নির্বাচন : আমরা কি আবার হোঁচট খাবো? by সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল
সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল |
স্বাধীন
বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে।
একেতো স্বাধীন দেশ, তার ওপর তখনকার বাংলার মানুষের মাথার তাজ জনাব শেখ
মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু। ৩০০ সংসদীয় আসনের
নির্বাচনে মোট ১৪টি দলের প্রার্থী ছিলেন এক হাজার ৮৯ জন। স্বতন্ত্র
প্রার্থী ১১৮ জন। মহিলা প্রার্থী ছিলেন ১৫ জন। ভোট প্রদানের হার ছিল ৫৫.৬১
শতাংশ। ফলাফল : আওয়ামী লীগের আসন ২৯২ যার মধ্যে সাতজন বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। স্বতন্ত্র জয়ী ছিলেন পাঁচজন; যার মধ্যে দুইজন
হলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের। একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে একটি আসনের
নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের সে নির্বাচনের ব্যাপারে তৎকালীন ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য ৯ মার্চ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন : কমপক্ষে ৭০টি আসনে ন্যাপ ও অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিজয় সুনিশ্চিত ছিল। সেই আসনসমূহে শাসক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করত অস্ত্রের ঝনঝনানি-ভয়ভীতি-সন্ত্রাস প্রয়োগ-গুণ্ডাবাহিনী ব্যবহার-ভুয়া ভোট-পোলিং বুথ দখল-পোলিং এজেন্ট অপহরণ-বিদেশী সাহায্য সংস্থা- রেডক্রস-জাতিসঙ্ঘ সরকারি গাড়ির অপব্যবহার প্রভৃতি চরম অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের জোরপূর্বক পরাজিত করেছে। জাতীয় সংসদ আসন ২৯৪ চট্টগ্রাম-১৪ এ সংবাদপত্র-বাংলাদেশ বেতার-বাংলাদেশ টলিভিশন-ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিদেশী পত্রপত্রিকা ন্যাপপ্রার্থী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরীকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা সত্ত্বেও তাকে পরাজিত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃত্বের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছিলেন : ৩১৫ (সংরক্ষিত ১৫ মহিলা আসনসহ) সদস্যের পার্লামেন্ট-এ জনা পঁচিশেক অপজিশন মেম্বার থাকিলে সরকারি দলের কোনোই অসুবিধা হইতো না। আর এসব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য এই যে, শেখ মুজিব এই উদারতার পথে না গিয়া উল্টা পথ ধরিলেন। অনেক প্রবীণ ও দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ানকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করিলেন।
আমি দেখিয়া খুবই আতঙ্কিত ও চিন্তাযুক্ত হইলাম যে, নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী নেতৃত্ব অপজিশনের প্রতি যে মনোভাব অবলম্বন করিয়াছিলেনÑ সেটা সাময়িক অ-বিবেচনাপ্রসূত ভুল ছিল না। তারা যেন নীতি হিসেবেই এই পন্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মন্তব্য ছিল : ইতিহাসে শেখ সাহেবের স্টেটসম্যান হইবার একটা সুযোগ ছিল। তিনি সেইটা কাজে লাগাইবার পারলেন না।
মার্কিন কূটনীতিক উইলিয়াম বি. মাইলাম এর পর্যবেক্ষণ ছিলো ’৭৩-এর মার্চ মাসের নির্বাচন হলো “শেষ যাত্রার শুরু”। বিপুলভাবে নির্বাচনে জিতেছিলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা ভোট নিয়ে ছেলেখেলা করেছে এবং জালিয়াতি থেকে নিজেদের নিবৃত্ত করতে পারেনি।
’৭৩-এর ৯ মার্চ জাসদ সাধারণ সম্পাদক আ স ম আব্দুর রব সংবাদ সম্মেলনে এক লিখিত বিবৃতিতে বলেনÑ বিরোধীদলের প্রার্থীদের পরাজিত হতে বাধ্য করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে জাসদ সভাপতি-মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব:) এম এ জলিল বলেনÑ তার দলকে পোলিং এজেন্ট দিতে দেয়া হয়নি। জাল ভোট দেয়া হয়েছেÑ সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে এবং ফলাফল ঘোষণায় ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে। ১৯৭৫ এর আগস্ট-নভেম্বর পর্যন্ত বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার পরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদার গণতান্ত্রিক মনোভাবের সুযোগে ‘বাকশাল’- পরিত্যাগ করে মরহুম শেখ মুজিবের অনুসারীদের বড় অংশ আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। জেনারেল ওসমানীকে জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের বিপক্ষে প্রার্থী করে আওয়ামী জোট প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিলো। ফলাফল সকলেরই জানা। পরে অংশ নিলো ১৯৭৯ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ৩৯ আসন নিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার আসন অলঙ্কৃত করলেন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আসাদুজ্জামান। তিন বছরের মাথায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণ করেন। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি পদে বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিপক্ষে আওয়ামী জোট প্রার্থী দিলো ড. কামাল হোসেনকে। বিজিত হলেন ড. কামাল হোসেন। দৃশ্যপটে এলেন বিশ্বনিন্দিত কূটনায়ক লে.জে. এরশাদ। এলো স্বৈরশাসন। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জোটবদ্ধ এবং যুগপৎ আন্দোলন শুরু হলো। বহু প্রাণ ঝরে গেল রাজপথে।
রাতের কালো পর্দার আবরণে সমঝোতা করে আচমকা ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে অজস্র মানুষের প্রত্যাশাকে পদদলিত করে অংশ নিলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। জনগণকে বোকা বানানোর এবং ধোঁকা খাওয়ানোর সেই নির্বাচন বৈধতা পেল না। সংসদ ভেঙে গেল দুই বছরের মাথায়। যদিও একটা একতরফা নির্বাচন করলেন এরশাদ সাহেব ১৯৮৮-এ। সেই সংসদ ভেঙে গেল জনতার তীব্র প্রতিবাদ-প্রতিরোধে। নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকার প্রশ্নে যুগান্তকরী গণ প্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে ‘নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হলো শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্য এবং অ-বিতর্কিত করতে। ১৯৯১-এ অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশ পরিচালনাকারী দলের ক্যাপ্টেনসি পেলেন, হলেন সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মহিলা প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষমতার পূর্ণ মেয়াদ পার করল তৎকালীন সরকার। অশান্তির আগুনে সারা দেশ জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী আন্দোলন করলেন। মেয়াদ শেষের পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণে শর্ত জুড়ে দিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। বারবার বললেন ‘বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচন এদেশের জনগণ মেনে নেবে না।’ মেয়াদ শেষ হওয়ার ১১ মাস আগে জাতীয় সংসদ থেকে জাতীয় পার্টি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগ একযোগে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি বাস্তবায়নে সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করার সংসদীয় প্রক্রিয়াকে অসম্ভব করে দিলো। বিএনপি সে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না বলে তত্ত্বাবধায়ক বিধানকে সাংবিধানিক রূপ দিতে অপরাগ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করল বিএনপি এবং নির্বাচন কমিশন। নবগঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই পাস হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন বিল। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে নতুন নির্বাচন হলো একই বছর জুন মাসে। অংশ নিলো আওয়ামী লীগ এবং বিজয়ী হয়ে সরকার ও গঠন করল। ক্যাপ্টেনসি নিলেন শেখ হাসিনা। বিএনপি ১১৬ আসন পেল। বিরোধী দলের নেত্রী হলেন বিএনপি নেত্রী সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
১৯৯৬-২০০১ সরকার এবং সংসদীয় মেয়াদের পর সঙ্গত কারণে আবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠল। বিএনপি তার মিত্রদের নিয়ে আন্দোলনে নামল। অনেক জুলুম-অত্যাচার-কারা ভোগের যন্ত্রণা এলো বিএনপির ভাগ্যে, যার মধ্যে সবচেয়ে নির্মম হিংস্রতা হলো ঢাকার মালিবাগ মোড়ে। ২০০১-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি ড. ইকবাল এমপির কমান্ডে মালীবাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলে প্রকাশ্য দিবালোকে মির্জা আব্বাস নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। মিছিলে তার পাশে ছিলাম আমি, খায়রুল কবির খোকনসহ স্থানীয় নেতাকর্মীরা। পেছন দিক থেকে হঠাৎ অবিরাম গুলিবর্ষণে নিহত হলো যুবদল কর্মী জসিম ও একজন মহিলা নেত্রীসহ চারজন। আহত শতাধিক। যে আঘাতের স্পিøন্টার এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। মেরুদণ্ডের ৪ ও ৫ নম্বর হাড় দুই দিকে সরে গিয়েছিল। সাড়ে চার ঘণ্টা অপারেশনে কিছু স্পিøন্টার শরীর থেকে বের করা হলো এবং মেরুদণ্ডের হাড় যথাস্থানে প্রতিস্থাপিত হলো। বাকি ৪০টির বেশি ছোট ছোট গুলি মাথার পেছন থেকে কোমর হয়ে পা পর্যন্ত চিরস্থায়ী হয়ে রইল। আল্লাহর রহমতে চিরতরে পঙ্গু হওয়া থেকে বেঁচে গেছি। দুঃখ হলো শেষ পর্যন্তও তখনকার প্রধানমন্ত্রী বলেই চললেন, ‘যখন নির্বাচন দিলে আমরা জয়ী হতে পারবো তখনই দেবো।’ (প্রথম আলো ২৭ মে ১৯৯৯)। যদিও সরকারের মেয়াদ শেষে পুনরায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ২০০১ এর ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো। বিএনপি জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। আওয়ামী লীগ প্রধান সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হলেন। সে নির্বাচনে বরিশাল-২ (বাবুগঞ্জ-উজিরপুর) আসন থেকে আমি নির্বাচিত হলাম ২য়বারের মতো। (মূলত ৩য়বার) প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন : আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, ওয়ার্কার্স পার্টি প্রার্থী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) প্রার্থী গোলাম ফারুক অভি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপু এবং অন্যরা।
বিএনপি জোটের সরকার গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিলো সংসদে শপথ নেবে না। পরে নিলো। ২০০১-০৬ মেয়াদের শেষ দিকে এসে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিচারপতি কে.এম. হাসানকে বিতর্কিত আখ্যায়িত করে আবারও সারা দেশে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করলো। গান-পাউডার দিয়ে বাসে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, লগি-বৈঠা দিয়ে ধীরেসুস্থে পিটিয়ে জীবন্ত মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নেচে নেচে উল্লাস প্রকাশের পশুত্ব দেখল দেশের মানুষ। শুরু হলো আবার আঁধারের অপ-রাজনীতির খেলা। বিএনপির দুধে-ঘিয়ে পরিপুষ্ট জেনারেল এরশাদÑ জেনারেল নাসিমের মতো একই পথে এগুলেন জেনারেল মইন-জেনারেল মাসুদ, ব্রিঃ জেনারেল আমিন গং। সহযাত্রী হলো ডঃ ফকরুদ্দীন এবং আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা বললেন ‘এ সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল’। নির্বাচন হলো নাÑ জরুরি অবস্থা জারি হলো। এরপর বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনার কারাবাস। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও ব্যবসায়ীরা আটক হলেন। ছাত্র-আন্দোলন হলো।
দু’বছর পর ২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ জোট ক্ষমতায় এলো। ২ যুগব্যাপী আওয়ামী লীগের ধ্বংস প্রচেষ্টাকারীরা মন্ত্রী হলেনÑ এমপি হলেন। বিএনপি জোট সংসদে এবং রাজপথে জোর দাবি তুলল ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর অধীনে একই ধারাবাহিকতায় মেয়াদ শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। থোড়াই কেয়ার করে আওয়ামী লীগ এবং আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করল সংসদে। ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং সংসদে এমপিরা নিজ নিজ পদে বহাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেসে-খেলে জিতলেন। ১৫৪ জন এর সৌভাগ্যবানদের নির্বাচন নামে কষ্টটা করতেই হলো না। কী আনন্দ ঘরে ঘরে। একই সময় প্রত্যেক এলাকায় দু’জন করে এমপি থাকল। প্রধানমন্ত্রী তার পদে বহাল থাকলেন। অন্তবর্তী একটি রূপরেখা বাস্তবায়ন করে সোনার পাথরবাটির মতো দেশ পরিচালিত হলো; বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ নিলো না। ক্ষমতায় পুনরায় কাঁঠালের আমসত্ত্ব তৈরি হলো। সে আমসত্ত্ব খাইয়ে স্থানীয় সরকার পরিষদের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচন হলো। বিএনপি জোট অংশ নিয়ে বিশাল জয় পেল। দ্বিতীয় ধাপে ভীত হয়ে শাসক দল আবার ভোট ছিনতাই করল। হতাশ-বিতৃষ্ণ মানুষ পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করতে শুরু করল। যেটার উল্টোপিঠে আরো জোরালো কারণ হচ্ছে সিটি করপোরেশন-উপজেলা-পৌরসভা-ইউনিয়ন পরিষদের সকল স্তরে বিএনপি জামায়াত এবং জোটের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নামে পরিকল্পিত মামলা দায়ের এবং এর দোহাই দিয়ে একের পর এক বরখাস্ত করা। সিটি করপোরেশনগুলোয় মেয়রদের মধ্যে একমাত্র বাকি রয়েছে হারাধনের একটি ছেলে বরিশালের কামাল। আর সচেতন বাংলাদেশীদের মনেতো আছেই শাসকদলের প্রধান শেখ হাসিনার অমিয় বাণীÑ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুধু একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। অচিরেই সব দলের অংশগ্রহণে পরবর্তী অংশীদারিত্বভিত্তিক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু কোথায় দিগন্ত? আজ কোথাও কাউকে সহ্য করা হচ্ছে না। কথা বললেই নানামুখী হেনস্তা। বিদগ্ধ অরাজনৈতিক ব্যক্তি ড. ইউনূস, আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক মানুষ অপমানিত পদে পদে। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানোর প্রকাশ্য ঘোষণা এবং আইনগত একতরফা প্রস্তুতি সম্পন্ন। এ দলের নেতাকর্মী প্রকারভেদে প্রায় ৫০ হাজার মামলায় পাঁচ লাখ আসামি। কারাগারে প্রায় ৩০ হাজার। সংখ্যা উভয় ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রতিদিনই বাড়ছে। এ অবস্থায় ছা-পোষা নির্বাচন কমিশন দিয়ে শূন্য মাঠে গোল দেয়ার স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রস্তুতি জোর কদমে এগিয়ে চলছে। জামায়াতকে অযোগ্য করে স্ব-নামে নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে।
হায় আওয়ামী লীগ! ১৯৭০-এর নির্বাচনের আওয়ামী লীগ হারিয়ে গেছে ১৯৭৩-এ। ১৯৭৮-৭৯-৮১ তে ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিল। আবার চোরাগলিতে হারিয়ে গেল ১৯৮৬তে, ফিরে এলো ১৯৯১-এ। নিজ ঠিকানায় থাকল ১৯৯৬, ২০০১-এ। ২০০৮-এ ঠিকানা মোটামুটি স্থায়ী হলো। আবার হোঁচট খেলো ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারিতে। উদগ্রীব হয়েছে এখন ১৯৭৫-এর বাকশাল এ ঠিকানা স্থায়ী করতে। তফাৎ শুধু পুরনো ঠিকানার রি-মডেলিং। মিত্র নতুন চেহারার পুরনো মানুষেরা। কিন্তু প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কি ভুলে গেছে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম মনের খোরাক হচ্ছে রাজনীতি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের ৩৩টি দেশের মধ্যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান ১ নম্বরে। এখানে ৬৫ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রায় রাজনীতি করে।
আমাদের রাজনীতিকে শাসক দলের মারমুখো তৎপরতায় সঙ্ঘাতমুখর অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ উচ্চমাত্রার প্ররোচনা এবং পৃষ্ঠপোষণকারী শাসক দল দেশের পরিস্থিতিকে আরো বিপজ্জনকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কি না সেটা ভাবার সময় কিন্তু হাতে বেশি নেই। নিকট এবং দূর-অতীতে সে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের হয়েছে। এ জন্য সমঝোতা সহিষ্ণুতা বড় বেশি প্রয়োজন এখন। না হলে ১৯৭৩ তে জাতীয় নির্বাচনের পর মার্কিন কূটনীতিকের সেই পর্যবেক্ষণ : ৭৩-এর মার্চের নির্বাচন ছিল ‘শেষ যাত্রার শুরু’ বাস্তবায়ন হলে ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের জীবিত অভিশাপ এবং আত্মার অভিসম্পাত আমাদের বহন করতে হবে না তো? মনে রাখা দরকার, সব বিজয়ই কিন্তু গৌরবের নয়। মীরজাফরের বাহিনী যুদ্ধে পরোক্ষভাবে জয়লাভ করেছিল, সিংহাসনও পেয়েছিল। লেন্দুপ দর্জি স্বাধীন সিকিমের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু পরিণতি সবারই জানা। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহানায়ক উইনস্টন চার্চিল কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটেনের নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। পেরেছিলেন গোটা বিশ্বের মানুষের মনজয় করতে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
১৯৭৩ সালের সে নির্বাচনের ব্যাপারে তৎকালীন ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য ৯ মার্চ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন : কমপক্ষে ৭০টি আসনে ন্যাপ ও অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিজয় সুনিশ্চিত ছিল। সেই আসনসমূহে শাসক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করত অস্ত্রের ঝনঝনানি-ভয়ভীতি-সন্ত্রাস প্রয়োগ-গুণ্ডাবাহিনী ব্যবহার-ভুয়া ভোট-পোলিং বুথ দখল-পোলিং এজেন্ট অপহরণ-বিদেশী সাহায্য সংস্থা- রেডক্রস-জাতিসঙ্ঘ সরকারি গাড়ির অপব্যবহার প্রভৃতি চরম অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের জোরপূর্বক পরাজিত করেছে। জাতীয় সংসদ আসন ২৯৪ চট্টগ্রাম-১৪ এ সংবাদপত্র-বাংলাদেশ বেতার-বাংলাদেশ টলিভিশন-ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিদেশী পত্রপত্রিকা ন্যাপপ্রার্থী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরীকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা সত্ত্বেও তাকে পরাজিত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃত্বের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছিলেন : ৩১৫ (সংরক্ষিত ১৫ মহিলা আসনসহ) সদস্যের পার্লামেন্ট-এ জনা পঁচিশেক অপজিশন মেম্বার থাকিলে সরকারি দলের কোনোই অসুবিধা হইতো না। আর এসব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য এই যে, শেখ মুজিব এই উদারতার পথে না গিয়া উল্টা পথ ধরিলেন। অনেক প্রবীণ ও দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ানকে পার্লামেন্টে ঢুকিতে না দিবার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করিলেন।
আমি দেখিয়া খুবই আতঙ্কিত ও চিন্তাযুক্ত হইলাম যে, নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী নেতৃত্ব অপজিশনের প্রতি যে মনোভাব অবলম্বন করিয়াছিলেনÑ সেটা সাময়িক অ-বিবেচনাপ্রসূত ভুল ছিল না। তারা যেন নীতি হিসেবেই এই পন্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মন্তব্য ছিল : ইতিহাসে শেখ সাহেবের স্টেটসম্যান হইবার একটা সুযোগ ছিল। তিনি সেইটা কাজে লাগাইবার পারলেন না।
মার্কিন কূটনীতিক উইলিয়াম বি. মাইলাম এর পর্যবেক্ষণ ছিলো ’৭৩-এর মার্চ মাসের নির্বাচন হলো “শেষ যাত্রার শুরু”। বিপুলভাবে নির্বাচনে জিতেছিলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা ভোট নিয়ে ছেলেখেলা করেছে এবং জালিয়াতি থেকে নিজেদের নিবৃত্ত করতে পারেনি।
’৭৩-এর ৯ মার্চ জাসদ সাধারণ সম্পাদক আ স ম আব্দুর রব সংবাদ সম্মেলনে এক লিখিত বিবৃতিতে বলেনÑ বিরোধীদলের প্রার্থীদের পরাজিত হতে বাধ্য করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে জাসদ সভাপতি-মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব:) এম এ জলিল বলেনÑ তার দলকে পোলিং এজেন্ট দিতে দেয়া হয়নি। জাল ভোট দেয়া হয়েছেÑ সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে এবং ফলাফল ঘোষণায় ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে। ১৯৭৫ এর আগস্ট-নভেম্বর পর্যন্ত বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার পরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদার গণতান্ত্রিক মনোভাবের সুযোগে ‘বাকশাল’- পরিত্যাগ করে মরহুম শেখ মুজিবের অনুসারীদের বড় অংশ আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। জেনারেল ওসমানীকে জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের বিপক্ষে প্রার্থী করে আওয়ামী জোট প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিলো। ফলাফল সকলেরই জানা। পরে অংশ নিলো ১৯৭৯ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ৩৯ আসন নিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার আসন অলঙ্কৃত করলেন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আসাদুজ্জামান। তিন বছরের মাথায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণ করেন। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি পদে বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিপক্ষে আওয়ামী জোট প্রার্থী দিলো ড. কামাল হোসেনকে। বিজিত হলেন ড. কামাল হোসেন। দৃশ্যপটে এলেন বিশ্বনিন্দিত কূটনায়ক লে.জে. এরশাদ। এলো স্বৈরশাসন। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জোটবদ্ধ এবং যুগপৎ আন্দোলন শুরু হলো। বহু প্রাণ ঝরে গেল রাজপথে।
রাতের কালো পর্দার আবরণে সমঝোতা করে আচমকা ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে অজস্র মানুষের প্রত্যাশাকে পদদলিত করে অংশ নিলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। জনগণকে বোকা বানানোর এবং ধোঁকা খাওয়ানোর সেই নির্বাচন বৈধতা পেল না। সংসদ ভেঙে গেল দুই বছরের মাথায়। যদিও একটা একতরফা নির্বাচন করলেন এরশাদ সাহেব ১৯৮৮-এ। সেই সংসদ ভেঙে গেল জনতার তীব্র প্রতিবাদ-প্রতিরোধে। নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকার প্রশ্নে যুগান্তকরী গণ প্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে ‘নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হলো শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্য এবং অ-বিতর্কিত করতে। ১৯৯১-এ অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশ পরিচালনাকারী দলের ক্যাপ্টেনসি পেলেন, হলেন সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মহিলা প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষমতার পূর্ণ মেয়াদ পার করল তৎকালীন সরকার। অশান্তির আগুনে সারা দেশ জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী আন্দোলন করলেন। মেয়াদ শেষের পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণে শর্ত জুড়ে দিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। বারবার বললেন ‘বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচন এদেশের জনগণ মেনে নেবে না।’ মেয়াদ শেষ হওয়ার ১১ মাস আগে জাতীয় সংসদ থেকে জাতীয় পার্টি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগ একযোগে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি বাস্তবায়নে সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করার সংসদীয় প্রক্রিয়াকে অসম্ভব করে দিলো। বিএনপি সে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না বলে তত্ত্বাবধায়ক বিধানকে সাংবিধানিক রূপ দিতে অপরাগ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করল বিএনপি এবং নির্বাচন কমিশন। নবগঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই পাস হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন বিল। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে নতুন নির্বাচন হলো একই বছর জুন মাসে। অংশ নিলো আওয়ামী লীগ এবং বিজয়ী হয়ে সরকার ও গঠন করল। ক্যাপ্টেনসি নিলেন শেখ হাসিনা। বিএনপি ১১৬ আসন পেল। বিরোধী দলের নেত্রী হলেন বিএনপি নেত্রী সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
১৯৯৬-২০০১ সরকার এবং সংসদীয় মেয়াদের পর সঙ্গত কারণে আবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠল। বিএনপি তার মিত্রদের নিয়ে আন্দোলনে নামল। অনেক জুলুম-অত্যাচার-কারা ভোগের যন্ত্রণা এলো বিএনপির ভাগ্যে, যার মধ্যে সবচেয়ে নির্মম হিংস্রতা হলো ঢাকার মালিবাগ মোড়ে। ২০০১-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি ড. ইকবাল এমপির কমান্ডে মালীবাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলে প্রকাশ্য দিবালোকে মির্জা আব্বাস নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। মিছিলে তার পাশে ছিলাম আমি, খায়রুল কবির খোকনসহ স্থানীয় নেতাকর্মীরা। পেছন দিক থেকে হঠাৎ অবিরাম গুলিবর্ষণে নিহত হলো যুবদল কর্মী জসিম ও একজন মহিলা নেত্রীসহ চারজন। আহত শতাধিক। যে আঘাতের স্পিøন্টার এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। মেরুদণ্ডের ৪ ও ৫ নম্বর হাড় দুই দিকে সরে গিয়েছিল। সাড়ে চার ঘণ্টা অপারেশনে কিছু স্পিøন্টার শরীর থেকে বের করা হলো এবং মেরুদণ্ডের হাড় যথাস্থানে প্রতিস্থাপিত হলো। বাকি ৪০টির বেশি ছোট ছোট গুলি মাথার পেছন থেকে কোমর হয়ে পা পর্যন্ত চিরস্থায়ী হয়ে রইল। আল্লাহর রহমতে চিরতরে পঙ্গু হওয়া থেকে বেঁচে গেছি। দুঃখ হলো শেষ পর্যন্তও তখনকার প্রধানমন্ত্রী বলেই চললেন, ‘যখন নির্বাচন দিলে আমরা জয়ী হতে পারবো তখনই দেবো।’ (প্রথম আলো ২৭ মে ১৯৯৯)। যদিও সরকারের মেয়াদ শেষে পুনরায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ২০০১ এর ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো। বিএনপি জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। আওয়ামী লীগ প্রধান সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হলেন। সে নির্বাচনে বরিশাল-২ (বাবুগঞ্জ-উজিরপুর) আসন থেকে আমি নির্বাচিত হলাম ২য়বারের মতো। (মূলত ৩য়বার) প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন : আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, ওয়ার্কার্স পার্টি প্রার্থী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) প্রার্থী গোলাম ফারুক অভি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপু এবং অন্যরা।
বিএনপি জোটের সরকার গঠনের পর পরই আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিলো সংসদে শপথ নেবে না। পরে নিলো। ২০০১-০৬ মেয়াদের শেষ দিকে এসে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিচারপতি কে.এম. হাসানকে বিতর্কিত আখ্যায়িত করে আবারও সারা দেশে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করলো। গান-পাউডার দিয়ে বাসে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, লগি-বৈঠা দিয়ে ধীরেসুস্থে পিটিয়ে জীবন্ত মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নেচে নেচে উল্লাস প্রকাশের পশুত্ব দেখল দেশের মানুষ। শুরু হলো আবার আঁধারের অপ-রাজনীতির খেলা। বিএনপির দুধে-ঘিয়ে পরিপুষ্ট জেনারেল এরশাদÑ জেনারেল নাসিমের মতো একই পথে এগুলেন জেনারেল মইন-জেনারেল মাসুদ, ব্রিঃ জেনারেল আমিন গং। সহযাত্রী হলো ডঃ ফকরুদ্দীন এবং আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা বললেন ‘এ সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল’। নির্বাচন হলো নাÑ জরুরি অবস্থা জারি হলো। এরপর বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনার কারাবাস। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও ব্যবসায়ীরা আটক হলেন। ছাত্র-আন্দোলন হলো।
দু’বছর পর ২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ জোট ক্ষমতায় এলো। ২ যুগব্যাপী আওয়ামী লীগের ধ্বংস প্রচেষ্টাকারীরা মন্ত্রী হলেনÑ এমপি হলেন। বিএনপি জোট সংসদে এবং রাজপথে জোর দাবি তুলল ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর অধীনে একই ধারাবাহিকতায় মেয়াদ শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। থোড়াই কেয়ার করে আওয়ামী লীগ এবং আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করল সংসদে। ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং সংসদে এমপিরা নিজ নিজ পদে বহাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেসে-খেলে জিতলেন। ১৫৪ জন এর সৌভাগ্যবানদের নির্বাচন নামে কষ্টটা করতেই হলো না। কী আনন্দ ঘরে ঘরে। একই সময় প্রত্যেক এলাকায় দু’জন করে এমপি থাকল। প্রধানমন্ত্রী তার পদে বহাল থাকলেন। অন্তবর্তী একটি রূপরেখা বাস্তবায়ন করে সোনার পাথরবাটির মতো দেশ পরিচালিত হলো; বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ নিলো না। ক্ষমতায় পুনরায় কাঁঠালের আমসত্ত্ব তৈরি হলো। সে আমসত্ত্ব খাইয়ে স্থানীয় সরকার পরিষদের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচন হলো। বিএনপি জোট অংশ নিয়ে বিশাল জয় পেল। দ্বিতীয় ধাপে ভীত হয়ে শাসক দল আবার ভোট ছিনতাই করল। হতাশ-বিতৃষ্ণ মানুষ পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করতে শুরু করল। যেটার উল্টোপিঠে আরো জোরালো কারণ হচ্ছে সিটি করপোরেশন-উপজেলা-পৌরসভা-ইউনিয়ন পরিষদের সকল স্তরে বিএনপি জামায়াত এবং জোটের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নামে পরিকল্পিত মামলা দায়ের এবং এর দোহাই দিয়ে একের পর এক বরখাস্ত করা। সিটি করপোরেশনগুলোয় মেয়রদের মধ্যে একমাত্র বাকি রয়েছে হারাধনের একটি ছেলে বরিশালের কামাল। আর সচেতন বাংলাদেশীদের মনেতো আছেই শাসকদলের প্রধান শেখ হাসিনার অমিয় বাণীÑ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুধু একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। অচিরেই সব দলের অংশগ্রহণে পরবর্তী অংশীদারিত্বভিত্তিক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু কোথায় দিগন্ত? আজ কোথাও কাউকে সহ্য করা হচ্ছে না। কথা বললেই নানামুখী হেনস্তা। বিদগ্ধ অরাজনৈতিক ব্যক্তি ড. ইউনূস, আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক মানুষ অপমানিত পদে পদে। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানোর প্রকাশ্য ঘোষণা এবং আইনগত একতরফা প্রস্তুতি সম্পন্ন। এ দলের নেতাকর্মী প্রকারভেদে প্রায় ৫০ হাজার মামলায় পাঁচ লাখ আসামি। কারাগারে প্রায় ৩০ হাজার। সংখ্যা উভয় ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রতিদিনই বাড়ছে। এ অবস্থায় ছা-পোষা নির্বাচন কমিশন দিয়ে শূন্য মাঠে গোল দেয়ার স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রস্তুতি জোর কদমে এগিয়ে চলছে। জামায়াতকে অযোগ্য করে স্ব-নামে নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে।
হায় আওয়ামী লীগ! ১৯৭০-এর নির্বাচনের আওয়ামী লীগ হারিয়ে গেছে ১৯৭৩-এ। ১৯৭৮-৭৯-৮১ তে ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিল। আবার চোরাগলিতে হারিয়ে গেল ১৯৮৬তে, ফিরে এলো ১৯৯১-এ। নিজ ঠিকানায় থাকল ১৯৯৬, ২০০১-এ। ২০০৮-এ ঠিকানা মোটামুটি স্থায়ী হলো। আবার হোঁচট খেলো ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারিতে। উদগ্রীব হয়েছে এখন ১৯৭৫-এর বাকশাল এ ঠিকানা স্থায়ী করতে। তফাৎ শুধু পুরনো ঠিকানার রি-মডেলিং। মিত্র নতুন চেহারার পুরনো মানুষেরা। কিন্তু প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কি ভুলে গেছে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম মনের খোরাক হচ্ছে রাজনীতি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের ৩৩টি দেশের মধ্যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান ১ নম্বরে। এখানে ৬৫ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রায় রাজনীতি করে।
আমাদের রাজনীতিকে শাসক দলের মারমুখো তৎপরতায় সঙ্ঘাতমুখর অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ উচ্চমাত্রার প্ররোচনা এবং পৃষ্ঠপোষণকারী শাসক দল দেশের পরিস্থিতিকে আরো বিপজ্জনকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কি না সেটা ভাবার সময় কিন্তু হাতে বেশি নেই। নিকট এবং দূর-অতীতে সে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের হয়েছে। এ জন্য সমঝোতা সহিষ্ণুতা বড় বেশি প্রয়োজন এখন। না হলে ১৯৭৩ তে জাতীয় নির্বাচনের পর মার্কিন কূটনীতিকের সেই পর্যবেক্ষণ : ৭৩-এর মার্চের নির্বাচন ছিল ‘শেষ যাত্রার শুরু’ বাস্তবায়ন হলে ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের জীবিত অভিশাপ এবং আত্মার অভিসম্পাত আমাদের বহন করতে হবে না তো? মনে রাখা দরকার, সব বিজয়ই কিন্তু গৌরবের নয়। মীরজাফরের বাহিনী যুদ্ধে পরোক্ষভাবে জয়লাভ করেছিল, সিংহাসনও পেয়েছিল। লেন্দুপ দর্জি স্বাধীন সিকিমের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু পরিণতি সবারই জানা। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহানায়ক উইনস্টন চার্চিল কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটেনের নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। পেরেছিলেন গোটা বিশ্বের মানুষের মনজয় করতে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
No comments