কারাগারে একদিনের একটি অনুভূতি by রিজভী আহমেদ
অনুভূতির
রয়েছে বিপরীতধর্মী সত্তা, যেমন-সুখানুভূতি, দুঃখানুভূতি, ভালোমন্দের
অনুভূতি, আনন্দ- বেদনার অনুভূতি। অনুভূতিকে কোয়ালিফাই করার জন্য তার
পূর্বে একটা বিশেষণ ব্যবহার করতে হয়। বন্দিশালার বাইরে বিশ্বসংসারের মতো
কারাসংসারের আনন্দ-বেদনা অনুভূতি কারাবন্দিদের মধ্যেও জাগ্রত হয়।
হাসি-কান্না, মনোমালিন্য, পরশ্রীকাতরতা, সহমর্মিতা সব মিলিয়েই মানব অনুভূতি
কারা-সংসারে আসন পেতে বসে। কিন্তু যদি কোনো একজন বন্দির চাপাকান্নার
গুমরানি অন্য একজন বন্দি অনুভব করতে পারে তাহলে তার হৃদয়ও অন্তহীন বেদনায়
আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। ২০১৬ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই মাসের মধ্যে
একদিনের একটি দুঃসহ ঘটনা আজও আমার মনকে পীড়িত ও বেদনার্ত করে, যে দিনটি ছিল
কোরবানির ঈদের দিন।
অসংখ্য কয়েদি-হাজতির অপরাধ সংঘটন এবং অপরাধ সংঘটন না করেও শাস্তি হিসেবে কারাভোগের বিচিত্র গল্পও শুনেছি। সেখানে ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধের অপরাধীদের পূর্ব-পরিকল্পনাসহ বাস্তবায়নের লোমহর্ষক এবং একইসঙ্গে চিত্তাকর্ষক গল্পও শুনেছি। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির কাছ থেকে শোনা নানা ডাইভারসিফাইড অপরাধের বর্ণনা আমার এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য নয়, বরং শিক্ষার আলোবঞ্চিত আর্থিক দুর্দশায় পীড়িত মানুষ তাদের অসহায়ত্বের কারণে কী ভয়াবহ মর্মপীড়ায় ভোগে, কোরবানির ঈদের দিন সেটির একটি দুঃসহ স্মৃতি আজও আমি ভুলতে পারি না।
রাজনৈতিক কারণে নিরবচ্ছিন্নভাবে না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেকবার কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করার দুর্ভাগ্যজনক সৌভাগ্য হয়েছে সেই আশির দশক থেকেই। এ কারণে লৌহ কপাটের ভেতরের অঙ্গনের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি লাভ করি নিবিড়ভাবে। সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে বয়ে আসা কারাগারে ব্যবহৃত কিছু পরিভাষার সঙ্গে পরিচয় হয়। যে পরিভাষাগুলো বিবর্তনের ধারায় খুব অল্প সংখ্যকেরই বর্তমানে পরিবর্তন হয়েছে। যেমন কেস-টেবিল, জেলার বা সুপার-ফাইল, চৌকা, মিয়া সাহেব, ফালতু, দফা, লক-আপ, ঘণ্টি ইত্যাদি। দফা বলতে এক একটি স্বতন্ত্র বিভাগ বোঝায়, যেমন- ধোপা দফা বলতে কাপড় ধোয়া ও ইস্ত্রি করা বোঝায়, চুল দফা বলতে নাপিত-এর চুল-দাড়ি কাটা বোঝায়। এভাবে নানা ধরনের দফা আছে। যেখানে বিভিন্ন দফার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে বন্দিরাই। বন্দিরাই কাজ করে বন্দিদের জন্য। যেখানে রান্নাবান্নার আয়োজন চলে সেটিকে বলে ‘চৌকা’। হালে দু’একটি পরিভাষার নাম পরিবর্তিত হয়েছে, যেমন-ফালতুর স্থলে সেবক, মিয়া সাহেবের স্থলে কারারক্ষী ব্যবহার করা হচ্ছে।
যেসব বন্দি জেলবিধি মোতাবেক শ্রেণিপ্রাপ্ত হন তারা কারাগারে অভিজাত শ্রেণি হিসেবে গণ্য হন। এই শ্রেণিপ্রাপ্তদের ‘ডিভিশন প্রিজনার’ বলা হয়। এই শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিরা যে ভবনে থাকেন তাকে ‘ডিভিশন সেল’ বলা হয়।
গত ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটক হওয়ার পর প্রায় সারা বছর কারাবন্দি থেকে ৮ই ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করি। কারামুক্তির পর মনে হয়েছে সহসা আবার আমার গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ এবার প্রায় এক বছর আমাকে কারাগারে আটকে রাখা হয়। কিন্তু একটি অজ্ঞাত মামলায় আমার নাম জড়িয়ে দিয়ে আট মাস পর ২০১৬ সালের আগস্টে পুনরায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমার বুঝতে কষ্ট হলো না যে, সরকারের তীব্র সমালোচনা করাটাই আমার জন্য কাল হয়েছে। লম্বা সময় কারাপ্রাচীরের বাইরে থাকা আর হলো না। যাই হোক দশ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ)-এ সূর্যমুখী ভবনের একটি নির্জন সেলে অবস্থান করার পরে আমাকে কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আমার থাকার স্থান নির্ধারিত হয় সাধারণ কয়েদিদের জন্য বরাদ্দকৃত ভবন কর্ণফুলি’র একটি সেলে। দু’দিন পর অর্থাৎ কারাগারে প্রবেশ করার ১২ দিনের মাথায় আমার ডিভিশনের কাগজ আসে এবং পাশেই ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য বরাদ্দকৃত ভবন সুরমা’তে আমাকে স্থানান্তরিত করা হয়। সুরমায় আমাকে সহযোগিতা করার জন্য সেবক দেয়া হয় মুকুল নামের একটি ছেলেকে।
মুকুল মঙ্গাকবলিত বৃহত্তর রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট জেলার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমার কক্ষে পরিচর্যার জন্য যাবতীয় কাজ সে সম্পাদন করতো। সেবক হিসেবে যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করার পর আমার জন্য বরাদ্দ খবরের কাগজটি আমার পড়ার পর সে আমারই কক্ষের মেঝেতে বিছানো তার বিছানায় নিয়ে গিয়ে পড়তো। সে যে কিছুটা লেখাপড়া জানে সেটি আমি উপলব্ধি করতে পারলাম, যখন দেখলাম-সে খবরের কাগজে রাজনীতি ও খেলার খবরগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর আমাকে ঐসব বিষয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করছে। আমার কক্ষটি ছিল দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বেশ বিস্তৃত। সেবক মুকুল ছিল সরল এবং বোকা স্বভাবের। কী জন্য তার কারাবাসের শাস্তি হয়েছে সে বিষয়ে বিশদ কিছু জানতাম না। তবে তার কথার ফাঁকে ফাঁকে বুঝতে পারতাম যে, বিবাহজনিত কোনো মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। মুকুলের জমানো সকল টাকা তার স্ত্রী হাতিয়ে নিয়ে অন্য একজন লোকের সঙ্গে বিদেশে চম্পট দিয়েছে। এক্ষেত্রে কিভাবে তাকে ফাঁসিয়েছে সে বিষয়ে আমি কিছু জানতে পারিনি। তার নির্বুদ্ধিতার কারণেই মামলায় ফেঁসে গিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। অসহায় গরিব মানুষের একটি বিপদে অসংখ্য বিপদ এসে যোগ দেয় এবং তখন সে ভাগ্যের দাসে পরিণত হয়, কোনো অবলম্বনই তখন সে খুঁজে পায় না, ফলে অতল খাদে পতনই হয় তার নিয়তি।
বহু কষ্ট করে হতদরিদ্র মুকুল কয়েক হাজার টাকা জোগাড় করে একজন উকিলকে দিয়েছিল মামলা পরিচালনার জন্য। কিন্তু উকিল সাহেব সকল টাকা পকেটস্থ করে মুকুলের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। তবে উকিল সাহেবদের কারো কারো এসমস্ত কাহিনী অশ্রুতপূর্ব নয়। এতো কিছুর পরও মুকুল কষ্টে-ক্লিষ্টে বেঁচে আছে কিন্তু মুষড়ে পড়েনি। ‘সে ভালোবাসে জীবনকে, মূল্য দেয় জীবনকে, জেলখানাতেই যেন লোকে জীবনকে আরো বেশি করে ভালোবাসে’।
গতবার সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে কোরবানির ঈদের আগমন ঘটে। কারাগারেও বন্দিদের মাঝে ঈদের আনন্দময় প্রকাশ ঘটে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। নিয়মানুযায়ী কারাকর্তৃপক্ষ ঈদের দিন বন্দিদের পরিবারের রান্না করা খাবার ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে থাকেন। আমাদের মতো বন্দিদের পরিবার থেকে ঈদের দিন বিশেষ রান্না করা খাবার আসে, কিন্তু মুকুলদের মতো বন্দিদের জন্য কেউ কিছু নিয়ে আসে না।
মুকুলের দরিদ্র পিতা-মাতা সুদূর লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ঈদের চারদিন আগে মুকুল আমাকে জানায় যে, বাড়ি থেকে খবর এসেছে যে, তার বাবা-মা ঈদের দিন তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তার কোনো কারাসঙ্গী তাকে এই খবরটি দিয়েছে। মুকুল বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা পাওয়ার আকুলতায় অস্থির হয়ে থাকতো ঈদের দিনের অপেক্ষায়। ঈদের দিনের সকালে দেখি তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। প্রায় চার বছর পর বাবা-মা তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে। ঢাকা কিংবা গাজীপুরে তার কেউ নেই। আগের দিন ঢাকায় এসে তার বাবা-মা কোথায় এসে উঠবে সেটিও সে জানে না। তাই উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর আনন্দে ঈদের দিনের আগের কয়েকটি দিন তার কেটেছে তীব্র প্রতীক্ষায়। ঈদের দিন সকাল ১১টার দিকে আমার স্ত্রী এবং পরিবারের কয়েকজন আমার জন্য ঈদের খাবার নিয়ে এসে কারাকার্যালয়ে দেখা করে চলে যায়। আমি আমার কক্ষে ফিরে এসে সেবক মুকুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, ঈদের খাবারগুলো অন্যান্য সহবন্দিদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য।
ঈদের সকালে দশটার পর থেকেই মুকুলের আর পাত্তা নেই। ভাবলাম বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা হওয়ার আবেগে সে হয়তো কারাগারের প্রধান ফটকের আশেপাশে ঘোরাফিরা করছে, কারাকর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কখন তার ডাক আসে বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা করার জন্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বেলা ৩টার দিকে বিষণ্ন ও মলিন মুখে মুকুল আমার কক্ষে এসে হাজির। তাকে দেখেই মনে হলো হয়তো তার বাবা-মা আসতে পারেনি। আমি ঘটনা কী জিজ্ঞাসা করতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সে কান্না যেন আর থামতে চায় না। সে একটু ধাতস্থ হলে আমি বিষয়টি জানতে চাইলে সে যে যা বলেছে তা আজও ভুলতে পারিনি। বাবা-মা’র সঙ্গে ঠিকই দেখা হয়েছে মুকুলের। যেহেতু ঈদের দিন সেহেতু মুকুলের বাবা-মা ছেলেকে কারাগারে দেখতে আসার সময় পথিমধ্যে মুকুলের জন্য সামান্য কিছু খাবার কিনেছিল, কিন্তু সেদিন আবহাওয়া ছিল ভীষণ উতপ্ত ও আর্দ্র্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন তার বাবা-মা মুকুলের সঙ্গে দেখা পেতে সক্ষম হয় তখন খাবারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এই পচা খাবারগুলো নিয়ে বাবা-মা যখন মুকুলের সামনে হাজির হয় তখন তাদের হৃদয় ফেটে চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে। দীর্ঘদিন পর ছেলের সঙ্গে বাবা-মা’র দেখা হওয়ার পর টাটকা খাবার ছেলের মুখে তুলে দিতে না পারার ব্যর্থতায় যে তীব্র বেদনা মুকুল লক্ষ্য করেছে সেই কষ্ট সে সামাল দিতে পারেনি। ঈদের দিনে মর্মস্পর্শী এই নিদারুণ কষ্টে মুকুলের সকল আনন্দ বিষণ্ন বেদনায় গুমরে উঠতে থাকে।
অসংখ্য কয়েদি-হাজতির অপরাধ সংঘটন এবং অপরাধ সংঘটন না করেও শাস্তি হিসেবে কারাভোগের বিচিত্র গল্পও শুনেছি। সেখানে ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধের অপরাধীদের পূর্ব-পরিকল্পনাসহ বাস্তবায়নের লোমহর্ষক এবং একইসঙ্গে চিত্তাকর্ষক গল্পও শুনেছি। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির কাছ থেকে শোনা নানা ডাইভারসিফাইড অপরাধের বর্ণনা আমার এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য নয়, বরং শিক্ষার আলোবঞ্চিত আর্থিক দুর্দশায় পীড়িত মানুষ তাদের অসহায়ত্বের কারণে কী ভয়াবহ মর্মপীড়ায় ভোগে, কোরবানির ঈদের দিন সেটির একটি দুঃসহ স্মৃতি আজও আমি ভুলতে পারি না।
রাজনৈতিক কারণে নিরবচ্ছিন্নভাবে না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেকবার কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করার দুর্ভাগ্যজনক সৌভাগ্য হয়েছে সেই আশির দশক থেকেই। এ কারণে লৌহ কপাটের ভেতরের অঙ্গনের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি লাভ করি নিবিড়ভাবে। সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে বয়ে আসা কারাগারে ব্যবহৃত কিছু পরিভাষার সঙ্গে পরিচয় হয়। যে পরিভাষাগুলো বিবর্তনের ধারায় খুব অল্প সংখ্যকেরই বর্তমানে পরিবর্তন হয়েছে। যেমন কেস-টেবিল, জেলার বা সুপার-ফাইল, চৌকা, মিয়া সাহেব, ফালতু, দফা, লক-আপ, ঘণ্টি ইত্যাদি। দফা বলতে এক একটি স্বতন্ত্র বিভাগ বোঝায়, যেমন- ধোপা দফা বলতে কাপড় ধোয়া ও ইস্ত্রি করা বোঝায়, চুল দফা বলতে নাপিত-এর চুল-দাড়ি কাটা বোঝায়। এভাবে নানা ধরনের দফা আছে। যেখানে বিভিন্ন দফার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে বন্দিরাই। বন্দিরাই কাজ করে বন্দিদের জন্য। যেখানে রান্নাবান্নার আয়োজন চলে সেটিকে বলে ‘চৌকা’। হালে দু’একটি পরিভাষার নাম পরিবর্তিত হয়েছে, যেমন-ফালতুর স্থলে সেবক, মিয়া সাহেবের স্থলে কারারক্ষী ব্যবহার করা হচ্ছে।
যেসব বন্দি জেলবিধি মোতাবেক শ্রেণিপ্রাপ্ত হন তারা কারাগারে অভিজাত শ্রেণি হিসেবে গণ্য হন। এই শ্রেণিপ্রাপ্তদের ‘ডিভিশন প্রিজনার’ বলা হয়। এই শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিরা যে ভবনে থাকেন তাকে ‘ডিভিশন সেল’ বলা হয়।
গত ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটক হওয়ার পর প্রায় সারা বছর কারাবন্দি থেকে ৮ই ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করি। কারামুক্তির পর মনে হয়েছে সহসা আবার আমার গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ এবার প্রায় এক বছর আমাকে কারাগারে আটকে রাখা হয়। কিন্তু একটি অজ্ঞাত মামলায় আমার নাম জড়িয়ে দিয়ে আট মাস পর ২০১৬ সালের আগস্টে পুনরায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমার বুঝতে কষ্ট হলো না যে, সরকারের তীব্র সমালোচনা করাটাই আমার জন্য কাল হয়েছে। লম্বা সময় কারাপ্রাচীরের বাইরে থাকা আর হলো না। যাই হোক দশ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ)-এ সূর্যমুখী ভবনের একটি নির্জন সেলে অবস্থান করার পরে আমাকে কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আমার থাকার স্থান নির্ধারিত হয় সাধারণ কয়েদিদের জন্য বরাদ্দকৃত ভবন কর্ণফুলি’র একটি সেলে। দু’দিন পর অর্থাৎ কারাগারে প্রবেশ করার ১২ দিনের মাথায় আমার ডিভিশনের কাগজ আসে এবং পাশেই ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য বরাদ্দকৃত ভবন সুরমা’তে আমাকে স্থানান্তরিত করা হয়। সুরমায় আমাকে সহযোগিতা করার জন্য সেবক দেয়া হয় মুকুল নামের একটি ছেলেকে।
মুকুল মঙ্গাকবলিত বৃহত্তর রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট জেলার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমার কক্ষে পরিচর্যার জন্য যাবতীয় কাজ সে সম্পাদন করতো। সেবক হিসেবে যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করার পর আমার জন্য বরাদ্দ খবরের কাগজটি আমার পড়ার পর সে আমারই কক্ষের মেঝেতে বিছানো তার বিছানায় নিয়ে গিয়ে পড়তো। সে যে কিছুটা লেখাপড়া জানে সেটি আমি উপলব্ধি করতে পারলাম, যখন দেখলাম-সে খবরের কাগজে রাজনীতি ও খেলার খবরগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর আমাকে ঐসব বিষয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করছে। আমার কক্ষটি ছিল দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বেশ বিস্তৃত। সেবক মুকুল ছিল সরল এবং বোকা স্বভাবের। কী জন্য তার কারাবাসের শাস্তি হয়েছে সে বিষয়ে বিশদ কিছু জানতাম না। তবে তার কথার ফাঁকে ফাঁকে বুঝতে পারতাম যে, বিবাহজনিত কোনো মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। মুকুলের জমানো সকল টাকা তার স্ত্রী হাতিয়ে নিয়ে অন্য একজন লোকের সঙ্গে বিদেশে চম্পট দিয়েছে। এক্ষেত্রে কিভাবে তাকে ফাঁসিয়েছে সে বিষয়ে আমি কিছু জানতে পারিনি। তার নির্বুদ্ধিতার কারণেই মামলায় ফেঁসে গিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। অসহায় গরিব মানুষের একটি বিপদে অসংখ্য বিপদ এসে যোগ দেয় এবং তখন সে ভাগ্যের দাসে পরিণত হয়, কোনো অবলম্বনই তখন সে খুঁজে পায় না, ফলে অতল খাদে পতনই হয় তার নিয়তি।
বহু কষ্ট করে হতদরিদ্র মুকুল কয়েক হাজার টাকা জোগাড় করে একজন উকিলকে দিয়েছিল মামলা পরিচালনার জন্য। কিন্তু উকিল সাহেব সকল টাকা পকেটস্থ করে মুকুলের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। তবে উকিল সাহেবদের কারো কারো এসমস্ত কাহিনী অশ্রুতপূর্ব নয়। এতো কিছুর পরও মুকুল কষ্টে-ক্লিষ্টে বেঁচে আছে কিন্তু মুষড়ে পড়েনি। ‘সে ভালোবাসে জীবনকে, মূল্য দেয় জীবনকে, জেলখানাতেই যেন লোকে জীবনকে আরো বেশি করে ভালোবাসে’।
গতবার সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে কোরবানির ঈদের আগমন ঘটে। কারাগারেও বন্দিদের মাঝে ঈদের আনন্দময় প্রকাশ ঘটে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। নিয়মানুযায়ী কারাকর্তৃপক্ষ ঈদের দিন বন্দিদের পরিবারের রান্না করা খাবার ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে থাকেন। আমাদের মতো বন্দিদের পরিবার থেকে ঈদের দিন বিশেষ রান্না করা খাবার আসে, কিন্তু মুকুলদের মতো বন্দিদের জন্য কেউ কিছু নিয়ে আসে না।
মুকুলের দরিদ্র পিতা-মাতা সুদূর লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ঈদের চারদিন আগে মুকুল আমাকে জানায় যে, বাড়ি থেকে খবর এসেছে যে, তার বাবা-মা ঈদের দিন তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তার কোনো কারাসঙ্গী তাকে এই খবরটি দিয়েছে। মুকুল বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা পাওয়ার আকুলতায় অস্থির হয়ে থাকতো ঈদের দিনের অপেক্ষায়। ঈদের দিনের সকালে দেখি তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। প্রায় চার বছর পর বাবা-মা তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে। ঢাকা কিংবা গাজীপুরে তার কেউ নেই। আগের দিন ঢাকায় এসে তার বাবা-মা কোথায় এসে উঠবে সেটিও সে জানে না। তাই উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর আনন্দে ঈদের দিনের আগের কয়েকটি দিন তার কেটেছে তীব্র প্রতীক্ষায়। ঈদের দিন সকাল ১১টার দিকে আমার স্ত্রী এবং পরিবারের কয়েকজন আমার জন্য ঈদের খাবার নিয়ে এসে কারাকার্যালয়ে দেখা করে চলে যায়। আমি আমার কক্ষে ফিরে এসে সেবক মুকুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, ঈদের খাবারগুলো অন্যান্য সহবন্দিদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য।
ঈদের সকালে দশটার পর থেকেই মুকুলের আর পাত্তা নেই। ভাবলাম বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা হওয়ার আবেগে সে হয়তো কারাগারের প্রধান ফটকের আশেপাশে ঘোরাফিরা করছে, কারাকর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কখন তার ডাক আসে বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা করার জন্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বেলা ৩টার দিকে বিষণ্ন ও মলিন মুখে মুকুল আমার কক্ষে এসে হাজির। তাকে দেখেই মনে হলো হয়তো তার বাবা-মা আসতে পারেনি। আমি ঘটনা কী জিজ্ঞাসা করতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সে কান্না যেন আর থামতে চায় না। সে একটু ধাতস্থ হলে আমি বিষয়টি জানতে চাইলে সে যে যা বলেছে তা আজও ভুলতে পারিনি। বাবা-মা’র সঙ্গে ঠিকই দেখা হয়েছে মুকুলের। যেহেতু ঈদের দিন সেহেতু মুকুলের বাবা-মা ছেলেকে কারাগারে দেখতে আসার সময় পথিমধ্যে মুকুলের জন্য সামান্য কিছু খাবার কিনেছিল, কিন্তু সেদিন আবহাওয়া ছিল ভীষণ উতপ্ত ও আর্দ্র্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন তার বাবা-মা মুকুলের সঙ্গে দেখা পেতে সক্ষম হয় তখন খাবারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এই পচা খাবারগুলো নিয়ে বাবা-মা যখন মুকুলের সামনে হাজির হয় তখন তাদের হৃদয় ফেটে চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে। দীর্ঘদিন পর ছেলের সঙ্গে বাবা-মা’র দেখা হওয়ার পর টাটকা খাবার ছেলের মুখে তুলে দিতে না পারার ব্যর্থতায় যে তীব্র বেদনা মুকুল লক্ষ্য করেছে সেই কষ্ট সে সামাল দিতে পারেনি। ঈদের দিনে মর্মস্পর্শী এই নিদারুণ কষ্টে মুকুলের সকল আনন্দ বিষণ্ন বেদনায় গুমরে উঠতে থাকে।
No comments