বোমার স্পিন্টারের আঘাতেই লে. কর্নেল আবুল
কালাম আজাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। শুক্রবার
সকালে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান
ডাক্তার সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, আবুল কালাম আজাদের বাম চোখে
স্পিন্টার ঢুকে মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করে। এতে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের কারণে
তার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তের সময় প্রায় ২ মিলিমিটারের একটি স্পিন্টার বের
করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার বাম চোখটি সম্পূর্ণ ড্যামেজ হয়ে
গিয়েছিল। এছাড়া তার শরীরের আর কোনো স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এদিকে
আজাদের অকাল মৃত্যুতে তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে
এসেছে। যুগান্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি ইমতিয়ার ফেরদৌস সুইট জানান,
র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান আবুল কালাম আজাদের পৈতৃক বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জেলার শিবগঞ্জ থানার মনাকসা ইউনিয়নের সহাপাড়া গ্রামে। তার শ্বশুরবাড়িও একই
এলাকায়। এলাকার এই কৃতীসন্তানের এমন অকাল মৃত্যুতে কাঁদছেন তার স্বজন ও
শুভান্যুধায়ীরা। কর্নেল আজাদের চাচা আফসার আলী জানান, শিবগঞ্জের সাবেক সংসদ
সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত ডা. মইন উদ্দিন আহাম্মেদ
মন্টুর ছোট মেয়ের সঙ্গে আজাদের বিয়ে হয়। বাবা রেজাউল করিমের সরকারি চাকরির
সুবাদে ঢাকাতেই বড় হয়েছেন আবুল কালাম আজাদ ও তার ছোট ভাই ইউসুফ হিমেল। বাবা
মারা যাওয়ার পর মা সায়েদা খানমকে নিজের কাছেই রেখেছিলেন তিনি। তবে
শ্বশুরবাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ হওয়ায় মাঝেমধ্যেই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে মনকসায়
বেড়াতে যেতেন। মেধাবী এই সেনা কর্মকর্তার এমন অকাল মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে
নিতে পারছেন না তার স্বজনরা। তার শ্যালক স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের
(স্বাচিপ) নেতা ডা. শিমুল জানান, কর্নেল আজাদের বড় ছেলে জারিফ ঢাকা
ক্যান্টমেন্টে অবস্থিত বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের (বিআইএস) ৬ষ্ঠ
শ্রেণীর ছাত্র। মেয়ে জারার বয়স আট বছর। সে একই স্কুলে পড়ছে ক্লাস ওয়ানে।
এছাড়া আরেক ছেলে জাবিরের বয়স এখন মাত্র ২ বছর তিন মাস। ব্যক্তি জীবনে
অত্যন্ত সদালাপী ও সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত কর্নেল আজাদ বন্ধু সহকর্মী ছাড়াও
গণমাধ্যমকর্মী, বিশেষ করে ঢাকার অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদকের কাছে অত্যন্ত
আপনজন ছিলেন। যে কোনো অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সহায়তা চাইলে তিনি
হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।
এ
কারণে শুক্রবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদকরা বনানীর সামরিক
কবরস্থানে ভিড় করেন। এটিএন নিউজের জেষ্ঠ অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদক ইমরান
হোসেন সুমন কান্নাজড়িত কণ্ঠে যুগান্তরকে বলেন, সদা হাস্যোজ্জ্বল আজাদ ভাই
নেই, এটা ভাবতেই পারছি না। দৈনিক কালের কণ্ঠের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও
বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার আলম
বলেন, আজাদ ভাইকে সব সময়ই আপন বড় ভাইয়ের মতোই পাশে পেয়েছি। যখনই কোনো দরকার
হয়েছে তিনি অতি আপনজনের মতো পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম
শাখা জানায়, ৩৪তম বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
তিনি ৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। এরপর ২০০৫
সালে উচ্চতর প্যারাট্রু–পার প্রশিক্ষণ নিয়ে সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো
হিসেবে নাম লেখান আজাদ। ২০১১ সালে মেজর পদমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে প্রথম
কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন
ব্যাটালিয়ন র্যাবে পোস্টিং পান। তিনি ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে উপ-অধিনায়ক ও
অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের অক্টোবরে পান গোয়েন্দা শাখার
প্রধানের দায়িত্ব। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন বিশেষ করে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও
হিজবুত তাহরিরের সদস্যদের গ্রেফতারে লে. কর্নেল আজাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান
রয়েছে। জঙ্গিবাদ এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তিনি
বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক (পিপিএম) পুরস্কারে
ভূষিত হন।
No comments