ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি না পেলে পণ্য ও সেবা বাড়ে না by এম এ খালেক
প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন,‘মানুষ পরিশ্রম করে নিজের জন্য নয়, করে অন্যরা যাতে বহাল তবিয়তে স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারে।’ তার এ বক্তব্য যে অত্যন্ত সঠিক এবং যৌক্তিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বক্তব্যটি পারিবারিক এবং সামাজিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আমরা যারা পরিশ্রম করি তারা নিজেরা তার সুফল প্রায়ই ভোগ করতে পারি না। কারণ পরিশ্রম করতে করতেই জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় চলে যায়। তাই কর্মজীবন থেকে অবসরগ্রহণের পর সারা জীবনে অর্জিত সম্পদের সুফল ভোগ করার তেমন কোনো সুযোগ আর থাকে না। সাধারণত উত্তরাধিকারিরাই তাদের পূর্বসূরিদের পরিশ্রমের সুফল ভোগ করে থাকে। অথচ যেভাবেই সম্পদ অর্জিত হোক না কেন, তার দায়ভার যিনি সম্পদ অর্জন করেন তাকেই বহন করতে হয়। যিনি বা যারা সম্পদ ভোগ করবেন তাদের সম্পদ অর্জনের বৈধ বা অবৈধতার দায়ভার বহন করতে হয় না। এটি দুনিয়ার নিয়ম। সম্পদ সৃষ্টি এবং ভোগস্পৃহা ব্যতীত উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে না। একইভাবে যারা বিভিন্ন কল-কারখানা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বা শ্রম দেন তারাও নিজেদের বিত্ত-বৈভব বাড়ানোর জন্য নয়, বরং সমস্যা সংকুল পৃথিবীতে শুধু টিকে থাকার জন্যই এটি করেন। শ্রমিক বা কর্মচারীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে যে সম্পদ সৃষ্টি হয় তার সুফল ভোগ করেন যিনি প্রতিষ্ঠানের মালিক। মালিক-শ্রমিকের আন্তঃসম্পর্কের এ দ্বন্দ্ব চিরন্তন এবং কখনোই তা শেষ হওয়ার নয়। কারণ মালিক এবং শ্রমিকের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী এবং দ্বান্দ্বিকতায় পূর্ণ। শ্রমিক সব সময় চেষ্টা করেন তার পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্যায়ন পেতে। এজন্য তিনি যা প্রয়োজন তাই করতে পারেন। অন্য দিকে মালিক শ্রেণী সবসময়ই নিজের স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট। তিনি চেষ্টা করেন কীভাবে শ্রমিককে ঠকিয়ে বেশি লাভ অর্জন করা যায়। বর্তমানে সারা বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়জয়কার চলছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল সূত্র অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এটি প্রকৃত পক্ষে পুঁজিবাদেরই নামান্তর। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যোগ্যতররাই টিকে থাকবে এটাই মেনে নেয়া হয়। পুঁজিবাদের প্রবক্তাদের অনেকেই মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের জন্মই হয়েছে বিত্তবানদের সেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য। তাদের অধিকার বলতে কিছু থাকতে নেই। একজন শ্রমিকের সব চাহিদা যদি পূরণ করা হয়, তাহলে সে আর কর্মে মনোযোগী হবে না। বরং শ্রমিকের চাহিদা অপূর্ণ রাখো এবং সে যদি অভুক্ত থাকে তাহলে সে আন্তরিকভাবে মালিকের কাজ করতে আগ্রহী থাকবে। এটি পুঁজিবাদ বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের কথা।
এখন অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে যে, শ্রমিকের চাহিদা পূরণের মাধ্যমেই তাকে দিয়ে ভালো কাজ করিয়ে নেয়া সম্ভব। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বর্তমানে শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণের জন্য নানারকম ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শ্রমিক-কর্মচারী যারা তৃণমূল পর্যায়ে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তাদের অভুক্ত রেখে বা তাদের চাহিদা অপূর্ণ রেখে কখনোই ভালো কাজ আশা করা যায় না। কারণ অভুক্ত মানুষের কাছ থেকে কখনোই নৈতিকতা আশা করা যায় না। আর যার মাঝে নৈতিকতার অভাব থাকবে তিনি যে কোনো অন্যায় কাজ করতে পারেন। তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা আশা করা বাতুলতা মাত্র। এছাড়া উদ্বেগ নিয়ে একজন কর্মী কখনোই সর্বোচ্চ মাত্রায় উৎপাদনশীলতা প্রদর্শন করতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে ডে-কেয়ার সেন্টারের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। উন্নত দেশে অনেক আগে থেকেই ডে-কেয়ার সেন্টার সিস্টেম চালু আছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেকেই মনে করতে পারেন, কোনো কারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের অর্থই হল অকারণে ব্যয় বৃদ্ধি করা। কিন্তু আসলে তা নয়। এটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কল্যাণমূলক বিনিয়োগ। ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হলে সেই প্রতিষ্ঠানের মহিলা কর্মীদের উৎপাদনশীলতা নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে। কারণ একজন মহিলা কর্মী তার ছোট বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে এসে কখনোই কাজে মন লাগাতে পারবেন না। সব সময় বাচ্চার নিরাপত্তা নিয়ে তাকে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। এ অবস্থায় তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা কোনোভাবেই পাওয়া যাবে না। যে প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার সেন্টার আছে এবং যে প্রতিষ্ঠানে তা নেই, উভয় প্রতিষ্ঠানের মহিলা কর্মীদের উৎপাদনশীলতা একই রকম হতে পারে না।
স্মর্তব্য, শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে অথবা অনুকূল কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হলেই একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবা উৎপাদন বাড়বে সবসময় তা আশা করা যায় না। পণ্য ও সেবা উৎপাদন বাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল সাধারণভাবে মানুষের ভোগপ্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং সেই ভোগ মেটানোর জন্য আর্থিক সঙ্গতি থাকা। একটি দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব যদি বেশি হয় এবং সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে জনগণের পর্যাপ্ততা থাকে এবং মানুষের ভোগের প্রবণতা এবং সামর্থ্য বৃদ্ধি পায় তাহলে পণ্য ও সেবার জোগান বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটির মতো। উন্নত বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের তিন-চারটি দেশের মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভোগের প্রবণতা এবং ভোগের জন্য ব্যয়ের সামর্থ্য উভয়ই বেড়েছে। আগেকার দিনে সাধারণত শহরের মানুষের মাঝে ভোগের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যেত। কারণ তাদের ভোগ ব্যয়ের সামর্থ্য ছিল বেশি। তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ জনগণের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। তারা দিন এনে দিন খেত। বিলাসিতা করার সুযোগ তাদের ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এখন গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থা বেশ উন্নত হয়েছে। তারা শহুরে কালচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। মূলত দৃশ্যমান দুটি কারণ গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে সহায়তা করেছে। প্রথমত, গ্রামের মানুষের মাঝে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এমন কোনো গ্রাম সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দুই থেকে চারজন বিদেশে কর্মসংস্থান করছে না। তারা প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। স্থানীয় বেনিফিসিয়ারিরা এ রেমিটেন্সের টাকায় বিলাসিতা করছে। তারা বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধি করে চলেছে। গ্রামের মানুষও এখন শহুরে জীবনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এমন কোনো গ্রাম সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে কোনো বাড়িতেই রঙিন টিভি-ফ্রিজ নেই। অনেক গ্রামেই এখন সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে হাল চাষ হচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের কল্যাণে। যারা বিদেশে কর্মসংস্থান করছে তাদের বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ। কোনো একজন বিদেশে কর্মসংস্থান করতে পারার অর্থই হচ্ছে তার আর্থিক এবং পারিবারিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হওয়া। গত অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছে। এর বেশিরভাগই গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঞ্চালিত হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। রফতানি আয় থেকে আসছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু রফতানি আয় থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে তার সবই জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে না। কারণ রফতানি খাতে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তার একটি বিরাট অংশই কাঁচামাল আমদানিতে চলে যায়। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশীরা যে অর্থ প্রতি বছর দেশে পাঠান তার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগই গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এ দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিদেশে কর্মরত আছে। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে বেকার সমস্যার কিছুটা হলেও নিরসন হয়েছে। দেশের একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ বলেছেন, আগে শহর থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চালিত হতো। আর এখন গ্রাম থেকে আসা অর্থ শহরের অর্থনীতিকে মজবুত করছে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে তা হল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক রূপান্তর। আগেকার দিনে গ্রামের মানুষ সাধারণত নানা ধরনের ফসল ফলানোর দিকেই বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখত। এমনকি তারা শুধু ধান চাষের প্রতিই আগ্রহী ছিল। আরও কোনো ফসল যে ধানের চেয়ে লাভজনক হতে পারে তা তারা ভাবতে পারত না। অর্থাৎ ক্রপ ডাইভার্সিফিকেশনের প্রতি তারা ছিল অনেকটাই উদাসীন। গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় অন্তত ৩১ ধরনের ফসল উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও ধান উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৫ ভাগ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থায় এক ধরনের বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এখন গ্রামের মানুষ আর শুধু ধান উৎপাদনে নিজেদের কর্ম-প্রচেষ্টা সীমিত রাখছে না। তারা নানা ধরনের ছোট ছোট কারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। হাঁস-মুরগির খামার, মাছের খামার, গরু-ছাগলের খামার এখন যে কোনো গ্রামে গেলেই চোখে পড়ে। অনেকেই তাদের বাড়ির আঙ্গিনা, যা আগে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকত তাকে পরিকল্পিতভাবে সবজি চাষ বা গরু-ছাগল পালনের খামারে পরিণত করেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে মূলত সেটাই জাতীয় অর্থনীতির চাকা চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। গ্রামীণ জনগণের উৎপাদনশীলতা এবং সামর্থ্য নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয়ের সুযোগ নেই। স্বাধীনতার পর যেখানে বাংলাদেশের মানুষ ছিল সাড়ে ৭ কোটি সেখানে এখন মানুষ বেড়ে হয়েছে ১৬ কোটি। তখন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হতো ১ কোটি মেট্রিক টনের মতো। বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হচ্ছে। যদিও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি অনেকটাই কমে গেছে।
বর্তমান সরকার গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, বিশেষ করে কৃষকদের আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সিডিউল ব্যাংকগুলোকে চলতি অর্থবছরে ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ১১ ভাগ সুদে কৃষকের এ ঋণ পাওয়ার কথা। কিন্তু একই আইনে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো যদি মাইক্রো ফিন্যান্স ইনস্টিটিউটের (এমএফআই) মাধ্যমে এ ঋণ বিতরণ করে তাহলে সেক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো ১১ ভাগ সুদ চার্জ করতে পারবে। এমএফআইগুলো মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নির্দেশিত সুদ হার এবং অন্যান্য শর্ত অনুসরণ করে এ ঋণ কৃষকদের মাঝে বিতরণ করবে। এমআরএ’র নির্ধারিত সুদ হার হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৭ ভাগ। এনজিওরা ব্যাংক থেকে ১১ ভাগ সুদে কৃষি ও পল্লী ঋণ নিয়ে কৃষক পর্যায়ে তা ২৭ ভাগ সুদে বিতরণ করছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারের একটি মহতী উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের কষ্ট লাঘব এবং টার্গেট পূরণের স্বার্থে এনজিও’দের মাধ্যমে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সত্যি কৃষকের উন্নয়ন চায়, বিশেষ করে তুলনামূলক স্বল্প সুদে কৃষকদের ঋণ দিতে চায় তাহলে, ব্যাংকের মতোই এনজিওদের ক্ষেত্রে কৃষি ঋণের সুদেও সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দিতে পারে। অন্যথায় কৃষক কৃষি ও পল্লী ঋণ গ্রহণ করতে গিয়ে উচ্চ সুদ চক্রে আবদ্ধ হতে পারে; যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
এমএ খালেক :অর্থনীতি বিষয়ক কলাম লেখক
এখন অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে যে, শ্রমিকের চাহিদা পূরণের মাধ্যমেই তাকে দিয়ে ভালো কাজ করিয়ে নেয়া সম্ভব। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বর্তমানে শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণের জন্য নানারকম ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শ্রমিক-কর্মচারী যারা তৃণমূল পর্যায়ে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তাদের অভুক্ত রেখে বা তাদের চাহিদা অপূর্ণ রেখে কখনোই ভালো কাজ আশা করা যায় না। কারণ অভুক্ত মানুষের কাছ থেকে কখনোই নৈতিকতা আশা করা যায় না। আর যার মাঝে নৈতিকতার অভাব থাকবে তিনি যে কোনো অন্যায় কাজ করতে পারেন। তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা আশা করা বাতুলতা মাত্র। এছাড়া উদ্বেগ নিয়ে একজন কর্মী কখনোই সর্বোচ্চ মাত্রায় উৎপাদনশীলতা প্রদর্শন করতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে ডে-কেয়ার সেন্টারের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। উন্নত দেশে অনেক আগে থেকেই ডে-কেয়ার সেন্টার সিস্টেম চালু আছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেকেই মনে করতে পারেন, কোনো কারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের অর্থই হল অকারণে ব্যয় বৃদ্ধি করা। কিন্তু আসলে তা নয়। এটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কল্যাণমূলক বিনিয়োগ। ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হলে সেই প্রতিষ্ঠানের মহিলা কর্মীদের উৎপাদনশীলতা নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে। কারণ একজন মহিলা কর্মী তার ছোট বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে এসে কখনোই কাজে মন লাগাতে পারবেন না। সব সময় বাচ্চার নিরাপত্তা নিয়ে তাকে উদ্বিগ্ন থাকতে হবে। এ অবস্থায় তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা কোনোভাবেই পাওয়া যাবে না। যে প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার সেন্টার আছে এবং যে প্রতিষ্ঠানে তা নেই, উভয় প্রতিষ্ঠানের মহিলা কর্মীদের উৎপাদনশীলতা একই রকম হতে পারে না।
স্মর্তব্য, শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে অথবা অনুকূল কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হলেই একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবা উৎপাদন বাড়বে সবসময় তা আশা করা যায় না। পণ্য ও সেবা উৎপাদন বাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল সাধারণভাবে মানুষের ভোগপ্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং সেই ভোগ মেটানোর জন্য আর্থিক সঙ্গতি থাকা। একটি দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব যদি বেশি হয় এবং সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে জনগণের পর্যাপ্ততা থাকে এবং মানুষের ভোগের প্রবণতা এবং সামর্থ্য বৃদ্ধি পায় তাহলে পণ্য ও সেবার জোগান বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটির মতো। উন্নত বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের তিন-চারটি দেশের মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভোগের প্রবণতা এবং ভোগের জন্য ব্যয়ের সামর্থ্য উভয়ই বেড়েছে। আগেকার দিনে সাধারণত শহরের মানুষের মাঝে ভোগের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যেত। কারণ তাদের ভোগ ব্যয়ের সামর্থ্য ছিল বেশি। তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ জনগণের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। তারা দিন এনে দিন খেত। বিলাসিতা করার সুযোগ তাদের ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এখন গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থা বেশ উন্নত হয়েছে। তারা শহুরে কালচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। মূলত দৃশ্যমান দুটি কারণ গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে সহায়তা করেছে। প্রথমত, গ্রামের মানুষের মাঝে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এমন কোনো গ্রাম সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দুই থেকে চারজন বিদেশে কর্মসংস্থান করছে না। তারা প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। স্থানীয় বেনিফিসিয়ারিরা এ রেমিটেন্সের টাকায় বিলাসিতা করছে। তারা বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধি করে চলেছে। গ্রামের মানুষও এখন শহুরে জীবনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এমন কোনো গ্রাম সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে কোনো বাড়িতেই রঙিন টিভি-ফ্রিজ নেই। অনেক গ্রামেই এখন সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে হাল চাষ হচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের কল্যাণে। যারা বিদেশে কর্মসংস্থান করছে তাদের বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ। কোনো একজন বিদেশে কর্মসংস্থান করতে পারার অর্থই হচ্ছে তার আর্থিক এবং পারিবারিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হওয়া। গত অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছে। এর বেশিরভাগই গ্রামীণ অর্থনীতিতে সঞ্চালিত হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। রফতানি আয় থেকে আসছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু রফতানি আয় থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে তার সবই জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে না। কারণ রফতানি খাতে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তার একটি বিরাট অংশই কাঁচামাল আমদানিতে চলে যায়। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশীরা যে অর্থ প্রতি বছর দেশে পাঠান তার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগই গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এ দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিদেশে কর্মরত আছে। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে বেকার সমস্যার কিছুটা হলেও নিরসন হয়েছে। দেশের একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ বলেছেন, আগে শহর থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চালিত হতো। আর এখন গ্রাম থেকে আসা অর্থ শহরের অর্থনীতিকে মজবুত করছে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে তা হল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক রূপান্তর। আগেকার দিনে গ্রামের মানুষ সাধারণত নানা ধরনের ফসল ফলানোর দিকেই বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখত। এমনকি তারা শুধু ধান চাষের প্রতিই আগ্রহী ছিল। আরও কোনো ফসল যে ধানের চেয়ে লাভজনক হতে পারে তা তারা ভাবতে পারত না। অর্থাৎ ক্রপ ডাইভার্সিফিকেশনের প্রতি তারা ছিল অনেকটাই উদাসীন। গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় অন্তত ৩১ ধরনের ফসল উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও ধান উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৫ ভাগ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থায় এক ধরনের বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এখন গ্রামের মানুষ আর শুধু ধান উৎপাদনে নিজেদের কর্ম-প্রচেষ্টা সীমিত রাখছে না। তারা নানা ধরনের ছোট ছোট কারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। হাঁস-মুরগির খামার, মাছের খামার, গরু-ছাগলের খামার এখন যে কোনো গ্রামে গেলেই চোখে পড়ে। অনেকেই তাদের বাড়ির আঙ্গিনা, যা আগে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকত তাকে পরিকল্পিতভাবে সবজি চাষ বা গরু-ছাগল পালনের খামারে পরিণত করেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে মূলত সেটাই জাতীয় অর্থনীতির চাকা চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। গ্রামীণ জনগণের উৎপাদনশীলতা এবং সামর্থ্য নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয়ের সুযোগ নেই। স্বাধীনতার পর যেখানে বাংলাদেশের মানুষ ছিল সাড়ে ৭ কোটি সেখানে এখন মানুষ বেড়ে হয়েছে ১৬ কোটি। তখন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হতো ১ কোটি মেট্রিক টনের মতো। বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হচ্ছে। যদিও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি অনেকটাই কমে গেছে।
বর্তমান সরকার গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, বিশেষ করে কৃষকদের আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সিডিউল ব্যাংকগুলোকে চলতি অর্থবছরে ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ১১ ভাগ সুদে কৃষকের এ ঋণ পাওয়ার কথা। কিন্তু একই আইনে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো যদি মাইক্রো ফিন্যান্স ইনস্টিটিউটের (এমএফআই) মাধ্যমে এ ঋণ বিতরণ করে তাহলে সেক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো ১১ ভাগ সুদ চার্জ করতে পারবে। এমএফআইগুলো মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নির্দেশিত সুদ হার এবং অন্যান্য শর্ত অনুসরণ করে এ ঋণ কৃষকদের মাঝে বিতরণ করবে। এমআরএ’র নির্ধারিত সুদ হার হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৭ ভাগ। এনজিওরা ব্যাংক থেকে ১১ ভাগ সুদে কৃষি ও পল্লী ঋণ নিয়ে কৃষক পর্যায়ে তা ২৭ ভাগ সুদে বিতরণ করছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারের একটি মহতী উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের কষ্ট লাঘব এবং টার্গেট পূরণের স্বার্থে এনজিও’দের মাধ্যমে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সত্যি কৃষকের উন্নয়ন চায়, বিশেষ করে তুলনামূলক স্বল্প সুদে কৃষকদের ঋণ দিতে চায় তাহলে, ব্যাংকের মতোই এনজিওদের ক্ষেত্রে কৃষি ঋণের সুদেও সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দিতে পারে। অন্যথায় কৃষক কৃষি ও পল্লী ঋণ গ্রহণ করতে গিয়ে উচ্চ সুদ চক্রে আবদ্ধ হতে পারে; যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
এমএ খালেক :অর্থনীতি বিষয়ক কলাম লেখক
No comments