সামরিকায়ন ও মুসলিমবিরোধী নীতি by বেন নর্টন
[ফ্রান্সের খ্যাতনামা সাংবাদিক, লেখক ও চিত্রশিল্পী বেন নর্টন
তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করেছেন প্যারিসের সন্ত্রাসী ঘটনা ও
তার অভিঘাত। salon.com-এ প্রকাশিত এই লেখায় গতানুগতিক পাশ্চাত্য
দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া যায়। নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য
লেখাটি অনুবাদ করেছেন মো: হাসান শরীফ]
নাইন-ইলেভেনের পর যখনই বেসামরিক কোনো হামলা হয়েছে, জননেতারা সাথে সাথে এর জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন মুসলমানদের। তাদের হাতে তেমন কোনো প্রমাণ থাকে না, কিন্তু মুসলিমবিদ্বেষী গোঁড়ামির স্থূলবুদ্ধিকেই তারা ব্যবহার করেন তাদের অভিযোগকে জোরদার করতে। অথচ সত্যিকারের প্রমাণ অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যেসব সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে, তার দুই শতাংশেরও কম ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১৩ সালে ১৫২টি সন্ত্রাসী হামলার মাত্র ১ শতাংশ ছিল ওই প্রকৃতির, ২০১২ সালে ২১৯টি সন্ত্রাসী হামলার ৩ শতাংশেরও কম ছিল ধর্মীয়ভাবে উদ্দীপ্ত।
বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসী হামলাগুলোর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো জাতিগত-জাতীয়তাবাদী কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী। ২০১৩ সালের সন্ত্রাসী হামলাগুলোর ৫৫ শতাংশ ছিল জাতিগত-জাতীয়তাবাদী কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী, ২০১২ সালে তিন-চতুর্থাংশ (৭৬ শতাংশ) সন্ত্রাসী হামলা ছিল জাতিগত-জাতীয়তাবাদ কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রণোদিত। কিন্তু এসব তথ্য পূর্বধারণায় বশীভূত পণ্ডিতদের তাদের নিজস্ব মতবাদে অনড় থাকা থেকে নড়াতে পারছে না।
গত ১৩ নভেম্বর প্যারিসে জঙ্গিদের কয়েকটি জঘন্য হামলায় অন্তত ১৩০ জনের মতো নিহত হয়েছে। এই ভয়াবহ ঘটনার ব্যাপারে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ায় কয়েকটি স্তরের ভণ্ডামি রয়েছে। এসব নৃশংস হামলা সৃষ্টির বৃহত্তর প্রোপট বোঝা এবং চূড়ান্তভাবে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের হামলা আর না হয়, সে জন্য এই ভণ্ডামিগুলোকে নিখুঁতভাবে শ্রেণিবিন্যস্ত করতে হবে।
চরমপন্থার সুযোগ গ্রহণ
হামলাগুলোর খবর প্রকাশের সাথে সাথে, যখন কোনো প্রমাণ ছিল না এবং হামলাকারীদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র তথ্য ছিল না, তখন ডানপন্থী মহা মহা পণ্ডিতেরা সাথে সাথে মুসলমানদের এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ভয়ঙ্কর হিসেবে তুলে ধরতে এই সহিংসতাকে তাদের সাথে জড়িয়ে ফেলার সুযোগটি লুফে নিলেন।
হতাহতের শিকারদের চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে নেতারা একযোগে চিৎকার করে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে এবং এমনকি সেগুলো অস্বীকার পর্যন্ত করার জন্য নৃশংস হামলার সুযোগটি কাজে লাগাতে মেতে ওঠেন। তারা সোজাসুজি মৌলিক নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ কর্মী, ন্যূনতম মজুরি দাবিকারী ফাস্টফুড শ্রমিক এবং ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থা থেকে মুক্তি কামনাকারী শ্রমিক ইউনিয়ন ও ছাত্রদের বলে বসেন, তোমাদের সমস্যাগুলো খুবই তুচ্ছ। কারণ তোমরা বন্দুকের মুখে পণবন্দী নও।
আরো গুরুতর ব্যাপার হলো, যখন প্রমাণ পাওয়া যেতে শুরু করল যে, এই হামলার জন্য চরমপন্থীরা দায়ী এবং যখন আইএসআইএস দায় স্বীকার করল, তখন নেতারা বলে বসলেন, ১৬০ কোটি মানুষের ধর্ম ইসলামের ওপর সব দোষ বর্তাবে এবং মুসলিম উদ্বাস্তুরা (তাদের বেশির ভাগ মুসলমান হলেও সবাই নয়) প্রধানত এ ধরনের হামলা চালানোর জন্যই পাশ্চাত্যে প্রবেশ করছে।
মুসলিম ও উদ্বাস্তুদের পীড়ন
যখনই ইসলামি চরমপন্থীরা কোনো হামলা চালায়, তখনই ১৬০ কোটি মুসলমানের কাছ থেকে সম্মিলিতভাবে মা প্রত্যাশা করা হয়, এই পর্যায়ে এটা জমাট বাঁধা ধারণায় পরিণত হয়ে গেছে।
মুসলমান ও উদ্বাস্তুদের ওপর পীড়ন চালিয়ে কারা উপকৃত হচ্ছে? এতে উপকৃত হয় প্রধানত দুটি গ্র“প : এক. খোদ চরমপন্থী গ্র“পগুলো। তাদের মতে, দমন-পীড়ন এটাই ‘প্রমাণ’ করে যে, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সেকুলার পাশ্চাত্যে দৃশ্যত মুসলমানদের কোনো স্থান নেই। দুই. ইউরোপের ক্রমবর্ধমান উগ্র ডানপন্থীরা। তাদের মতে, হামলা এটাই ‘প্রমাণ’ করে, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সেকুলার পাশ্চাত্যে দৃশ্যত মুসলমানদের কোনো স্থান নেই।
তারা যদিও পরস্পরের শত্র“, কিন্তু উভয় গ্র“পের মধ্যে এ ব্যাপারে অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। উগ্র ডানপন্থীরা চায় মুসলমান এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর উদ্বাস্তুরা (এমনকি যদি তারা মুসলমান না-ও হয়) পাশ্চাত্য ত্যাগ করুক। তাদের মতে, তারা জন্মগতভাবেই সহিংস সন্ত্রাসী। ইসলামি চরমপন্থীরা চায় মুসলিম উদ্বাস্তুরা চলে যাক, যাতে তারা চরমভাবাপন্ন হয়ে তাদের খিলাফতে যোগ দেয়।
আরো তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, জোর গলায় বলে দেয়া যায় যে, মুসলিম ও উদ্বাস্তুদের ওপর দমন-পীড়নে ইউরোপের ক্রমবর্ধমান উগ্র ডানপন্থী আন্দোলন লাভবান হতে থাকবে এবং মুসলিমবিদ্বেষী ও উদ্বাস্তুবিরোধী প্রপাগান্ডার মাধ্যম নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহ করা অব্যাহত রাখবে।
আইএসআইএস প্রকাশ্যেই বলেছে, তাদের ল্য হলো তাদের কথিত ‘গ্রে-জোন’-এর (বলা যেতে পারে পাশ্চাত্যে মুসলমানদের গ্রহণ করা) বিলুপ্তিসাধন। আইএসআইএসের নিজস্ব প্রকাশনায় বলা হয়েছে, গ্রে-জোন বিলুপ্তির ভয়ঙ্কর কাজ শুরু হয়েছে ১১ সেপ্টেম্বরের ‘বরকতময়’ অভিযানের মাধ্যমে। এসব অভিযান পৃথিবীর মানুষের কাছে দু’টি শিবিরকে তুলে ধরেছে : একটি হলো ইসলামের শিবির, অপরটি হলো কুফরের শিবির (ক্রুসেডার জোট)।’
পাশ্চাত্যের উগ্র ডানপন্থী ও ইসলামি চরমপন্থীদের স্বার্থ একাকার হয়ে গেছে। আইএসআইএস সুস্পষ্টভাবেই যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে, তাতে কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশএবং তার একগুঁয়ে শত্র“ আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মনের কথাই বলা হয়েছে। আইএসআইএস লিখেছে : “শায়খ ওসামা বিন্ লাদেন যেভাবে বলেছেন, ‘বিশ্ব আজ দুই শিবিরে বিভক্ত;’ বুশ যখন বলেন, তোমরা আমাদের সাথে কিংবা তোমরা সন্ত্রাসীদের সাথে’ তখন তিনি সত্য কথাই বলেন।’ অর্থাৎ হয় তুমি ক্রুসেডারের সাথে কিংবা ইসলামের সাথে।”
আইএসআইএসকে ভাইরাস হিসেবে চলার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে আমরা স্রেফ তাদের ধর্ষকামী ল্যগুলো পূরণ করতে সহায়তা করছি।
এ দিকে ফরাসি উগ্র ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি বিশেষভাবে লাভবান হচ্ছে। জনৈক নব্য নাৎসির গঠিত দলটিকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার বিচ্ছেদপ্রাপ্তা মেয়ে ম্যারিন লি পেন। তিনি মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন; ভণ্ডামির সাথে তাদের নাৎসি দখলদার হিসেবে অভিহিত করছেন। ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ‘ফ্যাসিবাদী’ দল বলা যুক্তিসম্মত বলে ২০১৪ সালে প্যারিসের একটি আদালত রায় দিয়েছিল।
প্যারিস হামলার আগে লি পেনের উগ্র ডানপন্থী আন্দোলন ছিল ফ্রান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। এখন তারা হয়তো প্রথম দলে পরিণত হয়ে গেছে।
যে গণহত্যাগুলো উপো করা হয়
ইউরোপে প্রতি বছর শত শত হামলা হয়ে থাকে। তবে কেবল সেগুলোই প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, যেগুলো মুসলমানেরা ঘটায়, যেগুলো জাতিগত-জাতীয়তাবাদী বা উগ্র ডান চরমপন্থীরা চালায় সেগুলো নজরে আসে না, যদিও সেগুলোই অনেক বেশি ঘটে থাকে।
অবশ্য কেবল ডানপন্থী পণ্ডিত আর মিডিয়াই প্যারিস হামলার মতো ঘটনাগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দেয় না, রাষ্ট্রপ্রধানেরাও তা করেন। প্যারিস হামলার কয়েক মিনিট পরই প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ আর প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশ্বের সামনে বক্তব্য রাখেন, প্রকাশ্যে ঘটনাটির তীব্র সমালোচনা করেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামলাকে ‘জঘন্য, শয়তানি ও ইতরামিপূর্ণ কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
এর মাত্র এক দিন আগে আরেকটি নৃশংস হামলা হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে ঘিরে সরকারি নীরবতা ছিল লণীয়। ১২ নভেম্বর শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত বৈরুতে আইএসআইএসের আত্মঘাতী বোমারুরা অন্তত ৪৩ জনকে হত্যা এবং অন্তত ২৩০ জনকে আহত করেছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশ্ববাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেননি এবং কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ওই বোমা হামলার নিন্দা করেননি।
বস্তুত, বিপরীতটাই ঘটেছে। মার্কিন মিডিয়ায় আইএসআইএস হামলার শিকার যারা, তাদের হিজবুল্লাহর মানব ঢাল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাদের দুর্ভাগ্যজনক ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে, তাই এ জন্য তারাই দায়ী বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো ডানপন্থী পণ্ডিত এই হামলা যৌক্তিক বলে অভিহিত করে বলেছেন, হামলাটি সম্ভবত হয়েছিল হিজবুল্লাহকে ল্য করে।
গত অক্টোবরে তুরস্কে কুর্দিপন্থী একটি রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলায় ১২৮ জনের নিহত এবং ৫০০ লোকের আহত হওয়ার খবরেও হোয়াইট হাউজ বিচলিত হয়নি।
আরো অবাক ব্যাপার হলো, রাষ্ট্রপ্রধানেরা তখন কোথায় ছিলেন যখন কোয়ালিশন বাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর ইয়েমেনের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে বিমান হামলা চালিয়ে ৮০ জন নারীসহ ১৩১ জন নিরীহ লোককে হত্যা করল? ওই হত্যাকাণ্ডের খবর তেমন প্রচারিত হয়নি, ওবামা ও ওলাঁদ মা চাননি।
ফরাসিদের জীবন কি লেবাননি, তুর্কি, কুর্দি ও ইয়েমেনিদের চেয়ে বেশি দামি? এসব হামলা কেন ‘জঘন্য, শয়তানি ও ইতরামিপূর্ণ কাজ’ হবে না?
অদ্ভুত মিল
আমরা এসব আগেও দেখেছি, এগুলোর মধ্যে অদ্ভুত মিল রয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারির নৃশংস হামলার প্রতিক্রিয়া ছিল অনুমিত। গৎবাঁধা ইসলামভীতির বুলি কপচিয়ে ওই মর্মান্তিক হামলার আসল কারণ চেপে যাওয়া হয়েছে। শার্লি এবদোতে কার্টুন আঁকার জন্য নয়, ওই হামলা হয়েছিল ইরাকে ভয়ঙ্কর মার্কিন আক্রমণ এবং আবু গারিব কারাগারে নৃশংস নির্যাতনের প্রতিবাদে। ইরাকের ঘটনাই বন্দুকধারীদের প্তি করে তুলেছিল। আরেকটি সত্য চেপে যাওয়া হয়েছে, তা হলোÑ চরমপন্থী হামলাকারীরা ছিল আলজেরিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের সন্তান। ওই দেশটি কয়েক দশক ধরে জঘন্য ফরাসি উপনিবেশে ছিল। লাখ লাখ আলজেরিয়ানের রক্তের বিনিময়েই কেবল দেশটি স্বাধীনতা পেয়েছিল।
জানুয়ারির প্যারিস হামলার পর সারা বিশ্বের নেতারা সতর্কভাবে পরিকল্পিত একটি ফটোসেশনে যোগ দিতে প্যারিসে সমবেত হয়েছিলেন। আর এসব হামলার জন্য মুসলমানদের কেবল পাইকারিভাবে দায়ীই করা হয় না, তাদের পাইকারিভাবে প্রত্যাঘাতও সহ্য করতে হয়।
জানুয়ারি হামলার মাত্র ছয় দিন পর ন্যাশনাল অবজারভেটরি অ্যাগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া ফ্রান্সে ইসলাম অনুসারীদের ওপর ৬০টি আক্রমণ ও হুমকি নথিভুক্ত করেছে। মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদী হামলা পর্যবেণকারী যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ‘টেলমামা’ও ৫০-৬০টি হুমকির খবর দিয়েছে।
আরেকটি কথা, জানুয়ারির প্যারিস হামলার মাত্র কয়েক দিন পর বিশ্ব সম্প্রদায় আরেকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা অনেকাংশেই চেপে গিয়েছিল : বোকো হারাম নাইজেরিয়ায় দুই হাজারের বেশি লোককে গলা কেটে হত্যা করে। আফ্রিকান নিহতরা রাষ্ট্রনায়কদের সমাবেশ পায়নি, কেবল ইসলামি চরমপন্থীদের পাশ্চাত্যের শিকারদের জন্য তা নির্ধারিত।
পাশ্চাত্যের অপরাধ
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটি অতি সামান্যভাবে আলোচিত হয় তা হলো, ইসলামি চরমপন্থীদের শিকারদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হলো মুসলমানেরা। তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেই বাস করে। ২০১২ সালে মার্কিন ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম সেন্টার খবর প্রকাশ করে, গত পাঁচ বছরে ধর্মীয় প্রণোদনায় চালিত সন্ত্রাসী হামলাগুলোর ৮২ থেকে ৯৭ শতাংশের শিকার হয়েছে মুসলমানেরা। অথচ পাশ্চাত্য এমনভাবে খবর প্রকাশ করে, যেন তারাই প্রধান শিকার; অথচ বিপরীতটাই সত্য।
কেউ কি কখনো প্রশ্ন তুলেছে, কেন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে এত উদ্বাস্তু পালিয়ে আসছে? এমন নয় যে, কোটি কোটি লোক তাদের বাড়িঘর ও পরিবার ফেলে আসতে চায়, আসলে তারা সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়, আর ওইসব সহিংসতা আর বিশৃঙ্খলার কারণ প্রায় সব েেত্রই পাশ্চাত্যের সামরিক হস্তপে।
পাশ্চাত্যের দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যভাবে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইয়েমেনের সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী, এ কারণেই কোটি কোটি উদ্বাস্তু পালাচ্ছে।
ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অবৈধ হামলায় অন্তত ১০ লাখ লোক মারা গেছে এবং পুরো অঞ্চলটিতে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্ট চরম পরিস্থিতিতে আল-কায়েদার মতো জঙ্গি গ্র“পগুলো দাবানলের মতো গজিয়ে উঠেছে। সেগুলোই অবশেষে আইএসআইএসের উত্থান ঘটিয়েছে।
আফগানিস্তানে চলমান মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর যুদ্ধ ও দখলদারিত্বের কারণে (ওবামা প্রশাসন যেটাকে দ্বিতীয়বারের মতো দীর্ঘায়িত করেছে) আড়াই লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেছে, কোটি কোটি আফগান উদ্বাস্তু হয়েছে।
লিবিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর হস্তেেপ দেশটির সরকার ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশটি চরমপন্থীদের উর্বর েেত্র পরিণত হয়েছে। উত্তর আফ্রিকায় আইএসআইএসের মতো জঙ্গি গ্র“পগুলোর কার্যক্রম চালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার লিবীয় নিহত হয়েছে, লাখ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে।
ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের জাতিগুলো সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে অস্ত্র ও সমর্থন দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গরিব দেশটির বেসামরিক এলাকায় নিষিদ্ধ গুচ্ছবোমা ফেলতে, অবকাঠামো ধ্বংস করতে। এখানেও একই কাহিনী : হাজার হাজার লোক নিহত, লাখ লাখ লোক উদ্বাস্তু।
সিরিয়া পরিস্থিতি আরেকটু জটিল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিক্ত যুদ্ধে বিধ্বস্ত, দেশটির অনেক উদ্বাস্তু আসাদ সরকারের নির্মম পীড়ন থেকে রা পেতে পালাচ্ছে। অবশ্য এ জন্য পাশ্চাত্যের দেশগুলো এবং তাদের মিত্ররাও দায়ী। সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো আল-নুসরা ধরনের মিত্ররা এই সঙ্ঘাত অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলছে।
বলা বাহুল্য, প্যারিসে আইএসআইএস যে হামলা চালিয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সেই একই ধরনের সন্ত্রাস থেকে রা পেতেই লাখ লাখ সিরিয়ান উদ্বাস্তু ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছে। চরমপন্থী গ্র“পগুলোর নির্মম সহিংসতা থেকে রা পেলেও পালিয়ে যাওয়া সিরিয়ান ও ইরাকি উদ্বাস্তুদের ফ্রান্স ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশ আরো করুণ অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে।
দোষ স্খলন
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যখন ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে বিয়ে অনুষ্ঠান ও হাসপাতালে বোমা ফেলে শত শত বেসামরিক লোককে হত্যা করে, ‘আমেরিকানরা’ তখন টুইটারে বিশ্বব্যাপী সেটা ছড়িয়ে দেয় না। কিন্তু যখন কথিত ইসলামি চরমপন্থীরা প্যারিসবাসীকে হত্যা করে, তখন ‘মুসলমানেরা’ করে।
সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য সব সময় দোষ অন্যের ঘাড়ে সরিয়ে দেয়। এটা সব সময় বিদেশী, অ-পাশ্চাত্য এবং অন্যদের দোষ, এটা কখনো আলোকিত পাশ্চাত্যের দোষ নয়।
ইসলাম হলো নতুন ‘বলির পাঁঠা’। পুরো জাতির ওপর প্রতিশোধ নেয়া, নিপীড়ক স্বৈরাচারীদের টিকিয়ে রাখা, চরমপন্থী গ্র“পগুলোকে সমর্থন দেয়ার পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের নীতির কথা সহজেই ভুলে যাওয়া হয়।
পাশ্চাত্য তার নিজস্ব সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতার সমাধান দিতে অক্ষম। এর বদলে সে তার রক্তরঞ্জিত আঙুল বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলমানের দিকে তাক করে তাদের বলে, তারা জন্মগতভাবেই সহিংস।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্যারিসে আমরা যেসব মর্মান্তিক ঘটনা দেখছি, সেগুলো মধ্যপ্রাচ্যের নৈমিত্তিক ঘটনা। আর এসবই ঘটছে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ইত্যাদি দেশের সরকারি নীতির কারণে।
এর মানে এই নয় যে, আমরা প্যারিস হামলার জন্য শোক প্রকাশ করব না। এসব ঘটনা অবশ্যই জঘন্য। আমাদের শোক প্রকাশ করতেই হবে। তবে আমাদের সরকারের অপরাধগুলোর জন্যও আমাদের একইভাবে শোক প্রকাশ করা দরকার।
আমরা যদি সত্যিই বিশ্বাস করি, সব জীবন সমান মূল্যবান; আমরা যদি সত্যিই বিশ্বাস করি, ফরাসিদের জীবন অন্যদের চেয়ে বেশি মূল্যবান নয়; তবে অবশ্যই আমাদের প্রতিটি জীবনের জন্যই শোক প্রকাশ করতে হবে।
অভ্যাসের বিপদ
আমরা জানি, হামলার প্রতিক্রিয়া এমন। এই পন্থায় চলতে থাকলে আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করবে।
সরকারগুলো মধ্যপ্রাচ্যে আরো বেশি পাশ্চাত্য সামরিক হস্তপে করতে যাচ্ছে; আরো বেশি বোমা ফেলবে; আরো বেশি বন্দুক পাঠাবে। কট্টর ডানপন্থী সিনেটর টেড ক্রুজ সাথে সাথেই ‘বেসামরিক লোকদের জন্য, আরো সহিষ্ণুতার জন্য’ বিমান হামলার দাবি জানিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যক্তিবিশেষের সন্ত্রাসের জবাব দেয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে।
দেশে আমরা আরো বেশি বেড়া, আরো বেশি পুলিশ, আরো বেশি তদারকির আহ্বান জানাব। প্যারিস হামলার সাথে সাথে ফ্রান্স তার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। হামলার খবর পাওয়ামাত্র যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক সিটির পুলিশ সেখানকার কোনো কোনো অংশকে সামরিকায়ন করতে শুরু করে দিয়েছে।
প্রাধান্য বিস্তারসূচক ‘সমাধানে’ সব সময়ই দেশে ও বিদেশে আরো বেশি সামরিকায়ন হয়ে থাকে। অথচ বাস্তবতা হলো, সমস্যার কারণ হচ্ছে এর উৎপত্তিস্থলে সামরিকায়ন।
নৃশংস ৯/১১ হামলার সময় আলকায়েদা ছিল তুলনামূলক ছোট ও বিচ্ছিন্ন গ্রুপ। ইরাক দখল করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সৃষ্ট চরম সহিংসতাপূর্ণ অবস্থা, হতাশা, সম্প্রদায়গত সঙ্ঘাত বিশ্বজুড়ে আলকায়েদাকে ছড়িয়ে দিয়েছে। সামরিকবাদের প্রতি আসক্ত পাশ্চাত্য চরমপন্থীদের সাথে হাত মিলিয়ে চলেছে। আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি, পচা আসক্তি নিয়ে আসছে পচা ফল : আইএসআইএস হলো পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের দৈত্য।
আমাদের সরকারগুলো যদি একনায়কদের কাছে অস্ত্র বিক্রির কৌশল চালিয়ে যায়, তবে প্যারিসের মতো হামলা কেবল চলতেই থাকবে না, আরো বেশি বেশি হবে; ডানপন্থীরা বাড়তেই থাকবে। আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক নব্য নাৎসিবাদীরা তাদের শক্তি আরো বাড়িয়ে নেবে। লোকজন চরম ভাবাপন্ন হয়ে পড়বে।
জাতিগত-জাতীয়তাবাদী বা উগ্র ডানপন্থীদের হামলার ঘটনা ইতোমধ্যেই ইউরোপ ও আমেরিকায় সন্ত্রাসের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। এটা আরো বাড়তেও পারে। পণ্ডিতেরা মুসলিমবিদ্বেষী গোঁড়ামি আরো চাঙ্গা করবেন, উদ্বাস্তুবিরোধী উত্তেজনা আরো বাড়াবেন। আর সেটা করতে গিয়ে তারা পরিস্থিতির কেবল অবনতিই ঘটাবেন।
আমাদের সরকারগুলো দেশে ও বিদেশে কী করছে, সেটা গভীরভাবে ভাবতে ভয়াবহ প্যারিস হামলাটি আমাদের উদ্বুদ্ধ করার অবকাশ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা না করি, যদি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিই, সহিংসতার রাস্তা ধরি, তবে ত আরো বাড়বেই। রক্তপাত শেষ পর্যন্ত আরো বেগবান হবে।
সংেেপ বলা যায়, প্যারিস হামলার প্রতিক্রিয়ায় যারা সামরিকায়ন এবং মুসলিমবিরোধী ও উদ্বাস্তুবিরোধী নীতি অব্যাহত রাখতে চায়, তারা আসলে সহিংসতা আর ঘৃণাকেই কেবল আরো উসকে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বৃত্তের যদি পরিবর্তন না হয়, তবে সহিংসতার বৃত্তও চলতে থাকবে।
নাইন-ইলেভেনের পর যখনই বেসামরিক কোনো হামলা হয়েছে, জননেতারা সাথে সাথে এর জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন মুসলমানদের। তাদের হাতে তেমন কোনো প্রমাণ থাকে না, কিন্তু মুসলিমবিদ্বেষী গোঁড়ামির স্থূলবুদ্ধিকেই তারা ব্যবহার করেন তাদের অভিযোগকে জোরদার করতে। অথচ সত্যিকারের প্রমাণ অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যেসব সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে, তার দুই শতাংশেরও কম ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১৩ সালে ১৫২টি সন্ত্রাসী হামলার মাত্র ১ শতাংশ ছিল ওই প্রকৃতির, ২০১২ সালে ২১৯টি সন্ত্রাসী হামলার ৩ শতাংশেরও কম ছিল ধর্মীয়ভাবে উদ্দীপ্ত।
বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসী হামলাগুলোর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো জাতিগত-জাতীয়তাবাদী কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী। ২০১৩ সালের সন্ত্রাসী হামলাগুলোর ৫৫ শতাংশ ছিল জাতিগত-জাতীয়তাবাদী কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী, ২০১২ সালে তিন-চতুর্থাংশ (৭৬ শতাংশ) সন্ত্রাসী হামলা ছিল জাতিগত-জাতীয়তাবাদ কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রণোদিত। কিন্তু এসব তথ্য পূর্বধারণায় বশীভূত পণ্ডিতদের তাদের নিজস্ব মতবাদে অনড় থাকা থেকে নড়াতে পারছে না।
গত ১৩ নভেম্বর প্যারিসে জঙ্গিদের কয়েকটি জঘন্য হামলায় অন্তত ১৩০ জনের মতো নিহত হয়েছে। এই ভয়াবহ ঘটনার ব্যাপারে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়ায় কয়েকটি স্তরের ভণ্ডামি রয়েছে। এসব নৃশংস হামলা সৃষ্টির বৃহত্তর প্রোপট বোঝা এবং চূড়ান্তভাবে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের হামলা আর না হয়, সে জন্য এই ভণ্ডামিগুলোকে নিখুঁতভাবে শ্রেণিবিন্যস্ত করতে হবে।
চরমপন্থার সুযোগ গ্রহণ
হামলাগুলোর খবর প্রকাশের সাথে সাথে, যখন কোনো প্রমাণ ছিল না এবং হামলাকারীদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র তথ্য ছিল না, তখন ডানপন্থী মহা মহা পণ্ডিতেরা সাথে সাথে মুসলমানদের এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ভয়ঙ্কর হিসেবে তুলে ধরতে এই সহিংসতাকে তাদের সাথে জড়িয়ে ফেলার সুযোগটি লুফে নিলেন।
হতাহতের শিকারদের চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে নেতারা একযোগে চিৎকার করে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে এবং এমনকি সেগুলো অস্বীকার পর্যন্ত করার জন্য নৃশংস হামলার সুযোগটি কাজে লাগাতে মেতে ওঠেন। তারা সোজাসুজি মৌলিক নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ কর্মী, ন্যূনতম মজুরি দাবিকারী ফাস্টফুড শ্রমিক এবং ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থা থেকে মুক্তি কামনাকারী শ্রমিক ইউনিয়ন ও ছাত্রদের বলে বসেন, তোমাদের সমস্যাগুলো খুবই তুচ্ছ। কারণ তোমরা বন্দুকের মুখে পণবন্দী নও।
আরো গুরুতর ব্যাপার হলো, যখন প্রমাণ পাওয়া যেতে শুরু করল যে, এই হামলার জন্য চরমপন্থীরা দায়ী এবং যখন আইএসআইএস দায় স্বীকার করল, তখন নেতারা বলে বসলেন, ১৬০ কোটি মানুষের ধর্ম ইসলামের ওপর সব দোষ বর্তাবে এবং মুসলিম উদ্বাস্তুরা (তাদের বেশির ভাগ মুসলমান হলেও সবাই নয়) প্রধানত এ ধরনের হামলা চালানোর জন্যই পাশ্চাত্যে প্রবেশ করছে।
মুসলিম ও উদ্বাস্তুদের পীড়ন
যখনই ইসলামি চরমপন্থীরা কোনো হামলা চালায়, তখনই ১৬০ কোটি মুসলমানের কাছ থেকে সম্মিলিতভাবে মা প্রত্যাশা করা হয়, এই পর্যায়ে এটা জমাট বাঁধা ধারণায় পরিণত হয়ে গেছে।
মুসলমান ও উদ্বাস্তুদের ওপর পীড়ন চালিয়ে কারা উপকৃত হচ্ছে? এতে উপকৃত হয় প্রধানত দুটি গ্র“প : এক. খোদ চরমপন্থী গ্র“পগুলো। তাদের মতে, দমন-পীড়ন এটাই ‘প্রমাণ’ করে যে, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সেকুলার পাশ্চাত্যে দৃশ্যত মুসলমানদের কোনো স্থান নেই। দুই. ইউরোপের ক্রমবর্ধমান উগ্র ডানপন্থীরা। তাদের মতে, হামলা এটাই ‘প্রমাণ’ করে, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সেকুলার পাশ্চাত্যে দৃশ্যত মুসলমানদের কোনো স্থান নেই।
তারা যদিও পরস্পরের শত্র“, কিন্তু উভয় গ্র“পের মধ্যে এ ব্যাপারে অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। উগ্র ডানপন্থীরা চায় মুসলমান এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর উদ্বাস্তুরা (এমনকি যদি তারা মুসলমান না-ও হয়) পাশ্চাত্য ত্যাগ করুক। তাদের মতে, তারা জন্মগতভাবেই সহিংস সন্ত্রাসী। ইসলামি চরমপন্থীরা চায় মুসলিম উদ্বাস্তুরা চলে যাক, যাতে তারা চরমভাবাপন্ন হয়ে তাদের খিলাফতে যোগ দেয়।
আরো তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, জোর গলায় বলে দেয়া যায় যে, মুসলিম ও উদ্বাস্তুদের ওপর দমন-পীড়নে ইউরোপের ক্রমবর্ধমান উগ্র ডানপন্থী আন্দোলন লাভবান হতে থাকবে এবং মুসলিমবিদ্বেষী ও উদ্বাস্তুবিরোধী প্রপাগান্ডার মাধ্যম নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহ করা অব্যাহত রাখবে।
আইএসআইএস প্রকাশ্যেই বলেছে, তাদের ল্য হলো তাদের কথিত ‘গ্রে-জোন’-এর (বলা যেতে পারে পাশ্চাত্যে মুসলমানদের গ্রহণ করা) বিলুপ্তিসাধন। আইএসআইএসের নিজস্ব প্রকাশনায় বলা হয়েছে, গ্রে-জোন বিলুপ্তির ভয়ঙ্কর কাজ শুরু হয়েছে ১১ সেপ্টেম্বরের ‘বরকতময়’ অভিযানের মাধ্যমে। এসব অভিযান পৃথিবীর মানুষের কাছে দু’টি শিবিরকে তুলে ধরেছে : একটি হলো ইসলামের শিবির, অপরটি হলো কুফরের শিবির (ক্রুসেডার জোট)।’
পাশ্চাত্যের উগ্র ডানপন্থী ও ইসলামি চরমপন্থীদের স্বার্থ একাকার হয়ে গেছে। আইএসআইএস সুস্পষ্টভাবেই যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে, তাতে কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশএবং তার একগুঁয়ে শত্র“ আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মনের কথাই বলা হয়েছে। আইএসআইএস লিখেছে : “শায়খ ওসামা বিন্ লাদেন যেভাবে বলেছেন, ‘বিশ্ব আজ দুই শিবিরে বিভক্ত;’ বুশ যখন বলেন, তোমরা আমাদের সাথে কিংবা তোমরা সন্ত্রাসীদের সাথে’ তখন তিনি সত্য কথাই বলেন।’ অর্থাৎ হয় তুমি ক্রুসেডারের সাথে কিংবা ইসলামের সাথে।”
আইএসআইএসকে ভাইরাস হিসেবে চলার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে আমরা স্রেফ তাদের ধর্ষকামী ল্যগুলো পূরণ করতে সহায়তা করছি।
এ দিকে ফরাসি উগ্র ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি বিশেষভাবে লাভবান হচ্ছে। জনৈক নব্য নাৎসির গঠিত দলটিকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার বিচ্ছেদপ্রাপ্তা মেয়ে ম্যারিন লি পেন। তিনি মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন; ভণ্ডামির সাথে তাদের নাৎসি দখলদার হিসেবে অভিহিত করছেন। ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ‘ফ্যাসিবাদী’ দল বলা যুক্তিসম্মত বলে ২০১৪ সালে প্যারিসের একটি আদালত রায় দিয়েছিল।
প্যারিস হামলার আগে লি পেনের উগ্র ডানপন্থী আন্দোলন ছিল ফ্রান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। এখন তারা হয়তো প্রথম দলে পরিণত হয়ে গেছে।
যে গণহত্যাগুলো উপো করা হয়
ইউরোপে প্রতি বছর শত শত হামলা হয়ে থাকে। তবে কেবল সেগুলোই প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, যেগুলো মুসলমানেরা ঘটায়, যেগুলো জাতিগত-জাতীয়তাবাদী বা উগ্র ডান চরমপন্থীরা চালায় সেগুলো নজরে আসে না, যদিও সেগুলোই অনেক বেশি ঘটে থাকে।
অবশ্য কেবল ডানপন্থী পণ্ডিত আর মিডিয়াই প্যারিস হামলার মতো ঘটনাগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দেয় না, রাষ্ট্রপ্রধানেরাও তা করেন। প্যারিস হামলার কয়েক মিনিট পরই প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ আর প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশ্বের সামনে বক্তব্য রাখেন, প্রকাশ্যে ঘটনাটির তীব্র সমালোচনা করেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামলাকে ‘জঘন্য, শয়তানি ও ইতরামিপূর্ণ কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
এর মাত্র এক দিন আগে আরেকটি নৃশংস হামলা হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে ঘিরে সরকারি নীরবতা ছিল লণীয়। ১২ নভেম্বর শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত বৈরুতে আইএসআইএসের আত্মঘাতী বোমারুরা অন্তত ৪৩ জনকে হত্যা এবং অন্তত ২৩০ জনকে আহত করেছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা বিশ্ববাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেননি এবং কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ওই বোমা হামলার নিন্দা করেননি।
বস্তুত, বিপরীতটাই ঘটেছে। মার্কিন মিডিয়ায় আইএসআইএস হামলার শিকার যারা, তাদের হিজবুল্লাহর মানব ঢাল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাদের দুর্ভাগ্যজনক ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে, তাই এ জন্য তারাই দায়ী বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো ডানপন্থী পণ্ডিত এই হামলা যৌক্তিক বলে অভিহিত করে বলেছেন, হামলাটি সম্ভবত হয়েছিল হিজবুল্লাহকে ল্য করে।
গত অক্টোবরে তুরস্কে কুর্দিপন্থী একটি রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলায় ১২৮ জনের নিহত এবং ৫০০ লোকের আহত হওয়ার খবরেও হোয়াইট হাউজ বিচলিত হয়নি।
আরো অবাক ব্যাপার হলো, রাষ্ট্রপ্রধানেরা তখন কোথায় ছিলেন যখন কোয়ালিশন বাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর ইয়েমেনের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে বিমান হামলা চালিয়ে ৮০ জন নারীসহ ১৩১ জন নিরীহ লোককে হত্যা করল? ওই হত্যাকাণ্ডের খবর তেমন প্রচারিত হয়নি, ওবামা ও ওলাঁদ মা চাননি।
ফরাসিদের জীবন কি লেবাননি, তুর্কি, কুর্দি ও ইয়েমেনিদের চেয়ে বেশি দামি? এসব হামলা কেন ‘জঘন্য, শয়তানি ও ইতরামিপূর্ণ কাজ’ হবে না?
অদ্ভুত মিল
আমরা এসব আগেও দেখেছি, এগুলোর মধ্যে অদ্ভুত মিল রয়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারির নৃশংস হামলার প্রতিক্রিয়া ছিল অনুমিত। গৎবাঁধা ইসলামভীতির বুলি কপচিয়ে ওই মর্মান্তিক হামলার আসল কারণ চেপে যাওয়া হয়েছে। শার্লি এবদোতে কার্টুন আঁকার জন্য নয়, ওই হামলা হয়েছিল ইরাকে ভয়ঙ্কর মার্কিন আক্রমণ এবং আবু গারিব কারাগারে নৃশংস নির্যাতনের প্রতিবাদে। ইরাকের ঘটনাই বন্দুকধারীদের প্তি করে তুলেছিল। আরেকটি সত্য চেপে যাওয়া হয়েছে, তা হলোÑ চরমপন্থী হামলাকারীরা ছিল আলজেরিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের সন্তান। ওই দেশটি কয়েক দশক ধরে জঘন্য ফরাসি উপনিবেশে ছিল। লাখ লাখ আলজেরিয়ানের রক্তের বিনিময়েই কেবল দেশটি স্বাধীনতা পেয়েছিল।
জানুয়ারির প্যারিস হামলার পর সারা বিশ্বের নেতারা সতর্কভাবে পরিকল্পিত একটি ফটোসেশনে যোগ দিতে প্যারিসে সমবেত হয়েছিলেন। আর এসব হামলার জন্য মুসলমানদের কেবল পাইকারিভাবে দায়ীই করা হয় না, তাদের পাইকারিভাবে প্রত্যাঘাতও সহ্য করতে হয়।
জানুয়ারি হামলার মাত্র ছয় দিন পর ন্যাশনাল অবজারভেটরি অ্যাগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া ফ্রান্সে ইসলাম অনুসারীদের ওপর ৬০টি আক্রমণ ও হুমকি নথিভুক্ত করেছে। মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদী হামলা পর্যবেণকারী যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ‘টেলমামা’ও ৫০-৬০টি হুমকির খবর দিয়েছে।
আরেকটি কথা, জানুয়ারির প্যারিস হামলার মাত্র কয়েক দিন পর বিশ্ব সম্প্রদায় আরেকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা অনেকাংশেই চেপে গিয়েছিল : বোকো হারাম নাইজেরিয়ায় দুই হাজারের বেশি লোককে গলা কেটে হত্যা করে। আফ্রিকান নিহতরা রাষ্ট্রনায়কদের সমাবেশ পায়নি, কেবল ইসলামি চরমপন্থীদের পাশ্চাত্যের শিকারদের জন্য তা নির্ধারিত।
পাশ্চাত্যের অপরাধ
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটি অতি সামান্যভাবে আলোচিত হয় তা হলো, ইসলামি চরমপন্থীদের শিকারদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হলো মুসলমানেরা। তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেই বাস করে। ২০১২ সালে মার্কিন ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম সেন্টার খবর প্রকাশ করে, গত পাঁচ বছরে ধর্মীয় প্রণোদনায় চালিত সন্ত্রাসী হামলাগুলোর ৮২ থেকে ৯৭ শতাংশের শিকার হয়েছে মুসলমানেরা। অথচ পাশ্চাত্য এমনভাবে খবর প্রকাশ করে, যেন তারাই প্রধান শিকার; অথচ বিপরীতটাই সত্য।
কেউ কি কখনো প্রশ্ন তুলেছে, কেন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে এত উদ্বাস্তু পালিয়ে আসছে? এমন নয় যে, কোটি কোটি লোক তাদের বাড়িঘর ও পরিবার ফেলে আসতে চায়, আসলে তারা সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়, আর ওইসব সহিংসতা আর বিশৃঙ্খলার কারণ প্রায় সব েেত্রই পাশ্চাত্যের সামরিক হস্তপে।
পাশ্চাত্যের দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যভাবে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইয়েমেনের সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী, এ কারণেই কোটি কোটি উদ্বাস্তু পালাচ্ছে।
ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অবৈধ হামলায় অন্তত ১০ লাখ লোক মারা গেছে এবং পুরো অঞ্চলটিতে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্ট চরম পরিস্থিতিতে আল-কায়েদার মতো জঙ্গি গ্র“পগুলো দাবানলের মতো গজিয়ে উঠেছে। সেগুলোই অবশেষে আইএসআইএসের উত্থান ঘটিয়েছে।
আফগানিস্তানে চলমান মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর যুদ্ধ ও দখলদারিত্বের কারণে (ওবামা প্রশাসন যেটাকে দ্বিতীয়বারের মতো দীর্ঘায়িত করেছে) আড়াই লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেছে, কোটি কোটি আফগান উদ্বাস্তু হয়েছে।
লিবিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর হস্তেেপ দেশটির সরকার ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশটি চরমপন্থীদের উর্বর েেত্র পরিণত হয়েছে। উত্তর আফ্রিকায় আইএসআইএসের মতো জঙ্গি গ্র“পগুলোর কার্যক্রম চালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার লিবীয় নিহত হয়েছে, লাখ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে।
ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের জাতিগুলো সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে অস্ত্র ও সমর্থন দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গরিব দেশটির বেসামরিক এলাকায় নিষিদ্ধ গুচ্ছবোমা ফেলতে, অবকাঠামো ধ্বংস করতে। এখানেও একই কাহিনী : হাজার হাজার লোক নিহত, লাখ লাখ লোক উদ্বাস্তু।
সিরিয়া পরিস্থিতি আরেকটু জটিল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিক্ত যুদ্ধে বিধ্বস্ত, দেশটির অনেক উদ্বাস্তু আসাদ সরকারের নির্মম পীড়ন থেকে রা পেতে পালাচ্ছে। অবশ্য এ জন্য পাশ্চাত্যের দেশগুলো এবং তাদের মিত্ররাও দায়ী। সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো আল-নুসরা ধরনের মিত্ররা এই সঙ্ঘাত অনেক গুণ বাড়িয়ে তুলছে।
বলা বাহুল্য, প্যারিসে আইএসআইএস যে হামলা চালিয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সেই একই ধরনের সন্ত্রাস থেকে রা পেতেই লাখ লাখ সিরিয়ান উদ্বাস্তু ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছে। চরমপন্থী গ্র“পগুলোর নির্মম সহিংসতা থেকে রা পেলেও পালিয়ে যাওয়া সিরিয়ান ও ইরাকি উদ্বাস্তুদের ফ্রান্স ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশ আরো করুণ অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে।
দোষ স্খলন
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যখন ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে বিয়ে অনুষ্ঠান ও হাসপাতালে বোমা ফেলে শত শত বেসামরিক লোককে হত্যা করে, ‘আমেরিকানরা’ তখন টুইটারে বিশ্বব্যাপী সেটা ছড়িয়ে দেয় না। কিন্তু যখন কথিত ইসলামি চরমপন্থীরা প্যারিসবাসীকে হত্যা করে, তখন ‘মুসলমানেরা’ করে।
সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য সব সময় দোষ অন্যের ঘাড়ে সরিয়ে দেয়। এটা সব সময় বিদেশী, অ-পাশ্চাত্য এবং অন্যদের দোষ, এটা কখনো আলোকিত পাশ্চাত্যের দোষ নয়।
ইসলাম হলো নতুন ‘বলির পাঁঠা’। পুরো জাতির ওপর প্রতিশোধ নেয়া, নিপীড়ক স্বৈরাচারীদের টিকিয়ে রাখা, চরমপন্থী গ্র“পগুলোকে সমর্থন দেয়ার পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের নীতির কথা সহজেই ভুলে যাওয়া হয়।
পাশ্চাত্য তার নিজস্ব সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতার সমাধান দিতে অক্ষম। এর বদলে সে তার রক্তরঞ্জিত আঙুল বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলমানের দিকে তাক করে তাদের বলে, তারা জন্মগতভাবেই সহিংস।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্যারিসে আমরা যেসব মর্মান্তিক ঘটনা দেখছি, সেগুলো মধ্যপ্রাচ্যের নৈমিত্তিক ঘটনা। আর এসবই ঘটছে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ইত্যাদি দেশের সরকারি নীতির কারণে।
এর মানে এই নয় যে, আমরা প্যারিস হামলার জন্য শোক প্রকাশ করব না। এসব ঘটনা অবশ্যই জঘন্য। আমাদের শোক প্রকাশ করতেই হবে। তবে আমাদের সরকারের অপরাধগুলোর জন্যও আমাদের একইভাবে শোক প্রকাশ করা দরকার।
আমরা যদি সত্যিই বিশ্বাস করি, সব জীবন সমান মূল্যবান; আমরা যদি সত্যিই বিশ্বাস করি, ফরাসিদের জীবন অন্যদের চেয়ে বেশি মূল্যবান নয়; তবে অবশ্যই আমাদের প্রতিটি জীবনের জন্যই শোক প্রকাশ করতে হবে।
অভ্যাসের বিপদ
আমরা জানি, হামলার প্রতিক্রিয়া এমন। এই পন্থায় চলতে থাকলে আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করবে।
সরকারগুলো মধ্যপ্রাচ্যে আরো বেশি পাশ্চাত্য সামরিক হস্তপে করতে যাচ্ছে; আরো বেশি বোমা ফেলবে; আরো বেশি বন্দুক পাঠাবে। কট্টর ডানপন্থী সিনেটর টেড ক্রুজ সাথে সাথেই ‘বেসামরিক লোকদের জন্য, আরো সহিষ্ণুতার জন্য’ বিমান হামলার দাবি জানিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যক্তিবিশেষের সন্ত্রাসের জবাব দেয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে।
দেশে আমরা আরো বেশি বেড়া, আরো বেশি পুলিশ, আরো বেশি তদারকির আহ্বান জানাব। প্যারিস হামলার সাথে সাথে ফ্রান্স তার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। হামলার খবর পাওয়ামাত্র যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্ক সিটির পুলিশ সেখানকার কোনো কোনো অংশকে সামরিকায়ন করতে শুরু করে দিয়েছে।
প্রাধান্য বিস্তারসূচক ‘সমাধানে’ সব সময়ই দেশে ও বিদেশে আরো বেশি সামরিকায়ন হয়ে থাকে। অথচ বাস্তবতা হলো, সমস্যার কারণ হচ্ছে এর উৎপত্তিস্থলে সামরিকায়ন।
নৃশংস ৯/১১ হামলার সময় আলকায়েদা ছিল তুলনামূলক ছোট ও বিচ্ছিন্ন গ্রুপ। ইরাক দখল করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সৃষ্ট চরম সহিংসতাপূর্ণ অবস্থা, হতাশা, সম্প্রদায়গত সঙ্ঘাত বিশ্বজুড়ে আলকায়েদাকে ছড়িয়ে দিয়েছে। সামরিকবাদের প্রতি আসক্ত পাশ্চাত্য চরমপন্থীদের সাথে হাত মিলিয়ে চলেছে। আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি, পচা আসক্তি নিয়ে আসছে পচা ফল : আইএসআইএস হলো পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের দৈত্য।
আমাদের সরকারগুলো যদি একনায়কদের কাছে অস্ত্র বিক্রির কৌশল চালিয়ে যায়, তবে প্যারিসের মতো হামলা কেবল চলতেই থাকবে না, আরো বেশি বেশি হবে; ডানপন্থীরা বাড়তেই থাকবে। আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক নব্য নাৎসিবাদীরা তাদের শক্তি আরো বাড়িয়ে নেবে। লোকজন চরম ভাবাপন্ন হয়ে পড়বে।
জাতিগত-জাতীয়তাবাদী বা উগ্র ডানপন্থীদের হামলার ঘটনা ইতোমধ্যেই ইউরোপ ও আমেরিকায় সন্ত্রাসের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। এটা আরো বাড়তেও পারে। পণ্ডিতেরা মুসলিমবিদ্বেষী গোঁড়ামি আরো চাঙ্গা করবেন, উদ্বাস্তুবিরোধী উত্তেজনা আরো বাড়াবেন। আর সেটা করতে গিয়ে তারা পরিস্থিতির কেবল অবনতিই ঘটাবেন।
আমাদের সরকারগুলো দেশে ও বিদেশে কী করছে, সেটা গভীরভাবে ভাবতে ভয়াবহ প্যারিস হামলাটি আমাদের উদ্বুদ্ধ করার অবকাশ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা না করি, যদি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিই, সহিংসতার রাস্তা ধরি, তবে ত আরো বাড়বেই। রক্তপাত শেষ পর্যন্ত আরো বেগবান হবে।
সংেেপ বলা যায়, প্যারিস হামলার প্রতিক্রিয়ায় যারা সামরিকায়ন এবং মুসলিমবিরোধী ও উদ্বাস্তুবিরোধী নীতি অব্যাহত রাখতে চায়, তারা আসলে সহিংসতা আর ঘৃণাকেই কেবল আরো উসকে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বৃত্তের যদি পরিবর্তন না হয়, তবে সহিংসতার বৃত্তও চলতে থাকবে।
No comments