বিচারক বদলিতে কনভেনশন গড়ে তুলতে চাই -বিশেষ সাক্ষাৎকারে আইনমন্ত্রী : আনিসুল হক by মিজানুর রহমান খান
আনিসুল হকের
জন্ম ১৯৫৬ সালে। পিতা সিরাজুল হক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌঁসুলি
ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর আইনজীবী হিসেবে মামলার অসমাপ্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন
করেন তিনি। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে আনিসুল হক আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো : বিচারকদের পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ সচিবেরা বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন, এর সর্বশেষ অবস্থাটি কী?
আনিসুল হক : এটা যে ইস্যু হয়েছে তা জানি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার দায়িত্ব কেবল বিচার বিভাগের নয়, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভারও। তাই এর আশু নিরসন হওয়া দরকার। যেখানে বিচারক ও বিচারপতিদের বেতন-ভাতার প্রশ্ন জড়িত, সেটা আমার কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারক ও বিচারপতিদের হাত শক্তিশালী করার জন্য, তাঁদের সম্মান বজায় রেখে যে বেতন তাঁদের প্রাপ্য, সেটা দেওয়াই উচিত। এটা যাতে বিরোধ সৃষ্টি না করে, তা সরকার দেখবে। সরকার চেষ্টা করবে বাস্তবতার নিরিখে যেটা ঠিক, সেটাই যেন তাঁরা পান।
প্রথম আলো : কবে এর সুরাহা হবে?
আনিসুল হক : ঈদের পরে।
প্রথম আলো : বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বাধীন পে-কমিশনের সুপারিশ কি জ্যেষ্ঠ সচিবেরা খতিয়ে দেখতে পারেন? কোনো সচিব কমিটি হয়েছে কি?
আনিসুল হক : এ রকম কোনো কমিটি এখন পর্যন্ত হয়নি। তবে জুডিশিয়াল পে-কমিশনের সুপারিশের আলোকে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে।
প্রথম আলো : অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধান বিচারপতি ও আপনার উপস্থিতিতেই মাসদার হোসেন মামলার রায় ওল্টানোর দাবি তুলেছেন?
আনিসুল হক : ওটা তাঁর ব্যক্তিগত মত।
প্রথম আলো : কিন্তু অর্থমন্ত্রীর ওই অভিমত এসেছে মন্ত্রিসভায় বিচার বিভাগের জন্য ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত পাস করানোর প্রেক্ষাপটে।
আনিসুল হক : আপনি কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছেন?
প্রথম আলো : আগে মোবাইল কোর্ট করেছেন, এখন অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার না করলেও ‘পারিপার্শ্বিক অবস্থা’ দেখে শাস্তি দেওয়ার বিধান করছেন, এর সবটাই তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
আনিসুল হক : মোবাইল কোর্ট এসেছে বাস্তবতার নিরিখে। এখন দোষ স্বীকার ছাড়াই শাস্তির বিধান করছি কেন? এর প্রয়োজন কী? বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্টে পেন্ডিং প্রায় ৩ লাখ। বাদবাকি মামলা পড়ে আছে নিম্ন আদালতে। জনগণের প্রত্যাশা, খাদ্যে ভেজাল, ট্রাফিক বিধি লঙ্ঘন, ফরমালিন ইত্যাদির ত্বরিত সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হোক। আমি ও সরকার যখন জনপ্রতিনিধি, সরকার জনগণকে সন্তুষ্ট করতে যে যে আইন দরকার, সেটা করবে। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যদি এ রকম আইন লাগে, তা জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এ রকম আইন করা হচ্ছে।
প্রথম আলো : কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা কোথাও বিচারকার্য করে না। যে মোবাইল কোর্ট করেছেন, তাও নজিরবিহীন। তাহলে কি বলতে চান, বিচারকেরা ত্বরিত বিচার দিতে পারেন না, যা সরকারি কর্মকর্তারা পারেন?
আনিসুল হক : না। আমি বলিনি ত্বরিত বিচার চাইলে নির্বাহী হাকিম লাগবে, তবে পৃথক্করণের আগে ক্ষমতা তাঁদের ছিল, এই জিনিসটা তাঁরা রেখে দিয়েছেন এবং এখন তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আমরা খেয়াল রাখছি আদালতগুলো যাতে মামলায় জর্জরিত না হয়। আমি আপনাকে ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেব। আমি এ বিষয়ে ওসব দেশের স্বনামধন্য বিচারকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, ৯০ শতাংশ মামলা আদালতের বাইরেই যাতে সুরাহা হয়, তাঁরা এখন তেমনভাবে আদালত চালাচ্ছেন। যেমন রেস্টোরেটিভ জাস্টিস, এর আওতায় থানায় দুই পক্ষকে এনে সুরাহা করে দেয়। এই ব্যবস্থা জনপ্রিয়তা অর্জনের পরে তারা আইনসিদ্ধ করে। আবার যেসব অপরাধ আপসযোগ্য, সেখানে আদালতই সংশ্লিষ্ট পক্ষকে জানিয়ে দেন যে এটা আপসযোগ্য অপরাধ, চেষ্টা করেছেন কি মীমাংসা করে নেওয়ার? বিচারপতি লায়নস, যিনি আমাকে এটা বলেছেন, তিনি আগামী মাসে ঢাকায় রেস্টোরেটিভ জাস্টিস-বিষয়ক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে আসছেন। আরেক মার্কিন ফেডারেল বিচারক আমাকে বলেছেন, কোর্টের বাইরে যদি ৯০ শতাংশ মামলা শেষ করতে না পারি, যদি আমরা কার্যপ্রণালি অনুযায়ী যাই, তাহলে জট সৃষ্টি হবেই। আমাদের এখানেও জট ছিল।
প্রথম আলো : আপনার এই উদাহরণের একটিও সরকারি কর্মকর্তা দিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ত্বরিত বিচারের ধারণাকে যথার্থতা দেয় না, ওসব দেশে এ ব্যবস্থা নেই।
আনিসুল হক : আমি যথার্থতা দেওয়ার কথা বলছিও না। বলছি এটা চালু আছে। ফরমালিন ও ভেজাল খাদ্য নিয়ে কথা ওঠার প্রেক্ষাপটে আমরা আগে থেকে চালু থাকা মোবাইল কোর্টকে অধিকতর কার্যকর করেছি। যেখানে সিআরপিসির ২৬২ ধারায় বলা আছে, দুই বছর পর্যন্ত সামারি ট্রায়ালে সাজা দেওয়া যাবে, ততটুকুই মোবাইল কোর্টকে সুযোগ দিচ্ছি; এর বেশি নয়।
প্রথম আলো : মোবাইল কোর্ট আইনে প্রথমে কেবল জরিমানা করার বিধান ছিল। এরপর সংসদকে এড়িয়ে আপনারা আইনটির তফসিলে প্রায় ১০০ আইন ঢুকিয়েছেন। যেখানে ১০ বছরের সাজা আছে, সেই আইনও ঢুকেছে, তাই দুই বছরের বিধান তো দ্বৈত বিচার চালু করেছে।
আনিসুল হক : আমি কিন্তু এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার অবস্থান নিয়েছি। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভাও একটি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে যে, কোনো অবস্থাতেই দুই বছরের বেশি সাজা দেওয়ার সীমার বাইরে যেতে পারবে না। এখন তফসিলভুক্ত প্রতিটি আইন পরীক্ষা করে দেখুন, সেখানে দুই বছর বা দুই বছরের কম সাজা আছে, কেবল এমন আইনেরই উল্লেখ আছে। এমনকি দুই বছর এক মাস যেখানে সাজার বিধান আছে, তেমন আইনও আর তফসিলে নেই।
প্রথম আলো : কিন্তু এ রকম আইন তফসিলে ছিল।
আনিসুল হক : এখানেই আমি জোরটা দিচ্ছি। একজন কর্মরত আইনজীবী হিসেবে আমি এটা দেখে অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে মন্ত্রিসভায় আমি যখন বক্তব্য রেখেছি, তখন প্রধানমন্ত্রীসহ প্রত্যেক সদস্য তাতে সম্মতি দিয়েছেন।
প্রথম আলো : দুই বছরের সাজা প্রদানের ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে চালানো ‘কোর্ট’ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত স্বাধীন আদালতের বিচার লাভে নাগরিকের অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কারণ এই ‘কোর্ট’ কোর্টই নয়, সুপ্রিম কোর্ট নিয়ন্ত্রিত নয়। আপনি যে বাস্তবতার কথা বলেন, তা কার সৃষ্টি? সরকারি হাকিম রাখার ব্যবস্থামুক্ত ভারত ও পাকিস্তানের বাস্তবতা আমাদের থেকে কীভাবে আলাদা করবেন?
আনিসুল হক : আমাদের দেশে যেটা দরকার, সেটাই তো করতে হবে। আমাদের সমাজে কিছু অপরাধ ছিল, যার বিরুদ্ধে আশু লড়াই চালানো দরকার ছিল এবং সেটা করে সুফল মিলেছে। এ বছর কিন্তু আমে ফরমালিন নেই। স্বাধীনতার কথা যেটা বলছেন, সে বিষয়ে আমি বলব, শিশুর জন্মের পরই তার ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়, এটা আস্তে আস্তে দিতে হয়। ২০০৭ সালে নিম্ন আদালত স্বাধীন হয়। এখন যতই দিন যাবে, ততই তাঁর স্বাধীনতার গণ্ডি প্রসারিত হবে এবং স্বাধীনতাকে ধারণ করার শক্তি আমাদের বিচার বিভাগ পাবে। এটা কিন্তু আমাদের মেনে নিতে হবে।
প্রথম আলো : সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনসংক্রান্ত আইনের খসড়া কবে মিলবে? বিচারপতি নিয়োগ আইনের কী হলো?
আনিসুল হক : প্রক্রিয়াগত এই আইনের খসড়া ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। এ নিয়ে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে নিশ্চয় আলোচনা করব। একজন বিচারপতিকে দুটি কারণে সরানো যাবে। এর একটি প্রমাণিত গুরুতর অসদাচরণ ও অন্যটি হলো অসামর্থ্য। যাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হবে, তিনি যেন নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পারেন, কোনো জায়গায় যাতে এ বিষয়ে কোনো ব্যত্যয় না ঘটে বা বাধা না আসে, সেটা আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে এবং যতক্ষণ তাঁকে সরানো না হবে, ততক্ষণ যাতে তাঁর সম্মান বা অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। আর বিচারক নিয়োগ আইনটির অগ্রগতি এখনো নেই, তবে এটাও করা হবে।
প্রথম আলো : ঢাকার সিএমএম পদে সরকারি প্রস্তাব তিনবার নাকচ হওয়ার পর চতুর্থবারে আপনি আপনার প্রস্তাবের পক্ষে নির্দিষ্টভাবে কারণ ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু চতুর্থবারও নাকচ করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কোনো কারণ দেখালেন না। পরস্পরের কাছে এই কারণ দেখানোর বিষয়ে কি এখন থেকে একটি নতুন কনভেনশন গড়ে তোলা যায়?
আনিসুল হক : আইন মন্ত্রণালয় এই প্রথম ব্যাখ্যা দিয়ে পাঠিয়েছে। প্রথম কথা হলো, বর্তমান সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সে জন্য আপনার মনে যে প্রশ্ন উঠেছে, আপনার বক্তব্য হলো সুপ্রিম কোর্ট যখন ফেরত পাঠালেন, তখন তাঁরা কিন্তু কোনো যুক্তি দেননি। কিন্তু আমি যেহেতু বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, তাই আমি কারণ দেখিয়ে একটি রিভিউ প্রস্তাব করেছিলাম, আর সেটা দেখেও তাঁরা যখন আগের অভিমতে স্থির থাকলেন, তখন আমি মনে করেছি নিশ্চয় তাঁদের অবস্থানের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে। সেটা জিজ্ঞেস করতে গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হয়তো কোনো জায়গায় ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই আমি এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি। একটি কনভেনশন, একটি প্র্যাকটিস, একটা নিয়ম যে ছিল, সেটা আমি তাঁদের জানিয়েছিলাম।
প্রথম আলো : কারণ দেখিয়ে কাউকে বদলির প্রস্তাব প্রদানকে কি একটি কনভেনশন হিসেবে গড়ে তুলতে চান? নাকি এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
আনিসুল হক : আইন মন্ত্রণালয় নির্বাহী বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। উভয়ের মধ্যে যাতে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি না হয়, সেটার ব্যাপারে প্রশ্ন জাগলে আমি বারংবারই তাদের কাছে এ রকম প্রশ্ন তুলব। বদলি বিষয়ে এখন কোনো নীতিমালা নেই।
প্রথম আলো : তাহলে আপনি মনে করেন যে, বদলি ও প্রেষণে বিচারকের পদায়নে একটি কনভেনশন গড়ে তোলা দরকার?
আনিসুল হক : হ্যাঁ। আমি এখানে একটি প্র্যাকটিস, একটি কনভেনশন গড়ে তোলার চেষ্টা করব। এখন যেসব প্রস্তাব যায়, তার মন্তব্যের ঘর আগে খালি থাকত কি না জানি না, এখন তা পূরণ করা থাকে। স্বামী-স্ত্রী এক জেলায় থাকবেন, সেটা নীতিমালার বরাতে ব্যাখ্যা করে দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম আলো : কখনো জনমনে এমন ধারণা হয় যে, সরকারের অপছন্দের আদেশ দানের পরপরই বিচারক বদলির সুপারিশ যাচ্ছে?
আনিসুল হক : অনেক সময় অভিযোগ আসে যে জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তখন সেটা দেখতে হয়। কারণ, জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে তাদের কথা শুনতে হয়। এর যদি ৫০-৫৫ শতাংশেরও সত্যতা মেলে, তখন আমাকে একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। আর এটাকেই বলে সুশাসন।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
আনিসুল হক : ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো : বিচারকদের পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ সচিবেরা বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন, এর সর্বশেষ অবস্থাটি কী?
আনিসুল হক : এটা যে ইস্যু হয়েছে তা জানি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার দায়িত্ব কেবল বিচার বিভাগের নয়, নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভারও। তাই এর আশু নিরসন হওয়া দরকার। যেখানে বিচারক ও বিচারপতিদের বেতন-ভাতার প্রশ্ন জড়িত, সেটা আমার কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারক ও বিচারপতিদের হাত শক্তিশালী করার জন্য, তাঁদের সম্মান বজায় রেখে যে বেতন তাঁদের প্রাপ্য, সেটা দেওয়াই উচিত। এটা যাতে বিরোধ সৃষ্টি না করে, তা সরকার দেখবে। সরকার চেষ্টা করবে বাস্তবতার নিরিখে যেটা ঠিক, সেটাই যেন তাঁরা পান।
প্রথম আলো : কবে এর সুরাহা হবে?
আনিসুল হক : ঈদের পরে।
প্রথম আলো : বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বাধীন পে-কমিশনের সুপারিশ কি জ্যেষ্ঠ সচিবেরা খতিয়ে দেখতে পারেন? কোনো সচিব কমিটি হয়েছে কি?
আনিসুল হক : এ রকম কোনো কমিটি এখন পর্যন্ত হয়নি। তবে জুডিশিয়াল পে-কমিশনের সুপারিশের আলোকে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে।
প্রথম আলো : অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধান বিচারপতি ও আপনার উপস্থিতিতেই মাসদার হোসেন মামলার রায় ওল্টানোর দাবি তুলেছেন?
আনিসুল হক : ওটা তাঁর ব্যক্তিগত মত।
প্রথম আলো : কিন্তু অর্থমন্ত্রীর ওই অভিমত এসেছে মন্ত্রিসভায় বিচার বিভাগের জন্য ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত পাস করানোর প্রেক্ষাপটে।
আনিসুল হক : আপনি কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছেন?
প্রথম আলো : আগে মোবাইল কোর্ট করেছেন, এখন অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষ স্বীকার না করলেও ‘পারিপার্শ্বিক অবস্থা’ দেখে শাস্তি দেওয়ার বিধান করছেন, এর সবটাই তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
আনিসুল হক : মোবাইল কোর্ট এসেছে বাস্তবতার নিরিখে। এখন দোষ স্বীকার ছাড়াই শাস্তির বিধান করছি কেন? এর প্রয়োজন কী? বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্টে পেন্ডিং প্রায় ৩ লাখ। বাদবাকি মামলা পড়ে আছে নিম্ন আদালতে। জনগণের প্রত্যাশা, খাদ্যে ভেজাল, ট্রাফিক বিধি লঙ্ঘন, ফরমালিন ইত্যাদির ত্বরিত সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হোক। আমি ও সরকার যখন জনপ্রতিনিধি, সরকার জনগণকে সন্তুষ্ট করতে যে যে আইন দরকার, সেটা করবে। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যদি এ রকম আইন লাগে, তা জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এ রকম আইন করা হচ্ছে।
প্রথম আলো : কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা কোথাও বিচারকার্য করে না। যে মোবাইল কোর্ট করেছেন, তাও নজিরবিহীন। তাহলে কি বলতে চান, বিচারকেরা ত্বরিত বিচার দিতে পারেন না, যা সরকারি কর্মকর্তারা পারেন?
আনিসুল হক : না। আমি বলিনি ত্বরিত বিচার চাইলে নির্বাহী হাকিম লাগবে, তবে পৃথক্করণের আগে ক্ষমতা তাঁদের ছিল, এই জিনিসটা তাঁরা রেখে দিয়েছেন এবং এখন তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আমরা খেয়াল রাখছি আদালতগুলো যাতে মামলায় জর্জরিত না হয়। আমি আপনাকে ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেব। আমি এ বিষয়ে ওসব দেশের স্বনামধন্য বিচারকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, ৯০ শতাংশ মামলা আদালতের বাইরেই যাতে সুরাহা হয়, তাঁরা এখন তেমনভাবে আদালত চালাচ্ছেন। যেমন রেস্টোরেটিভ জাস্টিস, এর আওতায় থানায় দুই পক্ষকে এনে সুরাহা করে দেয়। এই ব্যবস্থা জনপ্রিয়তা অর্জনের পরে তারা আইনসিদ্ধ করে। আবার যেসব অপরাধ আপসযোগ্য, সেখানে আদালতই সংশ্লিষ্ট পক্ষকে জানিয়ে দেন যে এটা আপসযোগ্য অপরাধ, চেষ্টা করেছেন কি মীমাংসা করে নেওয়ার? বিচারপতি লায়নস, যিনি আমাকে এটা বলেছেন, তিনি আগামী মাসে ঢাকায় রেস্টোরেটিভ জাস্টিস-বিষয়ক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে আসছেন। আরেক মার্কিন ফেডারেল বিচারক আমাকে বলেছেন, কোর্টের বাইরে যদি ৯০ শতাংশ মামলা শেষ করতে না পারি, যদি আমরা কার্যপ্রণালি অনুযায়ী যাই, তাহলে জট সৃষ্টি হবেই। আমাদের এখানেও জট ছিল।
প্রথম আলো : আপনার এই উদাহরণের একটিও সরকারি কর্মকর্তা দিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ত্বরিত বিচারের ধারণাকে যথার্থতা দেয় না, ওসব দেশে এ ব্যবস্থা নেই।
আনিসুল হক : আমি যথার্থতা দেওয়ার কথা বলছিও না। বলছি এটা চালু আছে। ফরমালিন ও ভেজাল খাদ্য নিয়ে কথা ওঠার প্রেক্ষাপটে আমরা আগে থেকে চালু থাকা মোবাইল কোর্টকে অধিকতর কার্যকর করেছি। যেখানে সিআরপিসির ২৬২ ধারায় বলা আছে, দুই বছর পর্যন্ত সামারি ট্রায়ালে সাজা দেওয়া যাবে, ততটুকুই মোবাইল কোর্টকে সুযোগ দিচ্ছি; এর বেশি নয়।
প্রথম আলো : মোবাইল কোর্ট আইনে প্রথমে কেবল জরিমানা করার বিধান ছিল। এরপর সংসদকে এড়িয়ে আপনারা আইনটির তফসিলে প্রায় ১০০ আইন ঢুকিয়েছেন। যেখানে ১০ বছরের সাজা আছে, সেই আইনও ঢুকেছে, তাই দুই বছরের বিধান তো দ্বৈত বিচার চালু করেছে।
আনিসুল হক : আমি কিন্তু এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার অবস্থান নিয়েছি। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভাও একটি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে যে, কোনো অবস্থাতেই দুই বছরের বেশি সাজা দেওয়ার সীমার বাইরে যেতে পারবে না। এখন তফসিলভুক্ত প্রতিটি আইন পরীক্ষা করে দেখুন, সেখানে দুই বছর বা দুই বছরের কম সাজা আছে, কেবল এমন আইনেরই উল্লেখ আছে। এমনকি দুই বছর এক মাস যেখানে সাজার বিধান আছে, তেমন আইনও আর তফসিলে নেই।
প্রথম আলো : কিন্তু এ রকম আইন তফসিলে ছিল।
আনিসুল হক : এখানেই আমি জোরটা দিচ্ছি। একজন কর্মরত আইনজীবী হিসেবে আমি এটা দেখে অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে মন্ত্রিসভায় আমি যখন বক্তব্য রেখেছি, তখন প্রধানমন্ত্রীসহ প্রত্যেক সদস্য তাতে সম্মতি দিয়েছেন।
প্রথম আলো : দুই বছরের সাজা প্রদানের ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে চালানো ‘কোর্ট’ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত স্বাধীন আদালতের বিচার লাভে নাগরিকের অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কারণ এই ‘কোর্ট’ কোর্টই নয়, সুপ্রিম কোর্ট নিয়ন্ত্রিত নয়। আপনি যে বাস্তবতার কথা বলেন, তা কার সৃষ্টি? সরকারি হাকিম রাখার ব্যবস্থামুক্ত ভারত ও পাকিস্তানের বাস্তবতা আমাদের থেকে কীভাবে আলাদা করবেন?
আনিসুল হক : আমাদের দেশে যেটা দরকার, সেটাই তো করতে হবে। আমাদের সমাজে কিছু অপরাধ ছিল, যার বিরুদ্ধে আশু লড়াই চালানো দরকার ছিল এবং সেটা করে সুফল মিলেছে। এ বছর কিন্তু আমে ফরমালিন নেই। স্বাধীনতার কথা যেটা বলছেন, সে বিষয়ে আমি বলব, শিশুর জন্মের পরই তার ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়, এটা আস্তে আস্তে দিতে হয়। ২০০৭ সালে নিম্ন আদালত স্বাধীন হয়। এখন যতই দিন যাবে, ততই তাঁর স্বাধীনতার গণ্ডি প্রসারিত হবে এবং স্বাধীনতাকে ধারণ করার শক্তি আমাদের বিচার বিভাগ পাবে। এটা কিন্তু আমাদের মেনে নিতে হবে।
প্রথম আলো : সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনসংক্রান্ত আইনের খসড়া কবে মিলবে? বিচারপতি নিয়োগ আইনের কী হলো?
আনিসুল হক : প্রক্রিয়াগত এই আইনের খসড়া ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। এ নিয়ে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে নিশ্চয় আলোচনা করব। একজন বিচারপতিকে দুটি কারণে সরানো যাবে। এর একটি প্রমাণিত গুরুতর অসদাচরণ ও অন্যটি হলো অসামর্থ্য। যাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হবে, তিনি যেন নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পারেন, কোনো জায়গায় যাতে এ বিষয়ে কোনো ব্যত্যয় না ঘটে বা বাধা না আসে, সেটা আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে এবং যতক্ষণ তাঁকে সরানো না হবে, ততক্ষণ যাতে তাঁর সম্মান বা অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। আর বিচারক নিয়োগ আইনটির অগ্রগতি এখনো নেই, তবে এটাও করা হবে।
প্রথম আলো : ঢাকার সিএমএম পদে সরকারি প্রস্তাব তিনবার নাকচ হওয়ার পর চতুর্থবারে আপনি আপনার প্রস্তাবের পক্ষে নির্দিষ্টভাবে কারণ ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু চতুর্থবারও নাকচ করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কোনো কারণ দেখালেন না। পরস্পরের কাছে এই কারণ দেখানোর বিষয়ে কি এখন থেকে একটি নতুন কনভেনশন গড়ে তোলা যায়?
আনিসুল হক : আইন মন্ত্রণালয় এই প্রথম ব্যাখ্যা দিয়ে পাঠিয়েছে। প্রথম কথা হলো, বর্তমান সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সে জন্য আপনার মনে যে প্রশ্ন উঠেছে, আপনার বক্তব্য হলো সুপ্রিম কোর্ট যখন ফেরত পাঠালেন, তখন তাঁরা কিন্তু কোনো যুক্তি দেননি। কিন্তু আমি যেহেতু বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, তাই আমি কারণ দেখিয়ে একটি রিভিউ প্রস্তাব করেছিলাম, আর সেটা দেখেও তাঁরা যখন আগের অভিমতে স্থির থাকলেন, তখন আমি মনে করেছি নিশ্চয় তাঁদের অবস্থানের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে। সেটা জিজ্ঞেস করতে গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হয়তো কোনো জায়গায় ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই আমি এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি। একটি কনভেনশন, একটি প্র্যাকটিস, একটা নিয়ম যে ছিল, সেটা আমি তাঁদের জানিয়েছিলাম।
প্রথম আলো : কারণ দেখিয়ে কাউকে বদলির প্রস্তাব প্রদানকে কি একটি কনভেনশন হিসেবে গড়ে তুলতে চান? নাকি এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
আনিসুল হক : আইন মন্ত্রণালয় নির্বাহী বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। উভয়ের মধ্যে যাতে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি না হয়, সেটার ব্যাপারে প্রশ্ন জাগলে আমি বারংবারই তাদের কাছে এ রকম প্রশ্ন তুলব। বদলি বিষয়ে এখন কোনো নীতিমালা নেই।
প্রথম আলো : তাহলে আপনি মনে করেন যে, বদলি ও প্রেষণে বিচারকের পদায়নে একটি কনভেনশন গড়ে তোলা দরকার?
আনিসুল হক : হ্যাঁ। আমি এখানে একটি প্র্যাকটিস, একটি কনভেনশন গড়ে তোলার চেষ্টা করব। এখন যেসব প্রস্তাব যায়, তার মন্তব্যের ঘর আগে খালি থাকত কি না জানি না, এখন তা পূরণ করা থাকে। স্বামী-স্ত্রী এক জেলায় থাকবেন, সেটা নীতিমালার বরাতে ব্যাখ্যা করে দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম আলো : কখনো জনমনে এমন ধারণা হয় যে, সরকারের অপছন্দের আদেশ দানের পরপরই বিচারক বদলির সুপারিশ যাচ্ছে?
আনিসুল হক : অনেক সময় অভিযোগ আসে যে জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তখন সেটা দেখতে হয়। কারণ, জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে তাদের কথা শুনতে হয়। এর যদি ৫০-৫৫ শতাংশেরও সত্যতা মেলে, তখন আমাকে একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। আর এটাকেই বলে সুশাসন।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
আনিসুল হক : ধন্যবাদ।
No comments