নতুন বছরে অর্থনীতির জন্য রয়েছে ৫ চ্যালেঞ্জ : ড. জাহিদ হোসেন by মনির হোসেন ও মামুন আব্দুল্লাহ
নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ৫টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব হল আন্তর্জাতিক অর্থনীতির নেতিবাচক পরিস্থিতি, দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, আর্থিক খাতে বিভিন্ন সংস্কার এবং সরকার ঘোষিত অর্থনৈতিক জোন বাস্তবায়ন। এসব চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারলে সরকারের কাক্সিক্ষত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এসব কথা বলেন। শীর্ষ এই অর্থনীতিবিদের মতে, দীর্ঘদিন থেকে বিনিয়োগ পরিস্থিতিও দুর্বল। এই দুর্বলতা কাটাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও এগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। ফলে আগামী ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে তেমন কোনো সুখবর নেই। এ সময় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সুপারিশ করেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
যুগান্তর : দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতার কারণ কী?
ড. জাহিদ হোসেন : গত বছরের প্রথম ৩ মাসে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলা চলে অচল ছিল। এ বছর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশংকা কিছুটা কম। তবে তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে কিনা এর নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। এই অনিশ্চয়তার কারণেই বিনিয়োগে গতি সঞ্চার হচ্ছে না। আগামীতে অর্থনীতির জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ।
বিনিয়োগের হার জিডিপির ৩৪-৩৫ শতাংশে নিয়ে যেতে না পারলে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির হার অর্জন হবে না। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিনিয়োগের হার ২৮ শতাংশ। বিনিয়োগেই এই গ্যাপ পূরণ করতে হবে। এই বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো ছিল, তা এখনও রয়ে গেছে। এজন্য বিনিয়োগের হার ৩৪ শতাংশে উঠে যাবে এমন ‘কনভিনসিভ এভিডেন্স’ বা বাস্তবসম্মত কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ বিনিয়োগের সেই পরিবেশ তৈরি হয়নি।
যুগান্তর : ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের বাধা কী?
ড. জাহিদ হোসেন : অনিশ্চয়তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ঘাটতিতে অবকাঠামোগত দুর্বলতা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। যা বাংলাদেশে এখনও প্রকট। ভিয়েতনামসহ বিশ্বের অন্য প্রতিযোগী দেশগুলো এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে। এ কারণে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে সব সময়ই পিছিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে যেসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল তা এখনও বহাল আছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে এখনও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতি তো আছেই। এছাড়া ব্যক্তি খাতের বড় বিনিয়োগ ভূমি সমস্যাও রয়েছে।
দেশের ভেতরে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এসেছে, কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটেনি। যে কোনো সময় রাজনীতি অস্থিতিশীল হবে না এমনটা কেউ বলতে পারে না। কারণ ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারিও কেউ ভাবেনি, পরবর্তী ৩ মাস দেশ অস্থির থাকবে। ছোট একটি ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হয়ে দেশ অচল হয়ে পড়েছিল। এখনও ওই নিশ্চয়তা আছে। ১৯৯০ সালের পর একটি প্রবণতা ছিল ৫ বছর পরপর দেশ চালানোর একটি নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দল ক্ষমতায় আসবে। যারা হেরে যাবে, তারা বলবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু ৩ মাস পর ঠিক হয়ে যাবে। এরপর টানা ৪ বছর স্থিতিশীল থাকবে দেশ। পঞ্চম বছরে এসে হরতাল-অবরোধ শুরু হবে। এটা বিনিয়োগকারীসহ দেশের সবার ধারণায় ছিল। কিন্তু দেশ এখন আর ওই অবস্থায় নেই। ২০১৯ সালেও নির্বাচন হলে সেটি কেমন নির্বাচন তা আমরা জানি না। বিরোধী দল সেটি মেনে নেবে কিনা। অথবা নির্বাচন নিয়ে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, সবকিছু নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইবে কিনা সেটি বিবেচ্য বিষয়।
যুগান্তর : বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন : বিশ্ব অর্থনীতির সামগ্রিক প্রেক্ষাপটও বাংলাদেশের আগামী অর্থনীতিকে কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর অন্য অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থা ভালো নয়। বেশ কিছু সময় ধরে ইউরোপে খারাপ অবস্থা চলছে। খুব শিগগিরই তা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। গ্রিস নিয়ে সমস্যায় পড়েছে পুরো ইউরোপ। এসব দেশের উৎপাদন কমছে। ফলে জ্বালানি চাহিদাও কমে আসছে।
আর বৈশ্বিক মন্দার কারণে এ বছরের রেমিটেন্স প্রবাহ কিছুটা কমে এসেছে। যদিও গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু রেমিটেন্স প্রবাহ সে অনুসারে বাড়েনি। এর মানে হল- শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও শ্রমিকের মাথাপিছু আয় কমেছে বা বাড়েনি। জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। আরও কমতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতিসহ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমে যাবে।
যুগান্তর : মিশ্র অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন : চীনের অর্থনীতির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে গড়ে দশমিক ৩ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে। এটি বাংলাদেশে রফতানি আয়ের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশ ইউরোপ-আমেরিকার পর নিজেদের তৈরি পোশাকের জন্য চীনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। চীন তাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এর মানে হল- চীনের অর্থনীতিতে গতি না বাড়লে রফতানি বাজার কাঙ্ক্ষিত হারে সম্প্রসারণ হবে না। আর বিশ্ববাজারে তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমছে।
যুগান্তর : আর্থিক খাতে সরকারের আয়ের বড় উৎস রাজস্ব আদায়। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকতে পারে- এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন : ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হবে। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল থেকে চাপও সৃষ্টি হয়েছে। পুরনো আইন দিয়ে ২০১৬ সালের ব্যবসা-বাণিজ্য চলে না। ব্যবসায় নতুন অনেক ডাইমেনশন এসেছে। এসব বিষয় ভাবতে হবে। নতুন কোম্পানি আইন, ভ্যাট আইন, কাস্টম আইন ও বিএসটিআই সংস্কারের কাজ চলছে। কিন্তু আগামীতে এগুলো বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
যুগান্তর : টিপিপিতে (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) যেসব দেশের নাম শোনা যাচ্ছে তার অন্যতম ভিয়েতনাম। এ দেশটি তৈরি পোশাক রফতানি খাতে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী। এ দেশটি শূন্য শুল্কে রফতানির সুবিধা পেলে বাংলাদেশের জন্য কী চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে?
ড. জাহিদ হোসেন : ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) বাংলাদেশের জন্য একটি মধ্যমেয়াদি চ্যালেঞ্জ। ভিয়েতনামসহ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলো এমনিতেই বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। এই চুক্তির ফলে তারা আরও সুবিধা পাবে এবং তা কাজে লাগানোর সক্ষমতা তাদের রয়েছে। বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার জন্য ২৪ থেকে ৩৬ মাস সময় পাবে। কারণ আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনের আগে এই চুক্তি পাস হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই সময়ে বাংলাদেশকে প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। শর্তপূরণ করে জিএসপি ফিরিয়ে আনতে হবে।
যুগান্তর : বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব। আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. জাহিদ হোসেন : গত দুই-এক বছরে আর্থিক খাতে বড় কেলেংকারি বা ঋণখেলাপির ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তা হওয়ার আর কোনো আশংকা নেই। ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রতিরোধে কিছুটা শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনিয়মের জন্য দায়ীদের মধ্যে ছোট ছোটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও রাঘব-বোয়ালরা বহাল তবিয়তে রয়েছে। ফলে এই প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে খুব একটা লাভ হবে না। ভবিষ্যতে আবার ঘটতে পারে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে রাঘব-বোয়ালদের কিছু হচ্ছে না। কে বা কারা এই কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত তা চিহ্নিত। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। কারা এই অর্থ পাচার করছে তা সবার জানা। শীর্ষ আমদানি-রফতানিকারকদের মধ্যে এরা রয়েছেন। কারণ ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, টাকা পাচারের বড় অংশ ওভার ইনভয়েসিং (আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখানো) এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (রফতানিতে পণ্যের দাম কম দেখানো) মাধ্যমে করা হয়েছে।
যুগান্তর : সরকার বলছে অর্থনীতির জোন তৈরির উদ্যোগ নেয়ায় কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়বে। এ উদ্যোগ আমাদের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
ড. জাহিদ হোসেন : আগামীতে বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য স্পেশাল ইকোনমিক জোন নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। চার লেন রাস্তা নির্মাণসহ গৃহীত বড় বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে হবে।
বিদেশীদের অর্থনৈতিক জোনের কথা শুধু মুখে বললেই হবে না। তা নির্মাণে গতি আনতে হবে। এছাড়া ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের বাস্তব রূপ দিতে হবে। আর্থিক খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
যুগান্তর : বিভিন্ন মহল থেকে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে বলা হচ্ছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতে হবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ড. জাহিদ হোসেন : জ্বালানি তেলের দাম অভ্যন্তরীণ বাজারে সমন্বয়ের সময় এসেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ভর্তুকি বা লোকসান পুষিয়ে নেয়ার অজুহাতে দাম না কমানো অযৌক্তিক। আন্তর্জাতিক বাজারে রেকর্ড পরিমাণ দাম কমে এসেছে, সামনের বছরও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এজন্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্য সমন্বয় করার এখনই উপযুক্ত সময়।
জ্বালানি তেল নিয়ে কথা বলছে সরকার। বলা হচ্ছে বিপিসির ৩০ হাজার কোটি টাকা লোকসান রয়েছে। এই লোকসান কাটিয়ে ওঠার পর দাম সমন্বয় করা হবে। এটা কোনো যুক্তি নয়। কারণ বিপিসির লোকসান হওয়ার কথা নয়। কারণ প্রতি বছর সরকার বিপিসিকে ভতুর্কি বাবদ টাকা দেয়া হয়। এটি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত। এসব টাকা জনগণের করের টাকা। যা খরচ হিসাবে দেখানো হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির দেনা থাকবে কেন? দাম সমন্বয়ের জন্য একটি নীতিমালা জরুরি। এটি সরকারের জন্য সহায়ক। নীতিমালাতে থাকতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ওঠানামা করলে দেশীয় বাজারে সমন্বয় করা হবে কীভাবে। যদি এখন সরকার দাম সমন্বয় না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক বেশি বাড়লেও দেশীয় বাজারে বাড়ানো কঠিন হবে।
যুগান্তর : চলতি বছর সরকারের অন্যতম ব্যয়ের খাত নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক কী প্রভাব পড়বে?
ড. জাহিদ হোসেন : বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে জিডিপিতে সরাসরি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৯ শতাংশ যুক্ত হবে। একইসঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম কমালে তা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেবে। মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমবে। যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে এখনও বেশি।
ড. জাহিদ হোসেন : গত বছরের প্রথম ৩ মাসে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলা চলে অচল ছিল। এ বছর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশংকা কিছুটা কম। তবে তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে কিনা এর নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। এই অনিশ্চয়তার কারণেই বিনিয়োগে গতি সঞ্চার হচ্ছে না। আগামীতে অর্থনীতির জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ।
বিনিয়োগের হার জিডিপির ৩৪-৩৫ শতাংশে নিয়ে যেতে না পারলে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির হার অর্জন হবে না। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিনিয়োগের হার ২৮ শতাংশ। বিনিয়োগেই এই গ্যাপ পূরণ করতে হবে। এই বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো ছিল, তা এখনও রয়ে গেছে। এজন্য বিনিয়োগের হার ৩৪ শতাংশে উঠে যাবে এমন ‘কনভিনসিভ এভিডেন্স’ বা বাস্তবসম্মত কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ বিনিয়োগের সেই পরিবেশ তৈরি হয়নি।
যুগান্তর : ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের বাধা কী?
ড. জাহিদ হোসেন : অনিশ্চয়তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ঘাটতিতে অবকাঠামোগত দুর্বলতা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। যা বাংলাদেশে এখনও প্রকট। ভিয়েতনামসহ বিশ্বের অন্য প্রতিযোগী দেশগুলো এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে। এ কারণে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে সব সময়ই পিছিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে যেসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল তা এখনও বহাল আছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে এখনও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতি তো আছেই। এছাড়া ব্যক্তি খাতের বড় বিনিয়োগ ভূমি সমস্যাও রয়েছে।
দেশের ভেতরে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এসেছে, কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটেনি। যে কোনো সময় রাজনীতি অস্থিতিশীল হবে না এমনটা কেউ বলতে পারে না। কারণ ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারিও কেউ ভাবেনি, পরবর্তী ৩ মাস দেশ অস্থির থাকবে। ছোট একটি ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হয়ে দেশ অচল হয়ে পড়েছিল। এখনও ওই নিশ্চয়তা আছে। ১৯৯০ সালের পর একটি প্রবণতা ছিল ৫ বছর পরপর দেশ চালানোর একটি নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দল ক্ষমতায় আসবে। যারা হেরে যাবে, তারা বলবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু ৩ মাস পর ঠিক হয়ে যাবে। এরপর টানা ৪ বছর স্থিতিশীল থাকবে দেশ। পঞ্চম বছরে এসে হরতাল-অবরোধ শুরু হবে। এটা বিনিয়োগকারীসহ দেশের সবার ধারণায় ছিল। কিন্তু দেশ এখন আর ওই অবস্থায় নেই। ২০১৯ সালেও নির্বাচন হলে সেটি কেমন নির্বাচন তা আমরা জানি না। বিরোধী দল সেটি মেনে নেবে কিনা। অথবা নির্বাচন নিয়ে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, সবকিছু নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইবে কিনা সেটি বিবেচ্য বিষয়।
যুগান্তর : বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন : বিশ্ব অর্থনীতির সামগ্রিক প্রেক্ষাপটও বাংলাদেশের আগামী অর্থনীতিকে কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর অন্য অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থা ভালো নয়। বেশ কিছু সময় ধরে ইউরোপে খারাপ অবস্থা চলছে। খুব শিগগিরই তা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। গ্রিস নিয়ে সমস্যায় পড়েছে পুরো ইউরোপ। এসব দেশের উৎপাদন কমছে। ফলে জ্বালানি চাহিদাও কমে আসছে।
আর বৈশ্বিক মন্দার কারণে এ বছরের রেমিটেন্স প্রবাহ কিছুটা কমে এসেছে। যদিও গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু রেমিটেন্স প্রবাহ সে অনুসারে বাড়েনি। এর মানে হল- শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও শ্রমিকের মাথাপিছু আয় কমেছে বা বাড়েনি। জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। আরও কমতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতিসহ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমে যাবে।
যুগান্তর : মিশ্র অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন : চীনের অর্থনীতির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে গড়ে দশমিক ৩ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে। এটি বাংলাদেশে রফতানি আয়ের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশ ইউরোপ-আমেরিকার পর নিজেদের তৈরি পোশাকের জন্য চীনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। চীন তাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এর মানে হল- চীনের অর্থনীতিতে গতি না বাড়লে রফতানি বাজার কাঙ্ক্ষিত হারে সম্প্রসারণ হবে না। আর বিশ্ববাজারে তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমছে।
যুগান্তর : আর্থিক খাতে সরকারের আয়ের বড় উৎস রাজস্ব আদায়। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকতে পারে- এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন : ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হবে। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল থেকে চাপও সৃষ্টি হয়েছে। পুরনো আইন দিয়ে ২০১৬ সালের ব্যবসা-বাণিজ্য চলে না। ব্যবসায় নতুন অনেক ডাইমেনশন এসেছে। এসব বিষয় ভাবতে হবে। নতুন কোম্পানি আইন, ভ্যাট আইন, কাস্টম আইন ও বিএসটিআই সংস্কারের কাজ চলছে। কিন্তু আগামীতে এগুলো বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
যুগান্তর : টিপিপিতে (ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) যেসব দেশের নাম শোনা যাচ্ছে তার অন্যতম ভিয়েতনাম। এ দেশটি তৈরি পোশাক রফতানি খাতে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী। এ দেশটি শূন্য শুল্কে রফতানির সুবিধা পেলে বাংলাদেশের জন্য কী চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে?
ড. জাহিদ হোসেন : ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) বাংলাদেশের জন্য একটি মধ্যমেয়াদি চ্যালেঞ্জ। ভিয়েতনামসহ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলো এমনিতেই বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। এই চুক্তির ফলে তারা আরও সুবিধা পাবে এবং তা কাজে লাগানোর সক্ষমতা তাদের রয়েছে। বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার জন্য ২৪ থেকে ৩৬ মাস সময় পাবে। কারণ আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনের আগে এই চুক্তি পাস হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই সময়ে বাংলাদেশকে প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। শর্তপূরণ করে জিএসপি ফিরিয়ে আনতে হবে।
যুগান্তর : বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব। আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. জাহিদ হোসেন : গত দুই-এক বছরে আর্থিক খাতে বড় কেলেংকারি বা ঋণখেলাপির ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তা হওয়ার আর কোনো আশংকা নেই। ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রতিরোধে কিছুটা শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনিয়মের জন্য দায়ীদের মধ্যে ছোট ছোটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও রাঘব-বোয়ালরা বহাল তবিয়তে রয়েছে। ফলে এই প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে খুব একটা লাভ হবে না। ভবিষ্যতে আবার ঘটতে পারে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে রাঘব-বোয়ালদের কিছু হচ্ছে না। কে বা কারা এই কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত তা চিহ্নিত। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। কারা এই অর্থ পাচার করছে তা সবার জানা। শীর্ষ আমদানি-রফতানিকারকদের মধ্যে এরা রয়েছেন। কারণ ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, টাকা পাচারের বড় অংশ ওভার ইনভয়েসিং (আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখানো) এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (রফতানিতে পণ্যের দাম কম দেখানো) মাধ্যমে করা হয়েছে।
যুগান্তর : সরকার বলছে অর্থনীতির জোন তৈরির উদ্যোগ নেয়ায় কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়বে। এ উদ্যোগ আমাদের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
ড. জাহিদ হোসেন : আগামীতে বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য স্পেশাল ইকোনমিক জোন নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। চার লেন রাস্তা নির্মাণসহ গৃহীত বড় বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে হবে।
বিদেশীদের অর্থনৈতিক জোনের কথা শুধু মুখে বললেই হবে না। তা নির্মাণে গতি আনতে হবে। এছাড়া ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের বাস্তব রূপ দিতে হবে। আর্থিক খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
যুগান্তর : বিভিন্ন মহল থেকে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে বলা হচ্ছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করতে হবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ড. জাহিদ হোসেন : জ্বালানি তেলের দাম অভ্যন্তরীণ বাজারে সমন্বয়ের সময় এসেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ভর্তুকি বা লোকসান পুষিয়ে নেয়ার অজুহাতে দাম না কমানো অযৌক্তিক। আন্তর্জাতিক বাজারে রেকর্ড পরিমাণ দাম কমে এসেছে, সামনের বছরও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এজন্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্য সমন্বয় করার এখনই উপযুক্ত সময়।
জ্বালানি তেল নিয়ে কথা বলছে সরকার। বলা হচ্ছে বিপিসির ৩০ হাজার কোটি টাকা লোকসান রয়েছে। এই লোকসান কাটিয়ে ওঠার পর দাম সমন্বয় করা হবে। এটা কোনো যুক্তি নয়। কারণ বিপিসির লোকসান হওয়ার কথা নয়। কারণ প্রতি বছর সরকার বিপিসিকে ভতুর্কি বাবদ টাকা দেয়া হয়। এটি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত। এসব টাকা জনগণের করের টাকা। যা খরচ হিসাবে দেখানো হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির দেনা থাকবে কেন? দাম সমন্বয়ের জন্য একটি নীতিমালা জরুরি। এটি সরকারের জন্য সহায়ক। নীতিমালাতে থাকতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ওঠানামা করলে দেশীয় বাজারে সমন্বয় করা হবে কীভাবে। যদি এখন সরকার দাম সমন্বয় না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক বেশি বাড়লেও দেশীয় বাজারে বাড়ানো কঠিন হবে।
যুগান্তর : চলতি বছর সরকারের অন্যতম ব্যয়ের খাত নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক কী প্রভাব পড়বে?
ড. জাহিদ হোসেন : বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে জিডিপিতে সরাসরি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৯ শতাংশ যুক্ত হবে। একইসঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম কমালে তা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেবে। মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় কমিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমবে। যা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে এখনও বেশি।
No comments