নিখোঁজ সাংসদ, এলোপাতাড়ি মন্ত্রিকুল by শাহদীন মালিক
প্রায়ই
মাননীয় মন্ত্রিকুলের বক্তব্যে আমরা যেকোনো ইস্যুর ভিন্ন ভিন্ন দিকের
ব্যাপারে আলোকিত হয়ে হরহামেশা পুলকিত হই। নিকট অতীেত বিভিন্ন টেলিভিশন
চ্যানেল টক শোগুলোতে কোনো একটা বিষয়ে বা ইস্যুতে আলোচনা করার জন্য টক
শো ভেদে দু-তিন-চারজনকে ডাকত। অংশগ্রহণকারীরা কেউ সাংবাদিক, কেউ বিশেষজ্ঞ,
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এনজিও কর্মকর্তা ইত্যাদি। এই হরেক গোছের
অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন মত তুলে ধরতেন। আইনজীবীরাও সুযোগ
পেতেন, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও মাঝেমধ্যে সামরিক কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ,
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী—সবাই থাকতেন ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলের বিভিন্ন টক শোতে।
মতবিরোধ হতো, বাহাস হতো, দু-চারবার গালমন্দও যে হয়নি তা-ও নয়। সব হয়েছে।
ধারণা হয়, টক শোগুলো বেশ ‘পপুলার’ হয়ে উঠেছিল।
টক শোতে অংশগ্রহণকারীর ভিন্ন ভিন্ন মতামতের প্রভাব—ধারণা হয়—মন্ত্রিকুলের ওপর আছর করেছে। টক শোর অংশগ্রহণকারীরা যেহেতু একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিতেন, তর্ক-বিতর্ক-বাহাস করতেন এবং মতানৈক্যের কারণেই তাঁদের পপুলারিটি—এই চিন্তা থেকেই পপুলার হওয়ার জন্যই বোধ হয় মন্ত্রিকুল একই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত বিশ্লেষণ জাতিকে উপহার দিচ্ছেন।
অধমের এই মূল্যায়নের ভিত্তি হলো ইদানীং দুই বিদেশি হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত, সে ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রিকুলের মতামত ও বিশ্লেষণ। টক শোগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা কস্মিনকালেও যেমন একে অপরের সঙ্গে একমত হতে চাইতেন না, তেমনি আজকাল মন্ত্রিকুলও বোধ হয় পণ করেছেন ভিন্নমত পোষণ করবেনই। একজন যদি বলেন যে আইএস আছে, তো অন্যজন বলেন নেই। কেউ বলেন বিদেশি জঙ্গি, আর কেউ বলেন দেশি। কারও মতে গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, কারও মতে দেশীয় চক্রান্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, সাবেক এক প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে দেশকে অস্থিতিশীল ইত্যাদি করার জন্য—ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, আগের টক শো আর নেই। মন্ত্রীরাই তো তার্কিকের জায়গা নিয়ে নিয়েছেন। যেহেতু মন্ত্রীদের বক্তব্য শুনলেই আপনি যেকোনো ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ পাবেন, তাই আজকাল টক শো দেখা কমে গেছে। চ্যানেলওয়ালারাও সেটা টের পেয়েছে। তাই টক শোগুলোতে আজকাল মতৈক্যই বেশি। কেউ হয়তো সরকারি দলের কট্টর সমর্থক, কারও সমর্থন কিছুটা প্রচ্ছন্ন। অতটা প্রকট না। এই সুযোগে মাননীয় মন্ত্রিকুলকে গায়ে পড়ে একটু সাবধান করে দিই। টক শোগুলোতে আজকাল যে নির্জলা-নির্ভেজাল তোষামোদি হয়, তাতে একটু খেয়াল রাখবেন ওই টক শোওয়ালারা আপনাদের না আবার গদিশূন্য করতে লেগে পড়ে।
প্রশ্ন জাগে, আপনারা কেমনে জানলেন, কারা এই দুই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখে রা নেই। ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে কুল্লে চার দিন পরেই নিস্তার। ১০ দিন রিমান্ড শেষে আরও রিমান্ড চাওয়াই যেখানে রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বিদেশি হত্যায় চার দিনেই রিমান্ড শেষ।
সচরাচরের মতো এবং অন্য সরকারগুলোর সময়ের মতো যেসব মন্ত্রী বেশি সবজান্তা, তদন্তের ভার তাঁদেরই নেওয়া উচিত। বিদেশিরা নিঃসন্দেহে শঙ্কিত। বিভিন্ন রঙের অ্যালার্ট তাঁরা জারি করে বসে আছেন। বায়াররা বিদেশে মিটিং ডাকছে। অধম ধানমন্ডিতে মিটিং ডাকলাম, গুলশান থেকেই আসতে চায় না। বলে, এখন বারণ আছে। সেটা ছিল বিজিবি নামার আগে। ধারণা করছি, জানালার পর্দা সরিয়ে টহল যান একেবারে তাঁদের গুলশান-বারিধারার অ্যাপার্টমেন্টের জানালার নিচে দেখে তারা ধানমন্ডি তো নয়ই, হয়তো হজরত শাহজালালমুখী হবেন। খোদ রাজধানীতে দিনদুপুরে সান্ত্রিবাহী বিরাট বিরাট গাড়ি দেখে তাঁরা যদি ভাবেন যে এই যুদ্ধ-যুদ্ধ দেশে থাকা নিরাপদ নয়, তাহলে অন্তত অধম তাঁদের দোষারোপ করব না। আর বিদেশি গণমাধ্যমে রাজধানীর গুলশান-বারিধারায় যদি সামরিক পোশাকে বিজিবির টহল দেওয়ার ‘ফুটেজ’ প্রচারিত হয়? পরিণতি পাঠকেরাই সহজে অনুমান করতে পারবেন।
২.
টক শোগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা কস্মিনকালেও যেমন একে অপরের সঙ্গে একমত হতে চাইতেন না, তেমনি আজকাল মন্ত্রিকুলও বোধ হয় পণ করেছেন ভিন্নমত পোষণ করবেনই। একজন যদি বলেন যে আইএস আছে, তো অন্যজন বলেন নেই। কেউ বলেন বিদেশি জঙ্গি, আর কেউ বলেন দেশি সরকারদলীয় সাংসদ, স্পষ্টতই অপরাধে অভিযুক্ত—তাঁকেই পুলিশ খুঁজে পায় না বেশ কিছুদিন ধরে। গোলাগুলি করা তাঁর নাকি বেশ কিছুকালের অভ্যাস (‘সামান্য ঘটনায় গুলি করা তাঁর স্বভাব’ শিরোনামে ১১ অক্টোবর, ২০১৫-এর প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠার খবর দ্রষ্টব্য)। যেহেতু মাননীয় সাংসদ, সেহেতু পুলিশের কাছে তাঁর নাম-ঠিকানা, ছবি, ফোন নম্বর—সবই থাকার কথা। তা-ও তারা পাচ্ছে না। অবশ্য ইতিমধ্যে অনেক সংবাদকর্মীই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেকেই জানেন। জানে পুলিশ।
গ্রেপ্তার না করার সম্ভাব্য কারণ তিনটি। প্রথমত, অদক্ষতা। খুঁজেই পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, পেয়েও গ্রেপ্তার করছে না—আর্থিক বা অন্য কোনো তদ্রূপ কারণে। তৃতীয়ত, ‘রাজনৈতিক নির্দেশ’ নেই। কারণ, এক বা একাধিক যেটাই হোক, জনমনের নিরাপত্তার জন্য কোনো কারণই আস্থার সৃষ্টি করে না। অদক্ষ পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারে না। অথবা দক্ষতা থাকলেও তারা যদি আর্থিক অথবা রাজনৈতিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাহলে অর্থ বা রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে থাকা জনগণের জন্য পুলিশ সহায়ক নয়।
আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতন তো আছেই। বিদেশি হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা হবে বলে অধম আশাবাদী নয়। বলা বাহুল্য, এ হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা আমরা সবাই চাই। বিদেশিরাও আশ্বস্ত হবে, ভরসা পাবে, বিদেশিদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বহাল থাকবে। কিন্তু এত কিছু পাব কি এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে? তবে আশায় থাকতে দোষ কী।
৩.
বিভিন্ন জাতির হরেক গোছের আর্কাইভ থাকে। বর্তমানকাল ভিডিওর যুগ। সবার মুঠোফোনে আজকাল ভিডিওর সুব্যবস্থা আছে। তাই অধমের প্রস্তাব—আমরা একটি ঘুষের ভিডিও আর্কাইভ চালু করি। প্রথম আলো (৯ অক্টোবর, প্রথম পাতার খবর) বলছে, ‘গুনে গুনে ঘুষ খান তিনি’-এর ছয় মিনিটের ভিডিওটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে, বিশেষত যাঁরা ঘুষ দেবেন, তাঁরা যদি তাঁদের ঘুষ প্রদানের ভিডিও চিত্র গ্রহণ করেন এবং আপাতত সেটা কখন কীভাবে দেখা যাবে, সে খবর প্রচার করেন, তাহলে ‘বক্স অফিস হিট’ না হলেও উৎসাহী দর্শকের কমতি হওয়ার কথা নয়।
বলা বাহুল্য, এরূপ ভিডিও সাক্ষ্য বা প্রমাণ হিসেবে আদালতে পাত্তা পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যল্প। মাঝপথে আছে দুদক নামক প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। অর্থাৎ ঘুষ নেওয়া-দেওয়ার ভিডিওটা নেহাত আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য।
তবে হ্যাঁ, যদি এ দেশে কখনো আইন, বিচার ইত্যাদি ফেরত আসে, ঘুষ-দুর্নীতি আবার খারাপ বলে বিবেচিত হয়; দুদক সাফাই সার্টিফিকেট দেওয়ার পরিবর্তে ঘুষখোরদের সন্ধান করে, নির্বাচন কমিশন আসলেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১৫-১৬ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্কদের পরিবর্তে ভোটার তালাশ করে, ইত্যাদি ইত্যাদি যদি হয়, তখন নাহয় ভিডিও দেখে ঘুষখোর খোঁজা হবে।
আইনের শাসন আর গণতন্ত্র ছাড়া পৃথিবীর দু-তিনটি দেশে উন্নতি হয়েছে। আর তাই দেখে গত ৫০ বছরে শ খানেক দেশ আইন আর গণতন্ত্র ছাড়াই উন্নতি করার পথ ধরেছিল। হয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, লিবিয়া, কঙ্গো, রুয়ান্ডা, নাইজেরিয়া, সুদান—অগায়রা, অগায়রা। প্রায় কেউই পারেনি। আমরা কি পারব উন্নতি করতে? আইন অমান্যকারী সাংসদেরা কি ধরা পড়বেন?
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।
টক শোতে অংশগ্রহণকারীর ভিন্ন ভিন্ন মতামতের প্রভাব—ধারণা হয়—মন্ত্রিকুলের ওপর আছর করেছে। টক শোর অংশগ্রহণকারীরা যেহেতু একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিতেন, তর্ক-বিতর্ক-বাহাস করতেন এবং মতানৈক্যের কারণেই তাঁদের পপুলারিটি—এই চিন্তা থেকেই পপুলার হওয়ার জন্যই বোধ হয় মন্ত্রিকুল একই বিষয়ে বিভিন্ন মতামত বিশ্লেষণ জাতিকে উপহার দিচ্ছেন।
অধমের এই মূল্যায়নের ভিত্তি হলো ইদানীং দুই বিদেশি হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত, সে ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রিকুলের মতামত ও বিশ্লেষণ। টক শোগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা কস্মিনকালেও যেমন একে অপরের সঙ্গে একমত হতে চাইতেন না, তেমনি আজকাল মন্ত্রিকুলও বোধ হয় পণ করেছেন ভিন্নমত পোষণ করবেনই। একজন যদি বলেন যে আইএস আছে, তো অন্যজন বলেন নেই। কেউ বলেন বিদেশি জঙ্গি, আর কেউ বলেন দেশি। কারও মতে গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, কারও মতে দেশীয় চক্রান্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, সাবেক এক প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে দেশকে অস্থিতিশীল ইত্যাদি করার জন্য—ইত্যাদি।
বলা বাহুল্য, আগের টক শো আর নেই। মন্ত্রীরাই তো তার্কিকের জায়গা নিয়ে নিয়েছেন। যেহেতু মন্ত্রীদের বক্তব্য শুনলেই আপনি যেকোনো ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ পাবেন, তাই আজকাল টক শো দেখা কমে গেছে। চ্যানেলওয়ালারাও সেটা টের পেয়েছে। তাই টক শোগুলোতে আজকাল মতৈক্যই বেশি। কেউ হয়তো সরকারি দলের কট্টর সমর্থক, কারও সমর্থন কিছুটা প্রচ্ছন্ন। অতটা প্রকট না। এই সুযোগে মাননীয় মন্ত্রিকুলকে গায়ে পড়ে একটু সাবধান করে দিই। টক শোগুলোতে আজকাল যে নির্জলা-নির্ভেজাল তোষামোদি হয়, তাতে একটু খেয়াল রাখবেন ওই টক শোওয়ালারা আপনাদের না আবার গদিশূন্য করতে লেগে পড়ে।
প্রশ্ন জাগে, আপনারা কেমনে জানলেন, কারা এই দুই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখে রা নেই। ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে কুল্লে চার দিন পরেই নিস্তার। ১০ দিন রিমান্ড শেষে আরও রিমান্ড চাওয়াই যেখানে রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বিদেশি হত্যায় চার দিনেই রিমান্ড শেষ।
সচরাচরের মতো এবং অন্য সরকারগুলোর সময়ের মতো যেসব মন্ত্রী বেশি সবজান্তা, তদন্তের ভার তাঁদেরই নেওয়া উচিত। বিদেশিরা নিঃসন্দেহে শঙ্কিত। বিভিন্ন রঙের অ্যালার্ট তাঁরা জারি করে বসে আছেন। বায়াররা বিদেশে মিটিং ডাকছে। অধম ধানমন্ডিতে মিটিং ডাকলাম, গুলশান থেকেই আসতে চায় না। বলে, এখন বারণ আছে। সেটা ছিল বিজিবি নামার আগে। ধারণা করছি, জানালার পর্দা সরিয়ে টহল যান একেবারে তাঁদের গুলশান-বারিধারার অ্যাপার্টমেন্টের জানালার নিচে দেখে তারা ধানমন্ডি তো নয়ই, হয়তো হজরত শাহজালালমুখী হবেন। খোদ রাজধানীতে দিনদুপুরে সান্ত্রিবাহী বিরাট বিরাট গাড়ি দেখে তাঁরা যদি ভাবেন যে এই যুদ্ধ-যুদ্ধ দেশে থাকা নিরাপদ নয়, তাহলে অন্তত অধম তাঁদের দোষারোপ করব না। আর বিদেশি গণমাধ্যমে রাজধানীর গুলশান-বারিধারায় যদি সামরিক পোশাকে বিজিবির টহল দেওয়ার ‘ফুটেজ’ প্রচারিত হয়? পরিণতি পাঠকেরাই সহজে অনুমান করতে পারবেন।
২.
টক শোগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা কস্মিনকালেও যেমন একে অপরের সঙ্গে একমত হতে চাইতেন না, তেমনি আজকাল মন্ত্রিকুলও বোধ হয় পণ করেছেন ভিন্নমত পোষণ করবেনই। একজন যদি বলেন যে আইএস আছে, তো অন্যজন বলেন নেই। কেউ বলেন বিদেশি জঙ্গি, আর কেউ বলেন দেশি সরকারদলীয় সাংসদ, স্পষ্টতই অপরাধে অভিযুক্ত—তাঁকেই পুলিশ খুঁজে পায় না বেশ কিছুদিন ধরে। গোলাগুলি করা তাঁর নাকি বেশ কিছুকালের অভ্যাস (‘সামান্য ঘটনায় গুলি করা তাঁর স্বভাব’ শিরোনামে ১১ অক্টোবর, ২০১৫-এর প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠার খবর দ্রষ্টব্য)। যেহেতু মাননীয় সাংসদ, সেহেতু পুলিশের কাছে তাঁর নাম-ঠিকানা, ছবি, ফোন নম্বর—সবই থাকার কথা। তা-ও তারা পাচ্ছে না। অবশ্য ইতিমধ্যে অনেক সংবাদকর্মীই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেকেই জানেন। জানে পুলিশ।
গ্রেপ্তার না করার সম্ভাব্য কারণ তিনটি। প্রথমত, অদক্ষতা। খুঁজেই পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, পেয়েও গ্রেপ্তার করছে না—আর্থিক বা অন্য কোনো তদ্রূপ কারণে। তৃতীয়ত, ‘রাজনৈতিক নির্দেশ’ নেই। কারণ, এক বা একাধিক যেটাই হোক, জনমনের নিরাপত্তার জন্য কোনো কারণই আস্থার সৃষ্টি করে না। অদক্ষ পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারে না। অথবা দক্ষতা থাকলেও তারা যদি আর্থিক অথবা রাজনৈতিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাহলে অর্থ বা রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে থাকা জনগণের জন্য পুলিশ সহায়ক নয়।
আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতন তো আছেই। বিদেশি হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা হবে বলে অধম আশাবাদী নয়। বলা বাহুল্য, এ হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা আমরা সবাই চাই। বিদেশিরাও আশ্বস্ত হবে, ভরসা পাবে, বিদেশিদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বহাল থাকবে। কিন্তু এত কিছু পাব কি এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে? তবে আশায় থাকতে দোষ কী।
৩.
বিভিন্ন জাতির হরেক গোছের আর্কাইভ থাকে। বর্তমানকাল ভিডিওর যুগ। সবার মুঠোফোনে আজকাল ভিডিওর সুব্যবস্থা আছে। তাই অধমের প্রস্তাব—আমরা একটি ঘুষের ভিডিও আর্কাইভ চালু করি। প্রথম আলো (৯ অক্টোবর, প্রথম পাতার খবর) বলছে, ‘গুনে গুনে ঘুষ খান তিনি’-এর ছয় মিনিটের ভিডিওটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে, বিশেষত যাঁরা ঘুষ দেবেন, তাঁরা যদি তাঁদের ঘুষ প্রদানের ভিডিও চিত্র গ্রহণ করেন এবং আপাতত সেটা কখন কীভাবে দেখা যাবে, সে খবর প্রচার করেন, তাহলে ‘বক্স অফিস হিট’ না হলেও উৎসাহী দর্শকের কমতি হওয়ার কথা নয়।
বলা বাহুল্য, এরূপ ভিডিও সাক্ষ্য বা প্রমাণ হিসেবে আদালতে পাত্তা পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যল্প। মাঝপথে আছে দুদক নামক প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। অর্থাৎ ঘুষ নেওয়া-দেওয়ার ভিডিওটা নেহাত আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য।
তবে হ্যাঁ, যদি এ দেশে কখনো আইন, বিচার ইত্যাদি ফেরত আসে, ঘুষ-দুর্নীতি আবার খারাপ বলে বিবেচিত হয়; দুদক সাফাই সার্টিফিকেট দেওয়ার পরিবর্তে ঘুষখোরদের সন্ধান করে, নির্বাচন কমিশন আসলেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১৫-১৬ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্কদের পরিবর্তে ভোটার তালাশ করে, ইত্যাদি ইত্যাদি যদি হয়, তখন নাহয় ভিডিও দেখে ঘুষখোর খোঁজা হবে।
আইনের শাসন আর গণতন্ত্র ছাড়া পৃথিবীর দু-তিনটি দেশে উন্নতি হয়েছে। আর তাই দেখে গত ৫০ বছরে শ খানেক দেশ আইন আর গণতন্ত্র ছাড়াই উন্নতি করার পথ ধরেছিল। হয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, লিবিয়া, কঙ্গো, রুয়ান্ডা, নাইজেরিয়া, সুদান—অগায়রা, অগায়রা। প্রায় কেউই পারেনি। আমরা কি পারব উন্নতি করতে? আইন অমান্যকারী সাংসদেরা কি ধরা পড়বেন?
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।
No comments