স্থানীয় সরকার কাজ করেনি দলীয় লোক না থাকায়? by মিজানুর রহমান খান

রাজনীতির শাস্ত্রে ‘পার্টিয়ার্কি’ শব্দটির নতুন প্রচলন ঘটেছে। কারণ দলীয় ভিত্তিতে মনোনয়ন আর দূষিত দলীয় ভিত্তিতে (পার্টিয়ার্কি) মনোনয়ন এক কথা নয়। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদাসহ অনেকেই দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইনকে সমর্থন করছেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের ধারণা বিকশিত হওয়ার মূলমন্ত্র হওয়ার কথা ছিল বিকেন্দ্রীকরণ। তবে কখনো এ কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না যে আমাদের স্থানীয় শাসন কার্যকর হতে না পারার বড় কারণ হলো এর নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হতে না পারা। বরং এ কথাই সবার জানা, এই ব্যবস্থা কখনো গতিশীল হতে পারেনি। কারণ, তোপখানা থেকে ক্ষমতার তোপ দাগানোর অভ্যাস কেউ ত্যাগ করতে রাজি হননি।
প্রথম কথাটা শুনেছি ২০০৮ সালে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ মত দেন যে ‘রাজনৈতিক দল’ যেহেতু সংবিধানে আছে, তাই তাকে স্থানীয় নির্বাচনে বারিত করা সাংবিধানিক নয়। তাই ওই বিধিনিষেধ বাতিল করা হলো। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত ‘রাজনৈতিক দল’ হিসেবে গড়ে উঠল কি না, সেটা তো আমরা ভুলে থাকতে পারব না। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, এগুলো এখনো দল নয়, সমাগম বা সম্মেলন।
১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট অনধিক ছয় মাসের মধ্যে সব স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আসীনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। এরপর সম্প্রতি আমরা জেলায় জেলায় দলীয় প্রশাসক পেলাম। কেন সুপ্রিম কোর্টের রায় তাঁরা মানতে পারেননি, তার কারণ হিসেবে কখনো শোনা যায়নি যে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন না থাকার কারণে সরকার এটা করতে পারছে না। বিএনপি কান্নাকাটি শুরু করেছে। কিন্তু তারা কেন রায় অগ্রাহ্য করেছিল, সে জন্য তওবা করতে নারাজ। উপজেলায় ইউএনওকে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা করে রাখাই তো গতির প্রতীক। সেই যে উপজেলা চেয়ারম্যানরা সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে গিয়েও পারলেন না। স্থানীয় সাংসদেরা সরকারের খাস পলিটিক্যাল এজেন্ট হিসেবে উল্লেখযোগ্য জেলা ও বড় শহরগুলো ছলেবলে কবজায় রাখছেন।
কী বা কোন পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় শাসনের ভোটে দলীয় প্রতীক জাতির কাঁধে চাপছে, সেটা আমরা সতর্কতার সঙ্গে মনে রাখব। আইয়ুবের মৌিলক গণতন্ত্র থেকে কি আমরা সত্যি নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছি? আজ দুই প্রধান দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এতটাই নাজুক যে তারা গোপন ব্যালটে কমিটি করতে পারে না। এমনকি বহু জায়গায় পকেট কমিটিও করতে পারছে না। সে কারণে সমাজের যে দু-চারজন ভালো লোক, যাঁরা এখনো পল্লির নিভৃতে দলনিরপেক্ষ থেকে তা বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, তাঁরা হারিয়ে যেতে পারেন। এই আইন তাই সামাজিক নেতৃত্ব গঠনে একটি রূপান্তর ঘটাতে পারে। অবশ্য যাঁরা দলীয় রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলেন, তাঁরা ঠেকায় পড়ে দলমুখীও হতে পারেন। আবার মোসাহেবি ও পেশিশক্তির প্রতিযোগিতায় অনেকে শামিল হতে চাইবেন না।
শান্তিপ্রিয় লোকজনের অনেকে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। নির্দলীয় হিসেবে তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন স্থানীয় সরকারে টিকে থাকার। এখন তাঁদের সেই ভরসায় আরও চিড় ধরতে পারে। তবে দলকে এমনভাবে পরিচালনা করা সম্ভব, যাতে ষাটের দশকের সেই দিনগুলো ফিরে আসে, যখন বিবাদে জড়িয়ে পড়া লোকজন থানা বা কোর্টকাছারিতে না ছুটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে আগে ছুটতেন। এ ধরনের রাজনৈতিক নেতারা এখন স্বীকৃত সংখ্যালঘুদের চেয়েও ভীষণ সংখ্যালঘু হয়ে গেছেন।
দলীয় কর্মী ও নেতা মানেই অধিকতর সম্মানিত, দায়িত্বশীল, বিবেচক ও ন্যায়বিচারক। এই দিকে আমাদের গন্তব্য স্থির করতে পারলে সমস্যা নেই। নিরপেক্ষ ÿথাকার নামে বড় দল মানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে যোগ্যতমদের দূরে থাকাটাকে আত্মঘাতী বলেই মনে হচ্ছে। ভালোমন্দ যা-ই থাক, মানুষকে দলমুখী হতে হবে। দল বাঁচলে রাজনীতি, সরকার—সবই বাঁচবে। কিন্তু সে জন্য সরকারি দল যাতে ‘প্লুরালিজম’ বা বহুদলীয় মতে বিশ্বাস করে, সেই আস্থা তৈরি করতে হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কতটুকু সম্ভব বা বাস্তবসম্মত?
গ্রাম আদালত ব্যবস্থা যেখানে ভালো কাজ দিচ্ছে, সেখানে চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের মধ্যে যাঁরা দলনিরপেক্ষ ÿবা দলে থেকেও নিষ্ঠাবান, তাঁদের প্রতিই কিন্তু জনগণের আস্থা বেশি। এখন খুব বেশি খারাপ লোকের দলীয় টিকিটের জোরে নির্বাচিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। এতে গ্রাম আদালত আরও নির্জীব হবে। তাই ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোট চালু করতে হবে। কারণ, ভোট না পচানোর যে জনপ্রিয় মনোভাবের কারণে সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থী কম জেতেন, সেটা এবার বড় আকারে স্থানীয় সরকারে ফিরে আসতে পারে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আরও কম জিতবেন। ভালো মানুষের কণ্ঠ আরও ক্ষীণতর হবে। আসলে ক্ষমতাসীন দলের জন্য তথাকথিত বিদ্রোহী প্রার্থীদের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং তাদের মনোনীত প্রার্থীদের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জিতে আসা হজম করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সুতরাং ক্ষমতাসীন দল দৃশ্যত এক ঢিলে অনেক পাখি শিকার করল।
এ টি এম শামসুল হুদা ও কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ উভয়ের কমিশনের অধীনেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বিরোধী দল–সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, ক্ষমতাসীনেরা অস্বস্তি চেপে সেটা প্রচারও করেছে। কিন্তু তারা সম্ভবত এই দৃশ্যপট পাল্টাতে চাইছে। দলে গণতন্ত্র না থাকলে ‘বিদ্রোহ’ বাড়ে, তারা এর রাশ টানতে চাইছে। তারা ভাবছে, মনোনয়নে আনুষ্ঠানিকতা থাকলে বিদ্রোহীর সংখ্যা কমবে।
এখন দলগুলো যদি তাদের প্রতিটি স্থানীয় স্তরে গোপন ব্যালটে বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো উপায়ে কমিটি-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়, তাহলে সেটা একটা বড় সান্ত্বনা। অনেকে বলছেন, দলীয় লোক হয়ে দলীয় মুখোশটা আড়াল করার কী যুক্তি থাকতে পারে? হতে পারে এটাই হয়তো আমাদের স্বাস্থ্যসম্মত রাজনীতি এনে দেবে। তবে আমরা জাতীয় পর্যায়ে এবং রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হতে দেখছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই উদ্যোগ কী ফল দেয়, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
সাবেক সিইসি শামসুল হুদা আনন্দিত। কারণ এটা তাঁর ভাষায় ‘দ্বৈতনীতি’ ঘোচাবে। কিন্তু এ কথা মানতে হবে যে যখন আইন ছিল নির্দলীয়ভাবে করার, তখন তাঁরা তা মানাতে পারেননি। এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, দলীয় ভিত্তিতে হলেই বা কী করে নির্বাচিত ব্যক্তিরা শক্তিশালী হবেন? এ বিষয়টি পরিষ্কার নয়। তবে আওয়ামী লীগের মাহবুব উল আলম হানিফ পরিষ্কার করেছেন। বার্তাটা পরিষ্কার: দলীয় ব্যক্তি নির্বাচনে জয়ী হলে, সেখানে বড় অঙ্কের বরাদ্দ মিলবে! এই বরাদ্দের রাজনীতি তো বিএনপির গন্ধ লেগে থাকা চট্টগ্রামের বিদায়ী মেয়র দেখিয়ে গেছেন।
দলের টিকিটে ভারত ও ব্রিটেনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়। আরও বহু উন্নত গণতন্ত্রে হয়। আসুন আমরা এই কীর্তির সপক্ষেÿ যুক্তি দিতে তাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করার আগে আরও কতগুলো, অন্তত ওই সব দেশের দল কীভাবে চলে, সেটাও রপ্ত করতে আরম্ভ করি। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তাঁর এক রায়ে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আজও যে দুর্বলতম রয়েছে, তার জন্য আর যা-ই হোক, দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন না করাকে দায়ী করা চলে না। আর দলের ভিত্তি হলো সেই ভিত্তি, যেখানে কার্যত দলীয় সংখ্যালঘু ব্যক্তিরা দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠকে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন। একদলীয় চীনও স্থানীয় সরকারে দলের প্রার্থী মনোনয়নে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তাদের ‘ইউপি চেয়ারম্যান’, অর্থাৎ ভিলেজ কমিটি ইলেকশন পদের জন্য মনোনয়নে দল সফল হলো কি না, তা বিচারের একটি অন্যতম মৌলিক মানদণ্ড হলো, সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যক্তিটিকে তারা বেছে নিতে পারল কি না। দীর্ঘ প্রচারণা চলে না। পোস্টার, চিকা আর মাইকেরও ব্যবহার নেই। ভোটের ঠিক কয়েক দিন আগে প্রার্থীরা গ্রামের একটি উন্মুক্ত স্থানে বক্তব্য দেন, যদিও নীরবে বাড়িতে বাড়িতে প্রচারণার কাজ চলে।
এখন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড পুনর্গঠন ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সংসদ সদস্যরা যেভাবে মনোনয়ন পাচ্ছেন, গণতন্ত্রবিমুখ থেকে দল চালালে সেই ধারা তো বদলাবে না। এটা তাই অনেক ক্ষেত্রে দলের জনপ্রিয় বা বিদ্রোহীদের স্তব্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হবে।
আর কেন জানি না, মুখে যতই জনপ্রতিনিধির কথা বলুক, শাসকের পছন্দ প্রশাসক। মেয়াদ উত্তীর্ণ জনপ্রতিনিধি সহ্য হয় না, প্রশাসক সহ্য হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সালের মে মাস পর্যন্ত আমাদের থানাগুলো প্রশাসকেরাই চালিয়েছিলেন, তখন না হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত ছিলাম। এখন?
প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯২ সালে ওই উপজেলা মামলায় যা লিখেছিলেন, তার একটি অংশ প্রণিধানযোগ্য: ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা দলীয় (পার্টিয়ার্কি অর্থে) রাজনীতি বা স্বৈরশাসকদের অশুভ রূপকল্পের (ইভিল ডিজাইন) শিকার হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ÿক্ষমতাসীন দলের মনোনীত চাকরবাকর (হেনশম্যান) দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এটাই যদি করা হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান থাকা বা না থাকার কোনো মানে হয় না। এতে তারা যে সময়ে সময়ে পরিবর্তন আনে, তা জনগণ ও আন্তর্জাতিক নেতাদের ধাপ্পা দেওয়ার জন্য।...সভ্যতার এই পর্যায়ে স্বৈরশাসক তা তিনি হোন রাজনৈতিক নেতা বা সামরিক ব্যক্তি, তাঁরা বিশ্বময় নিন্দা ও হাসিঠাট্টার পাত্র। একটি স্বৈরশাসন তা দেখতে যতই শক্তিশালী মনে হোক, তারা চেতনাগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল এবং জনবিচ্ছিন্ন থাকে। এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তাদেরও ভয়ংকর বিপদে পড়ার ঝুঁকি থাকে। সুতরাং স্বৈরশাসকেরা একধরনের রাজনৈতিক ভিত প্রত্যাশী হয়, আর সেই উদ্দেশ্যে প্রকৃত গণতন্ত্র (!) প্রতিষ্ঠার জন্য তারা গ্রাম, ইউনিয়ন ও থানায় ছুটে যায়।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.