দীপনদের আমরা কী করে ভুলে যাই? by সোহরাব হাসান
আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি, বইমেলা নিয়ে ওর উচ্ছ্বাস প্রকাশের কি আকুলতা! - দীপনের বাবা |
পৃথিবীতে
সবচেয়ে ভারী পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, যিনি
দেশে নবচিন্তা ও নবজাগৃতির স্বপ্ন দেখেন, তাঁকেই কিনা এই স্বাধীন
বাংলাদেশে সন্তানের লাশ বহন করতে হয়েছে। তিন মাসের বেশি সময় ধরে তিনি
পাথরচাপা বেদনার স্মৃতি বুকে নিয়ে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম
ফজলুল হকের ক্লাস করার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে তাঁরা জানেন, তিনি
শিক্ষার্থীদের কী অপরিসীম প্রীতি ও স্নেহে কাছে টেনে নেন। ভিন্নমতের
মানুষের সঙ্গেও তিনি আলোচনাকে এগিয়ে নিতে উৎসাহ দেখান। আগে যেমন তাঁকে
দেখতাম হাসিমুখে কথা বলেছেন, সন্তান হারানোর পরও সেটি অটুট রেখেছেন। কিন্তু
ওই হাসির ভেতরে যে কী গভীর বেদনা, সেটি আমরা অনেকেই জানার চেষ্টা করি না।
সমাজে কাপুরুষতা ও অমানবিকতা এতটাই জেঁকে বসেছে।
বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলছে। সেখানে প্রতিদিন লেখক-প্রকাশকেরা আসছেন, আসবেন। কিন্তু আসবেন না জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন। গত ৩১ অক্টোবর অন্ধকারের শক্তি তাঁকে হত্যা করে। আমরা প্রতিদিন মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মঞ্চে-মাঠে গলা ফাটালেও ফয়সল আরেফিনের হত্যাকারীদের ধরতে পারছি না। তাহলে কি ওরা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, আমাদের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী?
বইমেলা নিয়ে একটি পত্রিকা লিখেছে, ‘সাদা-কালোর আবহে তৈরি জাগৃতি প্রকাশনীর স্টল। যাতে রয়েছে মৌলবাদীদের হামলায় নিহত ফয়সল আরেফিন দীপনের হাসিমাখা মুখের আলোকচিত্র। শুধু ওই স্টলেই, মেলাজুড়ে আর কোথাও নেই দীপনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। তাই সেই স্টলে বসে তাঁর বাবা বললেন, “আমার ছেলেকে কেউ মনে রাখেননি। মেলা শুরু হয়েছে আজ (৩ ফেব্রুয়ারি) তিন দিন। এর মধ্যে কেউ দীপনের কথা বলেননি। বিশাল অনুষ্ঠান হচ্ছে প্রতিদিন, সেখানেও কেউ দীপনের কথা বলছেন না। কেউ তাঁকে স্মরণ করছেন না।”
বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলছে। সেখানে প্রতিদিন লেখক-প্রকাশকেরা আসছেন, আসবেন। কিন্তু আসবেন না জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন। গত ৩১ অক্টোবর অন্ধকারের শক্তি তাঁকে হত্যা করে। আমরা প্রতিদিন মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মঞ্চে-মাঠে গলা ফাটালেও ফয়সল আরেফিনের হত্যাকারীদের ধরতে পারছি না। তাহলে কি ওরা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, আমাদের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী?
বইমেলা নিয়ে একটি পত্রিকা লিখেছে, ‘সাদা-কালোর আবহে তৈরি জাগৃতি প্রকাশনীর স্টল। যাতে রয়েছে মৌলবাদীদের হামলায় নিহত ফয়সল আরেফিন দীপনের হাসিমাখা মুখের আলোকচিত্র। শুধু ওই স্টলেই, মেলাজুড়ে আর কোথাও নেই দীপনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। তাই সেই স্টলে বসে তাঁর বাবা বললেন, “আমার ছেলেকে কেউ মনে রাখেননি। মেলা শুরু হয়েছে আজ (৩ ফেব্রুয়ারি) তিন দিন। এর মধ্যে কেউ দীপনের কথা বলেননি। বিশাল অনুষ্ঠান হচ্ছে প্রতিদিন, সেখানেও কেউ দীপনের কথা বলছেন না। কেউ তাঁকে স্মরণ করছেন না।”
বইমেলায় ফয়সল আরেফিন দীপন এর জাগৃতি প্রকাশনীর স্টল |
তিনি
আরও বলেন, ‘দীপন মারা গেছে, এটা আমাদের পারিবারিক শোক। এর কোনো পূরণ নেই
আমাদের কাছে। কিন্তু জাতির স্বার্থে দীপনকে স্মরণ রাখা উচিত, হত্যার বিচার
হওয়া উচিত। সরকারকে অনুরোধ করব, এ বিষয়টি দেখতে। ভুললে চলবে না। আমরা তো
শুধু বিচার নয়, চাই এমন হত্যাকাণ্ড যেন আর না ঘটে।’ পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রু
সংবরণের চেষ্টা করছিলেন ফয়সলের স্ত্রী রাজিয়া রহমান। তিনি বললেন, ‘এত বড়
মেলা, কোথাও দীপনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন আছে? প্রতি স্টলে কি দীপন স্মরণে একটা
করে কালো ব্যাজ ধারণ করা যেতে পারত না? কিন্তু সেটিও হলো না।’ (সমকাল, ৪
ফেব্রুয়ারি ২০১৬)
ফয়সল আরেফিনের বাবা ও স্ত্রীর এই হৃদয়ভাঙা অনুভূতি আমাদের কাউকে স্পর্শ করছে বলে মনে হয় না। যাঁরা লেখক, যাঁরা মুক্তবুদ্ধির চর্চার কথা বলেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নিয়ত বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা কি একবারও ওই প্রদীপ্ত তরুণকে স্মরণ করতে পারতেন না? বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠানটিও কি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কোনো অনুষ্ঠান বা সেমিনারের ব্যবস্থা করতে পারত না? আমরা এত সহজে কী করে ভুলে গেলাম ফয়সল আরেফিনকে, যিনি অর্থশাস্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও কোনো চাকরি না নিয়ে আলো ছড়ানোর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে বহুমত ও চিন্তার লেখকের বই বের হয়েছে। তাই বিশেষ কোনো বইয়ের জন্য কেন তিনি ঘাতকের নিশানা হলেন? সেদিন আক্রান্ত হয়েছিলেন শুদ্ধস্বরের প্রকাশকসহ আরও তিন লেখক-প্রকাশক। তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন বলে বেঁচে গেছেন। কিন্তু ফয়সলকে বাঁচানো যায়নি। তাঁর হত্যার পর দেশজুড়ে যে প্রতিবাদ হয়েছিল, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তা মিইয়ে গেল! আজ আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে সত্য কথা বলা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন।
ফয়সল আরেফিনের বাবা ও স্ত্রীর এই হৃদয়ভাঙা অনুভূতি আমাদের কাউকে স্পর্শ করছে বলে মনে হয় না। যাঁরা লেখক, যাঁরা মুক্তবুদ্ধির চর্চার কথা বলেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নিয়ত বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা কি একবারও ওই প্রদীপ্ত তরুণকে স্মরণ করতে পারতেন না? বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠানটিও কি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কোনো অনুষ্ঠান বা সেমিনারের ব্যবস্থা করতে পারত না? আমরা এত সহজে কী করে ভুলে গেলাম ফয়সল আরেফিনকে, যিনি অর্থশাস্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও কোনো চাকরি না নিয়ে আলো ছড়ানোর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে বহুমত ও চিন্তার লেখকের বই বের হয়েছে। তাই বিশেষ কোনো বইয়ের জন্য কেন তিনি ঘাতকের নিশানা হলেন? সেদিন আক্রান্ত হয়েছিলেন শুদ্ধস্বরের প্রকাশকসহ আরও তিন লেখক-প্রকাশক। তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন বলে বেঁচে গেছেন। কিন্তু ফয়সলকে বাঁচানো যায়নি। তাঁর হত্যার পর দেশজুড়ে যে প্রতিবাদ হয়েছিল, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তা মিইয়ে গেল! আজ আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে সত্য কথা বলা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন।
দীপনের স্মৃতি ধারণ করে আছে জাগৃতি প্রকাশনী |
৩১
অক্টোবর ফয়সলের শোকস্তব্ধ বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সন্তান
হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না। আমি মানুষের
মধ্যে শুভবোধের জাগরণ চাই।’ এখন দেখা যাচ্ছে বিচার ও শুভবুদ্ধি—দুটোই অধরা।
একজন মানুষ কত মহৎ হলে সন্তান হারানোর পর এ রকম উচ্চারণ করতে পারেন।
ব্যক্তিগত শোক ও কষ্ট ভুলে তিনি জাতির বিবেককে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু
আমাদের বিবেক এতটাই অসাড় যে সেটি জাগানো কঠিন। ফলে তাঁর সেই বক্তব্যের ভুল
ব্যাখ্যা হলো। ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা অবলীলায় বলে ফেললেন, ঘাতকেরা যে
আদর্শে বিশ্বাস করে, তিনিও সম্ভবত সেই আদর্শে বিশ্বাস করেন, এ কারণে তিনি
বিচার চাইছেন না। সামাজিক মাধ্যমে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় কিছুক্ষণ
পর ওই নেতা তাঁর বক্তব্যটি প্রত্যাহারও করে নেন। আমরা ভাবলাম, রাষ্ট্রের
বোধোদয় হবে। সমাজে শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটবে। অন্ধকারের শক্তি পরাজিত হবে।
কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি। সরকার মুখে বলছে মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে
তারা জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে। কিন্তু তিন মাসেও ফয়সল হত্যাকারীদের কেউ
গ্রেপ্তার না হওয়া কি তার প্রমাণ? এরপরও অন্ধকারের শক্তি
লেখক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক এমনকি মন্ত্রী-সাংসদদেরও হুমকি দিয়ে চলেছে। এসব
কিসের লক্ষণ?
বইমেলার আয়োজকেরা ফয়সলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারতেন, প্রকাশকেরা তাঁর সম্মানে মেলায় কোনো স্মারকের ব্যবস্থা করতে পারতেন। কেননা, ওই হামলাটি তো কেবল ব্যক্তি ফয়সলের ওপর ছিল না। ওই হামলাটি ছিল মানুষের মত প্রকাশের ওপর। মুক্তচিন্তার ওপর হামলা। আজ থেকে ১২ বছর আগে আরেক ফেব্রুয়ারিতে জঙ্গিগোষ্ঠীর নির্মম হামলার শিকার হয়েছিলেন (পরে মৃত্যু) লেখক হুমায়ুন আজাদ। সেই হামলাকারীদেরও আমরা এখনো বিচারের মুখোমুখি করতে পারিনি। রাষ্ট্র খুঁজে বের করতে পারেনি অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুরের পলাতক হত্যাকারীদেরও। তাহলে মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ কি কেবলই লোক দেখানো? মুক্তবুদ্ধির ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা কি নিছকই রাজনৈতিক বুলি?
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে দেশের প্রভূত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। আমরাও অস্বীকার করছি না। সবার না হলেও বাংলাদেশ আজ সিংহভাগ মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পেরেছে। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে নাগরিকের ভাত, কাপড়ের সমস্যার সমাধানই শেষ কথা নয়, তাঁদের বাক্ব্যক্তি তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতাও থাকা চাই। একুশের বইমেলা কেবল প্রাণের মেলা নয়। দ্রোহেরও মেলা। শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই একুশের সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা যদি সেই প্রতিবাদের ভাষাটি ভুলে যাই, একুশ হবে নিছকই আনুষ্ঠানিকতা। হুমায়ুন আজাদ বা ফয়সল আরেফিনকে ভুলে যাওয়া কিংবা অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত দাশদের ঘাতকদের বিচার না করতে পারা একুশের চেতনার পরিপন্থী। আমরা যদি ফয়সলকে মনে না রাখি, তাহলে তাকে যারা খুন করেছে, ভবিষ্যতে সেই খুনিদের রাজত্বই প্রতিষ্ঠিত হবে।
রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করল কি না, সেটি আমরা অবশ্যই জিজ্ঞেস করব। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি কী করল সেই প্রশ্নও আমরা করব। কিন্তু একই সঙ্গে আরও জরুরি প্রশ্নটি হলো নাগরিক হিসেবে, লেখক হিসেবে, প্রকাশক হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছি? হত্যা–সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ কতটা জাগরূক রেখেছি? ফয়সল আরেফিন একজন প্রকাশক ছিলেন। বাংলাদেশে কেবল বই প্রকাশ করার জন্য এ রকম জীবন দেওয়ার ঘটনা দ্বিতীয়টি ঘটেছে বলে মনে হয় না। তারপরও প্রকাশকেরা নিশ্চুপ কেন? কেন তাঁরা ফয়সলের বিচারের দাবিটি সামনে আনছেন না? কেন আমরা সবাই অন্ধ ও বধিরের ভূমিকায় অভিনয় করছি? দীপনকে কে বা কারা হত্যা করেছে খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সরকারের। কিন্তু যে অন্ধকার চিন্তা দীপনদের হত্যা করতে প্ররোচিত করে, সেই অন্ধকার চিন্তা তিরোহিত করার প্রধান ও মূল কাজটি করতে হয় সমাজকেই। সমাজের শুভশক্তির প্রবক্তারা যদি সেই কাজটি করতেন, তাহলে অধ্যাপক হককে এভাবে আক্ষেপ করতে হতো না। দীপনের স্ত্রীকেও বইমেলায় গিয়ে দীপনের স্মারক খুঁজতে হতো না। সন্তানের হত্যার বিচার না হওয়ায় অধ্যাপক হক ব্যথিত ও বিচলিত হয়েছেন। কিন্তু তার চেয়েও তাঁকে বেশি উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে সমাজের আত্মবিনাশী অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা এবং সংঘাত। এই সংঘাতের শুরু থাকলেও শেষ নেই। আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটাকে ক্ষমতার লড়াইয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। জঙ্গিরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। আর সরকার তাদের টিকিটিও ধরতে পারছে না। অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছে। যে সমাজ মানুষের মধ্যে শুভবোধ তৈরি করে, সম্প্রীতির বন্ধনে সবাইকে মেলাতে চেষ্টা করে, যে সমাজ যুক্তি ও বুদ্ধির অনুশীলনের মাধ্যমে মনের অন্ধকার দূর করে, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আমরা সেই সমাজ তৈরি করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার জবাব কী?
জঙ্গি হামলার জন্য এত দিন আমরা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ওপর সব দোষ চাপিয়েছি। কিন্তু সাত বছর ধরে তো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিই ক্ষমতায়। তারপরও মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠী এত আস্ফালন কীভাবে দেখায়? তাহলে কি সরকারের জঙ্গি দমনের নীতি ও কৌশলে ঘাটতি আছে? তাহলে কি ক্ষমতাসীনদেরই কেউ সেই অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে অাঁতাত করছেন?
অধ্যাপক হক ভবিষ্যতে যাতে কাউকে ফয়সল আরেফিনের মতো জীবন দিতে না হয়, সে সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা সত্যিই কি সতর্ক হচ্ছি? এ প্রশ্নের উত্তর—সম্ভবত না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
বইমেলার আয়োজকেরা ফয়সলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারতেন, প্রকাশকেরা তাঁর সম্মানে মেলায় কোনো স্মারকের ব্যবস্থা করতে পারতেন। কেননা, ওই হামলাটি তো কেবল ব্যক্তি ফয়সলের ওপর ছিল না। ওই হামলাটি ছিল মানুষের মত প্রকাশের ওপর। মুক্তচিন্তার ওপর হামলা। আজ থেকে ১২ বছর আগে আরেক ফেব্রুয়ারিতে জঙ্গিগোষ্ঠীর নির্মম হামলার শিকার হয়েছিলেন (পরে মৃত্যু) লেখক হুমায়ুন আজাদ। সেই হামলাকারীদেরও আমরা এখনো বিচারের মুখোমুখি করতে পারিনি। রাষ্ট্র খুঁজে বের করতে পারেনি অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুরের পলাতক হত্যাকারীদেরও। তাহলে মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ কি কেবলই লোক দেখানো? মুক্তবুদ্ধির ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা কি নিছকই রাজনৈতিক বুলি?
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে দেশের প্রভূত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। আমরাও অস্বীকার করছি না। সবার না হলেও বাংলাদেশ আজ সিংহভাগ মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পেরেছে। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে নাগরিকের ভাত, কাপড়ের সমস্যার সমাধানই শেষ কথা নয়, তাঁদের বাক্ব্যক্তি তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতাও থাকা চাই। একুশের বইমেলা কেবল প্রাণের মেলা নয়। দ্রোহেরও মেলা। শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই একুশের সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা যদি সেই প্রতিবাদের ভাষাটি ভুলে যাই, একুশ হবে নিছকই আনুষ্ঠানিকতা। হুমায়ুন আজাদ বা ফয়সল আরেফিনকে ভুলে যাওয়া কিংবা অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত দাশদের ঘাতকদের বিচার না করতে পারা একুশের চেতনার পরিপন্থী। আমরা যদি ফয়সলকে মনে না রাখি, তাহলে তাকে যারা খুন করেছে, ভবিষ্যতে সেই খুনিদের রাজত্বই প্রতিষ্ঠিত হবে।
রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করল কি না, সেটি আমরা অবশ্যই জিজ্ঞেস করব। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি কী করল সেই প্রশ্নও আমরা করব। কিন্তু একই সঙ্গে আরও জরুরি প্রশ্নটি হলো নাগরিক হিসেবে, লেখক হিসেবে, প্রকাশক হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছি? হত্যা–সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ কতটা জাগরূক রেখেছি? ফয়সল আরেফিন একজন প্রকাশক ছিলেন। বাংলাদেশে কেবল বই প্রকাশ করার জন্য এ রকম জীবন দেওয়ার ঘটনা দ্বিতীয়টি ঘটেছে বলে মনে হয় না। তারপরও প্রকাশকেরা নিশ্চুপ কেন? কেন তাঁরা ফয়সলের বিচারের দাবিটি সামনে আনছেন না? কেন আমরা সবাই অন্ধ ও বধিরের ভূমিকায় অভিনয় করছি? দীপনকে কে বা কারা হত্যা করেছে খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সরকারের। কিন্তু যে অন্ধকার চিন্তা দীপনদের হত্যা করতে প্ররোচিত করে, সেই অন্ধকার চিন্তা তিরোহিত করার প্রধান ও মূল কাজটি করতে হয় সমাজকেই। সমাজের শুভশক্তির প্রবক্তারা যদি সেই কাজটি করতেন, তাহলে অধ্যাপক হককে এভাবে আক্ষেপ করতে হতো না। দীপনের স্ত্রীকেও বইমেলায় গিয়ে দীপনের স্মারক খুঁজতে হতো না। সন্তানের হত্যার বিচার না হওয়ায় অধ্যাপক হক ব্যথিত ও বিচলিত হয়েছেন। কিন্তু তার চেয়েও তাঁকে বেশি উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে সমাজের আত্মবিনাশী অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা এবং সংঘাত। এই সংঘাতের শুরু থাকলেও শেষ নেই। আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটাকে ক্ষমতার লড়াইয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। জঙ্গিরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। আর সরকার তাদের টিকিটিও ধরতে পারছে না। অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছে। যে সমাজ মানুষের মধ্যে শুভবোধ তৈরি করে, সম্প্রীতির বন্ধনে সবাইকে মেলাতে চেষ্টা করে, যে সমাজ যুক্তি ও বুদ্ধির অনুশীলনের মাধ্যমে মনের অন্ধকার দূর করে, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আমরা সেই সমাজ তৈরি করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার জবাব কী?
জঙ্গি হামলার জন্য এত দিন আমরা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ওপর সব দোষ চাপিয়েছি। কিন্তু সাত বছর ধরে তো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিই ক্ষমতায়। তারপরও মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠী এত আস্ফালন কীভাবে দেখায়? তাহলে কি সরকারের জঙ্গি দমনের নীতি ও কৌশলে ঘাটতি আছে? তাহলে কি ক্ষমতাসীনদেরই কেউ সেই অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে অাঁতাত করছেন?
অধ্যাপক হক ভবিষ্যতে যাতে কাউকে ফয়সল আরেফিনের মতো জীবন দিতে না হয়, সে সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা সত্যিই কি সতর্ক হচ্ছি? এ প্রশ্নের উত্তর—সম্ভবত না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments