৫৪ ধারায় আটকের পর কারাগারে ২২ বছর by মনির হোসেন

পাগল সন্দেহে ৫৪ ধারায় আটক হওয়ার পর ফজলু মিয়ার একে একে ২২ বছর কেটে গেল কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে। কবে মুক্তি পাবেন তা-ও তিনি জানেন না। অবশ্য ২০০২ সালে আদালতের বিচারক তাকে সুস্থ উল্লেখ করে জামিন দেন এবং বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও জেল সুপারকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরপরও আইনি মারপ্যাঁচে আটকে রয়েছে তার মুক্তির প্রক্রিয়া।
কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তার মুক্তি পেতে আইনগত কোনো বাধা নেই। স্ত্রী, নিকটাত্মীয় কেউ এলেই তার জিম্মায় তাকে মুক্তি দেয়া সম্ভব। কিন্তু ফজলুর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সাথে নানাভাবে যোগাযোগের পরও কেউ তাকে নিতে আসছে না। যার কারণে সবকিছু ঠিক থাকার পরও তাকে মুক্তি দেয়া যাচ্ছে না। কারাগারে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত ফজলুকে ১৯৫ বার আদালতে তোলা হয়।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ফজলু মিয়ার সাথে সাক্ষাৎ ও এ মামলা-সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
অভিযোগ রয়েছে, ফজলু মিয়ার পালিত বাবা গোলাম মওলার কোনো সন্তান নেই। গোলাম মওলা ও তার স্ত্রী মারা গেছেন। এখন তার এক ভাগিনা রয়েছেন। তিনি বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (ওএসডি) । রহস্যজনক কারণে তিনি ফজলুকে চেনেন না বলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন। যার কারণে বছরের পর বছর ফজলু মিয়াকে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। এতে এক দিকে যেমন তার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, অন্য দিকে আইনের শাসনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
এ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করা হয় ২০০৫ সালে। পরে আদালতের নির্দেশের পর ফজলু মিয়ার মুক্তির প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। সিলেট কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জন তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা জেলা কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরে সেখান থেকে আবার তাকে ফিরিয়ে আনা হয়।
সহকারী সার্জন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বন্দী ফজলু মিয়া সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছেন। তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের পরামর্শ মতে ওই কারাগারে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এবং ফলোআপ করানো হচ্ছে। ইতঃপূর্বে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আদালতের নির্দেশে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। বর্তমানে তার অবস্থা ভালো। প্রতিবেদন দেয়ার পরও কেটে গেছে আরো ১০ বছর; ফজলু মিয়ার মুক্তির ব্যাপারে কোনো সমাধানে আসতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ গত ৮ সেপ্টেম্বর সিলেটে জেলা ও দায়রা জজের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও পরিকল্পনা)। সেখানে ফজলু মিয়ার বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেলখাটার বিষয় উত্থাপন করে সিলেট কারা কর্তৃপক্ষ। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ ফজলুর পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে তার এলাকাবাসী, আত্মীয়স্বজন, সমাজসেবা অধিদফতর, পাবনা মানসিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিøষ্টদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে খোঁজ নিতে গেলে এ প্রতিবেদকের সাক্ষাৎ হয় ফজলু মিয়ার। একসময়ের টগবগে যুবক ফজলু মিয়া এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। কথা বললে মুখ দিয়ে বের হয় লালা। মাথায় টুপি। কাউকে দেখলেই ফজলু হাত তুলে আগে সালাম দেন। ফজলুর কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিল আপনি কি পাগল? জবাবে ফজলুর সোজা উত্তরÑ না আমি পাগল না। যারা আমাকে পাগল বলে তারা মিছা কথা বলে। পিতার নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৈয়দ গোলাম মওলা (পালক)। মাতার নাম নয়ন মনি। স্ত্রী, সন্তান আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সন্তান নেই। দুই স্ত্রী ছিল। একজনের নাম লাইলী বেগম, আরেকজন হোসনে আরা। আমার সাথে তারা বেঈমানি করায় দুইজনকে ছেড়ে দিয়েছি। কত দিন ধরে কারাগারে আছেন জানতে চাইলে তিনি গুনে গুনে বলেন ২২ বছর। কবে যাবেন বাড়িতে এমন কথার উত্তরে ফজলুর সোজা কথা ওরা এলেই আমি বাড়ি যাবো। এক ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি বড় বলে জানান।
এ ব্যাপারে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো: ছগীর মিয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি এ কারাগারে আসার পর কয়েকজন পুরনো বন্দী পেয়েছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন ধরে কারাগারে আছেন ফজলু মিয়া। তার নথিপত্র ঘেঁটে জানতে পারি গোলাম মওলা ফজলু মিয়ার আসল বাবা নন। পালক বাবা। তাকে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে গোলাম মওলা এনে বড় করেছেন। গোলাম মওলা ও তার স্ত্রী দুইজনেই মারা গেছেন। তিনি বলেন, গোলাম মওলার কোনো সন্তান নেই। তবে তার এক ভাগিনা বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি (ওএসডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমি তার সাথে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তিনি তাকে চেনেন না বলে জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ফজলুকে যখন কোতোয়ালি থানা পুলিশ আটক করেছিল তখন তাকে পাগল আইনে আটক করেছিল। তিনি জানতে চান যদি ফজলু মিয়া পাগল হয়ে থাকেন, তাহলে তার ঠিকানা হবে সমাজসেবা অধিদফতরের কোনো পুনর্বাসন কেন্দ্রে, কারাগারে নয়। তারপরও তাকে বছরের পর বছর কারাগারেই কাটাতে হচ্ছে। সর্বশেষ ফজলুর মুক্তির বিষয়টি নিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ আব্দুল আহাদ উপস্থিত ছিলেন। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ফজলুকে ২০০২ সালেই আদালত জামিন দিয়েছিলেন। আদালতের নির্দেশনা ছিল তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। কিন্তু ওই সময়ে দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি আদালতে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ফজলু মিয়ার কোনো আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আমরা তার আত্মীয়স্বজন খুঁজতে শুরু করি। কিন্তু অদ্যাবধি তাকে কেউ নিতে না আসায় আমরা ফজলু মিয়াকে মুক্তি দিতে পারিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৩ সালে পাগল আইনের ১৩ ধারায় ফজলুর বিরুদ্ধে সিলেটের কোতোয়ালি থানার ডায়েরি নং-৬৯২, ধারা কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সিলেট সদর থানার ট্রাফিক সার্জেন্ট মো: জাকির হোসেন বাদি হয়ে মামলা করেন।
মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ‘১৯৯৩ সালের ৭ নভেম্বর বেলা ১২টা ৪৫ মিনিটের সময় সাক্ষীদের মাধ্যমে বর্ণিত পাগলকে প্রেরণ করিয়া জানাই যে, উল্লেখিত পাগল বেশ কিছু দিন যাবৎ বন্দর পয়েন্ট সুরমা পয়েন্ট এবং কোর্টের আশপাশে পাগলামি করিয়া নিরীহ মানুষকে হয়রানি করিতেছে। এমনকি যানবাহন চলাচলের সময় রাস্তার মাঝে বসিয়া থাকে এবং মাঝে মধ্যে গাড়ির নিচে লাফ দিয়া পড়ার চেষ্টা করে। আবার মাঝে মধ্যে কুদরতউল্লাহ মসজিদে প্রবেশ করিয়া নামাজের সময় মুসল্লিদের কাপড় ধরিয়া টানাটানি করে ও মুসল্লিদের মাথার টুপি কাড়িয়া নিয়ে আসে। ফলে উল্লেখিত এলাকাকে অতিষ্ঠ করিয়া ফেলিয়াছে। তাহাকে থানায় নিয়ে আমি পাগল আইনে প্রসিকিউশন দেয়ার নিমিত্তে আদালতের কার্যবিধি আইনের ৫৪ ধারায় পুনরায় গ্রেফতার করি। উল্লিখিত পাগলকে জিজ্ঞাসাবাদে সে কোনো প্রকার নাম ঠিকানা বলে না। নাম ঠিকানা জানার জন্য অনেক চেষ্টা করা হইয়াছে। তবে বিভিন্ন লোকজনকে জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার নাম ফজলু মিয়া বলিয়া জানা যায়। কিন্তু কেহ তাহার নাম ঠিকানা বলিতে পারে না। কেউ কেউ বলে তার বাড়ি ময়মনসিংহে। মামলার অভিযোগে ফজলু মিয়ার পিতার নাম মৃত সৈয়দ গোলাম মওলা, ঠিকানা ধরাদরপুর, থানা কোতোয়ালি, জেলা সিলেট (বর্তমানে দক্ষিণ সুরমা) উল্লেখ করা হয়।’
এরপর থেকে ফজলু মিয়াকে কারাগার থেকে আদালতে আনানেয়া হতে থাকে। ১০ বছর পর ফজলু মিয়াকে ২০০২ সালের ২৮ জানুয়ারি সিলেটের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কে এম তারিকুল ইসলাম জামিন প্রদান করেন। বিচারক তার আদেশের অনুলিপিতে উল্লেখ করেন, কথিত পাগল মো: ফজলু মিয়াকে জেল থেকে কোর্টে আনা হয়। নোটিশ জারি ছাড়া ফেরত পাওয়া যায়। দেখা গেল আসামির পালক বাবা মৃত। প্রতিবেদন মতে আসামিকে সুস্থ বলে প্রতীয়মান হয়। তাকে নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওসি (পিএস) দক্ষিণ সুরমাকে বলা হলো। আদেশের কপি ওসি সুরমা ও জেল সুপারকে দেয়া হোক।
গতকাল মঙ্গলবার সিলেটের সাবেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক, বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কে এম তারিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি ওই সময় ফজলু মিয়াকে সুস্থ দেখে জামিনের আদেশ দিয়েছিলাম। পেশকারও সেই আদেশ ওসি দক্ষিণ সুরমা ও জেল সুপারের কাছে পাঠিয়েছেন। আদালতের আদেশ তামিল করার দায়িত্ব ছিল তাদের। তা ছাড়া একজন বন্দীর কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দী থাকা খুবই দুর্ভাগ্যজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গতকাল সিলেটের একাধিক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা নয়া দিগন্তকে বলেন, মারা যাওয়া গোলাম মওলার সম্পত্তির দাবিদার হবেন ফজলু মিয়া। এমনও হতে পারে ওই জমিজমার ভাগ না দেয়ার জন্য পাগল সাজিয়ে কারাগারে বন্দী করে রেখেছে। সরকার এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়তে পারে। আর কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন ফজলু মিয়া। তবে সেই দিন ফজলু মিয়ার জীবনে কবে আসবে সেটিই এখন প্রশ্ন।

No comments

Powered by Blogger.