কী অপরূপ এই বাংলাদেশ by আনিসুল হক
কী
অপরূপ এই বাংলাদেশ! সুন্দরবনের হলুদ ডোরাকাটা বাঘ যেন গ্রীবা তুলে
দাঁড়িয়ে আছে শক্তি, সৌন্দর্য আর জিগীষার একটা মূর্ত প্রতীক হয়ে!
আপনারা কি ব্যাট হাতে সৌম্য কিংবা তামিমের দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা খেয়াল করেছেন? বল জিনিসটা পেটানোর জন্য, তা তোমরা যে দলই হও না কেন—পাকিস্তান, কিংবা ভারত, কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা—বলটা করো, তারপর দেখো, কোথায় যায়! একটু আগে দক্ষিণ আফ্রিকা যেখানে ব্যাট হাতে থরথর করে কাঁপছিল, সেখানে মারের পরে মার, অসহায় দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়েরা সীমানা থেকে বল কুড়িয়ে আনতে আনতে ধ্বস্ত! সেই উইকেটে খেলতে নেমে সৌম্য কিংবা তামিমের চোখেমুখে দেহভঙ্গিমায় কোনো ভয়ডর দেখেছেন? ভয়শূন্য ক্রিকেট বা ফিয়ারলেস ক্রিকেট—বাংলাদেশের খেলা সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে আজকাল। আর চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, সেখানে কী হয়, রবীন্দ্রনাথ বলেই রেখেছেন, উচ্চ সেথা শির।
কিন্তু এই ছেলেগুলো ‘উন্নত মম শির’ হয়ে উঠল কোত্থেকে? তা কি শুধুই ক্রিকেট! জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার খেয়ে ক্রিকেটে ভালো করা যায় না। তার মানেটা হলো, বাংলাদেশ ভালো করছে জাতীয় জীবনের আরও আরও ক্ষেত্রে। গতকাল আর পরশুর প্রথম আলোতেই আছে কতগুলো ইতিবাচক খবর। থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে রৌপ্যপদক পেয়েছে একটা, ব্রোঞ্জ পদক চারটা, বাংলাদেশ ভালো করেছে ভারতের চেয়েও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে হয়েছে প্রথম। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতকে মনে করা হয় প্রকৌশলী উৎপাদনকারী দেশ। তাদের চেয়ে গণিতে ভালো করা অনেক বড় অর্জন। এক দিন আগেই খবর বেরিয়েছে, বিবিএসের জরিপের সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। চার বছরে গড় আয়ু বেড়েছে তিন বছরের বেশি। আর এর পেছনে আছে সামাজিক ও মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের ভালো করা। শিশু ও মায়ের মৃত্যু কমেছে, বাল্যবিবাহ কমেছে, শিক্ষার হার বাড়ছে। প্রাণঘাতী রোগ এই দেশে বিস্তার লাভ করতে পারে না, মানুষ সচেতন এবং নতুন প্রযুক্তি কিংবা পদ্ধতি গ্রহণে তারা দ্বিধাহীন।
অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের এই উন্নতির কথা বারবার করে বলছেন। ভারতের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে ঢের বেশি, কিন্তু বাংলাদেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করে চলেছে নারী ও শিশুর উন্নয়নে, কি শিক্ষায়, কি স্বাস্থ্যে। ভারতের প্রতি দুজনের একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চলে যান উন্মুক্ত আকাশের নিচে, আর বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০১২ সালে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার না করা মানুষের সংখ্যা ১২ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ (http://blogs.wsj.com/indiarealtime/2014/10/08/why-many-indians-cant-stand-to-use-the-toilet/)|
এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি, বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে মধ্য আয়ের দেশে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আমরা এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশ। বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে। দেশে ১০ কোটিরও বেশি লোকের হাতে মোবাইল ফোন, এমন বাড়ি এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে মোবাইল ফোন নেই। ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত। কমছে কেরোসিনের বাতি ব্যবহারের হার, বাড়ছে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার।
ফলটা কী দাঁড়াচ্ছে?
আমাদের দুজন অফিস সহকারীর সঙ্গে কথা বলেছি। দুজনেরই মেয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। তারপর তারা ভর্তি হয়েছে ঢাকার দুটো ভালো স্কুলে। তাঁদের দুজনেরই আশা, মেয়ে দুটো বড় হলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। অর্থাৎ মানুষ সামনে আলো দেখছে। তারা আশা দেখছে।
সামনে আলো থাকলে কী হয়? আপনার ছায়া পড়ে আপনার পেছনে। আলেকজান্ডারের ঘোড়া বুসেফালাস একবার খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে কিছুতেই বাগ মানছিল না। কারণ, সূর্য ছিল তার পেছনে। তার ছায়া পড়েছিল তার সামনে। সেই ছায়া দেখে ঘোড়াটা ভীত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যখন ঘোড়াটিকে সূর্যের দিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করানো হলো, তার ছায়া পড়ল পেছনে, ঘোড়াটি শান্ত হয়ে গেল। আমাদের সামনে যদি আলো থাকে, আমরা নির্ভীক হয়ে উঠি। আমাদের ছায়া যদি আমাদের সামনে পড়ে, আমরা ভয় পাই।
বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ সামনে আলো দেখতে পাচ্ছেন। ছায়া পড়ছে আমাদের পেছনে। আমরা আর ভয় পাই না। অন্ধকারের দিকে নয়, আমরা আলোর দিকে যাচ্ছি। ভয় পান না সৌম্য কিংবা সাব্বির। ভয় পান না মুস্তাফিজ কিংবা রুবেল। লাখ লাখ মুস্তাফিজ, সাব্বির, মুমিনুল, জোবায়ের বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ থেকে উঠে আসছেন।
মুস্তাফিজুরের গল্পটাই তো রূপকথাকে হার মানাবে। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সাতক্ষীরা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে থাকেন। ছেলে ক্রিকেট খেলতে চায়। বাবা তাকে চারটা টিউটর দিয়েছিলেন ক্লাস সিক্সে, যেন সে পড়তে বসে, বারবার ছুটে মাঠে না যায়। সেই ছেলেকে তার সেজো ভাই মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যেতেন সাতক্ষীরা শহরে, সেখানেও গড়ে উঠেছে একটা ক্রিকেট একাডেমি। সেখানে গিয়ে ছেলে ক্রিকেট শেখে। চেহারায় শৈশবের লালিত্য এখনো রয়ে গেছে, পৃথিবীর সেরা ব্যাটসম্যানকে আউট করে সে শিশুর মতো হাততালি দেয়, যেন সে সাতক্ষীরায় তাদের টিনে ছাওয়া বাড়ির ছাদে এই মাত্র একটা পোষা পায়রাকে দেখল শূন্যে ডিগবাজি খেতে। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা, তারপর সরাসরি ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক রেকর্ড বইয়ে। প্রত্যেকেরই প্রায় একই গল্প, সাকিব আল হাসানের বাবা সাকিবের ছোটবেলায় মাগুরা শহরের বাড়িতে সাকিবের ক্রিকেট ব্যাট কেটে ফেলেছিলেন, তাঁর আশঙ্কা ছিল, ছেলে না আবার বড় হয়ে ক্রিকেটার হয়ে যায়। সেই ছেলে এল বিকেএসপিতে, আজ সাকিব পৃথিবীর এক নম্বর, আমি আবার বলছি, পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার, ক্রিকেটের তিনটা ফরমেই। কী যে মায়া লাগে এই ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বললে। আর কী যে সাহস! মাশরাফি বিন মুর্তজার হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে ছয়বার। বিশ্বকাপেও তাঁর ট্রাউজার ভেদ করে ফুলে ছিল হাঁটুতে বেঁধে রাখা কী এক ক্যাপ। ছেলেটা মাঠে নামার আগে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে ফুলে ওঠা হাঁটু থেকে পানি বের করে নিতেন। সেই ছেলের বুকে কত সাহস, কত স্নেহ, প্রেরণার কী অনিঃশেষ ফল্গুধারা। রিকশায় চড়ে অনুশীলনে যাচ্ছিলেন, বাসের ধাক্কায় ছিলে গেল হাতের কনুই। তিনি তাঁর সহখেলোয়াড়দের বলেছেন, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। কোহলি আর ধোনিরা বিস্মিত, ঘটনা কী, বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে পারলে ধন্য হয়ে যাবে, তা না উল্টো চোখে চোখ রেখে কথা বলছে! আর মাশরাফির রসবোধ দেখেছেন? রস+আলোয় গত সোমবার বেরোনো তাঁর সাক্ষাৎকারটি পড়ুন।
সাকিব যখন বলেছিলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ স্পষ্ট ফেবারিট, তা নিয়ে শোর উঠেছিল, ধবলধোলাই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রমাণ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে শেষ ওডিআইয়ের আগেও সাকিব জানালেন, সিরিজ জয় করে নেওয়ার এটা হলো সুবর্ণ সুযোগ।
দক্ষিণ আফ্রিকা আগে ব্যাট করে অতি অল্প রান করে আউট হয়েছে। দ্বিতীয় ওডিআইয়ের দিনের কথা। ব্যাট করতে নেমে তামিম আর লিটন দাস শুরুতেই আউট। কিন্তু বাংলাদেশ শিবিরে কোনো উদ্বেগ নেই, দুশ্চিন্তা নেই। সেদিন মাঠে গিয়েছিলাম, দেখি, নাসির আর সাব্বির নীল রঙের পোশাকটা পরে মাঠের ধারে বসে আছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে এই রকম একটা ম্যাচে প্যাড পরে বসে থেকে খেলা শেষে হেসে বললেন, ভাই, ব্যাটিং তো পাইলাম না। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে শেষ দুই ওডিআইতে তাঁর সেই আফসোসও নেই। কারণ, তাঁরা জানেন, ব্যাট করতে হবে না। মাঠে সৌম্য আছেন, তামিম বা রিয়াদ আছেন।
এই যে সাহস, এই যে মনোবল, এই যে ভয়হীন চিত্তের উচ্চ-শির পারফরম্যান্স, এটা এসেছে একটা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের সার্বিক আত্মবিশ্বাস থেকে। ওই যে কবি বলেছিলেন, শাবাশ বাংলাদেশ, এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। একাত্তরে যুদ্ধে জিতে দেশ পেয়েছি, বন্যা-খরা-জলোচ্ছ্বাসে মরিনি, তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে পরিণত হয়েছি বিশ্বের শস্যভান্ডারে, দক্ষিণ এশিয়ায় মানব উন্নয়ন সূচকে কি নারীর ক্ষমতায়নে ভালো করে চলেছি, বাংলাদেশ এখন কেবল এমার্জিং টাইগার নয়, রোরিং টাইগার।
তবে সবটাই যে সুসংবাদ, তা তো নয়। এক হাজারটা ক্ষেত্র আছে, যেখানে আমাদের ভালো করতে পারতে হবে। গতকালের পত্রিকাতেই খবর, আইনের শাসনে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১০২টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ৯৩তম। মানবাধিকার পরিস্থিতি এখানে ভালো নয়।
বাংলাদেশের মানুষ সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ভালো করছে, তারা ভালো করবেই। তার পেছনে নিশ্চয়ই সরকারগুলোর অনেক অবদান আছে। তবু, আরেকটু ভালো শাসন এই দেশের মানুষের প্রাপ্য। দুর্নীতি যদি কমে আসে, প্রকল্পগুলোর পেছনের উদ্দেশ্য যদি টেকসই উন্নয়ন হয়, লুটপাট না হয়, যদি পরিকল্পনা হয় সুদূরপ্রসারী, যদি থাকে জবাবদিহি, তাহলে এই দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবেই।
অভিনন্দন মাশরাফি বাহিনীকে, ঈদের আগে আমাদের এত সুন্দর একটা উপহার দেওয়ার জন্য। তবে আমাদের নিজেদেরই একটা কথা বলতে হবে, খেলা শেষ পর্যন্ত খেলাই। জয়-পরাজয় থাকবেই। জয়টাকে যেমন সুন্দরভাবে উদ্যাপন করতে পারতে হবে, পরাজয়টাও নিতে পারতে হবে খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়েই। মাশরাফি বলেছিলেন, জয় উদ্যাপন করা সহজ, হারার পরে কে কীভাবে সেটাকে নিচ্ছে, এটা আমি দেখতে চেয়েছিলাম। তিনি তাঁর সহখেলোয়াড়দের সম্পর্কে এটা বলেছিলেন। এটা কিন্তু আমরা আমাদের নিয়েও বলতে পারি, হারার পরে আমরা, দর্শকেরা, কে কী আচরণ করি, সেটাই পরীক্ষা।
এযাবৎকালের বাংলাদেশে দর্শকেরা সেই পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে এসেছে, হারি-জিতি আমরা বাংলাদেশ দলের সঙ্গেই ছিলাম, আছি, থাকব।
এগিয়ে যাও, বাংলাদেশ।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আপনারা কি ব্যাট হাতে সৌম্য কিংবা তামিমের দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা খেয়াল করেছেন? বল জিনিসটা পেটানোর জন্য, তা তোমরা যে দলই হও না কেন—পাকিস্তান, কিংবা ভারত, কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা—বলটা করো, তারপর দেখো, কোথায় যায়! একটু আগে দক্ষিণ আফ্রিকা যেখানে ব্যাট হাতে থরথর করে কাঁপছিল, সেখানে মারের পরে মার, অসহায় দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়েরা সীমানা থেকে বল কুড়িয়ে আনতে আনতে ধ্বস্ত! সেই উইকেটে খেলতে নেমে সৌম্য কিংবা তামিমের চোখেমুখে দেহভঙ্গিমায় কোনো ভয়ডর দেখেছেন? ভয়শূন্য ক্রিকেট বা ফিয়ারলেস ক্রিকেট—বাংলাদেশের খেলা সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে আজকাল। আর চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, সেখানে কী হয়, রবীন্দ্রনাথ বলেই রেখেছেন, উচ্চ সেথা শির।
কিন্তু এই ছেলেগুলো ‘উন্নত মম শির’ হয়ে উঠল কোত্থেকে? তা কি শুধুই ক্রিকেট! জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার খেয়ে ক্রিকেটে ভালো করা যায় না। তার মানেটা হলো, বাংলাদেশ ভালো করছে জাতীয় জীবনের আরও আরও ক্ষেত্রে। গতকাল আর পরশুর প্রথম আলোতেই আছে কতগুলো ইতিবাচক খবর। থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে রৌপ্যপদক পেয়েছে একটা, ব্রোঞ্জ পদক চারটা, বাংলাদেশ ভালো করেছে ভারতের চেয়েও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে হয়েছে প্রথম। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতকে মনে করা হয় প্রকৌশলী উৎপাদনকারী দেশ। তাদের চেয়ে গণিতে ভালো করা অনেক বড় অর্জন। এক দিন আগেই খবর বেরিয়েছে, বিবিএসের জরিপের সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। চার বছরে গড় আয়ু বেড়েছে তিন বছরের বেশি। আর এর পেছনে আছে সামাজিক ও মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের ভালো করা। শিশু ও মায়ের মৃত্যু কমেছে, বাল্যবিবাহ কমেছে, শিক্ষার হার বাড়ছে। প্রাণঘাতী রোগ এই দেশে বিস্তার লাভ করতে পারে না, মানুষ সচেতন এবং নতুন প্রযুক্তি কিংবা পদ্ধতি গ্রহণে তারা দ্বিধাহীন।
অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের এই উন্নতির কথা বারবার করে বলছেন। ভারতের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে ঢের বেশি, কিন্তু বাংলাদেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করে চলেছে নারী ও শিশুর উন্নয়নে, কি শিক্ষায়, কি স্বাস্থ্যে। ভারতের প্রতি দুজনের একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চলে যান উন্মুক্ত আকাশের নিচে, আর বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০১২ সালে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার না করা মানুষের সংখ্যা ১২ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ (http://blogs.wsj.com/indiarealtime/2014/10/08/why-many-indians-cant-stand-to-use-the-toilet/)|
এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি, বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে মধ্য আয়ের দেশে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আমরা এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশ। বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে। দেশে ১০ কোটিরও বেশি লোকের হাতে মোবাইল ফোন, এমন বাড়ি এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে মোবাইল ফোন নেই। ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত। কমছে কেরোসিনের বাতি ব্যবহারের হার, বাড়ছে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার।
ফলটা কী দাঁড়াচ্ছে?
আমাদের দুজন অফিস সহকারীর সঙ্গে কথা বলেছি। দুজনেরই মেয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। তারপর তারা ভর্তি হয়েছে ঢাকার দুটো ভালো স্কুলে। তাঁদের দুজনেরই আশা, মেয়ে দুটো বড় হলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। অর্থাৎ মানুষ সামনে আলো দেখছে। তারা আশা দেখছে।
সামনে আলো থাকলে কী হয়? আপনার ছায়া পড়ে আপনার পেছনে। আলেকজান্ডারের ঘোড়া বুসেফালাস একবার খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে কিছুতেই বাগ মানছিল না। কারণ, সূর্য ছিল তার পেছনে। তার ছায়া পড়েছিল তার সামনে। সেই ছায়া দেখে ঘোড়াটা ভীত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যখন ঘোড়াটিকে সূর্যের দিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করানো হলো, তার ছায়া পড়ল পেছনে, ঘোড়াটি শান্ত হয়ে গেল। আমাদের সামনে যদি আলো থাকে, আমরা নির্ভীক হয়ে উঠি। আমাদের ছায়া যদি আমাদের সামনে পড়ে, আমরা ভয় পাই।
বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ সামনে আলো দেখতে পাচ্ছেন। ছায়া পড়ছে আমাদের পেছনে। আমরা আর ভয় পাই না। অন্ধকারের দিকে নয়, আমরা আলোর দিকে যাচ্ছি। ভয় পান না সৌম্য কিংবা সাব্বির। ভয় পান না মুস্তাফিজ কিংবা রুবেল। লাখ লাখ মুস্তাফিজ, সাব্বির, মুমিনুল, জোবায়ের বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ থেকে উঠে আসছেন।
মুস্তাফিজুরের গল্পটাই তো রূপকথাকে হার মানাবে। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সাতক্ষীরা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে থাকেন। ছেলে ক্রিকেট খেলতে চায়। বাবা তাকে চারটা টিউটর দিয়েছিলেন ক্লাস সিক্সে, যেন সে পড়তে বসে, বারবার ছুটে মাঠে না যায়। সেই ছেলেকে তার সেজো ভাই মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যেতেন সাতক্ষীরা শহরে, সেখানেও গড়ে উঠেছে একটা ক্রিকেট একাডেমি। সেখানে গিয়ে ছেলে ক্রিকেট শেখে। চেহারায় শৈশবের লালিত্য এখনো রয়ে গেছে, পৃথিবীর সেরা ব্যাটসম্যানকে আউট করে সে শিশুর মতো হাততালি দেয়, যেন সে সাতক্ষীরায় তাদের টিনে ছাওয়া বাড়ির ছাদে এই মাত্র একটা পোষা পায়রাকে দেখল শূন্যে ডিগবাজি খেতে। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা, তারপর সরাসরি ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক রেকর্ড বইয়ে। প্রত্যেকেরই প্রায় একই গল্প, সাকিব আল হাসানের বাবা সাকিবের ছোটবেলায় মাগুরা শহরের বাড়িতে সাকিবের ক্রিকেট ব্যাট কেটে ফেলেছিলেন, তাঁর আশঙ্কা ছিল, ছেলে না আবার বড় হয়ে ক্রিকেটার হয়ে যায়। সেই ছেলে এল বিকেএসপিতে, আজ সাকিব পৃথিবীর এক নম্বর, আমি আবার বলছি, পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার, ক্রিকেটের তিনটা ফরমেই। কী যে মায়া লাগে এই ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বললে। আর কী যে সাহস! মাশরাফি বিন মুর্তজার হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে ছয়বার। বিশ্বকাপেও তাঁর ট্রাউজার ভেদ করে ফুলে ছিল হাঁটুতে বেঁধে রাখা কী এক ক্যাপ। ছেলেটা মাঠে নামার আগে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে ফুলে ওঠা হাঁটু থেকে পানি বের করে নিতেন। সেই ছেলের বুকে কত সাহস, কত স্নেহ, প্রেরণার কী অনিঃশেষ ফল্গুধারা। রিকশায় চড়ে অনুশীলনে যাচ্ছিলেন, বাসের ধাক্কায় ছিলে গেল হাতের কনুই। তিনি তাঁর সহখেলোয়াড়দের বলেছেন, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। কোহলি আর ধোনিরা বিস্মিত, ঘটনা কী, বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে পারলে ধন্য হয়ে যাবে, তা না উল্টো চোখে চোখ রেখে কথা বলছে! আর মাশরাফির রসবোধ দেখেছেন? রস+আলোয় গত সোমবার বেরোনো তাঁর সাক্ষাৎকারটি পড়ুন।
সাকিব যখন বলেছিলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ স্পষ্ট ফেবারিট, তা নিয়ে শোর উঠেছিল, ধবলধোলাই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রমাণ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে শেষ ওডিআইয়ের আগেও সাকিব জানালেন, সিরিজ জয় করে নেওয়ার এটা হলো সুবর্ণ সুযোগ।
দক্ষিণ আফ্রিকা আগে ব্যাট করে অতি অল্প রান করে আউট হয়েছে। দ্বিতীয় ওডিআইয়ের দিনের কথা। ব্যাট করতে নেমে তামিম আর লিটন দাস শুরুতেই আউট। কিন্তু বাংলাদেশ শিবিরে কোনো উদ্বেগ নেই, দুশ্চিন্তা নেই। সেদিন মাঠে গিয়েছিলাম, দেখি, নাসির আর সাব্বির নীল রঙের পোশাকটা পরে মাঠের ধারে বসে আছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে এই রকম একটা ম্যাচে প্যাড পরে বসে থেকে খেলা শেষে হেসে বললেন, ভাই, ব্যাটিং তো পাইলাম না। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে শেষ দুই ওডিআইতে তাঁর সেই আফসোসও নেই। কারণ, তাঁরা জানেন, ব্যাট করতে হবে না। মাঠে সৌম্য আছেন, তামিম বা রিয়াদ আছেন।
এই যে সাহস, এই যে মনোবল, এই যে ভয়হীন চিত্তের উচ্চ-শির পারফরম্যান্স, এটা এসেছে একটা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের সার্বিক আত্মবিশ্বাস থেকে। ওই যে কবি বলেছিলেন, শাবাশ বাংলাদেশ, এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। একাত্তরে যুদ্ধে জিতে দেশ পেয়েছি, বন্যা-খরা-জলোচ্ছ্বাসে মরিনি, তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে পরিণত হয়েছি বিশ্বের শস্যভান্ডারে, দক্ষিণ এশিয়ায় মানব উন্নয়ন সূচকে কি নারীর ক্ষমতায়নে ভালো করে চলেছি, বাংলাদেশ এখন কেবল এমার্জিং টাইগার নয়, রোরিং টাইগার।
তবে সবটাই যে সুসংবাদ, তা তো নয়। এক হাজারটা ক্ষেত্র আছে, যেখানে আমাদের ভালো করতে পারতে হবে। গতকালের পত্রিকাতেই খবর, আইনের শাসনে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১০২টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ৯৩তম। মানবাধিকার পরিস্থিতি এখানে ভালো নয়।
বাংলাদেশের মানুষ সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ভালো করছে, তারা ভালো করবেই। তার পেছনে নিশ্চয়ই সরকারগুলোর অনেক অবদান আছে। তবু, আরেকটু ভালো শাসন এই দেশের মানুষের প্রাপ্য। দুর্নীতি যদি কমে আসে, প্রকল্পগুলোর পেছনের উদ্দেশ্য যদি টেকসই উন্নয়ন হয়, লুটপাট না হয়, যদি পরিকল্পনা হয় সুদূরপ্রসারী, যদি থাকে জবাবদিহি, তাহলে এই দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবেই।
অভিনন্দন মাশরাফি বাহিনীকে, ঈদের আগে আমাদের এত সুন্দর একটা উপহার দেওয়ার জন্য। তবে আমাদের নিজেদেরই একটা কথা বলতে হবে, খেলা শেষ পর্যন্ত খেলাই। জয়-পরাজয় থাকবেই। জয়টাকে যেমন সুন্দরভাবে উদ্যাপন করতে পারতে হবে, পরাজয়টাও নিতে পারতে হবে খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়েই। মাশরাফি বলেছিলেন, জয় উদ্যাপন করা সহজ, হারার পরে কে কীভাবে সেটাকে নিচ্ছে, এটা আমি দেখতে চেয়েছিলাম। তিনি তাঁর সহখেলোয়াড়দের সম্পর্কে এটা বলেছিলেন। এটা কিন্তু আমরা আমাদের নিয়েও বলতে পারি, হারার পরে আমরা, দর্শকেরা, কে কী আচরণ করি, সেটাই পরীক্ষা।
এযাবৎকালের বাংলাদেশে দর্শকেরা সেই পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে এসেছে, হারি-জিতি আমরা বাংলাদেশ দলের সঙ্গেই ছিলাম, আছি, থাকব।
এগিয়ে যাও, বাংলাদেশ।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments