নির্বাচন দেশে-বিদেশে by তাইছির মাহমুদ
গেল বছরের এপ্রিলে বাবার আকস্মিক
মৃত্যুজনিত কারণে দেশে গিয়েছিলাম। এসময় দুই সপ্তাহ সময় কাটে গ্রামের বাড়িতে
একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে। বিভিন্ন সময় বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আড্ডা
বসত। এতে গ্রামের হালচাল থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশ ও জাতি কোনো
কিছুই বাদ পড়ত না। রাজনীতির আলোচনায় প্রাধান্য পেত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির
ভোটারবিহীন নির্বাচন। যে নির্বাচনে ৫ শতাংশেরও কম ভোট পড়েছিল। নির্বাচনী
আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল- কে কীভাবে ভোট দিলেন, কতটি দিলেন।
চাচাতো ভাই শাহেদ স্থানীয় ছাত্রলীগের একজন মাঝারি কিসিমের কর্মী। বয়স আঠারোর বেশি হয়নি এখনও। সে-ও আলোচনায় যোগ দিল। নিজের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলল- ভাই, এটা কি একটা নির্বাচন? আমি একাই ৭০টি ভোট দিয়েছি। আর বড় ভাই বললেন, তিনি ভোট কেন্দ্রে পৌঁছে দেখেন, তার ভোটটি এরই মধ্যে দেয়া হয়ে গেছে। তিনি যখন কেন্দ্রে পৌঁছলেন তখন তাকে দেখে বন্ধু-বান্ধবরা অট্টহাসি দিয়ে বলল, কষ্ট করে আসার কী দরকার ছিল? আমরা তো আছি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের গল্পের বোধহয় শেষ নেই। ওই নির্বাচন কেমন ছিল- সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারে থাকলেও আমরা সবই জেনেছি। সংবাদপত্রে তো বটেই, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বদান্যতায় প্রকাশ্যে ভোট জালিয়াতির দৃশ্য দেখে লজ্জায় মুখ ঢাকতে হয়েছে। এ কেমন নির্বাচন? পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে একের পর এক ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢোকানোর দৃশ্য এখনও চোখের সামনে ভেসে আছে। মনে আছে, ওই সময় সেন্ট্রাল লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে এক ইংলিশ সাংবাদিকের কাছে লজ্জা পেতে হয়েছিল। আমার প্রতি ব্যঙ্গ প্রশ্ন ছুড়ে বলেছিলেন- তোমাদের দেশে কি এভাবে ভোট হয়? আমার তখন কোনো জবাব ছিল না।
কী জবাব দেব? কোথায় বাংলাদেশ আর কোথায় ব্রিটেন। এখানে কেউ জাল ভোট দেয়ার কিংবা নেয়ার চিন্তাই করতে পারে না। জাল ভোট শব্দের সঙ্গে ব্রিটিশরা মোটেও পরিচিত নন। সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে। সারা দিন একজন-দুইজন করে এসে ভোট দিয়ে যায়। আর বৃষ্টি হলে ভোট কেন্দ্র থাকে অনেকটাই ফাঁকা। ভোট কেন্দ্রের আশপাশে দাঁড়িয়ে দু-চারজন এজেন্টকে তাদের প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট বিলি করতে দেখা যায়। এছাড়া সেখানে অন্য কোনো মানুষই পাওয়া যায় না। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে এসে ভোট প্রদান করে। ভোট কেন্দ্রে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয়ে পুলিশ ডাকতে হয়েছে- এমন কোনো খবর কখনও শুনিনি। আর বাংলাদেশে তো ভোট একটা উৎসব। তাছাড়া জাল ভোটের মহোৎসব চলে সব আমলেই। বিএনপির আমলে ধানের শীষেই সর্বাধিক ভোট পড়ত। আর আওয়ামী লীগ আমলে নৌকা ভর্তি করে দেশবাসী ভোট দেয়। এ ছিল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগের ও তা বাতিল হওয়ার পরের বাংলাদেশের নির্বাচনী হালচাল।
প্রায় দুই যুগ আগের ঘটনা। একবার স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে এক মেম্বার প্রার্থীর পোলিং এজেন্টের দায়িত্বে ছিলাম। তখন আইডি কার্ড বলতে কিছু ছিল না। তাই এজেন্টদের প্রধান কাজ ছিল ভোটারদের শনাক্ত করা। প্রথমদিকে আমরা সব এজেন্টই বাধাহীন দায়িত্ব পালন করছিলাম। কিন্তু বিকালের দিকে দেখা দেয় চরম বিপত্তি। দেখতে পাই ভোটার তালিকায় এক ব্যক্তির নাম, কিন্তু ভোট দিতে এসেছেন অন্যজন। ভোটার লিস্টের নামের সঙ্গে ভোটারের নামের মিল নেই। ভোটার তালিকার নামের ব্যক্তি বিদেশে থাকেন। প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে অভিযোগ করলে তিনি ভোটারকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন। এভাবে যখন চার থেকে পাঁচজনকে বের করে দেয়া হল তখনই দেখা দিল বড় সমস্যা। গ্রামের একজন মাতবর ভোট কেন্দ্রের দরজায় দাঁড়িয়ে হুমকি দিয়ে গেলেন, আর কোনো ভোটারকে আটকালে তিনি আমাকে দেখে নেবেন। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ ভোট কেন্দ্র ভর্তি লোকজন। প্রিসাইডিং অফিসারসহ অন্য কর্মকর্তারা রয়েছেন। আশপাশে পুলিশও আছে। কেউ কিছুই বলল না। ভাবলাম ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী। নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে তো আর লাভ নেই। এরপর থেকে নিশ্চুপ থাকলাম। একের পর এক জাল ভোট দেয়া চলল। বিদেশে থাকা গ্রামের যুবকদের কোনো ভোটই বাকি থাকল না। সব ভোটই দেয়া হয়ে গেল।
ভোট গ্রহণের সময় শেষ হয়ে এলে আর কোনো ভোটার না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের এক প্রার্থীর এজেন্ট উঠে গিয়ে অবশিষ্ট ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দিলেন। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। দেখলেন প্রিসাইডিং অফিসার ও অন্য কর্মকর্তারা। বিকালে ভোট গণনা শুরু হল। দেখা গেল ক্ষমতাসীন দলের মদদপুষ্ট প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন।
এই ছিল নির্বাচনী কাজে দায়িত্ব পালনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। তখনকার সময় প্রচারমাধ্যম বলতে বিটিভি ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। আজকের দিনের মতো সোস্যাল মিডিয়া ছিল না। সংবাদপত্র ছিল হাতেগোনা। তাই নির্বাচনে কী ধরনের জালিয়াতি হতো ভেতরে না থাকলে বাইরে থেকে বুঝা মুশকিল ছিল।
এখন জালিয়াতি দেখার জন্য ভোট কেন্দ্রের ভেতরে থাকার প্রয়োজন হয় না। বিশ্বের যে কোনো দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে আয়নায় যেভাবে মুখ দেখা যায় সেভাবেই ভোট জালিয়াতির দৃশ্য দেখা যায়। যেমন দেখলাম ৩০ ডিসেম্বরের পৌর নির্বাচনে। পুলিশের সহযোগিতায় পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের সামনে একের পর এক নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে বাক্স ভর্তি করে দেয়া হচ্ছে। এক মেয়র প্রার্থীকে পিটিয়ে আধমরা করে ছাড়ার ঘটনাতো সোস্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
একাত্তর টিভির সিলেট ব্যুরো চিফ ইকবাল মাহমুদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা পৌরসভায়। দুপুরে বড়লেখা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে তাদের টিমকে ঘিরে ফেলে সরকারি ছাত্র ও যুব সংগঠনের শত লোক। তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। সাহায্য চেয়ে পুলিশের কাছ থেকে জুটে ভর্ৎসনা। ওসি পরিচয়ে একজন তাদের শাসিয়েছেন। ক্যামেরা বন্ধ করে তাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর কোনোমতে সেখান থেকে অক্ষত ফিরতে পেরেছেন তারা। এ নিয়ে ফেসবুকে ইকবাল মাহমুদের দেয়া জবানবন্দি সাড়া ফেলেছে।
যমুনা টিভির একটি লাইভ রিপোর্টে দেখা গেছে, একটি ভোট কেন্দ্রের বাইরে গ্রামের অর্ধশতাধিক তরুণ সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ভোট প্রদানের জন্য। তাদের কাছে কোনো আইডি কার্ড নেই। রিপোর্টার তাদের পিতার নাম জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, জবাবে কেউই তাদের পিতার নাম বলতে পারেনি।
টিভি সাক্ষাৎকারে এক নির্বাচন কর্মকর্তার অসহায়ত্ব দেখে নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে। তিনি সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন, আপনারা তো দেখছেনই। প্রশ্ন করে বিপদে ফেলবেন না প্লিজ। আমাকে জান নিয়ে বাড়ি ফিরতে দিন।
নির্বাচন কর্মকর্তা কেন এ কথা বলছেন- তার কি ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন আছে? তিনি নিশ্চয়ই মনের সুখে কথাটি বলেননি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতিনেতাদের হুমকির মুখে তাকে ভোট কেন্দ্র ছেড়ে দিতে হয়েছে। হ্যাঁ, সত্যিই তো। জান বাঁচানোই ফরজ। সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়ে নিজেকে বাঁচানো জরুরি। পুলিশকেও চাকরি রক্ষা করতে হবে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে চাকরি চলেও যেতে পারে।
অবাধ জাল ভোট আর কেন্দ্র দখলের পরও প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকিবউদ্দীন বলেছেন নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। হ্যাঁ, তিনি তো বলবেনই। কারণ ঘুমন্ত মানুষকেই শুধু জাগানো যায়। জাগানো মানুষকে জাগানো যায় না। তিনি তো জেগেই ঘুমাচ্ছেন। দেশবাসী জানে তিনিও অসহায়। কিন্তু সেটা তিনি বলছেন না চাকরিচ্যুতির ভয়ে। চাকরি চলে গেলে উপোস মরবেন, তাই জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেও বলছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগের স্বার্থে দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার চেয়ে সিইসির চাকরি ছেড়ে উপোস থাকাটাই তার জন্য কি সম্মানের ছিল না?
তাইছির মাহমুদ : সম্পাদক, দৈনিক দেশ, লন্ডন
চাচাতো ভাই শাহেদ স্থানীয় ছাত্রলীগের একজন মাঝারি কিসিমের কর্মী। বয়স আঠারোর বেশি হয়নি এখনও। সে-ও আলোচনায় যোগ দিল। নিজের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলল- ভাই, এটা কি একটা নির্বাচন? আমি একাই ৭০টি ভোট দিয়েছি। আর বড় ভাই বললেন, তিনি ভোট কেন্দ্রে পৌঁছে দেখেন, তার ভোটটি এরই মধ্যে দেয়া হয়ে গেছে। তিনি যখন কেন্দ্রে পৌঁছলেন তখন তাকে দেখে বন্ধু-বান্ধবরা অট্টহাসি দিয়ে বলল, কষ্ট করে আসার কী দরকার ছিল? আমরা তো আছি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের গল্পের বোধহয় শেষ নেই। ওই নির্বাচন কেমন ছিল- সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারে থাকলেও আমরা সবই জেনেছি। সংবাদপত্রে তো বটেই, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বদান্যতায় প্রকাশ্যে ভোট জালিয়াতির দৃশ্য দেখে লজ্জায় মুখ ঢাকতে হয়েছে। এ কেমন নির্বাচন? পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে একের পর এক ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢোকানোর দৃশ্য এখনও চোখের সামনে ভেসে আছে। মনে আছে, ওই সময় সেন্ট্রাল লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে এক ইংলিশ সাংবাদিকের কাছে লজ্জা পেতে হয়েছিল। আমার প্রতি ব্যঙ্গ প্রশ্ন ছুড়ে বলেছিলেন- তোমাদের দেশে কি এভাবে ভোট হয়? আমার তখন কোনো জবাব ছিল না।
কী জবাব দেব? কোথায় বাংলাদেশ আর কোথায় ব্রিটেন। এখানে কেউ জাল ভোট দেয়ার কিংবা নেয়ার চিন্তাই করতে পারে না। জাল ভোট শব্দের সঙ্গে ব্রিটিশরা মোটেও পরিচিত নন। সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলে। সারা দিন একজন-দুইজন করে এসে ভোট দিয়ে যায়। আর বৃষ্টি হলে ভোট কেন্দ্র থাকে অনেকটাই ফাঁকা। ভোট কেন্দ্রের আশপাশে দাঁড়িয়ে দু-চারজন এজেন্টকে তাদের প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট বিলি করতে দেখা যায়। এছাড়া সেখানে অন্য কোনো মানুষই পাওয়া যায় না। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে এসে ভোট প্রদান করে। ভোট কেন্দ্রে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ভয়ে পুলিশ ডাকতে হয়েছে- এমন কোনো খবর কখনও শুনিনি। আর বাংলাদেশে তো ভোট একটা উৎসব। তাছাড়া জাল ভোটের মহোৎসব চলে সব আমলেই। বিএনপির আমলে ধানের শীষেই সর্বাধিক ভোট পড়ত। আর আওয়ামী লীগ আমলে নৌকা ভর্তি করে দেশবাসী ভোট দেয়। এ ছিল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগের ও তা বাতিল হওয়ার পরের বাংলাদেশের নির্বাচনী হালচাল।
প্রায় দুই যুগ আগের ঘটনা। একবার স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে এক মেম্বার প্রার্থীর পোলিং এজেন্টের দায়িত্বে ছিলাম। তখন আইডি কার্ড বলতে কিছু ছিল না। তাই এজেন্টদের প্রধান কাজ ছিল ভোটারদের শনাক্ত করা। প্রথমদিকে আমরা সব এজেন্টই বাধাহীন দায়িত্ব পালন করছিলাম। কিন্তু বিকালের দিকে দেখা দেয় চরম বিপত্তি। দেখতে পাই ভোটার তালিকায় এক ব্যক্তির নাম, কিন্তু ভোট দিতে এসেছেন অন্যজন। ভোটার লিস্টের নামের সঙ্গে ভোটারের নামের মিল নেই। ভোটার তালিকার নামের ব্যক্তি বিদেশে থাকেন। প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে অভিযোগ করলে তিনি ভোটারকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন। এভাবে যখন চার থেকে পাঁচজনকে বের করে দেয়া হল তখনই দেখা দিল বড় সমস্যা। গ্রামের একজন মাতবর ভোট কেন্দ্রের দরজায় দাঁড়িয়ে হুমকি দিয়ে গেলেন, আর কোনো ভোটারকে আটকালে তিনি আমাকে দেখে নেবেন। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ ভোট কেন্দ্র ভর্তি লোকজন। প্রিসাইডিং অফিসারসহ অন্য কর্মকর্তারা রয়েছেন। আশপাশে পুলিশও আছে। কেউ কিছুই বলল না। ভাবলাম ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী। নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে তো আর লাভ নেই। এরপর থেকে নিশ্চুপ থাকলাম। একের পর এক জাল ভোট দেয়া চলল। বিদেশে থাকা গ্রামের যুবকদের কোনো ভোটই বাকি থাকল না। সব ভোটই দেয়া হয়ে গেল।
ভোট গ্রহণের সময় শেষ হয়ে এলে আর কোনো ভোটার না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের এক প্রার্থীর এজেন্ট উঠে গিয়ে অবশিষ্ট ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দিলেন। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। দেখলেন প্রিসাইডিং অফিসার ও অন্য কর্মকর্তারা। বিকালে ভোট গণনা শুরু হল। দেখা গেল ক্ষমতাসীন দলের মদদপুষ্ট প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন।
এই ছিল নির্বাচনী কাজে দায়িত্ব পালনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। তখনকার সময় প্রচারমাধ্যম বলতে বিটিভি ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। আজকের দিনের মতো সোস্যাল মিডিয়া ছিল না। সংবাদপত্র ছিল হাতেগোনা। তাই নির্বাচনে কী ধরনের জালিয়াতি হতো ভেতরে না থাকলে বাইরে থেকে বুঝা মুশকিল ছিল।
এখন জালিয়াতি দেখার জন্য ভোট কেন্দ্রের ভেতরে থাকার প্রয়োজন হয় না। বিশ্বের যে কোনো দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে আয়নায় যেভাবে মুখ দেখা যায় সেভাবেই ভোট জালিয়াতির দৃশ্য দেখা যায়। যেমন দেখলাম ৩০ ডিসেম্বরের পৌর নির্বাচনে। পুলিশের সহযোগিতায় পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারের সামনে একের পর এক নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে বাক্স ভর্তি করে দেয়া হচ্ছে। এক মেয়র প্রার্থীকে পিটিয়ে আধমরা করে ছাড়ার ঘটনাতো সোস্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
একাত্তর টিভির সিলেট ব্যুরো চিফ ইকবাল মাহমুদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা পৌরসভায়। দুপুরে বড়লেখা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে তাদের টিমকে ঘিরে ফেলে সরকারি ছাত্র ও যুব সংগঠনের শত লোক। তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। সাহায্য চেয়ে পুলিশের কাছ থেকে জুটে ভর্ৎসনা। ওসি পরিচয়ে একজন তাদের শাসিয়েছেন। ক্যামেরা বন্ধ করে তাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর কোনোমতে সেখান থেকে অক্ষত ফিরতে পেরেছেন তারা। এ নিয়ে ফেসবুকে ইকবাল মাহমুদের দেয়া জবানবন্দি সাড়া ফেলেছে।
যমুনা টিভির একটি লাইভ রিপোর্টে দেখা গেছে, একটি ভোট কেন্দ্রের বাইরে গ্রামের অর্ধশতাধিক তরুণ সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ভোট প্রদানের জন্য। তাদের কাছে কোনো আইডি কার্ড নেই। রিপোর্টার তাদের পিতার নাম জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, জবাবে কেউই তাদের পিতার নাম বলতে পারেনি।
টিভি সাক্ষাৎকারে এক নির্বাচন কর্মকর্তার অসহায়ত্ব দেখে নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে। তিনি সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন, আপনারা তো দেখছেনই। প্রশ্ন করে বিপদে ফেলবেন না প্লিজ। আমাকে জান নিয়ে বাড়ি ফিরতে দিন।
নির্বাচন কর্মকর্তা কেন এ কথা বলছেন- তার কি ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন আছে? তিনি নিশ্চয়ই মনের সুখে কথাটি বলেননি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতিনেতাদের হুমকির মুখে তাকে ভোট কেন্দ্র ছেড়ে দিতে হয়েছে। হ্যাঁ, সত্যিই তো। জান বাঁচানোই ফরজ। সুষ্ঠু নির্বাচনের চেয়ে নিজেকে বাঁচানো জরুরি। পুলিশকেও চাকরি রক্ষা করতে হবে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে চাকরি চলেও যেতে পারে।
অবাধ জাল ভোট আর কেন্দ্র দখলের পরও প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকিবউদ্দীন বলেছেন নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। হ্যাঁ, তিনি তো বলবেনই। কারণ ঘুমন্ত মানুষকেই শুধু জাগানো যায়। জাগানো মানুষকে জাগানো যায় না। তিনি তো জেগেই ঘুমাচ্ছেন। দেশবাসী জানে তিনিও অসহায়। কিন্তু সেটা তিনি বলছেন না চাকরিচ্যুতির ভয়ে। চাকরি চলে গেলে উপোস মরবেন, তাই জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেও বলছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগের স্বার্থে দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার চেয়ে সিইসির চাকরি ছেড়ে উপোস থাকাটাই তার জন্য কি সম্মানের ছিল না?
তাইছির মাহমুদ : সম্পাদক, দৈনিক দেশ, লন্ডন
No comments