আওয়ামী লীগ কি ববীকাসিকে ছাড় দিতে যাচ্ছে? by বদিউর রহমান
রাজনীতি
পাটিগণিত কিংবা জ্যামিতির সূত্র দিয়ে চলে না। রাজনীতি সুযোগ বুঝে সাহিত্য
হয়ে পড়ে, তা কবিতাই হোক আর গল্পই হোক। রাজনীতিতে কে যে কখন কার দোস্ত বা
প্রেমিক হয়ে পড়বেন, তা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো আগেভাগে সর্বদা আঁচ করা
যায় না। তারপরও চলনে-বলনে কিংবা হাসিতে-কাশিতে মন যে কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে,
তা বোধহয় পাকা-ঘুঘুরা কিছুটা হলেও বুঝে নেয়। অমরা অধমরা রাজনীতি তেমন বুঝি
না, কিন্তু রাজনীতির হালহকিকতে আগ্রহী থাকি, কার হাঁড়ির ভাত কে কীভাবে
খাচ্ছে বা খেতে চাচ্ছে তা দেখতে পারি। ক্ষমতার জন্য যদি নীতি একটু
এদিক-সেদিক করতেও হয়, তা রাজনীতিতে বোধহয় অনৈতিক নয়। এ জন্যই তো বলা হয়ে
থাকে যে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আরও বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিতে কেউ
চিরশত্র“ নয়, আবার কেউ চিরমিত্রও নয়। দেশ সেবার জন্য যে যখন যে নীতি অনুসরণ
করে, যে দলে যায় তখন তার জন্য সে নীতি এবং সে দলই হবে উত্তম নীতি এবং
উত্তম দল। মরহুম কিংবা জীবিত- ক’জন রাজনীতিকের উদাহরণ দেব? আজ এ-দলে তো কাল
ও-দলে, পরশু না হয় নিজেরই একটা দল। বাংলাদেশে দলপতি বা দলবাজ হলে রাষ্ট্র
ক্ষমতায় যেতে না পারলেও ক্ষমতাসীন দল থেকে অন্তত কলাটা-মুলাটার সুযোগ নেয়া
যায়, নাকি?
তা না হলে নাম না-জানা, লোক-না-থাকা এত এত দল হল কীভাবে?ব্যক্তিভিত্তিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক একজন্যা বা দু’জন্যা দলগুলোর সভাপতি বা চেয়ারম্যানকে জনগণের অনেকে হয়তো চেনেন। কিন্তু তার বা তাদের দলকে মানুষ প্রায় চেনেই না। গ্রামগঞ্জে যখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনা করি, তখন অনেক হাসির খোরাক জোটে। দলের শেষে লীগ শুনলেই সাধারণ মানুষ ভাবে ওই দলটা আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গসংগঠন, আর দলের শেষে দল থাকলে ভাবে ওটা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কোনো অংশ। তার মানেটা কী? মানে হচ্ছে সারা দেশে আওয়ামী লীগ (আলী) আর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদ) ছাড়া অন্য দলকে মানুষ তেমন চেনেই না। এমন অচেনা-অজানা দলের কর্ণধারদের কিন্তু নামে চেনে অনেকে। এমন নামগুলোর মধ্যে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কর্নেল (অব.) অলি, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা (ব্যানাহুদা হিসেবে বেশি পরিচিত), ড. ফেরদৌস কোরেশী, ড. কামাল হোসেন, মেজর জেনারেল ইব্রাহীম, হাসানুল হক ইনু, আসম রব, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (ববীকাসি) বীর উত্তম অন্যতম। ব্যক্তি-খ্যাতিতে তারা স্বনামধন্য। অবশ্যই বলা চলে জনগণের কাছে কমবেশি পরিচিত এবং সম্মানীয় তো বটেই।
কিন্তু তাদের দলের নাম জিজ্ঞেস করলে সাধারণ মানুষ বোঝে না, চেনে না; হাসে। কেউ কেউ, ওই যে আগে বললাম, আলী কিংবা বাজাদের অঙ্গসংগঠন হিসেবেই মনে করে ফেলে। আমি একবার ববীকাসির দল সম্পর্কে একজনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ও, বাঘা সিদ্দিকীর দল তো আওয়ামী লীগেরই অংশ। শেখ হাসিনার সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা একটি নাম দিয়েছে আর কী! কী জঘন্য, জ্বলজ্যান্ত একটা আলাদা দল ববীকাসির কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, অথচ বলে কিনা আওয়ামী লীগের অংশ! আরেকজন রাজনীতি সম্পর্কে বেশ সচেতন মনে হল, বললেন, বাঘা সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত; তাই বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের নামানুসারে তার দলের নাম রেখেছে। আমরা বাঘা সিদ্দিকীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই নামে চিনি, তার সাহসে আমরা গর্বিত হই, শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার অকৃত্রিম প্রতিবাদ আমাদের অন্তরে তার জন্য আলাদা সম্মানের স্থান সৃষ্টি করে। কিন্তু বড় কষ্ট লাগে, তাকে আলাদা দল করার পর যখন গামছাওয়ালা বলেও কেউ কেউ ঠাট্টা-মশকরা করে। কিছুদিন আগে ফুটপাতে গামছা বিছিয়ে টাকা উঠানো নিয়ে তো হেসেছেই।
আমি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে তার বক্তৃতা শুনেছি। চমৎকার তার বাচনভঙ্গি, উন্নত তার শব্দশৈলী, সুনিপুণ তার বিষয়বস্তুর অবতারণা, সর্বোপরি সুবিন্যস্ত তার বিষয়ভিত্তিক কথামালা। আমার ভালো লেগেছে তার আলোচনার সময়ের মাত্রাজ্ঞানও। কিন্তু একজন বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা ও কিংবদন্তিতুল্য বীর উত্তম হয়েও তিনি স্বাধীনতার পর সোনার বাংলা প্রকৌশলী সংস্থা (প্রা.) লিমিটেড নামে যে নির্মাণ সংস্থা গঠন করেছিলেন তা তার নিজের জন্য কল্যাণই বরং বহন করে এনেছে বলা যেতে পারে। তার নেতৃত্বাধীন এ প্রতিষ্ঠানের ‘অপকর্ম’ নিয়ে, ব্যর্থতা নিয়ে সচিত্র খবর পত্রপত্রিকায় এসেছিল। এমনও শুনেছিলাম, তার এ সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্তও করা হয়েছিল। তার সংস্থা অনেক সেতু অসমাপ্ত রেখে বদনাম কুড়িয়েছিল। আমি আগে এক লেখায় তাকে বঙ্গবীরের সঙ্গে ‘অসমাপ্ত সেতু বীর’ খেতাবে ভূষিত করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেছিলাম। অতি সম্প্রতি তিনি ‘কেন এমন হলো!’ শিরোনামে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ সেপ্টেম্বর; ১৫) এ প্রতিষ্ঠান গঠনের এবং ঋণের সুদ মাফ সম্পর্কিত পূর্ব খবরের ব্যাপারে তার নিজস্ব কিছুটা ব্যাখ্যা তুলেও ধরেছেন। তিনি বলেন যেমন চমৎকার, তেমনি লিখেনও রসালোভাবে, যদিও তার অনেক লেখাকেই আমি ‘হাবির মা কিস্সা’ রূপেই গণ্য করি। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই ‘সময়ের প্রয়োজনে’ এ নির্মাণ সংস্থা গঠনের তার দাবি কি সর্বগ্রাহ্য বা সর্বজন-সমর্থিত হবে? কী এমন ‘সময়ের প্রয়োজন’ ছিল যে বাঘা সিদ্দিকীকে এমন একটা নির্মাণ সংস্থা গঠন করতে হবে? তার লেখার মধ্যে প্রায়ই তার কিছু না-পাওয়ার হতাশা উঠে আসে, যদিও তিনি প্রকাশ্যে ভাব দেখাতে চান যে তার কোনো ‘চাহিদা’ নেই। ‘৯ কোটি টাকা সুদ মাফ পেলেন কাদের সিদ্দিকী’- এর প্রতিবাদমূলক মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি কি প্রকারান্তরে তার না-পাওয়ার বেদনাকে আরও প্রকাশ্য করেননি? তা না হলে তার মতো স্বনামধন্য বীর উত্তম কীভাবে লেখেন ‘স্বাধীনতার পর আমি যদি মতিঝিলের কোথাও লক্ষণ রেখা টেনে দিতাম কার বাবার সাধ্য ছিল সে দাগ মুছে দেয়া? না, তেমন ক্ষমতা কারও ছিল না’? এত বড় স্পর্ধাপূর্ণ মন্তব্য ববীকাসিকে মানায় না। এমন মন্তব্য তাকে ‘ছোট’ করেছে, আমরা কষ্ট পেয়েছি। তার বড় করুণ মন্তব্য ‘এক সময় যারা আমার বোচকা টানতে স্বর্গসুখ অনুভব করত, এখন তাদের কত হাজার হাজার কোটি, ঢাকার এখানে ওখানে কত জায়গা-জমি। তারপরও তারা সৎ, আমরা অসৎ। তারা ভালো, আমরা খারাপ।’ আমাদের বড় ভাবায়, তার হতাশা যখন প্রকাশ্য হয়। আমরা যদি বলি, ববীকাসি, আপনিও তো নির্মাণ সংস্থাটা করেছিলেন হাজার কোটির মালিক হতেই, নয় কি? হয়তো আপনি সফল হতে পারেননি, অন্যরা পেরেছে। সময়ে বোচকা টানার লোকেরা মনিবও হয়, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। অয়োময় নাটকে জমিদার বাড়ি শেষতক কে কিনেছিল তা দেখেননি? আমরা বলব, স্বাধীনতার পর আপনারা দেশকে সঠিক পথে চালাতে চরম ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই এখন এত দুঃখ করতে পারছেন, নচেৎ এ সুযোগই বা কোথায় পেতেন?
এখন ববীকাসি একজন রাজনীতিক, একজন্যা দলের ‘পতি’ হলেও তিনি দলপতি। এবার তার সোনার বাংলার ৯ কোটি টাকা সুদ মাফে আমরা ঈর্ষান্বিত নই। হোক তার প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সুদ, তার ভাষায় তার ব্যক্তিগত নয়; কিন্তু সুদ তো মাফ হয়েছে, নাকি? অংকের হেরফেরের বিষয় হয়তো সমাধান হবে। সংশ্লিষ্ট ডিজিএম ‘অসত্য’ খবরের প্রতিবাদ না করলে ববীকাসি তার নামে মামলা করবেন মর্মে লিখেছেন। এগুলো তাদের বিষয়। কিন্তু আমরা ভাবছি, তাকে না হোক, তার সংস্থাকেই বা এ সুদ কেন মাফ করা হল? আচ্ছা, তাও হোক, কত হাজার হাজার কোটি টাকা কতভাবে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, সে তুলনায় একজন বীর উত্তমের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান বিবেচনায় ৯ কোটি টাকা সুদ মাফ ‘তুচ্ছই’ বলা চলে। বীর উত্তমের দাবি বিবেচনা আমাদের জন্য স্বস্তিদায়কও বটে। ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের সুরাহা তাদের হিসাবের এবং দাবির বিষয়। কিন্তু টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের আগে এ সুদ মাফ কি অন্য কোনো রাজনৈতিক ছাড়? আলী কি লতিফ সিদ্দিকীর আসনে ববীকাসিকে ছাড় দিতে যাচ্ছে? এ সুদ মাফ কি তাকে নির্বাচনের জন্য সাফ-সুরত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ? ববীকাসি গত বছর ধরে যেভাবে শেখ হাসিনার প্রশংসায় এবং তোষণে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, শেখ হাসিনার তাকে লেখা চিঠি ফুটপাতেও প্রদর্শন করেছেন, ‘আলোর দিশা পেতে’ শেখ হাসিনার কাছে প্রতিকার কামনা করেছেন, তাতে আমরা বোধহয় আঁচ করতে পারছি যে আলী বোধহয় টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে ববীকাসিকে ছাড় দিতেও পারে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরুক, আলাদা সংসার করে হলেও, তাও মন্দের ভালো। তাহলে অন্তত মতিয়া-ইনুদের প্রতি হয়তো তার ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমতে পারে। কিন্তু আমরা বলব, আলী যেন এতদ্বিষয়ে আবেগে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়। আলীকে ভাবতে হবে, ববীকাসিকে ছাড় দিলে আলীর আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা। ববীকাসির লাভের জন্য আলী যেন ‘খাদে’ না পড়ে-সেটাই আমাদের কাম্য।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
তা না হলে নাম না-জানা, লোক-না-থাকা এত এত দল হল কীভাবে?ব্যক্তিভিত্তিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক একজন্যা বা দু’জন্যা দলগুলোর সভাপতি বা চেয়ারম্যানকে জনগণের অনেকে হয়তো চেনেন। কিন্তু তার বা তাদের দলকে মানুষ প্রায় চেনেই না। গ্রামগঞ্জে যখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলোচনা করি, তখন অনেক হাসির খোরাক জোটে। দলের শেষে লীগ শুনলেই সাধারণ মানুষ ভাবে ওই দলটা আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গসংগঠন, আর দলের শেষে দল থাকলে ভাবে ওটা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কোনো অংশ। তার মানেটা কী? মানে হচ্ছে সারা দেশে আওয়ামী লীগ (আলী) আর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদ) ছাড়া অন্য দলকে মানুষ তেমন চেনেই না। এমন অচেনা-অজানা দলের কর্ণধারদের কিন্তু নামে চেনে অনেকে। এমন নামগুলোর মধ্যে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কর্নেল (অব.) অলি, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা (ব্যানাহুদা হিসেবে বেশি পরিচিত), ড. ফেরদৌস কোরেশী, ড. কামাল হোসেন, মেজর জেনারেল ইব্রাহীম, হাসানুল হক ইনু, আসম রব, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (ববীকাসি) বীর উত্তম অন্যতম। ব্যক্তি-খ্যাতিতে তারা স্বনামধন্য। অবশ্যই বলা চলে জনগণের কাছে কমবেশি পরিচিত এবং সম্মানীয় তো বটেই।
কিন্তু তাদের দলের নাম জিজ্ঞেস করলে সাধারণ মানুষ বোঝে না, চেনে না; হাসে। কেউ কেউ, ওই যে আগে বললাম, আলী কিংবা বাজাদের অঙ্গসংগঠন হিসেবেই মনে করে ফেলে। আমি একবার ববীকাসির দল সম্পর্কে একজনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ও, বাঘা সিদ্দিকীর দল তো আওয়ামী লীগেরই অংশ। শেখ হাসিনার সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা একটি নাম দিয়েছে আর কী! কী জঘন্য, জ্বলজ্যান্ত একটা আলাদা দল ববীকাসির কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, অথচ বলে কিনা আওয়ামী লীগের অংশ! আরেকজন রাজনীতি সম্পর্কে বেশ সচেতন মনে হল, বললেন, বাঘা সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত; তাই বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের নামানুসারে তার দলের নাম রেখেছে। আমরা বাঘা সিদ্দিকীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই নামে চিনি, তার সাহসে আমরা গর্বিত হই, শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার অকৃত্রিম প্রতিবাদ আমাদের অন্তরে তার জন্য আলাদা সম্মানের স্থান সৃষ্টি করে। কিন্তু বড় কষ্ট লাগে, তাকে আলাদা দল করার পর যখন গামছাওয়ালা বলেও কেউ কেউ ঠাট্টা-মশকরা করে। কিছুদিন আগে ফুটপাতে গামছা বিছিয়ে টাকা উঠানো নিয়ে তো হেসেছেই।
আমি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে তার বক্তৃতা শুনেছি। চমৎকার তার বাচনভঙ্গি, উন্নত তার শব্দশৈলী, সুনিপুণ তার বিষয়বস্তুর অবতারণা, সর্বোপরি সুবিন্যস্ত তার বিষয়ভিত্তিক কথামালা। আমার ভালো লেগেছে তার আলোচনার সময়ের মাত্রাজ্ঞানও। কিন্তু একজন বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা ও কিংবদন্তিতুল্য বীর উত্তম হয়েও তিনি স্বাধীনতার পর সোনার বাংলা প্রকৌশলী সংস্থা (প্রা.) লিমিটেড নামে যে নির্মাণ সংস্থা গঠন করেছিলেন তা তার নিজের জন্য কল্যাণই বরং বহন করে এনেছে বলা যেতে পারে। তার নেতৃত্বাধীন এ প্রতিষ্ঠানের ‘অপকর্ম’ নিয়ে, ব্যর্থতা নিয়ে সচিত্র খবর পত্রপত্রিকায় এসেছিল। এমনও শুনেছিলাম, তার এ সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্তও করা হয়েছিল। তার সংস্থা অনেক সেতু অসমাপ্ত রেখে বদনাম কুড়িয়েছিল। আমি আগে এক লেখায় তাকে বঙ্গবীরের সঙ্গে ‘অসমাপ্ত সেতু বীর’ খেতাবে ভূষিত করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেছিলাম। অতি সম্প্রতি তিনি ‘কেন এমন হলো!’ শিরোনামে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ সেপ্টেম্বর; ১৫) এ প্রতিষ্ঠান গঠনের এবং ঋণের সুদ মাফ সম্পর্কিত পূর্ব খবরের ব্যাপারে তার নিজস্ব কিছুটা ব্যাখ্যা তুলেও ধরেছেন। তিনি বলেন যেমন চমৎকার, তেমনি লিখেনও রসালোভাবে, যদিও তার অনেক লেখাকেই আমি ‘হাবির মা কিস্সা’ রূপেই গণ্য করি। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই ‘সময়ের প্রয়োজনে’ এ নির্মাণ সংস্থা গঠনের তার দাবি কি সর্বগ্রাহ্য বা সর্বজন-সমর্থিত হবে? কী এমন ‘সময়ের প্রয়োজন’ ছিল যে বাঘা সিদ্দিকীকে এমন একটা নির্মাণ সংস্থা গঠন করতে হবে? তার লেখার মধ্যে প্রায়ই তার কিছু না-পাওয়ার হতাশা উঠে আসে, যদিও তিনি প্রকাশ্যে ভাব দেখাতে চান যে তার কোনো ‘চাহিদা’ নেই। ‘৯ কোটি টাকা সুদ মাফ পেলেন কাদের সিদ্দিকী’- এর প্রতিবাদমূলক মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি কি প্রকারান্তরে তার না-পাওয়ার বেদনাকে আরও প্রকাশ্য করেননি? তা না হলে তার মতো স্বনামধন্য বীর উত্তম কীভাবে লেখেন ‘স্বাধীনতার পর আমি যদি মতিঝিলের কোথাও লক্ষণ রেখা টেনে দিতাম কার বাবার সাধ্য ছিল সে দাগ মুছে দেয়া? না, তেমন ক্ষমতা কারও ছিল না’? এত বড় স্পর্ধাপূর্ণ মন্তব্য ববীকাসিকে মানায় না। এমন মন্তব্য তাকে ‘ছোট’ করেছে, আমরা কষ্ট পেয়েছি। তার বড় করুণ মন্তব্য ‘এক সময় যারা আমার বোচকা টানতে স্বর্গসুখ অনুভব করত, এখন তাদের কত হাজার হাজার কোটি, ঢাকার এখানে ওখানে কত জায়গা-জমি। তারপরও তারা সৎ, আমরা অসৎ। তারা ভালো, আমরা খারাপ।’ আমাদের বড় ভাবায়, তার হতাশা যখন প্রকাশ্য হয়। আমরা যদি বলি, ববীকাসি, আপনিও তো নির্মাণ সংস্থাটা করেছিলেন হাজার কোটির মালিক হতেই, নয় কি? হয়তো আপনি সফল হতে পারেননি, অন্যরা পেরেছে। সময়ে বোচকা টানার লোকেরা মনিবও হয়, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। অয়োময় নাটকে জমিদার বাড়ি শেষতক কে কিনেছিল তা দেখেননি? আমরা বলব, স্বাধীনতার পর আপনারা দেশকে সঠিক পথে চালাতে চরম ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেই এখন এত দুঃখ করতে পারছেন, নচেৎ এ সুযোগই বা কোথায় পেতেন?
এখন ববীকাসি একজন রাজনীতিক, একজন্যা দলের ‘পতি’ হলেও তিনি দলপতি। এবার তার সোনার বাংলার ৯ কোটি টাকা সুদ মাফে আমরা ঈর্ষান্বিত নই। হোক তার প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সুদ, তার ভাষায় তার ব্যক্তিগত নয়; কিন্তু সুদ তো মাফ হয়েছে, নাকি? অংকের হেরফেরের বিষয় হয়তো সমাধান হবে। সংশ্লিষ্ট ডিজিএম ‘অসত্য’ খবরের প্রতিবাদ না করলে ববীকাসি তার নামে মামলা করবেন মর্মে লিখেছেন। এগুলো তাদের বিষয়। কিন্তু আমরা ভাবছি, তাকে না হোক, তার সংস্থাকেই বা এ সুদ কেন মাফ করা হল? আচ্ছা, তাও হোক, কত হাজার হাজার কোটি টাকা কতভাবে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, সে তুলনায় একজন বীর উত্তমের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান বিবেচনায় ৯ কোটি টাকা সুদ মাফ ‘তুচ্ছই’ বলা চলে। বীর উত্তমের দাবি বিবেচনা আমাদের জন্য স্বস্তিদায়কও বটে। ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের সুরাহা তাদের হিসাবের এবং দাবির বিষয়। কিন্তু টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের আগে এ সুদ মাফ কি অন্য কোনো রাজনৈতিক ছাড়? আলী কি লতিফ সিদ্দিকীর আসনে ববীকাসিকে ছাড় দিতে যাচ্ছে? এ সুদ মাফ কি তাকে নির্বাচনের জন্য সাফ-সুরত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ? ববীকাসি গত বছর ধরে যেভাবে শেখ হাসিনার প্রশংসায় এবং তোষণে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, শেখ হাসিনার তাকে লেখা চিঠি ফুটপাতেও প্রদর্শন করেছেন, ‘আলোর দিশা পেতে’ শেখ হাসিনার কাছে প্রতিকার কামনা করেছেন, তাতে আমরা বোধহয় আঁচ করতে পারছি যে আলী বোধহয় টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে ববীকাসিকে ছাড় দিতেও পারে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরুক, আলাদা সংসার করে হলেও, তাও মন্দের ভালো। তাহলে অন্তত মতিয়া-ইনুদের প্রতি হয়তো তার ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমতে পারে। কিন্তু আমরা বলব, আলী যেন এতদ্বিষয়ে আবেগে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়। আলীকে ভাবতে হবে, ববীকাসিকে ছাড় দিলে আলীর আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা। ববীকাসির লাভের জন্য আলী যেন ‘খাদে’ না পড়ে-সেটাই আমাদের কাম্য।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments