ক্ষমতার চুষনি মুখে রাগী যুবকেরা by ফারুক ওয়াসিফ
কী রাগী যুবকদের কাল এল রে বাবা। মানুষের ওপর কেউ খেলে গাড়ি নিয়ে, কেউ খেলে গুলিখেলা। কেউ লাঠি নিয়ে খেলতে খেলতে মেরে ফেলে খুঁটিতে বাঁধা শিশুকে। রাগী তরুণেরা কী দারুণ জোশে গাড়ি ছোটায় দুর্গতিময় ঢাকার রাস্তায়। ঠেকানোর নাইরে পুলিশ নাইরে রেড সিগন্যাল। মানুষ মরে বা আহত হয়। কত কত পারিবারিক অ্যালবামে দুঃসহ শোকের রং লাগে। কর্তারা পাষাণ, তাঁদের মন গলে না। দেশ তরতর করে তবু নাকি কোথায় এগিয়ে চলে।
গুলশানের রাস্তায় রেসিং কার ছোটাল যে ছেলে দুটি, তারা তো বেচারি, দুর্ভাগ্যের শিকার। তাদের গাড়ির ধাক্কায় যারা আহত হয়েছে, তারাও দুর্ভাগা। সবই দুর্ঘটনা, কপালের লিখন। ওই ছেলে দুটিরও দুর্ভাগ্য, কেন তাদের মতো মজারুদের আনন্দ-বিনোদনের অভয়ারণ্য করা হয়নি রাজধানীকে? ভিডিও গেমের মতো একটা বাস্তবতা পাওয়া গেলে কতই-না ভালো লাগত খেলতে?
সত্যিই তাদের দোষ দেওয়া চলে না। অপরাধ প্রমাণিত হলে বড়জোর তাদের বয়সোচিত অজুহাতে কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধনাগারে পাঠানো হবে। যদি বিচারই না হয়, তাহলে তো তাদের ‘সংশোধনের’ দরকারই থাকল না। যুব বয়সে অপরাধ করে ছাড় পেয়ে বড় ক্ষমতাধর হয়েছেন, এমন নজিরের অভাব নেই সোনার বাংলাদেশে।
সুন্দরগঞ্জের বীর সাংসদ লিটনের গাড়ির সামনে পড়ে গিয়েছিল এক শিশু। তাঁরও বিরক্তি হয়েছিল। তাই তিনি সঠিক নিশানায় তার দুই পায়ে গুলি করেন। ভাগ্যিস নিশানা সঠিক, নইলে ‘ভুল’ করে বুকে লাগলে শিশুটি নির্ঘাত মারা পড়ত! ক্ষমতার বরপুত্রদের চলার পথে কেন কালা-কুৎসিত হাভাতে গরিবেরা পড়ে? এত স্বাধীনতা তাদের কে দিল? এঁদের চলার পথে কেন এত মানুষ ও যানবাহন থাকবে?
অতএব হাওয়া গরম করার কিছু নেই। আবহমানকাল থেকে এ দেশে এ রকমই ঘটে আসছে। আগে তো জমিদারবাড়ির সামনে দিয়ে জুতা-জামা পরে ছাতা মাথায় হাঁটাই যেত না। এখন একই রাস্তায় আমির ও ফকির একসঙ্গে চলতে পারে, এটাই কি স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ নয়? সুতরাং যারা মরে, তাদেরই দোষ। কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায় বলা যায়, গরিবগুলো এত্ত খারাপ, একটুতেই মরে যায়!
হ্যাঁ, এসব রাগী তরুণ-যুবারা জানেন, দেশটাই তো টাকা ও ক্ষমতার লীলাখেলার ময়দান। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অক্ষয়-অটুট থাকলে তা ভাববেনই না কেন? রাগে-দুঃখে সাধারণ মানুষ কপাল চাপড়ায়, আর এঁরা মদ খেয়ে গাড়ি দৌড়ান বা গুলি ফোটান বা নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর মতো নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করেন। সবই তো ফান। আর হাউ ফানি এই আমজনতা! কদিন আগে প্রতাপশালী যে সাংসদের পুত্র রাজপথে এলোপাতাড়ি গুলি করে প্রাণ হরণ করেছিলেন দুজনের, তাঁরও নিশ্চয় সবকিছু ফানি লেগেছিল! ক্ষমতার সামনে সকল স্পেসে অপমান আর আঘাত সয়ে চুপ থাকাই কি বাঁচার তরিকা হলো বাংলাদেশ?
গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়লে মানুষ যেভাবে পালায়, রাস্তায় ছোট প্রাণী তথা রিকশা, সাইকেল কিংবা কেবল পদাতিক, তাদেরও উচিত বাঘের মতো গোঁ গোঁ করা গাড়ি দেখলে সভয়ে দূরে সরে যাওয়া। এ রকম ছুটন্ত বীরবাচক গাড়ির ভয়ে লাফ দিয়ে সরে যেতে যেতে ‘আরেকটু হলেই মরতাম’ ভেবে এত্তগুলা খুশি থাকা। অপমান, লাঞ্ছনার কথা নাহয় বাদ। এসব কি পথসন্ত্রাস নয়? মর্যাদাবোধের কথাও থাক, ছোট ও নির্ধন মানুষদের দেহে প্রাণ-মন থাকতে নেই? থাকতে নেই কানের পর্দা নামক নাজুক বস্তুটি। এই প্রাণ পিষ্ট হলে, গুলি খেলে মরে যায়; কানের পর্দা উৎকট আওয়াজে ফেটে যায় বা শোনার ক্ষমতা হারায়।
গতি নাকি নেশাময়, তার সঙ্গে মিশেছে তরল নেশার তাপ। আর এই উদগ্র আনন্দের সাক্ষী থাকে মোবাইলের সেলফি। গতির নেশা, তরলের নেশা, ফুর্তির নেশায় মত্তদের আসল নেশা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতা মস্তিষ্কের এমন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়, তখন আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ক্রিকেটার শাহাদাতও এমন এক রাগী তরুণ। রাগের বশে গৃহপরিচারিকা শিশুর পা ভেঙে দিয়েছেন। ব্যাধি শুধু রাজনীতিতে না, সবখানেই।
দিন আসলেই বদলেছে। এ ধরনের অন্যায় ক্ষমতার চুষনি মুখে বেড়ে উঠছে অনেক অনেক রাগী বাঘের বাচ্চা। এদের মুখ থেকে ক্ষমতার চুষনি না সরালে সাধারণ পদাতিকেরা বাঁচব কী করে এই বুধবারের প্রথম আলোর সংবাদ, ‘গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর এলাকার বিজয় সরণি উচ্চবিদ্যালয়ের ফটকে কবিতা রানী দাস (১৬) নামের এক স্কুলছাত্রীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বিক্রম চন্দ্র সরকার নামের এক যুবক এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। পুলিশ বিক্রমকে আটক করেছে।’ বিক্রম তাঁর নামের সার্থকতা প্রমাণ করলেও শেষ পর্যন্ত আটক হয়েছেন, কিন্তু গুলশানের ধনীর দুলালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনীতিতে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়াদের জীবন যায়, এদিকে বাঘের বাচ্চাদের আনন্দের খাতিরেও রক্ত ঝরে মানুষের বাচ্চার। এই রাগী তরুণেরা ছাত্র-যুব নেতা হয়ে খুনখারাবি নির্যাতন চালাতে কসুর করেন না। কী দেশ কী কালচার বানালাম আমরা?
দেশে এ রকম বীর সাংসদ, নেতা, ধনকুবের, খ্যাতিমান ব্যক্তি বিস্তর আছেন। আর এটা রাগী যুবকদেরও কাল। নো ভ্যাট আন্দোলনের এক সংগঠক আরিফ চৌধুরী আন্দোলনের অপরাধে দুই দফা পিটুনি খেয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর যা–তা রাগ ঝেড়েছেন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য। রাগীরাই এখন রাজনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার। এঁদের সবাই যে ধনী ও বড় ক্ষমতার মালিক, তাও না। ক্ষমতার হাই ভোল্টেজ লাইনের সঙ্গে সংযোগ থাকলেই হলো। যেকেউ পূর্ণমাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা দেখাবেন। তখন ১০০ হাত দূরে থাকাই নিয়ম।
গতিবেগ এঁদের আবেগ কেড়ে নিয়েছে, ক্ষমতার ছায়া এঁদের করেছে অমানুষ। গতিই নাকি সুখ, আরও সুখ অপরকে কষ্ট দিতে পারলে। বাংলাদেশের রাস্তাগুলো ক্ষমতা ও বৈষম্যের তুমুল প্রদর্শনী। কেউ সেখানে ছোটেন দ্রুতগতিতে; অন্যরা পিপীলিকা প্রায়। কেউ একাই বিরাট গাড়িতে ১০ জন বাসযাত্রীর জায়গা দখল করে থাকবেন, বাকিরা সরে তাঁকে জায়গা দেবেন। নো প্রবলেম।
একসময় ঢাকার সিনেমার নায়কেরা ছিলেন মৃদু ধরনের স্বপ্নবান যুবক। সাইকেল বা পায়ে হাঁটলেও তাঁদের নায়কই লাগত। নৌকার মাঝি হওয়া তো ছিল আরও রোমান্টিক। এরপর এল গোঁ গোঁ করে ছোটা মোটরসাইকেল। এখনকার নায়কদের বড় দামি গাড়ি থাকতে হয়। আর থাকতে হয় অনেক রাগ। তাঁরা হন অনেক পুরুষালি, অনেক রাগ-ক্ষোভ তাঁদের। এভাবে এখনকার বাণিজ্যিক অ্যাকশন ছবির নায়কদের রাগী ও দুর্ধর্ষ করে দেখিয়ে তরুণদের সামনে মডেল হিসেবে খাড়া করা হয়। এমনকি প্রেমের ছবির নায়কদেরও অনেক রাগ। কাহিনির প্রয়োজনে তাঁরাও নায়িকাদের দু-একটা চড়-থাপড় না মেরে পারেন না।
অথচ বিপ্লবের মহানায়ক ক্ষুদিরাম ও চে গুয়েভারা থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, নব্বইয়ের নূর হোসেনরাও কিন্তু রাগী ছিলেন। তাঁদের রাগ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আর আজকের ক্ষমতাবিত্তের জাতকদের রাগের প্রকাশটাই এক চূড়ান্ত অন্যায়। দিন আসলেই বদলেছে। এ ধরনের অন্যায় ক্ষমতার চুষনি মুখে বেড়ে উঠছে অনেক অনেক রাগী বাঘের বাচ্চা। এদের মুখ থেকে ক্ষমতার চুষনি না সরালে সাধারণ পদাতিকেরা বাঁচব কী করে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
গুলশানের রাস্তায় রেসিং কার ছোটাল যে ছেলে দুটি, তারা তো বেচারি, দুর্ভাগ্যের শিকার। তাদের গাড়ির ধাক্কায় যারা আহত হয়েছে, তারাও দুর্ভাগা। সবই দুর্ঘটনা, কপালের লিখন। ওই ছেলে দুটিরও দুর্ভাগ্য, কেন তাদের মতো মজারুদের আনন্দ-বিনোদনের অভয়ারণ্য করা হয়নি রাজধানীকে? ভিডিও গেমের মতো একটা বাস্তবতা পাওয়া গেলে কতই-না ভালো লাগত খেলতে?
সত্যিই তাদের দোষ দেওয়া চলে না। অপরাধ প্রমাণিত হলে বড়জোর তাদের বয়সোচিত অজুহাতে কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধনাগারে পাঠানো হবে। যদি বিচারই না হয়, তাহলে তো তাদের ‘সংশোধনের’ দরকারই থাকল না। যুব বয়সে অপরাধ করে ছাড় পেয়ে বড় ক্ষমতাধর হয়েছেন, এমন নজিরের অভাব নেই সোনার বাংলাদেশে।
সুন্দরগঞ্জের বীর সাংসদ লিটনের গাড়ির সামনে পড়ে গিয়েছিল এক শিশু। তাঁরও বিরক্তি হয়েছিল। তাই তিনি সঠিক নিশানায় তার দুই পায়ে গুলি করেন। ভাগ্যিস নিশানা সঠিক, নইলে ‘ভুল’ করে বুকে লাগলে শিশুটি নির্ঘাত মারা পড়ত! ক্ষমতার বরপুত্রদের চলার পথে কেন কালা-কুৎসিত হাভাতে গরিবেরা পড়ে? এত স্বাধীনতা তাদের কে দিল? এঁদের চলার পথে কেন এত মানুষ ও যানবাহন থাকবে?
অতএব হাওয়া গরম করার কিছু নেই। আবহমানকাল থেকে এ দেশে এ রকমই ঘটে আসছে। আগে তো জমিদারবাড়ির সামনে দিয়ে জুতা-জামা পরে ছাতা মাথায় হাঁটাই যেত না। এখন একই রাস্তায় আমির ও ফকির একসঙ্গে চলতে পারে, এটাই কি স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ নয়? সুতরাং যারা মরে, তাদেরই দোষ। কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায় বলা যায়, গরিবগুলো এত্ত খারাপ, একটুতেই মরে যায়!
হ্যাঁ, এসব রাগী তরুণ-যুবারা জানেন, দেশটাই তো টাকা ও ক্ষমতার লীলাখেলার ময়দান। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অক্ষয়-অটুট থাকলে তা ভাববেনই না কেন? রাগে-দুঃখে সাধারণ মানুষ কপাল চাপড়ায়, আর এঁরা মদ খেয়ে গাড়ি দৌড়ান বা গুলি ফোটান বা নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর মতো নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করেন। সবই তো ফান। আর হাউ ফানি এই আমজনতা! কদিন আগে প্রতাপশালী যে সাংসদের পুত্র রাজপথে এলোপাতাড়ি গুলি করে প্রাণ হরণ করেছিলেন দুজনের, তাঁরও নিশ্চয় সবকিছু ফানি লেগেছিল! ক্ষমতার সামনে সকল স্পেসে অপমান আর আঘাত সয়ে চুপ থাকাই কি বাঁচার তরিকা হলো বাংলাদেশ?
গ্রামে বাঘ ঢুকে পড়লে মানুষ যেভাবে পালায়, রাস্তায় ছোট প্রাণী তথা রিকশা, সাইকেল কিংবা কেবল পদাতিক, তাদেরও উচিত বাঘের মতো গোঁ গোঁ করা গাড়ি দেখলে সভয়ে দূরে সরে যাওয়া। এ রকম ছুটন্ত বীরবাচক গাড়ির ভয়ে লাফ দিয়ে সরে যেতে যেতে ‘আরেকটু হলেই মরতাম’ ভেবে এত্তগুলা খুশি থাকা। অপমান, লাঞ্ছনার কথা নাহয় বাদ। এসব কি পথসন্ত্রাস নয়? মর্যাদাবোধের কথাও থাক, ছোট ও নির্ধন মানুষদের দেহে প্রাণ-মন থাকতে নেই? থাকতে নেই কানের পর্দা নামক নাজুক বস্তুটি। এই প্রাণ পিষ্ট হলে, গুলি খেলে মরে যায়; কানের পর্দা উৎকট আওয়াজে ফেটে যায় বা শোনার ক্ষমতা হারায়।
গতি নাকি নেশাময়, তার সঙ্গে মিশেছে তরল নেশার তাপ। আর এই উদগ্র আনন্দের সাক্ষী থাকে মোবাইলের সেলফি। গতির নেশা, তরলের নেশা, ফুর্তির নেশায় মত্তদের আসল নেশা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতা মস্তিষ্কের এমন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়, তখন আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ক্রিকেটার শাহাদাতও এমন এক রাগী তরুণ। রাগের বশে গৃহপরিচারিকা শিশুর পা ভেঙে দিয়েছেন। ব্যাধি শুধু রাজনীতিতে না, সবখানেই।
দিন আসলেই বদলেছে। এ ধরনের অন্যায় ক্ষমতার চুষনি মুখে বেড়ে উঠছে অনেক অনেক রাগী বাঘের বাচ্চা। এদের মুখ থেকে ক্ষমতার চুষনি না সরালে সাধারণ পদাতিকেরা বাঁচব কী করে এই বুধবারের প্রথম আলোর সংবাদ, ‘গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর এলাকার বিজয় সরণি উচ্চবিদ্যালয়ের ফটকে কবিতা রানী দাস (১৬) নামের এক স্কুলছাত্রীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বিক্রম চন্দ্র সরকার নামের এক যুবক এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। পুলিশ বিক্রমকে আটক করেছে।’ বিক্রম তাঁর নামের সার্থকতা প্রমাণ করলেও শেষ পর্যন্ত আটক হয়েছেন, কিন্তু গুলশানের ধনীর দুলালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনীতিতে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়াদের জীবন যায়, এদিকে বাঘের বাচ্চাদের আনন্দের খাতিরেও রক্ত ঝরে মানুষের বাচ্চার। এই রাগী তরুণেরা ছাত্র-যুব নেতা হয়ে খুনখারাবি নির্যাতন চালাতে কসুর করেন না। কী দেশ কী কালচার বানালাম আমরা?
দেশে এ রকম বীর সাংসদ, নেতা, ধনকুবের, খ্যাতিমান ব্যক্তি বিস্তর আছেন। আর এটা রাগী যুবকদেরও কাল। নো ভ্যাট আন্দোলনের এক সংগঠক আরিফ চৌধুরী আন্দোলনের অপরাধে দুই দফা পিটুনি খেয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর যা–তা রাগ ঝেড়েছেন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য। রাগীরাই এখন রাজনৈতিক আধিপত্যের হাতিয়ার। এঁদের সবাই যে ধনী ও বড় ক্ষমতার মালিক, তাও না। ক্ষমতার হাই ভোল্টেজ লাইনের সঙ্গে সংযোগ থাকলেই হলো। যেকেউ পূর্ণমাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা দেখাবেন। তখন ১০০ হাত দূরে থাকাই নিয়ম।
গতিবেগ এঁদের আবেগ কেড়ে নিয়েছে, ক্ষমতার ছায়া এঁদের করেছে অমানুষ। গতিই নাকি সুখ, আরও সুখ অপরকে কষ্ট দিতে পারলে। বাংলাদেশের রাস্তাগুলো ক্ষমতা ও বৈষম্যের তুমুল প্রদর্শনী। কেউ সেখানে ছোটেন দ্রুতগতিতে; অন্যরা পিপীলিকা প্রায়। কেউ একাই বিরাট গাড়িতে ১০ জন বাসযাত্রীর জায়গা দখল করে থাকবেন, বাকিরা সরে তাঁকে জায়গা দেবেন। নো প্রবলেম।
একসময় ঢাকার সিনেমার নায়কেরা ছিলেন মৃদু ধরনের স্বপ্নবান যুবক। সাইকেল বা পায়ে হাঁটলেও তাঁদের নায়কই লাগত। নৌকার মাঝি হওয়া তো ছিল আরও রোমান্টিক। এরপর এল গোঁ গোঁ করে ছোটা মোটরসাইকেল। এখনকার নায়কদের বড় দামি গাড়ি থাকতে হয়। আর থাকতে হয় অনেক রাগ। তাঁরা হন অনেক পুরুষালি, অনেক রাগ-ক্ষোভ তাঁদের। এভাবে এখনকার বাণিজ্যিক অ্যাকশন ছবির নায়কদের রাগী ও দুর্ধর্ষ করে দেখিয়ে তরুণদের সামনে মডেল হিসেবে খাড়া করা হয়। এমনকি প্রেমের ছবির নায়কদেরও অনেক রাগ। কাহিনির প্রয়োজনে তাঁরাও নায়িকাদের দু-একটা চড়-থাপড় না মেরে পারেন না।
অথচ বিপ্লবের মহানায়ক ক্ষুদিরাম ও চে গুয়েভারা থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, নব্বইয়ের নূর হোসেনরাও কিন্তু রাগী ছিলেন। তাঁদের রাগ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আর আজকের ক্ষমতাবিত্তের জাতকদের রাগের প্রকাশটাই এক চূড়ান্ত অন্যায়। দিন আসলেই বদলেছে। এ ধরনের অন্যায় ক্ষমতার চুষনি মুখে বেড়ে উঠছে অনেক অনেক রাগী বাঘের বাচ্চা। এদের মুখ থেকে ক্ষমতার চুষনি না সরালে সাধারণ পদাতিকেরা বাঁচব কী করে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
No comments