ঘুরে এলাম শেখ হাসিনার বাংলাদেশ by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
এবারের ইংরেজি নববর্ষের দিনটি আমার জীবনে আকাশ ভ্রমণের দিন। ২০১৬ সালের প্রথম দিনটি ঢাকা থেকে লন্ডনে আসার জন্য আকাশপথে কাটিয়েছি। দিন কুড়ি বাংলাদেশে ছিলাম। মাত্র এক বছর পর বাংলাদেশে গিয়ে দেখলাম, রাজধানী ঢাকার চেহারা আরও বদলে গেছে। বদলে গেছে মানুষজনও। এই বদলে যাওয়া ভালোর দিকে না মন্দের দিকে তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। আমি ভালো-মন্দ দুটো দিকই দেখেছি। মনে হয়েছে দেশের রাজনীতির একমাত্র নিয়ন্ত্রক এখন শেখ হাসিনা। আর সবাই তলিয়ে গেছেন। শত্রু-মিত্র সবাই এখন স্বীকার করছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য হাসিনা নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। দেশের জন্য, দেশকে জঙ্গি মৌলবাদীদের কবল থেকে রক্ষার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বই একমাত্র ভরসা।
এটার ভালো দিক হল, বাংলাদেশকে একটা নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে তুলে আনতে যে সবল ও সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন, শেখ হাসিনা সেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বিশ্বব্যাংক বা আমেরিকার ভ্রুকুটিকে গ্রাহ্য করেননি। আবার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ দমন এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণেও পিছপা হননি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ সব পারে। সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সে এগিয়ে যাওয়ার সাহস রাখে। এই আত্মবিশ্বাসটা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছেন। এজন্য বলা চলে একুশ শতকের নতুন বাংলাদেশের নির্মাতা শেখ হাসিনাই। বর্তমান সময়ের বাংলাদেশকে বলা চলে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।
এ অবস্থার ভালো-মন্দ দু’দিক আছে। আগেই বলেছি, এমন সবল ও একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশ একটি অকার্যকর দেশ হয়ে উঠত। কিন্তু এই নেতৃত্বের একক হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার একটা বিপদ এই, কোনোভাবে এই নেতৃত্বকে হঠাৎ ধ্বংস করা গেলে তার সাফল্যের গোটা সৌধটিই ভেঙে পড়বে। তাকে রক্ষা করার জন্য যে শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যাকআপ দরকার তা তার থাকে না। প্রশাসন তো চিরকালই সুবিধাবাদী এবং উদিত সূর্যের পূজারি।
এবার দেশের মানুষের মধ্যেও এই আশা-আশংকার দোলাচল আমি লক্ষ করেছি। দেশের জন্য অসম্ভব সব উন্নয়নকার্যে হাত দিয়ে হাসিনা সফল হচ্ছেন। তাতে মানুষের মুখে তার জয়ধ্বনি। কিন্তু তার রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি আওয়ামী লীগ নামে যে সংগঠন তা জনপ্রিয়তা অর্জনে তেমন এগোতে পারেনি। সাধারণ মানুষের বৃহত্তর অংশের মধ্যে একটা নেগেটিভ মনোভাব আছে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে। বিএনপি রাজনীতিতে এখন ধস নেমেছে। তবু ভবিষ্যতে বিএনপি যদি কোনো নির্বাচনে জেতে, তা জিতবে নেগেটিভ ভোটে। আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী, এমনকি সরকারে আসন গ্রহণকারী মন্ত্রী ও এমপিদের অনেকের সম্পর্কেও সত্য-মিথ্যা নানা অভিযোগ মানুষের মনে। এই অভিযোগগুলো খণ্ডন করার ব্যাপারে শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র নেই আওয়ামী লীগের। বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যতটা শক্তিশালী, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে ততটাই দুর্বল।
কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি যদি দুর্বল থাকে, তাহলে সেখানে সামরিক ও অসামরিক ব্যুরোক্রেসি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই ব্যুরোক্রেসির মাথায় ছাতা ধরে চরিত্রহীন নব্যধনীর দল। বাংলাদেশে এখন তাই ঘটেছে অথবা ঘটতে চলেছে। সমাজের আগের মূল্যবোধগুলো ধ্বংস হয়েছে। নতুন মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি। বরং অর্থের বিনিময়ে যে কোনো মূল্যবোধের বেচাকিনি চলে। শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা সর্বত্র এই মূল্যবোধহীনতার ছাপ পড়েছে। ফলে হাসিনা সরকারের আমলে দেশের যে চমৎকার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে, তা সামাজিক অবক্ষয় রোধ করতে পারেনি।
সামাজিক অবক্ষয় দ্রুত হওয়ায় মানবতাবোধ, দেশপ্রেম ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বাড়ছে, তা পূরণ করছে ধর্মান্ধতা এবং জঙ্গি মৌলবাদ। এ ঘাতক জঙ্গিদের মধ্যে শিক্ষিত তরুণদের অংশগ্রহণের মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক দেখে মনে হয় দেশের তরুণ প্রজন্মের সামনে কোনো গণতান্ত্রিক দলই আদর্শবাদের কোনো দিশা দেখাতে পারেনি। ফলে তারা দিশাহীন হয়ে টেরোরিজমের দিকে ঝুঁকছে। গত শতকের গোড়ায় অবিভক্ত বাংলায় তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেমের তাড়ায় টেরোরিস্ট হয়েছিল। তারা অনেকেই সাহসের সঙ্গে আত্মদান করেছেন। বর্তমান শতকে স্বাধীন বাংলাদেশে যে টেরোরিজমের আবির্ভাব ঘটেছে, তার পেছনে কোনো আদর্শবাদ নেই। আছে ধর্মান্ধতা। আছে জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক চক্রের আর্থিক ও অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতা। এরা নিরীহ, নির্দোষ মানুষ হত্যায় আনন্দ লাভ করে।
এই জঙ্গিবাদ দমনেই হাসিনা সরকার সময় ও শক্তি অধিক ব্যয় করছে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামাজিক নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে তার সরকার এখনও ততটা এগোতে পারেনি। বরং তার দল, সহযোগী ছাত্র ও যুব সংগঠন দারুণভাবে এই অবক্ষয় দ্বারা আক্রান্ত। ফলে সরকারের রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি খুব সুদৃঢ় নয়। হঠাৎ পাল্টা বাতাসের ধাক্কায় এই ভিত্তি সামলানো যাবে কিনা সে সন্দেহ অনেকের মনে আছে। অনেকে আবার মনে করেন, বিএনপির শিবিরে বর্তমানে যে বেহালদশা, তাতে এ দলটি শিগগির আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। অনুমানটি হয়তো সঠিক। কিন্তু বিপদ বিএনপিকে নিয়ে নয়। খালেদা-তারেকের রাজত্বের দিন না হয় শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাদের পেছনে যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপশক্তি খাপ মেরে আছে, তারা সুযোগ পেলে নতুন চেহারায়, নতুন স্লোগানের হাতিয়ার নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে। এই আশংকাবোধ করার জন্য যে রাজনৈতিক শক্তির যূথবদ্ধতা দরকার, আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের সরকার তা ঘটাতে পারছে না।
একদিকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অন্যদিকে তার সহযোগী দেশের ছোট-বড় বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর অসহায় রাজনৈতিক অবস্থান হাসিনা সরকারের বর্তমান সুদৃঢ় অবস্থাসত্ত্বেও অনেককে ভাবিত করে। এবারে পৌরসভার মেয়র নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মহাজোটের মহাবিপর্যয় এই দলগুলোর রাজনৈতিক শক্তিহীনতারই প্রমাণ দেয়। আওয়ামী লীগ অবশ্য বিরাট জয়ের অধিকারী হয়েছে। কিন্তু এই জয় সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের কোনো গ্যারান্টি নয়। ব্রিটেনেও দেখা গেছে, কোনো দল স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে জিতে সাধারণ নির্বাচনে বিরাটভাবে হেরে গেছে। পৌরসভায় নির্বাচনে জয়লাভের দ্বারা আওয়ামী লীগ অতিমাত্রায় কমপ্লাসেন্ট হলে দারুণ ভুল করবে।
এবার বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দেখেছি, মানুষের চেহারায় একটা পরিবর্তনের চিহ্ন। ছিন্নবস্ত্র মানুষের সংখ্যা খুবই কম। গ্রামের মানুষের আর্থিক সম্পত্তি ও ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। দিনমজুর পাওয়া মুশকিল। শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু এই স্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে অস্বস্তিকর দিকটি হল আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটা। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত একশ্রেণীর চাঁদাবাজ ও তোলাবাজদের অত্যাচারে ও দুর্নীতিতে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। দেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকার এত ভালো কাজ করা সত্ত্বেও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ যে জনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারেনি এটাই তার একটা বড় কারণ।
আমি যখন বাংলাদেশে তখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের মনে আশংকা ছিল, একাধিক যুদ্ধাপরাধীর দ্রুত ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর নিজামীর ফাঁসির আদেশ হয়তো রিভিউতে গিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিণত হতে পারে। সাকা চৌধুরীর ব্যাপারেও এই আশংকাটা জনমনে ছিল। সেই আশংকা যেমন সত্য হয়নি, তেমনি নিজামীর ব্যাপারেও হয়নি। লন্ডনে ফিরে এসেই জানতে পেরেছি, নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রয়েছে। তাতে জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এমনকি বিলাতের বাঙালি কমিউনিটিতেও। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানে হাসিনা সরকার যে অকুতোভয় এবং অবিচল, নিজামীর ব্যাপারেও তা প্রমাণিত হয়েছে। এই বিচার ও দণ্ডদানের ফলে বাংলাদেশের মানুষের মনে দীর্ঘদিন যাবত পোষিত আত্মগ্লানি দূর হয়েছে। জাতি হিসেবে তারা এই মনোবল ফিরে পেয়েছে যে, অন্যের ভ্রুকুটিতে তাদের ভীত হওয়ার কিছু নেই। বর্তমান হাসিনা সরকারের বড় সাফল্য, তারা জাতিকে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
আমি বাংলাদেশে থাকতেই সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত তথাকথিত জঙ্গিবাদবিরোধী সামরিক এলায়েন্সে বাংলাদেশ যোগ দেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে কিনা তা নিয়ে দেশে বিতর্ক দেখা যায়। বর্তমানে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। সৌদি আরবে শিয়া আলেমের প্রাণদণ্ডকে কেন্দ্র করে ইরানে বিক্ষোভ এবং তার ফলে তেহরান-রিয়াদ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। বাহরাইন, কাতার, সুদান ইত্যাদি কতিপয় সৌদি মিত্রদেশও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করবে? তার সৌদি এলায়েন্সে যোগ দেয়া কি সঙ্গত হয়েছে? এসব নানা প্রশ্ন উঠেছে দেশে। আমার ধারণা সৌদি এলায়েন্সে যোগ দেয়ার বিষয়টি সরকারের আরও গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব করা উচিত ছিল। এখন পরিস্থিতি যেখানে গড়িয়েছে, সেখানে হাসিনা সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ইরানের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত না হয়। আমার বিশ্বাস, শেখ হাসিনা সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে এই বিপজ্জনক বিরোধের সময়েও বাংলাদেশের জন্য একটি ভারসাম্যের নীতি গ্রহণ করতে পারবেন। জঙ্গি দমনের নামে আমরা যেন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ি, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারণ করতে হবে।
কুড়িদিন যাবৎ ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ ঘুরেছি। মনে আশংকার চাইতে আশা বেশি। অসম্ভব সব বাধা ও বিপত্তি কাটিয়েছে হাসিনা সরকার। আমার ধারণা, বর্তমানের বাধা-বিপত্তিগুলোও এই সরকার কাটিয়ে উঠবে। এজন্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে শেখ হাসিনাকে মনোযোগ দিতে হবে। হাসিনা সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তারা কিভাবে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক শক্তি বাড়াবেন এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সত্যিকার অর্থেই কিভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ফিরিয়ে আনবেন।
এটার ভালো দিক হল, বাংলাদেশকে একটা নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে তুলে আনতে যে সবল ও সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন, শেখ হাসিনা সেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বিশ্বব্যাংক বা আমেরিকার ভ্রুকুটিকে গ্রাহ্য করেননি। আবার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ দমন এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণেও পিছপা হননি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ সব পারে। সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সে এগিয়ে যাওয়ার সাহস রাখে। এই আত্মবিশ্বাসটা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছেন। এজন্য বলা চলে একুশ শতকের নতুন বাংলাদেশের নির্মাতা শেখ হাসিনাই। বর্তমান সময়ের বাংলাদেশকে বলা চলে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।
এ অবস্থার ভালো-মন্দ দু’দিক আছে। আগেই বলেছি, এমন সবল ও একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশ একটি অকার্যকর দেশ হয়ে উঠত। কিন্তু এই নেতৃত্বের একক হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার একটা বিপদ এই, কোনোভাবে এই নেতৃত্বকে হঠাৎ ধ্বংস করা গেলে তার সাফল্যের গোটা সৌধটিই ভেঙে পড়বে। তাকে রক্ষা করার জন্য যে শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যাকআপ দরকার তা তার থাকে না। প্রশাসন তো চিরকালই সুবিধাবাদী এবং উদিত সূর্যের পূজারি।
এবার দেশের মানুষের মধ্যেও এই আশা-আশংকার দোলাচল আমি লক্ষ করেছি। দেশের জন্য অসম্ভব সব উন্নয়নকার্যে হাত দিয়ে হাসিনা সফল হচ্ছেন। তাতে মানুষের মুখে তার জয়ধ্বনি। কিন্তু তার রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি আওয়ামী লীগ নামে যে সংগঠন তা জনপ্রিয়তা অর্জনে তেমন এগোতে পারেনি। সাধারণ মানুষের বৃহত্তর অংশের মধ্যে একটা নেগেটিভ মনোভাব আছে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে। বিএনপি রাজনীতিতে এখন ধস নেমেছে। তবু ভবিষ্যতে বিএনপি যদি কোনো নির্বাচনে জেতে, তা জিতবে নেগেটিভ ভোটে। আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী, এমনকি সরকারে আসন গ্রহণকারী মন্ত্রী ও এমপিদের অনেকের সম্পর্কেও সত্য-মিথ্যা নানা অভিযোগ মানুষের মনে। এই অভিযোগগুলো খণ্ডন করার ব্যাপারে শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র নেই আওয়ামী লীগের। বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যতটা শক্তিশালী, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে ততটাই দুর্বল।
কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি যদি দুর্বল থাকে, তাহলে সেখানে সামরিক ও অসামরিক ব্যুরোক্রেসি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই ব্যুরোক্রেসির মাথায় ছাতা ধরে চরিত্রহীন নব্যধনীর দল। বাংলাদেশে এখন তাই ঘটেছে অথবা ঘটতে চলেছে। সমাজের আগের মূল্যবোধগুলো ধ্বংস হয়েছে। নতুন মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি। বরং অর্থের বিনিময়ে যে কোনো মূল্যবোধের বেচাকিনি চলে। শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা সর্বত্র এই মূল্যবোধহীনতার ছাপ পড়েছে। ফলে হাসিনা সরকারের আমলে দেশের যে চমৎকার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে, তা সামাজিক অবক্ষয় রোধ করতে পারেনি।
সামাজিক অবক্ষয় দ্রুত হওয়ায় মানবতাবোধ, দেশপ্রেম ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বাড়ছে, তা পূরণ করছে ধর্মান্ধতা এবং জঙ্গি মৌলবাদ। এ ঘাতক জঙ্গিদের মধ্যে শিক্ষিত তরুণদের অংশগ্রহণের মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক দেখে মনে হয় দেশের তরুণ প্রজন্মের সামনে কোনো গণতান্ত্রিক দলই আদর্শবাদের কোনো দিশা দেখাতে পারেনি। ফলে তারা দিশাহীন হয়ে টেরোরিজমের দিকে ঝুঁকছে। গত শতকের গোড়ায় অবিভক্ত বাংলায় তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেমের তাড়ায় টেরোরিস্ট হয়েছিল। তারা অনেকেই সাহসের সঙ্গে আত্মদান করেছেন। বর্তমান শতকে স্বাধীন বাংলাদেশে যে টেরোরিজমের আবির্ভাব ঘটেছে, তার পেছনে কোনো আদর্শবাদ নেই। আছে ধর্মান্ধতা। আছে জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক চক্রের আর্থিক ও অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতা। এরা নিরীহ, নির্দোষ মানুষ হত্যায় আনন্দ লাভ করে।
এই জঙ্গিবাদ দমনেই হাসিনা সরকার সময় ও শক্তি অধিক ব্যয় করছে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামাজিক নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে তার সরকার এখনও ততটা এগোতে পারেনি। বরং তার দল, সহযোগী ছাত্র ও যুব সংগঠন দারুণভাবে এই অবক্ষয় দ্বারা আক্রান্ত। ফলে সরকারের রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি খুব সুদৃঢ় নয়। হঠাৎ পাল্টা বাতাসের ধাক্কায় এই ভিত্তি সামলানো যাবে কিনা সে সন্দেহ অনেকের মনে আছে। অনেকে আবার মনে করেন, বিএনপির শিবিরে বর্তমানে যে বেহালদশা, তাতে এ দলটি শিগগির আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। অনুমানটি হয়তো সঠিক। কিন্তু বিপদ বিএনপিকে নিয়ে নয়। খালেদা-তারেকের রাজত্বের দিন না হয় শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাদের পেছনে যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপশক্তি খাপ মেরে আছে, তারা সুযোগ পেলে নতুন চেহারায়, নতুন স্লোগানের হাতিয়ার নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে। এই আশংকাবোধ করার জন্য যে রাজনৈতিক শক্তির যূথবদ্ধতা দরকার, আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের সরকার তা ঘটাতে পারছে না।
একদিকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অন্যদিকে তার সহযোগী দেশের ছোট-বড় বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর অসহায় রাজনৈতিক অবস্থান হাসিনা সরকারের বর্তমান সুদৃঢ় অবস্থাসত্ত্বেও অনেককে ভাবিত করে। এবারে পৌরসভার মেয়র নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মহাজোটের মহাবিপর্যয় এই দলগুলোর রাজনৈতিক শক্তিহীনতারই প্রমাণ দেয়। আওয়ামী লীগ অবশ্য বিরাট জয়ের অধিকারী হয়েছে। কিন্তু এই জয় সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের কোনো গ্যারান্টি নয়। ব্রিটেনেও দেখা গেছে, কোনো দল স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে জিতে সাধারণ নির্বাচনে বিরাটভাবে হেরে গেছে। পৌরসভায় নির্বাচনে জয়লাভের দ্বারা আওয়ামী লীগ অতিমাত্রায় কমপ্লাসেন্ট হলে দারুণ ভুল করবে।
এবার বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দেখেছি, মানুষের চেহারায় একটা পরিবর্তনের চিহ্ন। ছিন্নবস্ত্র মানুষের সংখ্যা খুবই কম। গ্রামের মানুষের আর্থিক সম্পত্তি ও ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। দিনমজুর পাওয়া মুশকিল। শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু এই স্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে অস্বস্তিকর দিকটি হল আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটা। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত একশ্রেণীর চাঁদাবাজ ও তোলাবাজদের অত্যাচারে ও দুর্নীতিতে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। দেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকার এত ভালো কাজ করা সত্ত্বেও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ যে জনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারেনি এটাই তার একটা বড় কারণ।
আমি যখন বাংলাদেশে তখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের মনে আশংকা ছিল, একাধিক যুদ্ধাপরাধীর দ্রুত ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর নিজামীর ফাঁসির আদেশ হয়তো রিভিউতে গিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিণত হতে পারে। সাকা চৌধুরীর ব্যাপারেও এই আশংকাটা জনমনে ছিল। সেই আশংকা যেমন সত্য হয়নি, তেমনি নিজামীর ব্যাপারেও হয়নি। লন্ডনে ফিরে এসেই জানতে পেরেছি, নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রয়েছে। তাতে জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এমনকি বিলাতের বাঙালি কমিউনিটিতেও। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানে হাসিনা সরকার যে অকুতোভয় এবং অবিচল, নিজামীর ব্যাপারেও তা প্রমাণিত হয়েছে। এই বিচার ও দণ্ডদানের ফলে বাংলাদেশের মানুষের মনে দীর্ঘদিন যাবত পোষিত আত্মগ্লানি দূর হয়েছে। জাতি হিসেবে তারা এই মনোবল ফিরে পেয়েছে যে, অন্যের ভ্রুকুটিতে তাদের ভীত হওয়ার কিছু নেই। বর্তমান হাসিনা সরকারের বড় সাফল্য, তারা জাতিকে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
আমি বাংলাদেশে থাকতেই সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত তথাকথিত জঙ্গিবাদবিরোধী সামরিক এলায়েন্সে বাংলাদেশ যোগ দেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে কিনা তা নিয়ে দেশে বিতর্ক দেখা যায়। বর্তমানে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। সৌদি আরবে শিয়া আলেমের প্রাণদণ্ডকে কেন্দ্র করে ইরানে বিক্ষোভ এবং তার ফলে তেহরান-রিয়াদ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। বাহরাইন, কাতার, সুদান ইত্যাদি কতিপয় সৌদি মিত্রদেশও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করবে? তার সৌদি এলায়েন্সে যোগ দেয়া কি সঙ্গত হয়েছে? এসব নানা প্রশ্ন উঠেছে দেশে। আমার ধারণা সৌদি এলায়েন্সে যোগ দেয়ার বিষয়টি সরকারের আরও গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব করা উচিত ছিল। এখন পরিস্থিতি যেখানে গড়িয়েছে, সেখানে হাসিনা সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ইরানের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত না হয়। আমার বিশ্বাস, শেখ হাসিনা সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে এই বিপজ্জনক বিরোধের সময়েও বাংলাদেশের জন্য একটি ভারসাম্যের নীতি গ্রহণ করতে পারবেন। জঙ্গি দমনের নামে আমরা যেন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ি, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারণ করতে হবে।
কুড়িদিন যাবৎ ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ ঘুরেছি। মনে আশংকার চাইতে আশা বেশি। অসম্ভব সব বাধা ও বিপত্তি কাটিয়েছে হাসিনা সরকার। আমার ধারণা, বর্তমানের বাধা-বিপত্তিগুলোও এই সরকার কাটিয়ে উঠবে। এজন্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে শেখ হাসিনাকে মনোযোগ দিতে হবে। হাসিনা সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তারা কিভাবে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক শক্তি বাড়াবেন এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সত্যিকার অর্থেই কিভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ফিরিয়ে আনবেন।
No comments