ওরা রাষ্ট্র বোঝে, মানুষ বোঝে না! by আনিসুল হক
মহাপুরুষেরা
চিরকাল বলে এসেছেন, ভালোবাসো। অন্তর থেকে বিদ্বেষ বিষ নাশো। কিন্তু
মাটি আর বায়ুতে বিষ ছড়ায় যারা, তাদেরও কি ভালোবাসতে হবে? ভগবান কি তাদেরও
ক্ষমা করবেন?
প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আপনি লিখেছিলেন ‘প্রশ্ন’ নামের কবিতায়।
আজকে প্রিয় কবি, আপনাকেই আমি চিঠি লিখি। আমি বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ। প্রশ্নটা হলো, মানুষ কি মানুষ নামের যোগ্য? আমরা কি দিন দিন সভ্য হচ্ছি, নাকি দিন দিন পরিণত হচ্ছি পশুর অধিক পশুতে? আমাদের এই সভ্যতা, এই রাষ্ট্রসমূহ, এই জাতিসংঘ, এই সীমান্ত, এই আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো, আমাদের যাবতীয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা, লাইব্রেরি, কবিতা, সংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র—আমাদের যাবতীয় মধুর ভাষণরাশি—সবকিছুই কি অর্থহীন নয়? আমাদের এই জাতীয় আর আন্তর্জাতিক নীতি আর কূটনীতি, মানবতা আর মানবাধিকার রক্ষার বাজারসমূহ—সবকিছুই কি কেবল লোক দেখানো বিবেকের দংশন থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলার একটা নিমিত্তমাত্র নয়?
প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, আপনার গান, আপনার কবিতা, আপনার লেখা গদ্য-পদ্য আমাদের নিরন্তর আশার কথা শোনায়, এই যে মহাজগৎ, আকাশভরা সূর্যতারা, ভোরের আলো, গাছে গাছে সবুজ পাতা, রঙিন ফুল—সবকিছু বয়ে চলেছে এক নিরন্তর শুভর দিকে, এই আশ্বাস আমরা আপনার কাছে লাভ করি। কিন্তু রবিবাবু, কী হবে সেই আশ্বাসে? প্রকৃতি মানুষকে কষ্ট দেয়, তার সাজানো বাগান কেড়ে নেয়—সে সময়ও না হয় আপনার এবং আপনার মতো মহাপুরুষদের পরিবেশিত আশ্বাসবাণী থেকে সান্ত্বনা খুঁজতে পারি। এমনকি যুদ্ধের সময় হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, মানুষ পরিণত হয় পশুতে—সেটারও একটা সান্ত্বনা থাকে যে এই যুদ্ধ থেমে যাবে, একদিন বইবে শান্তির সুবাতাস, পৃথিবীতে মানবিকতার জয় হবে।
কিন্তু ঘোরতর শান্তির সময়ে আমরা যখন রাষ্ট্র আর সভ্যতার প্রহরী হয়ে নিজের দায়দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করার জন্যই আশ্রয় নিই অমানবিকতার, সিদ্ধান্ত নিই ঠান্ডা মাথায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে, এক চুমুক কফির সঙ্গে এক কামড় বিস্কুট চিবোতে চিবোতে যে, সাগরে ভাসতে থাকা ওই মানুষগুলোকে ভিড়তে দিয়ো না, ওরা মরলে মরবে—আর শোনো, জেলে-মাঝিরা, কেউ যদি সাগরে পড়ে গিয়ে ভাসতে ভাসতে ডুবে মরেও যায়, তাদের উদ্ধার করবে না।
তারও আগে আছে মর্মান্তিক সব কাহিনি। দাস ব্যবসার, অপহরণের, মানুষ কেনাবেচার, মানুষকে বন্দী করে রাখার, মানুষকে হত্যা করার।
রবিবাবু, কাহিনিটা নাহয় এমন করে বলি।
আমার মোবাইল ফোনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেবার যখন বেড়াতে গেলাম ঝিনাইদহে, তখনই পরিচয় আলাউদ্দিন শেখের সঙ্গে। ২৭-২৮ বছরের যুবক। তেমন কী আর লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু নিশ্চয়ই লোকটা জাদু জানেন। আমার মোবাইল ফোনটা কাজ করছে না। তাঁর ছোট দোকানে তিনি বসে আছেন, তখন তাঁর কাঁধে ছিল একটা ঝুঁটিশালিক, শালিক পাখিও পোষেন তিনি। তাঁকে মোবাইল ফোনটা দিলাম। তিনি সেটা খুললেন। কী একটা পরীক্ষা করলেন। বললেন, সারবে। ৫০০ টাকা লাগবে।
আমার দামি সেট। ৫০০ টাকা কোনো ব্যাপার নয়, বিশেষ করে সেটটায় অনেকগুলো মোবাইল ফোনের নম্বর সেভ করা আছে, কাজেই আমি রাজি হলাম।
বললাম, ‘আপনার কাঁধের পাখিটা কি ময়না?’
তিনি বললেন, ‘না, শালিক পাখি।’
‘শালিক পাখি পোষা যায়?’
তিনি বললেন, ‘ভালোবাসা পেলে সবাই পোষ মানে। বনের পশুপাখিও।’
এক যুবা বয়সী মানুষের মুখে এই রকম দার্শনিক উক্তি শুনে চমকে উঠেছিলাম।
পরে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই মোবাইল ফোনে কথা বলতাম। ঢাকায় ফেরার পরেও। তিনিই ফোন করতেন।
সেই আলাউদ্দিন শেখ, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের আলাউদ্দিন, বেড়াতে গিয়েছিলেন কক্সবাজারে। তাঁর এক পরিচিত বন্ধুই তাঁকে প্ররোচিত করে সাগর দেখানোর কথা বলে। তারপর, টুরিস্টের মতো তাঁরা যান মহেশখালী। এরপরে তিনি আর টুরিস্ট থাকেন না। একদিন নিজেকে আবিষ্কার করেন একটা ঝুপড়ি ঘরে। তাঁর হাত-পা বাঁধা।
তাঁর বন্ধু শহীদ তাঁকে বস্তা হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে ১০ হাজার টাকায়।
ঝুপড়ি ঘরে এই রকম বন্দীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জনাপঞ্চাশেক হলে তাঁদের তোলা হয় ছোট নৌকায়। সেখান থেকে ট্রলারে। ট্রলার থেকে বড় জাহাজে। জাহাজে তখনো পর্যাপ্ত বন্দী জোটেনি, কাজেই মিয়ানমারের জলসীমায় জাহাজ অপেক্ষা করে ৮০ দিন। কেউ প্রতিবাদ করলে মেরে ফেলে দেওয়া হতো সমুদ্রে। খাবার নেই। পানি নেই।
সমুদ্রে নেমে যে গাছগাছালি পেয়েছেন, তা-ই চিবিয়ে খেয়েছেন এই রকম সমুদ্রবন্দীরা। পানি না পেয়ে মানুষের মূত্রপান করেছেন কেউ-বা। হাড্ডিসার সেসব ছবি ছাপা হচ্ছে কাগজে...
রবিবাবু, আলাউদ্দিনের গল্পটা সত্য। ইত্তেফাক–এ ছাপা হয়েছে ২১ মে ২০১৫। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হতো আলাউদ্দিনের মতো মানুষদের, বিক্রি করে দেওয়া হতো, মেরে ফেলা হতো। গণকবর উদ্ধার হয়েছে...মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় আকাশে-বাতাসে কত হাহাকার, কত অশ্রু, কত শেষনিশ্বাস ভেসে আছে।
তারপরও সাগরে ভাসছে হাজার হাজার মানুষ। কোনো একটা দেশে তারা নামতে চায়। তাদের নৌযানে পানি নেই, খাবার নেই। তারা মারা যাচ্ছে...উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে...পৃথিবীর সভ্যতার ধ্বজাধারীরা, মানবতার রক্ষকেরা নিয়ম করছেন, হেলিকপ্টার পাঠাও, এতটা অমানবিক আমরা হতে পারি না, হেলিকপ্টার থেকে সমুদ্রের জলে ফেলা হচ্ছে খাবার কিংবা পানির পাত্র, ওই মানুষগুলো জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে উত্তাল সমুদ্রে, একটুখানি খাবারের আশায়, পানির আশায় ওই ছবিও আমরা দেখছি।
কিন্তু নির্দেশ কড়া, একটা মানুষও যেন আমার সীমানায় পা রাখতে না পারে। মরলে মরুক।
তাঁদের কথায় যুক্তি আছে, একজনকে উঠতে দিলে অভিবাসীদের ঢল নামবে।
আমাদেরও যুক্তি আছে। আমরা, বাংলাদেশের মানুষেরাও, রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দিইনি। কয়েক লাখ ঢুকতে দিয়েছি। তাদের ফেরানো যাচ্ছে না। আমাদের দেশে তারা নানা ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ফৌজদারি সমস্যা তৈরি করছে। কেন দেব তাদের আমরা ঢুকতে? তারা তো বাংলাদেশি না। রোহিঙ্গা।
আর মিয়ানমারের শাসক ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ওদের মেরে, জ্বালিয়ে, ধর্ষণ করে, তাদের লক্ষ্মণরেখা এঁকে, তার ভেতরে বন্দী করে, তাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের জমিজমা দখল করা যায়, এথনিক ক্লিনজিং করা যায়, কারণ ওদের ধর্ম আলাদা, ভাষা আলাদা।
তাহলে এই দাঁড়াল আমাদের সভ্যতা, মানবতা, মানবিকতা, মানবাধিকারের কোটি কোটি পাতার ইশতেহারের? আপনার এবং আপনার মতো কবি-সাহিত্যিকদের প্রেমময় পঙ্ক্তিগুলোর? যুগে যুগে প্রেমের বাণী নিয়ে, শান্তির বাণী নিয়ে আসা মহামানবদের অমৃতময় বচন আর শিক্ষাসমূহের?
রবিবাবু, আপনি ভগবানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যারা বায়ুদূষণ করে, মাটিকে বিষাক্ত করে, তাদের কি ভগবান ক্ষমা করে? রবিবাবু, আপনি বলেন, যারা প্যান্ট-শার্ট পরে, নিয়মকানুন রচনা করে, রাষ্ট্র আর বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করে সভ্যতাকে পরিচালনা করছে, তারা কি আদৌ মানুষ?
বিকাশ করে কুড়ি হাজার টাকা পাঠানোর পরে আলাউদ্দিন শেখসহ ১৮ জনকে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁরা সাঁতরে কূলে উঠেছেন।
সেই শালিক পাখিটা অপেক্ষা করছে। ঝিনাইদহে ফিরে যাবেন আলাউদ্দিন। অপেক্ষা করছেন এই রকম হাজার হাজার আলাউদ্দিনের বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন। গোয়ালের গরু কিংবা পোষা বিড়াল।
কত হাজার মরলে পরে, রবিবাবু, বলবে এরা শেষে, বড্ড বেশি মানুষ গেছে আদম পাচারে ভেসে?
আলাউদ্দিন শেখ ফিরে যাবেন ঘরে। শালিক পাখিটা উড়ে এসে বসবে তাঁর কাঁধে। আলাউদ্দিনের মা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবেন তাঁকে। মায়ের আঁচলের গন্ধে আলাউদ্দিন বাক্যহারা হয়ে রইবেন। তাঁর মাও কথা বলতে পারবেন না। দুজনের চার চোখ দিয়ে বয়ে যাবে জলধারা। শালিক পাখিটা আনন্দে উড়তে থাকবে মাথার ওপর দিয়ে।
আমি অপেক্ষা করছি আলাউদ্দিনের ফোনের জন্য, আমার নম্বরটা খুঁজে পেলেই তিনি নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করে বলবেন, ‘ভাইজান, ফিরে এয়েছি।’
রবিবাবু, আলাউদ্দিন শেখের কাহিনিটা সত্য। শালিক পাখি কিংবা আমার সঙ্গে তাঁর মোবাইল ফোনের কথা বলার গল্পটা বানানো। আপনি জানেন, মানুষ যখন সংখ্যা হয়ে যায়, তখনই মানবাধিকারের মৃত্যু ঘটে। আলাউদ্দিনরা যে সংখ্যা নয়, আমাদেরই মতো মানুষ, তা বোঝানোর জন্য কাহিনি কিছুটা আমি বানিয়েছি। কিন্তু আপনি জানেন, এই হাজার হাজার মানুষের প্রত্যেকের জীবনেই আছে এমনি সব মানবিক গল্প।
শুধু রাষ্ট্রগুলো মানুষ বোঝে না, তারা সীমান্ত বোঝে, বৃহত্তর স্বার্থ বোঝে। মানুষ বোঝে না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আপনি লিখেছিলেন ‘প্রশ্ন’ নামের কবিতায়।
আজকে প্রিয় কবি, আপনাকেই আমি চিঠি লিখি। আমি বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ। প্রশ্নটা হলো, মানুষ কি মানুষ নামের যোগ্য? আমরা কি দিন দিন সভ্য হচ্ছি, নাকি দিন দিন পরিণত হচ্ছি পশুর অধিক পশুতে? আমাদের এই সভ্যতা, এই রাষ্ট্রসমূহ, এই জাতিসংঘ, এই সীমান্ত, এই আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো, আমাদের যাবতীয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা, লাইব্রেরি, কবিতা, সংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র—আমাদের যাবতীয় মধুর ভাষণরাশি—সবকিছুই কি অর্থহীন নয়? আমাদের এই জাতীয় আর আন্তর্জাতিক নীতি আর কূটনীতি, মানবতা আর মানবাধিকার রক্ষার বাজারসমূহ—সবকিছুই কি কেবল লোক দেখানো বিবেকের দংশন থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলার একটা নিমিত্তমাত্র নয়?
প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, আপনার গান, আপনার কবিতা, আপনার লেখা গদ্য-পদ্য আমাদের নিরন্তর আশার কথা শোনায়, এই যে মহাজগৎ, আকাশভরা সূর্যতারা, ভোরের আলো, গাছে গাছে সবুজ পাতা, রঙিন ফুল—সবকিছু বয়ে চলেছে এক নিরন্তর শুভর দিকে, এই আশ্বাস আমরা আপনার কাছে লাভ করি। কিন্তু রবিবাবু, কী হবে সেই আশ্বাসে? প্রকৃতি মানুষকে কষ্ট দেয়, তার সাজানো বাগান কেড়ে নেয়—সে সময়ও না হয় আপনার এবং আপনার মতো মহাপুরুষদের পরিবেশিত আশ্বাসবাণী থেকে সান্ত্বনা খুঁজতে পারি। এমনকি যুদ্ধের সময় হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, মানুষ পরিণত হয় পশুতে—সেটারও একটা সান্ত্বনা থাকে যে এই যুদ্ধ থেমে যাবে, একদিন বইবে শান্তির সুবাতাস, পৃথিবীতে মানবিকতার জয় হবে।
কিন্তু ঘোরতর শান্তির সময়ে আমরা যখন রাষ্ট্র আর সভ্যতার প্রহরী হয়ে নিজের দায়দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করার জন্যই আশ্রয় নিই অমানবিকতার, সিদ্ধান্ত নিই ঠান্ডা মাথায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে, এক চুমুক কফির সঙ্গে এক কামড় বিস্কুট চিবোতে চিবোতে যে, সাগরে ভাসতে থাকা ওই মানুষগুলোকে ভিড়তে দিয়ো না, ওরা মরলে মরবে—আর শোনো, জেলে-মাঝিরা, কেউ যদি সাগরে পড়ে গিয়ে ভাসতে ভাসতে ডুবে মরেও যায়, তাদের উদ্ধার করবে না।
তারও আগে আছে মর্মান্তিক সব কাহিনি। দাস ব্যবসার, অপহরণের, মানুষ কেনাবেচার, মানুষকে বন্দী করে রাখার, মানুষকে হত্যা করার।
রবিবাবু, কাহিনিটা নাহয় এমন করে বলি।
আমার মোবাইল ফোনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেবার যখন বেড়াতে গেলাম ঝিনাইদহে, তখনই পরিচয় আলাউদ্দিন শেখের সঙ্গে। ২৭-২৮ বছরের যুবক। তেমন কী আর লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু নিশ্চয়ই লোকটা জাদু জানেন। আমার মোবাইল ফোনটা কাজ করছে না। তাঁর ছোট দোকানে তিনি বসে আছেন, তখন তাঁর কাঁধে ছিল একটা ঝুঁটিশালিক, শালিক পাখিও পোষেন তিনি। তাঁকে মোবাইল ফোনটা দিলাম। তিনি সেটা খুললেন। কী একটা পরীক্ষা করলেন। বললেন, সারবে। ৫০০ টাকা লাগবে।
আমার দামি সেট। ৫০০ টাকা কোনো ব্যাপার নয়, বিশেষ করে সেটটায় অনেকগুলো মোবাইল ফোনের নম্বর সেভ করা আছে, কাজেই আমি রাজি হলাম।
বললাম, ‘আপনার কাঁধের পাখিটা কি ময়না?’
তিনি বললেন, ‘না, শালিক পাখি।’
‘শালিক পাখি পোষা যায়?’
তিনি বললেন, ‘ভালোবাসা পেলে সবাই পোষ মানে। বনের পশুপাখিও।’
এক যুবা বয়সী মানুষের মুখে এই রকম দার্শনিক উক্তি শুনে চমকে উঠেছিলাম।
পরে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই মোবাইল ফোনে কথা বলতাম। ঢাকায় ফেরার পরেও। তিনিই ফোন করতেন।
সেই আলাউদ্দিন শেখ, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের আলাউদ্দিন, বেড়াতে গিয়েছিলেন কক্সবাজারে। তাঁর এক পরিচিত বন্ধুই তাঁকে প্ররোচিত করে সাগর দেখানোর কথা বলে। তারপর, টুরিস্টের মতো তাঁরা যান মহেশখালী। এরপরে তিনি আর টুরিস্ট থাকেন না। একদিন নিজেকে আবিষ্কার করেন একটা ঝুপড়ি ঘরে। তাঁর হাত-পা বাঁধা।
তাঁর বন্ধু শহীদ তাঁকে বস্তা হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে ১০ হাজার টাকায়।
ঝুপড়ি ঘরে এই রকম বন্দীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জনাপঞ্চাশেক হলে তাঁদের তোলা হয় ছোট নৌকায়। সেখান থেকে ট্রলারে। ট্রলার থেকে বড় জাহাজে। জাহাজে তখনো পর্যাপ্ত বন্দী জোটেনি, কাজেই মিয়ানমারের জলসীমায় জাহাজ অপেক্ষা করে ৮০ দিন। কেউ প্রতিবাদ করলে মেরে ফেলে দেওয়া হতো সমুদ্রে। খাবার নেই। পানি নেই।
সমুদ্রে নেমে যে গাছগাছালি পেয়েছেন, তা-ই চিবিয়ে খেয়েছেন এই রকম সমুদ্রবন্দীরা। পানি না পেয়ে মানুষের মূত্রপান করেছেন কেউ-বা। হাড্ডিসার সেসব ছবি ছাপা হচ্ছে কাগজে...
রবিবাবু, আলাউদ্দিনের গল্পটা সত্য। ইত্তেফাক–এ ছাপা হয়েছে ২১ মে ২০১৫। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হতো আলাউদ্দিনের মতো মানুষদের, বিক্রি করে দেওয়া হতো, মেরে ফেলা হতো। গণকবর উদ্ধার হয়েছে...মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় আকাশে-বাতাসে কত হাহাকার, কত অশ্রু, কত শেষনিশ্বাস ভেসে আছে।
তারপরও সাগরে ভাসছে হাজার হাজার মানুষ। কোনো একটা দেশে তারা নামতে চায়। তাদের নৌযানে পানি নেই, খাবার নেই। তারা মারা যাচ্ছে...উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে...পৃথিবীর সভ্যতার ধ্বজাধারীরা, মানবতার রক্ষকেরা নিয়ম করছেন, হেলিকপ্টার পাঠাও, এতটা অমানবিক আমরা হতে পারি না, হেলিকপ্টার থেকে সমুদ্রের জলে ফেলা হচ্ছে খাবার কিংবা পানির পাত্র, ওই মানুষগুলো জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে উত্তাল সমুদ্রে, একটুখানি খাবারের আশায়, পানির আশায় ওই ছবিও আমরা দেখছি।
কিন্তু নির্দেশ কড়া, একটা মানুষও যেন আমার সীমানায় পা রাখতে না পারে। মরলে মরুক।
তাঁদের কথায় যুক্তি আছে, একজনকে উঠতে দিলে অভিবাসীদের ঢল নামবে।
আমাদেরও যুক্তি আছে। আমরা, বাংলাদেশের মানুষেরাও, রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দিইনি। কয়েক লাখ ঢুকতে দিয়েছি। তাদের ফেরানো যাচ্ছে না। আমাদের দেশে তারা নানা ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ফৌজদারি সমস্যা তৈরি করছে। কেন দেব তাদের আমরা ঢুকতে? তারা তো বাংলাদেশি না। রোহিঙ্গা।
আর মিয়ানমারের শাসক ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ওদের মেরে, জ্বালিয়ে, ধর্ষণ করে, তাদের লক্ষ্মণরেখা এঁকে, তার ভেতরে বন্দী করে, তাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের জমিজমা দখল করা যায়, এথনিক ক্লিনজিং করা যায়, কারণ ওদের ধর্ম আলাদা, ভাষা আলাদা।
তাহলে এই দাঁড়াল আমাদের সভ্যতা, মানবতা, মানবিকতা, মানবাধিকারের কোটি কোটি পাতার ইশতেহারের? আপনার এবং আপনার মতো কবি-সাহিত্যিকদের প্রেমময় পঙ্ক্তিগুলোর? যুগে যুগে প্রেমের বাণী নিয়ে, শান্তির বাণী নিয়ে আসা মহামানবদের অমৃতময় বচন আর শিক্ষাসমূহের?
রবিবাবু, আপনি ভগবানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যারা বায়ুদূষণ করে, মাটিকে বিষাক্ত করে, তাদের কি ভগবান ক্ষমা করে? রবিবাবু, আপনি বলেন, যারা প্যান্ট-শার্ট পরে, নিয়মকানুন রচনা করে, রাষ্ট্র আর বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করে সভ্যতাকে পরিচালনা করছে, তারা কি আদৌ মানুষ?
বিকাশ করে কুড়ি হাজার টাকা পাঠানোর পরে আলাউদ্দিন শেখসহ ১৮ জনকে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁরা সাঁতরে কূলে উঠেছেন।
সেই শালিক পাখিটা অপেক্ষা করছে। ঝিনাইদহে ফিরে যাবেন আলাউদ্দিন। অপেক্ষা করছেন এই রকম হাজার হাজার আলাউদ্দিনের বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন। গোয়ালের গরু কিংবা পোষা বিড়াল।
কত হাজার মরলে পরে, রবিবাবু, বলবে এরা শেষে, বড্ড বেশি মানুষ গেছে আদম পাচারে ভেসে?
আলাউদ্দিন শেখ ফিরে যাবেন ঘরে। শালিক পাখিটা উড়ে এসে বসবে তাঁর কাঁধে। আলাউদ্দিনের মা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবেন তাঁকে। মায়ের আঁচলের গন্ধে আলাউদ্দিন বাক্যহারা হয়ে রইবেন। তাঁর মাও কথা বলতে পারবেন না। দুজনের চার চোখ দিয়ে বয়ে যাবে জলধারা। শালিক পাখিটা আনন্দে উড়তে থাকবে মাথার ওপর দিয়ে।
আমি অপেক্ষা করছি আলাউদ্দিনের ফোনের জন্য, আমার নম্বরটা খুঁজে পেলেই তিনি নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করে বলবেন, ‘ভাইজান, ফিরে এয়েছি।’
রবিবাবু, আলাউদ্দিন শেখের কাহিনিটা সত্য। শালিক পাখি কিংবা আমার সঙ্গে তাঁর মোবাইল ফোনের কথা বলার গল্পটা বানানো। আপনি জানেন, মানুষ যখন সংখ্যা হয়ে যায়, তখনই মানবাধিকারের মৃত্যু ঘটে। আলাউদ্দিনরা যে সংখ্যা নয়, আমাদেরই মতো মানুষ, তা বোঝানোর জন্য কাহিনি কিছুটা আমি বানিয়েছি। কিন্তু আপনি জানেন, এই হাজার হাজার মানুষের প্রত্যেকের জীবনেই আছে এমনি সব মানবিক গল্প।
শুধু রাষ্ট্রগুলো মানুষ বোঝে না, তারা সীমান্ত বোঝে, বৃহত্তর স্বার্থ বোঝে। মানুষ বোঝে না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments