শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই আন্দোলন -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : ফরিদ উদ্দিন আহমেদ by মশিউল আলম
প্রথম
আলো : অষ্টম জাতীয় বেতনকাঠামো ঘোষণার পর থেকে আপনাদের যে আন্দোলন চলছে,
তাতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আপনারা বলছেন, দাবি মানা না হলে অচিরেই আন্দোলনের আরও কঠোর কর্মসূচি নেওয়া
হবে। তাহলে কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : আসলে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়েছে এ বছরের ১৪ মে থেকে, যখন সচিব কমিটির বেতনকাঠামো পর্যালোচনার বিবরণ নিয়ে সংবাদপত্রে খবর ছাপা হলো এবং আমরা জানতে পারলাম যে শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমন ঘটতে যাচ্ছে। শিক্ষকেরা মর্যাদার যে জায়গায় ছিলেন, সেখানে আর থাকতে পারবেন না।
প্রথম আলো : কীভাবে অবনমন ঘটতে যাচ্ছিল?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : শিক্ষকদের জন্য যে সিলেকশন গ্রেড ছিল, অষ্টম বেতনকাঠামোতে সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে, উপরন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য শূন্য গ্রেড ও সুপার গ্রেড সৃষ্টি করে শিক্ষকদের দৃশ্যত চার ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সপ্তম বেতনকাঠামোতে কিন্তু সিনিয়র সচিব বলতে কিছু ছিল না, দুনিয়ার কোথাও নেই। তারপর আরেকটা করা হলো পদায়িত সচিব। এভাবে শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমন করা হয়েছে।
প্রথম আলো : কিন্তু নতুন বেতনকাঠামোতে আপনাদের বেতন-ভাতা তো ৯১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবু আন্দোলন কেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে বেতন-ভাতা বাড়ানো অবশ্যই প্রয়োজন। সেটা করা হয়েছে, ভালো হয়েছে। আবার এটাও দেখার বিষয় যে নতুন বেতনকাঠামো ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রব্যমূল্য যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, তাতে এই বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুফল বাস্তবে কতটা পাওয়া যাবে, সেটাও চিন্তার বিষয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে বেতন-ভাতার বিষয়টি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আন্দোলন হচ্ছে মর্যাদার প্রশ্নে। বাড়তি মর্যাদা আমরা দাবি করছি না, মর্যাদার অবনমনের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যে মর্যাদা ছিল, তা রক্ষার জন্য আন্দোলন করছি। শিক্ষকদের সিলেকশন গ্রেড ছিল, তাতে কী সমস্যা হচ্ছিল? সেটা বাতিল করা হলো কেন? কী প্রয়োজন ছিল বাতিল করার?
প্রথম আলো : কিন্তু সে জন্য শিক্ষকদের আন্দোলন, কর্মবিরতি—এসবের ফলে তো শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে তারা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ বিষয়টি কি আপনাদের বিবেচনায় আছে?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : অবশ্যই আছে। আমরা কখনোই আমাদের ছেলেমেয়েদের ক্ষতি করে আন্দোলন করতে চাই না। সে জন্য আমরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা ইত্যাদির ব্যাঘাত ঘটিয়ে কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি খুব একটা দিইনি। মাত্র তিন দিন ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে, কারণ আমাদের মানববন্ধন ছিল, শিক্ষকেরা সেখানে যোগ দিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তারপরে একদিন মাত্র আমরা ক্লাস বিরতি দিয়েছি পূর্ণ দিন, তার মধ্যে পরীক্ষাও ছিল। ওই তিন দিন আর এই ছয় ঘণ্টা ছাড়া আমরা কিন্তু ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখে কিছু করিনি।
প্রথম আলো : কিন্তু আপনারা তো ঘোষণা দিয়েছেন যে আরও কঠোর কর্মসূচিতে যাচ্ছেন, তখন কী হবে?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : আন্দোলন-কর্মসূচির নানা রকম পদ্ধতি আছে, তার মানে এটা নয় যে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আমরা আন্দোলনে যাব।
প্রথম আলো : তাহলে আপনাদের ‘কঠোর কর্মসূচি’র বাস্তব রূপটা কী হবে?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : সেটা এখন বলতে চাইছি না। আমাদের কিছু উদ্ভাবনী ভাবনা আছে। সমস্যাটা এখন যে পর্যায়ে আছে, তাতে আমরা আশাবাদী যে অচিরেই একটা সমাধান হবে। মন্ত্রিপরিষদ এ বিষয়টা দেখার জন্য একটা মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করেছে, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও সেই উপকমিটির সদস্য, ৫ অক্টোবর আমরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে তুলে ধরেছি।
প্রথম আলো : বেতন কমিশন কিন্তু বলেছে, নতুন বেতনকাঠামোতে শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্য করা হয়নি।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : এর আগে সাতটি বেতন কমিশন হয়েছে, কিন্তু অষ্টম বেতন কমিশন শিক্ষকদের বেতন যতটা বাড়িয়েছে, আগের কোনো কমিশনই ততটা বাড়ায়নি। সেদিক থেকে এই বেতন কমিশন অবশ্যই বেশি দিয়েছে। কিন্তু আপনাকে আগেই বলেছি, শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা নিয়ে উদ্বিগ্ন নন, আমাদের সবার উদ্বেগের জায়গাটা হলো আমাদের মর্যাদার অবনমন।
প্রথম আলো : আপনারা সিলেকশন গ্রেড বহাল রাখতে বলছেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : বিষয়টি শুধু সিলেকশন গ্রেড নিয়ে নয়। সুপার গ্রেড যেটা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব—এ দুটি কিন্তু আগে গ্রেডিংয়ের মধ্যে ছিল না। আগে ছিল একটা ফুটনোট হিসেবে, এখন এটাকে ওপরে রাখা হয়েছে। তারপর আরেকটা হলো সিনিয়র সচিব। যদি তাঁদের ওপরে রাখতেই হয়, গ্রেড হিসেবে রাখলে কী ক্ষতি ছিল? এটাকে সুপার গ্রেড বা জিরো গ্রেড করার কী প্রয়োজন ছিল? আরেকটা কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই,শিক্ষকেরা যখন অধ্যাপক হন, সেখান থেকে সিলেকশন গ্রেড বা গ্রেড-১ পেতে ১৬-১৭ বছর লেগে যেত। আর সিলেকশন গ্রেড পেতেন অধ্যাপকদের মাত্র ২৫ শতাংশ। অধিকাংশই সিলেকশন গ্রেড না পেয়ে অবসরে চলে যেতেন। কিন্তু কিছুসংখ্যক তো পেতেন। এখন সিলেকশন গ্রেড বাতিল করার কারণে অধ্যাপকেরা কোনো দিনই আর ওই জায়গায় যেতে পারবেন না। অধ্যাপকেরা এখন শুরু করবেন তৃতীয় গ্রেড থেকে। আমাদের কথা হচ্ছে, শিক্ষকদের একটা মর্যাদা দেওয়ার পরে তো আপনি সেটা ফিরিয়ে নিতে পারেন না, নেওয়া উচিত নয়। সিনিয়র সচিব, মুখ্য সচিবদের বেতন বাড়ানো হয়েছে ১০০ শতাংশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে ৯১ শতাংশ, সব মিলিয়ে। কিন্তু আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত নই, বেতন একটু কম-বেশি হতে পারে। আমাদের কথা হচ্ছে, শিক্ষকেরা এই পেশায় আসেন সম্মানের জন্য, মর্যাদার জন্য। সেই সম্মান দিয়ে আপনি কেড়ে নেবেন—এটা তো হয় না, এটা ন্যায়বিচার হতে পারে না। ওপরের দিকের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তার বেতন-ভাতা দিগুণ বাড়ানো হলো, মর্যাদা বাড়ানো হলো, নতুন নতুন পদ তৈরি করা হলো, আর শিক্ষকেরা যে মর্যাদা পেয়ে আসছিলেন, সেটা কেড়ে নিয়ে তাঁদের অবমানিত করা হলো—এটা তো হতে পারে না।
প্রথম আলো : আপনারা আপনাদের দাবিনামার এক জায়গায় বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকদের বেতনকাঠামো সপ্তম গ্রেডে নির্ধারণ করা হোক। কিন্তু বিসিএস ক্যাডারদের চাকরি তো শুরু হয় নবম গ্রেড থেকে। আপনারা বাড়তি দাবি করছেন কেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : এর মূল উদ্দেশ্য দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করা। আমরা যদি দেশ-জাতির আরও উন্নয়ন-অগ্রগতি চাই, তাহলে ভালো শিক্ষক দরকার। শিক্ষকদের হাতেই তৈরি হন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, সচিবসহ অন্যান্য সব পেশাজীবী। সুদক্ষ সচিব তৈরির জন্য মেধাবী শিক্ষক দরকার। এটাই আমাদের এই দাবির মৌলিক ভাবনা। এটা সরকারের বা একটা রাষ্ট্রের জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হওয়া উচিত। বিশ্বের যেসব দেশ এগিয়ে গেছে, তারা শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে সবচেয়ে বেশি; সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য তারা সবকিছু করে।
প্রথম আলো : আপনাদের আন্দোলন কিন্তু এক মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। আর কত দিন চালাবেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : সরকার একটা মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করেছে, সেখানে অত্যন্ত সুবিবেচক অনেকে আছেন। আমি মনে করি, সমস্যাটা সমাধানের জন্য আর বেশি সময় লাগার কথা নয়, একটি-দুটি বৈঠক হলেই কিন্তু সমাধান হয়ে যায়। আমরা পাঁচ মাস ধরে অপেক্ষা করছি, আমরা কঠোর আন্দোলনে যাইনি। যাইনি এ জন্য যে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জিম্মি করে কিছু করতে চাইছি না। আমরা অনেক কষ্ট করে তাদের সেশনজট দূর করেছি। এখন আমরা মনে করি, অনেক সময়ক্ষেপণ হয়েছে, আর বিলম্ব না করে সমস্যাটার সমাধান করা হোক।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সভাপতি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : আসলে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়েছে এ বছরের ১৪ মে থেকে, যখন সচিব কমিটির বেতনকাঠামো পর্যালোচনার বিবরণ নিয়ে সংবাদপত্রে খবর ছাপা হলো এবং আমরা জানতে পারলাম যে শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমন ঘটতে যাচ্ছে। শিক্ষকেরা মর্যাদার যে জায়গায় ছিলেন, সেখানে আর থাকতে পারবেন না।
প্রথম আলো : কীভাবে অবনমন ঘটতে যাচ্ছিল?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : শিক্ষকদের জন্য যে সিলেকশন গ্রেড ছিল, অষ্টম বেতনকাঠামোতে সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে, উপরন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য শূন্য গ্রেড ও সুপার গ্রেড সৃষ্টি করে শিক্ষকদের দৃশ্যত চার ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সপ্তম বেতনকাঠামোতে কিন্তু সিনিয়র সচিব বলতে কিছু ছিল না, দুনিয়ার কোথাও নেই। তারপর আরেকটা করা হলো পদায়িত সচিব। এভাবে শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমন করা হয়েছে।
প্রথম আলো : কিন্তু নতুন বেতনকাঠামোতে আপনাদের বেতন-ভাতা তো ৯১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবু আন্দোলন কেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে বেতন-ভাতা বাড়ানো অবশ্যই প্রয়োজন। সেটা করা হয়েছে, ভালো হয়েছে। আবার এটাও দেখার বিষয় যে নতুন বেতনকাঠামো ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রব্যমূল্য যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, তাতে এই বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুফল বাস্তবে কতটা পাওয়া যাবে, সেটাও চিন্তার বিষয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে বেতন-ভাতার বিষয়টি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আন্দোলন হচ্ছে মর্যাদার প্রশ্নে। বাড়তি মর্যাদা আমরা দাবি করছি না, মর্যাদার অবনমনের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যে মর্যাদা ছিল, তা রক্ষার জন্য আন্দোলন করছি। শিক্ষকদের সিলেকশন গ্রেড ছিল, তাতে কী সমস্যা হচ্ছিল? সেটা বাতিল করা হলো কেন? কী প্রয়োজন ছিল বাতিল করার?
প্রথম আলো : কিন্তু সে জন্য শিক্ষকদের আন্দোলন, কর্মবিরতি—এসবের ফলে তো শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে তারা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ বিষয়টি কি আপনাদের বিবেচনায় আছে?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : অবশ্যই আছে। আমরা কখনোই আমাদের ছেলেমেয়েদের ক্ষতি করে আন্দোলন করতে চাই না। সে জন্য আমরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা ইত্যাদির ব্যাঘাত ঘটিয়ে কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি খুব একটা দিইনি। মাত্র তিন দিন ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে, কারণ আমাদের মানববন্ধন ছিল, শিক্ষকেরা সেখানে যোগ দিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তারপরে একদিন মাত্র আমরা ক্লাস বিরতি দিয়েছি পূর্ণ দিন, তার মধ্যে পরীক্ষাও ছিল। ওই তিন দিন আর এই ছয় ঘণ্টা ছাড়া আমরা কিন্তু ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখে কিছু করিনি।
প্রথম আলো : কিন্তু আপনারা তো ঘোষণা দিয়েছেন যে আরও কঠোর কর্মসূচিতে যাচ্ছেন, তখন কী হবে?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : আন্দোলন-কর্মসূচির নানা রকম পদ্ধতি আছে, তার মানে এটা নয় যে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে আমরা আন্দোলনে যাব।
প্রথম আলো : তাহলে আপনাদের ‘কঠোর কর্মসূচি’র বাস্তব রূপটা কী হবে?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : সেটা এখন বলতে চাইছি না। আমাদের কিছু উদ্ভাবনী ভাবনা আছে। সমস্যাটা এখন যে পর্যায়ে আছে, তাতে আমরা আশাবাদী যে অচিরেই একটা সমাধান হবে। মন্ত্রিপরিষদ এ বিষয়টা দেখার জন্য একটা মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করেছে, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও সেই উপকমিটির সদস্য, ৫ অক্টোবর আমরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে তুলে ধরেছি।
প্রথম আলো : বেতন কমিশন কিন্তু বলেছে, নতুন বেতনকাঠামোতে শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্য করা হয়নি।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : এর আগে সাতটি বেতন কমিশন হয়েছে, কিন্তু অষ্টম বেতন কমিশন শিক্ষকদের বেতন যতটা বাড়িয়েছে, আগের কোনো কমিশনই ততটা বাড়ায়নি। সেদিক থেকে এই বেতন কমিশন অবশ্যই বেশি দিয়েছে। কিন্তু আপনাকে আগেই বলেছি, শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা নিয়ে উদ্বিগ্ন নন, আমাদের সবার উদ্বেগের জায়গাটা হলো আমাদের মর্যাদার অবনমন।
প্রথম আলো : আপনারা সিলেকশন গ্রেড বহাল রাখতে বলছেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : বিষয়টি শুধু সিলেকশন গ্রেড নিয়ে নয়। সুপার গ্রেড যেটা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব—এ দুটি কিন্তু আগে গ্রেডিংয়ের মধ্যে ছিল না। আগে ছিল একটা ফুটনোট হিসেবে, এখন এটাকে ওপরে রাখা হয়েছে। তারপর আরেকটা হলো সিনিয়র সচিব। যদি তাঁদের ওপরে রাখতেই হয়, গ্রেড হিসেবে রাখলে কী ক্ষতি ছিল? এটাকে সুপার গ্রেড বা জিরো গ্রেড করার কী প্রয়োজন ছিল? আরেকটা কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই,শিক্ষকেরা যখন অধ্যাপক হন, সেখান থেকে সিলেকশন গ্রেড বা গ্রেড-১ পেতে ১৬-১৭ বছর লেগে যেত। আর সিলেকশন গ্রেড পেতেন অধ্যাপকদের মাত্র ২৫ শতাংশ। অধিকাংশই সিলেকশন গ্রেড না পেয়ে অবসরে চলে যেতেন। কিন্তু কিছুসংখ্যক তো পেতেন। এখন সিলেকশন গ্রেড বাতিল করার কারণে অধ্যাপকেরা কোনো দিনই আর ওই জায়গায় যেতে পারবেন না। অধ্যাপকেরা এখন শুরু করবেন তৃতীয় গ্রেড থেকে। আমাদের কথা হচ্ছে, শিক্ষকদের একটা মর্যাদা দেওয়ার পরে তো আপনি সেটা ফিরিয়ে নিতে পারেন না, নেওয়া উচিত নয়। সিনিয়র সচিব, মুখ্য সচিবদের বেতন বাড়ানো হয়েছে ১০০ শতাংশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে ৯১ শতাংশ, সব মিলিয়ে। কিন্তু আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত নই, বেতন একটু কম-বেশি হতে পারে। আমাদের কথা হচ্ছে, শিক্ষকেরা এই পেশায় আসেন সম্মানের জন্য, মর্যাদার জন্য। সেই সম্মান দিয়ে আপনি কেড়ে নেবেন—এটা তো হয় না, এটা ন্যায়বিচার হতে পারে না। ওপরের দিকের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তার বেতন-ভাতা দিগুণ বাড়ানো হলো, মর্যাদা বাড়ানো হলো, নতুন নতুন পদ তৈরি করা হলো, আর শিক্ষকেরা যে মর্যাদা পেয়ে আসছিলেন, সেটা কেড়ে নিয়ে তাঁদের অবমানিত করা হলো—এটা তো হতে পারে না।
প্রথম আলো : আপনারা আপনাদের দাবিনামার এক জায়গায় বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকদের বেতনকাঠামো সপ্তম গ্রেডে নির্ধারণ করা হোক। কিন্তু বিসিএস ক্যাডারদের চাকরি তো শুরু হয় নবম গ্রেড থেকে। আপনারা বাড়তি দাবি করছেন কেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : এর মূল উদ্দেশ্য দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করা। আমরা যদি দেশ-জাতির আরও উন্নয়ন-অগ্রগতি চাই, তাহলে ভালো শিক্ষক দরকার। শিক্ষকদের হাতেই তৈরি হন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, সচিবসহ অন্যান্য সব পেশাজীবী। সুদক্ষ সচিব তৈরির জন্য মেধাবী শিক্ষক দরকার। এটাই আমাদের এই দাবির মৌলিক ভাবনা। এটা সরকারের বা একটা রাষ্ট্রের জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হওয়া উচিত। বিশ্বের যেসব দেশ এগিয়ে গেছে, তারা শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে সবচেয়ে বেশি; সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য তারা সবকিছু করে।
প্রথম আলো : আপনাদের আন্দোলন কিন্তু এক মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। আর কত দিন চালাবেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : সরকার একটা মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করেছে, সেখানে অত্যন্ত সুবিবেচক অনেকে আছেন। আমি মনে করি, সমস্যাটা সমাধানের জন্য আর বেশি সময় লাগার কথা নয়, একটি-দুটি বৈঠক হলেই কিন্তু সমাধান হয়ে যায়। আমরা পাঁচ মাস ধরে অপেক্ষা করছি, আমরা কঠোর আন্দোলনে যাইনি। যাইনি এ জন্য যে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জিম্মি করে কিছু করতে চাইছি না। আমরা অনেক কষ্ট করে তাদের সেশনজট দূর করেছি। এখন আমরা মনে করি, অনেক সময়ক্ষেপণ হয়েছে, আর বিলম্ব না করে সমস্যাটার সমাধান করা হোক।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সভাপতি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
No comments