মিডিয়ার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আহ্বান
গণমাধ্যমের
পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। বন্ধ মিডিয়া হাউজগুলো অবিলম্বে খুলে দেয়া ও সরকারের
সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশের কারণে যেসব প্রকাশক, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে
অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল ইউরোপীয়
পার্লামেন্টে উত্থাপিত এক প্রস্তাবে এসব আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবটি পাস
হয় ৫৮৬ ভোটে। বিপক্ষে পড়ে ৩১ ভোট। অনুপস্থিত ছিলেন ২৫ জন। আলোচনায় গণতন্ত্র
ও সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংলাপের প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলো তুলে
ধরেন বক্তারা। ‘বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য
রাখেন জিন ল্যাম্বার্ট, ইকনাজিও কোরাও, চার্লস ট্যানক, ক্রিশ্চিয়ান ড্যান
প্রেদা, ডিটা চারানজোভা, পিয়ের অ্যান্টোনিও প্যানজেরি, লোলা সাঞ্চেজ
ক্যালডেন্টি, শন কেলি, রিচার্ড হোয়িট, ক্যারোল কারস্কি, বৃট্রিজ বেকেরা
বাস্তেরেকিয়া, লিন বয়লাম, ডায়ান জেমস, ল্যামপ্রোস ফাউন্টুলিস, নিনা গিল,
মনিকা ম্যাকোভেই, জিরি পসপিসিল, নোটিস মারিয়াস, আইভান জ্যাকাভিচ,
স্ট্যানিসলাভ পোলক্যাক ও ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। শুনানিতে বক্তারা বলেন,
ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশ। তাই ইউরোপীয়
ইউনিয়ন মত প্রকাশের স্বাধীনতার ইস্যু উত্থাপন অব্যাহত রাখবে। গণতন্ত্র ও
সুশাসন জোরদার করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য বাংলাদেশকে সহায়তায় ইইউ
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাবের অন্যতম লেখক জিন
ল্যাম্বার্ট বলেন, আমরা প্রত্যাশা করবো যারা বাংলাদেশে ঝুঁকির মুখে রয়েছে,
তাদের রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। আর একই সুবিধা দেবে রাজনৈতিক
বিরোধীদেরও। কেননা, তারাও বিভিন্নভাবে হামলার সম্মুখীন হয়েছে। তিনি আরও
বলেন, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে।
নিনা গিল বলেন, মিডিয়ার কণ্ঠরোধ, সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর অভিযান, ধর্মনিরপেক্ষ
ব্যক্তি ও বিরোধীদের ওপর হামলা এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করে দেয়ার
ঘটনাগুলো দমন-পীড়নের স্পষ্ট সংকেত। উদ্বেগের বিষয় হলো সহিংসতা আসছে দুই
দিক থেকে- কট্টরপন্থি সংগঠন এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলো। বাংলাদেশ সরকারের
প্রতি আমার বার্তা হলো, উগ্রপন্থি সহিংসতা থেকে একটি সমাজকে রক্ষা করার
জন্য সকলের অংশগ্রহণ, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং মত প্রকাশের
স্বাধীনতার থেকে উত্তম কোন অস্ত্র নেই। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ
সরকারকে আমি এ বার্তায় সত্যিকার অর্থে কর্ণপাত করার আহ্বান জানাই। আমি
জানি, ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে মানবাধিকার রক্ষায় উল্লেখ্যযোগ্য কিছু
পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা
প্রয়োজন। আর আমি এ কমিশনের উচ্চ প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানাই, এসব
প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য। একই সঙ্গে দেশটিতে সব গণতান্ত্রিক
দল এবং সুশীলসমাজের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সংলাপ প্রয়োজন। রিটা চারানজোভা
বলেন, বাংলাদেশসহ গণতান্ত্রিক সব দেশে মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা মৌলিক
অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে এর নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
এতে এ-ও বলা আছে যে, শুধু যৌক্তিক কারণে স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ আরোপ করা
যাবে। রিচার্ড হোয়িট বলেন, সমালোচনাকে সরকার ক্রিমিনালাইজ করেছে। আইসিটির
৫৭ ধারায় ধর্ম নিয়ে সমালোচনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক রিপোর্টিং
ক্রিমিনাইজ করা হয়েছে। লিন বয়লান বলেন, এ বছর ৫ জন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিকে
হত্যা করা হয়েছে। এমন ভীতি প্রদর্শন ও ভবিষ্যৎ সহিংসতার হুমকি দ্রুতই
বাংলাদেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। অনেক লেখক এমন
হুমকিতে হয়তো দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, না হয় আত্মগোপনে আছেন। এটা অগ্রহণযোগ্য।
বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে সম্প্রতি বেশ কিছু হত্যা ও সহিংসতা সংঘটিত
হয়েছে ব্লগার, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীদের ওপর। এগুলো পরিষ্কারভাবে
সন্ত্রাস। এগুলো তীব্র নিন্দাযোগ্য। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ভঙ্গুর
গণতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করার অংশ এগুলো। আমরা ইউরোপে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে
লড়াই করছি। আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাচ্ছি এ লড়াই
কতটা কঠিন। তাই যখনই আমরা বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে যাবো, সমালোচনা করবো
তখন এটা আমাদের স্মরণে থাকা উচিত। পার্লামেন্টের আরেক সদস্য বলেন,
বাংলাদেশে দায়েশ বা আইসিসের হুমকি রয়েছে। সরকারের উচিত সব সাংবাদিককে যথাযথ
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আরেক বক্তা বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি
গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলো বাংলাদেশ। তবে দেশটি অবশ্যই মানবাধিকারের উদাহরণ
নয়। এ বছর সেখানে ৫ জন ব্লগার, সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। অপর এক বক্তা
বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হলো গণতন্ত্রের
অংশ। এর ওপর ইসলামপন্থিরাই শুধু আক্রমণ করছে তা নয়। একই সঙ্গে সরকারও একই
কাজ করছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতিটি আলোচনায় তুলে
ধরতে হবে। আরেক এমপি বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ প্রত্যাহার
করতে হবে। ফিরিয়ে দিতে হবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। অপর এক বক্তা বলেন, গুম
হয়ে যাওয়া বিরোধী দলের সদস্যদের অবস্থা সম্পর্কে আমাদের ব্যাখ্যা জানা
প্রয়োজন। আমরা এসব গুমের ঘটনার তদন্ত দাবি করছি।
ওদিকে, পার্লামেন্টে যে প্রস্তাবটি (জঈ-ই৮-১২৫৭/২০১৫) উত্থাপিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সাংবাদিক, সুশীলসমাজ ও মানবাধিকার কর্মীরা যাতে নিরাপদে মত প্রকাশ করতে পারেন তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এতে নতুন মিডিয়া আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যে নীতির অধীনে দেশের মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বাংলাদেশ সরকার। একই সঙ্গে নতুন মিডিয়া নীতি পর্যালোচনার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়, রাজিব হায়দার, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ফরসাল আরেফিন দীপনসহ এ বছরে ব্লগার, মানবাধিকার কর্মী, প্রকাশকদের ওপর ভয়াবহ হামলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু হামলায় অনেকে আহত হয়ে বেঁচে আছেন। আরও অনেক লেখক ও প্রকাশককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। এ বছরেই ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা, জাপানি কুনিও হোশিসহ বিদেশী নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে। কয়েকজন আহত হয়েছেন কট্টরপন্থিদের হাতে। ভয়াবহ হামলার মুখোমুখি হয়েছেন শিয়া মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। ২৪শে অক্টোবর বোমা হামলা হয়েছে শিয়াদের একটি র্যালিতে। এতে এক কিশোর নিহত হয়েছে। এ বছর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার অপরাধে জড়িত ইসলামপন্থি নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অপরাধের বিচার হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেখা দেয় সহিংসতা। হাজার হাজার মানুষ ওইসব ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায়। বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন সুসম্পর্ক রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। এর মধ্যে রয়েছে অংশীদারি ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতা চুক্তি। বিদেশী কিছু গোয়েন্দা বিষয়ক এজেন্সি বলেছে বাংলাদেশে সক্রিয় ইসলামিক স্টেট ও আল কায়েদা। এ ছাড়া এখানে রয়েছে অভ্যন্তরীণ কট্টরপন্থিদের সমস্যা। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। ওই নির্বাচন বর্জন করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এ নির্বাচনে বিএনপির হরতাল ও তার ফলে সহিংসতা ছায়া ফেলেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার জনঅধিকার সীমিত করার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে সরকার একটি আইন প্রস্তাব করে। এর নাম ফরেন ডোনেশনস (ভলান্টারি এক্টিভিটিজ) রেগুলেশন অ্যাক্ট। এর ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আগস্টে বাংলাদেশ সরকার নতুন মিডিয়া নীতি প্রয়োগ করা শুরু করে। এতে মিডিয়ার স্বাধীনতা সীমিত করার নীতি আরোপ করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায় এমন বক্তব্য নিষিদ্ধ করা হয়। জাতীয় আদর্শের বিরুদ্ধে যায় তাও নিষিদ্ধ করা হয়। নৈরাজ্য, বিদ্রোহ অথবা সহিংসতার ওপর রিপোর্টিং করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা দেয়া হয়েছে। গত কয়েক মাসে বেশ কিছু সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি আইন লঙ্ঘনের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ওই প্রস্তাবে জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এসব হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সুপারিশে বলা হয়, বহু মতের পক্ষে, ইসলামপন্থিদের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, জিহাদি গ্রুপের বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এতে সব রাজনৈতিক দল, তাদের নেতাদের ঐকবদ্ধভাবে অবস্থান নিতে আহ্বান জানানো হয়। আহ্বান জানানো হয় মুক্তমত প্রকাশকে সমর্থন দিতে। দোষীদের বিচারের আওতায় এনে আরও হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। লেখক, প্রকাশক ও অন্য যাদের হুমকি দেয়া হয়েছে তাদের রক্ষা করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে। পুলিশ বাহিনী ও অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে শক্তিশালী করায় সাধুবাদ জানানো হয়েছে। লেখক, অনলাইন ব্লগারদের ওপর হামলা ও হত্যার তদন্তে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে। এরই মধ্যে অভিজিত রায় হত্যায় জড়িত থাকায় আটক করা হয়েছে আট জনকে। ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যায় দুজনকে, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হত্যায় চারজনকে আটক করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সাংবাদিক, সুশীলসমাজ ও মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তমত প্রকাশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেকটা অগ্রগতি করেছে। এতে লাখ লাখ মানুষের বাস্তব জীবন উন্নত হয়েছে। স্বীকার করে নিতে হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ জটিল পরিস্থিতিতে এ উন্নয়ন হয়েছে। ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, নতুন মিডিয়া আইন নিয়ে নিরপেক্ষ গ্রুপগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করতে এবং নিশ্চিত করতে যে, যদি এটা গৃহীত হয় তাহলে তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখবে, যেসব অধিকার সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৫ বাস্তবায়িত হলে তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। যদি এটা বাস্তবায়িত হয় তাহলে বিকল্প দৃষ্টিভক্তির ওপর কর্তৃত্বপরায়ণ শক্তি কঠোর হবে। ইতালিয়ান নাগরিক সিজার তাভেলা ও জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বাংলাদেশকে স্বাগত জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, দুটি হত্যাকাণ্ডেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েকজনকে। এখনও অনুসন্ধান চলছে। জাতিগত ও ধর্মীয় উদ্দেশে সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ধর্মীয় সংগঠন, তাদের নেতা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে পুনর্জাগরণের। এসব সহিংসতায় যারা জড়িত তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে বলা হয়েছে সরকারকে। শিয়া মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সহ অন্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ওদিকে, পার্লামেন্টে যে প্রস্তাবটি (জঈ-ই৮-১২৫৭/২০১৫) উত্থাপিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সাংবাদিক, সুশীলসমাজ ও মানবাধিকার কর্মীরা যাতে নিরাপদে মত প্রকাশ করতে পারেন তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এতে নতুন মিডিয়া আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যে নীতির অধীনে দেশের মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বাংলাদেশ সরকার। একই সঙ্গে নতুন মিডিয়া নীতি পর্যালোচনার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়, রাজিব হায়দার, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ফরসাল আরেফিন দীপনসহ এ বছরে ব্লগার, মানবাধিকার কর্মী, প্রকাশকদের ওপর ভয়াবহ হামলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু হামলায় অনেকে আহত হয়ে বেঁচে আছেন। আরও অনেক লেখক ও প্রকাশককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। এ বছরেই ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা, জাপানি কুনিও হোশিসহ বিদেশী নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে। কয়েকজন আহত হয়েছেন কট্টরপন্থিদের হাতে। ভয়াবহ হামলার মুখোমুখি হয়েছেন শিয়া মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। ২৪শে অক্টোবর বোমা হামলা হয়েছে শিয়াদের একটি র্যালিতে। এতে এক কিশোর নিহত হয়েছে। এ বছর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার অপরাধে জড়িত ইসলামপন্থি নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অপরাধের বিচার হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেখা দেয় সহিংসতা। হাজার হাজার মানুষ ওইসব ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায়। বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন সুসম্পর্ক রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। এর মধ্যে রয়েছে অংশীদারি ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতা চুক্তি। বিদেশী কিছু গোয়েন্দা বিষয়ক এজেন্সি বলেছে বাংলাদেশে সক্রিয় ইসলামিক স্টেট ও আল কায়েদা। এ ছাড়া এখানে রয়েছে অভ্যন্তরীণ কট্টরপন্থিদের সমস্যা। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। ওই নির্বাচন বর্জন করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এ নির্বাচনে বিএনপির হরতাল ও তার ফলে সহিংসতা ছায়া ফেলেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার জনঅধিকার সীমিত করার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে সরকার একটি আইন প্রস্তাব করে। এর নাম ফরেন ডোনেশনস (ভলান্টারি এক্টিভিটিজ) রেগুলেশন অ্যাক্ট। এর ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আগস্টে বাংলাদেশ সরকার নতুন মিডিয়া নীতি প্রয়োগ করা শুরু করে। এতে মিডিয়ার স্বাধীনতা সীমিত করার নীতি আরোপ করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায় এমন বক্তব্য নিষিদ্ধ করা হয়। জাতীয় আদর্শের বিরুদ্ধে যায় তাও নিষিদ্ধ করা হয়। নৈরাজ্য, বিদ্রোহ অথবা সহিংসতার ওপর রিপোর্টিং করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা দেয়া হয়েছে। গত কয়েক মাসে বেশ কিছু সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি আইন লঙ্ঘনের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ওই প্রস্তাবে জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এসব হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সুপারিশে বলা হয়, বহু মতের পক্ষে, ইসলামপন্থিদের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, জিহাদি গ্রুপের বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এতে সব রাজনৈতিক দল, তাদের নেতাদের ঐকবদ্ধভাবে অবস্থান নিতে আহ্বান জানানো হয়। আহ্বান জানানো হয় মুক্তমত প্রকাশকে সমর্থন দিতে। দোষীদের বিচারের আওতায় এনে আরও হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। লেখক, প্রকাশক ও অন্য যাদের হুমকি দেয়া হয়েছে তাদের রক্ষা করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে। পুলিশ বাহিনী ও অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে শক্তিশালী করায় সাধুবাদ জানানো হয়েছে। লেখক, অনলাইন ব্লগারদের ওপর হামলা ও হত্যার তদন্তে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে। এরই মধ্যে অভিজিত রায় হত্যায় জড়িত থাকায় আটক করা হয়েছে আট জনকে। ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যায় দুজনকে, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হত্যায় চারজনকে আটক করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সাংবাদিক, সুশীলসমাজ ও মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তমত প্রকাশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেকটা অগ্রগতি করেছে। এতে লাখ লাখ মানুষের বাস্তব জীবন উন্নত হয়েছে। স্বীকার করে নিতে হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ জটিল পরিস্থিতিতে এ উন্নয়ন হয়েছে। ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, নতুন মিডিয়া আইন নিয়ে নিরপেক্ষ গ্রুপগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করতে এবং নিশ্চিত করতে যে, যদি এটা গৃহীত হয় তাহলে তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখবে, যেসব অধিকার সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৫ বাস্তবায়িত হলে তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। যদি এটা বাস্তবায়িত হয় তাহলে বিকল্প দৃষ্টিভক্তির ওপর কর্তৃত্বপরায়ণ শক্তি কঠোর হবে। ইতালিয়ান নাগরিক সিজার তাভেলা ও জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বাংলাদেশকে স্বাগত জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, দুটি হত্যাকাণ্ডেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েকজনকে। এখনও অনুসন্ধান চলছে। জাতিগত ও ধর্মীয় উদ্দেশে সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ধর্মীয় সংগঠন, তাদের নেতা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে পুনর্জাগরণের। এসব সহিংসতায় যারা জড়িত তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে বলা হয়েছে সরকারকে। শিয়া মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সহ অন্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
No comments