বাংলা মায়ের বদনখানি মলিন by সৈয়দ আবুল মকসুদ
অনেক
দেশের জাতীয় সংগীতে জাতির অহংকার ও বীরত্বের কথাই বেশি। বাংলাদেশের জাতীয়
সংগীতে বাংলার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনাই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে
শেষ কথাটি: ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন জলে ভাসি।।’ দেশ মায়ের
প্রতি ভালোবাসা থেকে তার বদন বা মুখটি মলিন হওয়ার আশঙ্কাও করেছিলেন
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি ১১০ বছর আগে।
মায়ের মুখ মলিন কখন হয়? যখন সে তার সন্তানের অমঙ্গল দ্যাখে। সন্তানের সুখ-সমৃদ্ধিতে মায়ের মুখে হাসি ফোটে, অমঙ্গলে জননীর মুখখানি শুকিয়ে মলিন হয়ে যায়। টেলিভিশন সেটের ভেতরে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে যাঁরা যে কথাই বলুন, আজ বাংলা মায়ের মুখখানি যে বিষণ্নতায় মলিন, তা তার সন্তানদের চোখ এড়ানোর কথা নয়। রঙিন বিলবোর্ড দিয়ে রাস্তাঘাট, অলিগলি, গ্রামগঞ্জ ভরে ফেললেও বাংলা মায়ের মলিন মুখ আড়াল করা সম্ভব নয়।
কী কী কারণে মায়ের মুখ ম্লান হতে পারে, তা অনুসন্ধানের চেষ্টা এখন আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে লক্ষ করা যায় না।
স্বাধীনতা একটি পরম মূল্যবান জিনিস। স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কঠিন কাজ। সেই রাষ্ট্রকে সুসংহত ও সমৃদ্ধ করার কাজটি আরও কঠিন। অনেক জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র থাকে না। যেমন কুর্দিরা। আবার জাতি গঠনের আগেই জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র গঠনের পরে বহু সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে সবার স্বার্থ রক্ষা করে জাতিরাষ্ট্র গঠন কঠিনতর কাজ। কাজটি কঠিন শুধু নয়, সাধনাসাপেক্ষ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসসাপেক্ষ। আধুনিক ইন্দোনেশীয় জাতি আগে ছিল না। বালি, সুমাত্রা, বোর্নিও, লোম্বোকসহ শত শত দ্বীপে বাস করত বহু ভাষাভাষী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বহু জাতিগোষ্ঠী। ডাচ সাম্রাজ্যবাদীরা সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে শোষণ-শাসন করেছে। বহু জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বহু দ্বীপ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইন্দোনেশিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় ইন্দোনেশীয় জাতি। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক চিহ্নগুলো মুছে ফেলেছে। আমরা ছোটবেলায় যাকে বলতাম বাটাভিয়া, এখন তার নাম জাকার্তা। একটি আধুনিক রাজধানী নগরী। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। মালয়, চৈনিক প্রভৃতি সম্প্রদায় ছিল মালয় দ্বীপপুঞ্জে। তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না। তারা বাঙালির মতোই ছিল পরাধীন। ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে এখন সমৃদ্ধ মালয়েশীয় জাতিতে পরিণত হয়েছে।
বাঙালিকে ইন্দোনেশীয় বা মালয়েশীয়দের মতো অত ঝামেলা পোহাতে হয়নি। হাজার হাজার বছরে বাংলাভাষী একটি জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। একটি অখণ্ড ভূমিতে তারা বসবাস করছে। একটি অভিন্ন সংস্কৃতি তারা নির্মাণ করেছে। আগেও অনেকবার তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক ছিল। তবে দীর্ঘদিন তারা স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারেনি। অষ্টম শতকে পাল রাজারা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখনই বাঙালির মধ্যে একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চল বা গৌড়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। তুর্কি শাসনামলে বঙ্গ বা বাংলা নামটি প্রতিষ্ঠা পায়। শক্তিশালী বাংলা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। আলীবর্দী খাঁ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীন শাসকই ছিলেন। ইংরেজের শাসনাধীন আমলে বাঙালির হাতে শাসনক্ষমতা না থাকলেও এ সময় বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে এশিয়ার অধিকাংশ জাতির থেকে এগিয়ে যায়। বিত্ত কম ছিল, কিন্তু বিদ্যায় কমতি ছিল না। ১৯৪৭-এর পরে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রদেশের নাগরিক হিসেবে পূর্ব বাংলার মানুষ জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে। তখন সক্ষমতা অর্জন না করলে একাত্তরে একটি বর্বর সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে পারত না। পাঞ্জাবিরা একেবারে পিষে মেরে ফেলত।
রাষ্ট্র যদি একটি নৌকা হয়ে থাকে, তাহলে জনগণ তার যাত্রী, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তার দাঁড়ি এবং কর্ণধার বা মাঝি হলো সরকার। মাঝি যদি দক্ষ না হন, তাহলে নৌকা ঘূর্ণাবর্তে গিয়ে পড়তে পারে অথবা কোনো চড়ায় গিয়ে ঠেকে যাত্রা বিঘ্নিত হতে পারে। বাঙালির যোগ্যতার অভাব নেই, কিন্তু স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা তার ১৯৭২-এর আগে ছিল না। স্বাধীনতার চেতনা বলতে বাঙালির একটি শ্রেণি বোঝে টাকা ও জমি, ঘন ঘন চাকরিতে প্রমোশন, অস্বাভাবিক উপায়ে রাতারাতি বিত্তবান হওয়া, যেকোনো পথে ব্যবসা-বাণিজ্যে ফুলে-ফেঁপে ওঠা এবং জিডিপি বাড়া। স্বাধীনতা এসবের চেয়ে আরও অনেক বড় বিষয়।
বাংলাদেশ হলো আন্দোলনের দেশ। আন্দোলন আগেও হতো, এখনো হচ্ছে। আগে হতো জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন; এখন বিভিন্ন গোত্র তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্দোলন করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছাড়া, দেশের কল্যাণের জন্য সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করা ছাড়া, মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করা ছাড়া আর সব ব্যাপারেই উত্তাল আন্দোলন হয়। সড়ক অবরোধ হয়, ভাঙচুর পর্যন্ত।
কোনো সরকারের সময় যদি দেশ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উন্নতি করে, তাহলে পুরো কৃতিত্ব সেই সরকারের। কিন্তু যদি দেশের মুখ কোনো কারণে মলিন হয় বা রাষ্ট্র সমস্যায় পড়ে, তার দায় শুধু সরকারের নয়, সব রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার নেতৃস্থানীয় মানুষের। আজ জাতির মর্যাদা রক্ষায় সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী, তা মানুষ জানে না। ইতিহাসের কাছে রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতা, পেশাজীবী নেতা ও শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতের নেতারা কী জবাব দেবেন? দুর্নীতি, অপচয়, মাদক ও নানা অনাচারে চিরকালের বাঙালি সমাজ আজ ধ্বংসের পথে, রাজনীতি শেষ হতে হতে বিরাজনীতির চূড়ান্ত পর্যায়ে, এর প্রতিবিধানে কেউ তো এগিয়ে আসছেন না। গোলটেবিল আর মানববন্ধনে দুই কথা বললে সমাজ তো এক ইঞ্চিও নড়বে না, রাষ্ট্র একচুলও সংশোধন হবে না।
আমাদের বয়সী যারা, রাজনীতির মধ্যে, রাজনীতি দেখতে দেখতে, কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণ করে বেড়ে উঠেছি, তাদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতি অস্বাভাবিক মনে হয়। খুবই বেদনাদায়ক। ষাটের দশক ছিল সামরিক একনায়কত্বের সময়। তখন ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষিত তরুণেরা রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। কৃষকেরা মাঠের কাজ ফেলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। শ্রমিক কিস্তি টুপি খুলে মাথায় দিয়েছেন লাল টুপি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররা জানতেন আন্দোলনে যোগ দিলে সরকারি চাকরি পেতে অসুবিধা হবে। তবু দ্বিধা করেননি। তাঁদের অভিভাবকদেরও নীরব সমর্থন ছিল। তাঁরা সমাজেরও সহানুভূতি পেয়েছেন ত্যাগের জন্য। ত্যাগ ছাড়া শুধু বক্তৃতা দিয়ে বা গণমাধ্যমে প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে কিছু অর্জন সম্ভব নয়। স্বাধীনতার আগে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তা আমাদের নেতাদের ত্যাগ ও জনগণের অংশগ্রহণে হয়েছে। প্রেস রিলিজ দ্বারা হয়নি।
বিক্রি হওয়ার মতো মানুষ সব সমাজে সব কালেই থাকেন। স্বাধীনতার আগে বাঙালি সমাজেও ঢের ছিলেন। কথায় কথায় দৌড় দিতেন ইসলামাবাদ, করাচি ও লাহোরে। কিন্তু এমনও তো অনেকেই ছিলেন, যাঁদের মাথা কেনা যায়নি। তাঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন। নীতি বিসর্জন দেননি। ছাত্রসমাজে ছিলেন, শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন, শিল্পী-সাহিত্যিক ও আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন। শ্রমিক নেতারা শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় জেলে গেছেন। শ্রমিকদের মধ্যে দালাল ছিল না। সামরিক শাসনের মধ্যে নিম্ন ও উচ্চ আদালতের বিচারকেরা সাহস করে রায় দিয়েছেন। ষাটের দশকেও আদালতকে বলতে দেখা গেছে, নৌবাহিনীর লোক কামাল উদ্দিনকে কোর্টে হাজির করা হোক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সরকার সমর্থন পায়নি আইনজীবী ও বিচারকদের।
নানা প্রক্রিয়ায় সমাজের প্রগতিশীল শক্তিও আজ নির্জীব হয়ে গেছে। বড় মানুষই বিক্রি হন। কেউ অবৈধ টাকায় ব্যাংক খুলেছেন। কেউ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি পেয়েছেন। নিজের ও সন্তান–সন্ততির জন্য চাকরি বাগাচ্ছেন। আগে ছিল ১০ কাঠা ৭ কাঠা। এখন জায়গার অভাব, মানুষ বেশি। তাই ৪ কাঠা, ৩ কাঠা হলেও চলে। ভোটেই নির্বাচিত হোন বা বিনা ভোটেই নির্বাচিত হোন, সংসদের জনপ্রতিনিধিরা কোন সাংবিধানিক অধিকারে আবাসিক প্লট পাবেন? তিনি কি তাঁর এলাকার সব ভোটারের আবাসিক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন? বিপুল বেতন-ভাতার পরে এখন শুনছি তাঁরা নাকি ছাপোষা কেরানিদের মতো পেনশনও চান। এ দেশে কিছু চাইলে তা পাওয়া যাবেই।
দীর্ঘদিনের লালিত হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে এমনভাবে বিভক্ত করেছে যে দেশ, জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি সম্পর্কে সুস্থ ও যুক্তিঋদ্ধ চিন্তার প্রকাশ কঠিন। অসুস্থ সামাজিক পরিবেশেও পঞ্চাশের দশক থেকে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মধ্যশ্রেণি গড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সাহস ও ত্যাগের মনোভাব নেই। অন্যদিকে, শাসকশ্রেণি নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতীয়তা সম্পর্কে সচেতন নয়। এর ফলে তাঁদের কেউ কেউ এমন সব কথাবার্তা বলেন এবং কাণ্ড করেন, যা গোটা জাতির বেইজ্জতির কারণ হয়। বহির্বিশ্বে দেশের মুখ ম্লান হয়। যে প্রসঙ্গে কথা বলার কথা থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা বা আইওর, সে প্রসঙ্গে বক্তব্য দেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা। জনগণের কালেক্টিভ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা হার্ভার্ডের ঝানু প্রফেসরের চেয়ে কম নয়। তা ছাড়া ব্যক্তি-মানুষের চোখে ধুলা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিশ্ববিধাতার চক্ষে ধুলা দিবার আয়োজন’ করা বোকামি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
মায়ের মুখ মলিন কখন হয়? যখন সে তার সন্তানের অমঙ্গল দ্যাখে। সন্তানের সুখ-সমৃদ্ধিতে মায়ের মুখে হাসি ফোটে, অমঙ্গলে জননীর মুখখানি শুকিয়ে মলিন হয়ে যায়। টেলিভিশন সেটের ভেতরে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে যাঁরা যে কথাই বলুন, আজ বাংলা মায়ের মুখখানি যে বিষণ্নতায় মলিন, তা তার সন্তানদের চোখ এড়ানোর কথা নয়। রঙিন বিলবোর্ড দিয়ে রাস্তাঘাট, অলিগলি, গ্রামগঞ্জ ভরে ফেললেও বাংলা মায়ের মলিন মুখ আড়াল করা সম্ভব নয়।
কী কী কারণে মায়ের মুখ ম্লান হতে পারে, তা অনুসন্ধানের চেষ্টা এখন আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে লক্ষ করা যায় না।
স্বাধীনতা একটি পরম মূল্যবান জিনিস। স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কঠিন কাজ। সেই রাষ্ট্রকে সুসংহত ও সমৃদ্ধ করার কাজটি আরও কঠিন। অনেক জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র থাকে না। যেমন কুর্দিরা। আবার জাতি গঠনের আগেই জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র গঠনের পরে বহু সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে সবার স্বার্থ রক্ষা করে জাতিরাষ্ট্র গঠন কঠিনতর কাজ। কাজটি কঠিন শুধু নয়, সাধনাসাপেক্ষ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসসাপেক্ষ। আধুনিক ইন্দোনেশীয় জাতি আগে ছিল না। বালি, সুমাত্রা, বোর্নিও, লোম্বোকসহ শত শত দ্বীপে বাস করত বহু ভাষাভাষী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বহু জাতিগোষ্ঠী। ডাচ সাম্রাজ্যবাদীরা সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে শোষণ-শাসন করেছে। বহু জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বহু দ্বীপ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইন্দোনেশিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় ইন্দোনেশীয় জাতি। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক চিহ্নগুলো মুছে ফেলেছে। আমরা ছোটবেলায় যাকে বলতাম বাটাভিয়া, এখন তার নাম জাকার্তা। একটি আধুনিক রাজধানী নগরী। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। মালয়, চৈনিক প্রভৃতি সম্প্রদায় ছিল মালয় দ্বীপপুঞ্জে। তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না। তারা বাঙালির মতোই ছিল পরাধীন। ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে এখন সমৃদ্ধ মালয়েশীয় জাতিতে পরিণত হয়েছে।
বাঙালিকে ইন্দোনেশীয় বা মালয়েশীয়দের মতো অত ঝামেলা পোহাতে হয়নি। হাজার হাজার বছরে বাংলাভাষী একটি জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। একটি অখণ্ড ভূমিতে তারা বসবাস করছে। একটি অভিন্ন সংস্কৃতি তারা নির্মাণ করেছে। আগেও অনেকবার তারা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক ছিল। তবে দীর্ঘদিন তারা স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারেনি। অষ্টম শতকে পাল রাজারা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখনই বাঙালির মধ্যে একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চল বা গৌড়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। তুর্কি শাসনামলে বঙ্গ বা বাংলা নামটি প্রতিষ্ঠা পায়। শক্তিশালী বাংলা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। আলীবর্দী খাঁ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীন শাসকই ছিলেন। ইংরেজের শাসনাধীন আমলে বাঙালির হাতে শাসনক্ষমতা না থাকলেও এ সময় বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে এশিয়ার অধিকাংশ জাতির থেকে এগিয়ে যায়। বিত্ত কম ছিল, কিন্তু বিদ্যায় কমতি ছিল না। ১৯৪৭-এর পরে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রদেশের নাগরিক হিসেবে পূর্ব বাংলার মানুষ জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে। তখন সক্ষমতা অর্জন না করলে একাত্তরে একটি বর্বর সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে পারত না। পাঞ্জাবিরা একেবারে পিষে মেরে ফেলত।
রাষ্ট্র যদি একটি নৌকা হয়ে থাকে, তাহলে জনগণ তার যাত্রী, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তার দাঁড়ি এবং কর্ণধার বা মাঝি হলো সরকার। মাঝি যদি দক্ষ না হন, তাহলে নৌকা ঘূর্ণাবর্তে গিয়ে পড়তে পারে অথবা কোনো চড়ায় গিয়ে ঠেকে যাত্রা বিঘ্নিত হতে পারে। বাঙালির যোগ্যতার অভাব নেই, কিন্তু স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা তার ১৯৭২-এর আগে ছিল না। স্বাধীনতার চেতনা বলতে বাঙালির একটি শ্রেণি বোঝে টাকা ও জমি, ঘন ঘন চাকরিতে প্রমোশন, অস্বাভাবিক উপায়ে রাতারাতি বিত্তবান হওয়া, যেকোনো পথে ব্যবসা-বাণিজ্যে ফুলে-ফেঁপে ওঠা এবং জিডিপি বাড়া। স্বাধীনতা এসবের চেয়ে আরও অনেক বড় বিষয়।
বাংলাদেশ হলো আন্দোলনের দেশ। আন্দোলন আগেও হতো, এখনো হচ্ছে। আগে হতো জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন; এখন বিভিন্ন গোত্র তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্দোলন করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছাড়া, দেশের কল্যাণের জন্য সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করা ছাড়া, মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করা ছাড়া আর সব ব্যাপারেই উত্তাল আন্দোলন হয়। সড়ক অবরোধ হয়, ভাঙচুর পর্যন্ত।
কোনো সরকারের সময় যদি দেশ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উন্নতি করে, তাহলে পুরো কৃতিত্ব সেই সরকারের। কিন্তু যদি দেশের মুখ কোনো কারণে মলিন হয় বা রাষ্ট্র সমস্যায় পড়ে, তার দায় শুধু সরকারের নয়, সব রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার নেতৃস্থানীয় মানুষের। আজ জাতির মর্যাদা রক্ষায় সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী, তা মানুষ জানে না। ইতিহাসের কাছে রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতা, পেশাজীবী নেতা ও শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতের নেতারা কী জবাব দেবেন? দুর্নীতি, অপচয়, মাদক ও নানা অনাচারে চিরকালের বাঙালি সমাজ আজ ধ্বংসের পথে, রাজনীতি শেষ হতে হতে বিরাজনীতির চূড়ান্ত পর্যায়ে, এর প্রতিবিধানে কেউ তো এগিয়ে আসছেন না। গোলটেবিল আর মানববন্ধনে দুই কথা বললে সমাজ তো এক ইঞ্চিও নড়বে না, রাষ্ট্র একচুলও সংশোধন হবে না।
আমাদের বয়সী যারা, রাজনীতির মধ্যে, রাজনীতি দেখতে দেখতে, কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণ করে বেড়ে উঠেছি, তাদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতি অস্বাভাবিক মনে হয়। খুবই বেদনাদায়ক। ষাটের দশক ছিল সামরিক একনায়কত্বের সময়। তখন ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষিত তরুণেরা রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। কৃষকেরা মাঠের কাজ ফেলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। শ্রমিক কিস্তি টুপি খুলে মাথায় দিয়েছেন লাল টুপি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররা জানতেন আন্দোলনে যোগ দিলে সরকারি চাকরি পেতে অসুবিধা হবে। তবু দ্বিধা করেননি। তাঁদের অভিভাবকদেরও নীরব সমর্থন ছিল। তাঁরা সমাজেরও সহানুভূতি পেয়েছেন ত্যাগের জন্য। ত্যাগ ছাড়া শুধু বক্তৃতা দিয়ে বা গণমাধ্যমে প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে কিছু অর্জন সম্ভব নয়। স্বাধীনতার আগে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তা আমাদের নেতাদের ত্যাগ ও জনগণের অংশগ্রহণে হয়েছে। প্রেস রিলিজ দ্বারা হয়নি।
বিক্রি হওয়ার মতো মানুষ সব সমাজে সব কালেই থাকেন। স্বাধীনতার আগে বাঙালি সমাজেও ঢের ছিলেন। কথায় কথায় দৌড় দিতেন ইসলামাবাদ, করাচি ও লাহোরে। কিন্তু এমনও তো অনেকেই ছিলেন, যাঁদের মাথা কেনা যায়নি। তাঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন। নীতি বিসর্জন দেননি। ছাত্রসমাজে ছিলেন, শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন, শিল্পী-সাহিত্যিক ও আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন। শ্রমিক নেতারা শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় জেলে গেছেন। শ্রমিকদের মধ্যে দালাল ছিল না। সামরিক শাসনের মধ্যে নিম্ন ও উচ্চ আদালতের বিচারকেরা সাহস করে রায় দিয়েছেন। ষাটের দশকেও আদালতকে বলতে দেখা গেছে, নৌবাহিনীর লোক কামাল উদ্দিনকে কোর্টে হাজির করা হোক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সরকার সমর্থন পায়নি আইনজীবী ও বিচারকদের।
নানা প্রক্রিয়ায় সমাজের প্রগতিশীল শক্তিও আজ নির্জীব হয়ে গেছে। বড় মানুষই বিক্রি হন। কেউ অবৈধ টাকায় ব্যাংক খুলেছেন। কেউ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি পেয়েছেন। নিজের ও সন্তান–সন্ততির জন্য চাকরি বাগাচ্ছেন। আগে ছিল ১০ কাঠা ৭ কাঠা। এখন জায়গার অভাব, মানুষ বেশি। তাই ৪ কাঠা, ৩ কাঠা হলেও চলে। ভোটেই নির্বাচিত হোন বা বিনা ভোটেই নির্বাচিত হোন, সংসদের জনপ্রতিনিধিরা কোন সাংবিধানিক অধিকারে আবাসিক প্লট পাবেন? তিনি কি তাঁর এলাকার সব ভোটারের আবাসিক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন? বিপুল বেতন-ভাতার পরে এখন শুনছি তাঁরা নাকি ছাপোষা কেরানিদের মতো পেনশনও চান। এ দেশে কিছু চাইলে তা পাওয়া যাবেই।
দীর্ঘদিনের লালিত হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে এমনভাবে বিভক্ত করেছে যে দেশ, জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি সম্পর্কে সুস্থ ও যুক্তিঋদ্ধ চিন্তার প্রকাশ কঠিন। অসুস্থ সামাজিক পরিবেশেও পঞ্চাশের দশক থেকে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মধ্যশ্রেণি গড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সাহস ও ত্যাগের মনোভাব নেই। অন্যদিকে, শাসকশ্রেণি নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতীয়তা সম্পর্কে সচেতন নয়। এর ফলে তাঁদের কেউ কেউ এমন সব কথাবার্তা বলেন এবং কাণ্ড করেন, যা গোটা জাতির বেইজ্জতির কারণ হয়। বহির্বিশ্বে দেশের মুখ ম্লান হয়। যে প্রসঙ্গে কথা বলার কথা থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা বা আইওর, সে প্রসঙ্গে বক্তব্য দেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা। জনগণের কালেক্টিভ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা হার্ভার্ডের ঝানু প্রফেসরের চেয়ে কম নয়। তা ছাড়া ব্যক্তি-মানুষের চোখে ধুলা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিশ্ববিধাতার চক্ষে ধুলা দিবার আয়োজন’ করা বোকামি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments