সচিবসহ ৪ জন জড়িত by শেখ মামুনূর রশীদ
মুক্তিযুদ্ধে
বিশেষ অবদান রাখা বিদেশীদের দেয়া সম্মাননার ক্রেস্টে সোনা কম দেয়ার ঘটনায়
জড়িত থাকার অভিযোগে মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকীসহ চার
কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে সংসদীয় তদন্ত কমিটি। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। অভিযুক্ত বাকি তিনজন হলেন-
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আবুল কাশেম তালুকদার,
উপসচিব ও জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব এসএম এনামুল কবির এবং ভারপ্রাপ্ত
প্রশাসনিক কর্মকর্তা (শাখা সহকারী) আবুল কাশেম। এ ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক
মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম এবং
সাবেক সচিব মিজানুর রহমানসহ বাকি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তাদের
কারোরই এ ঘটনায় সম্পৃক্ততা পায়নি সংসদীয় তদন্ত কমিটি। এজন্য তাদের অভিযোগ
থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে।
রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় সংসদীয় তদন্ত কমিটি। সংসদীয় তদন্ত কমিটির সদস্য ইকবালুর রহীম প্রতিবেদনটি জমা দেন। কমিটির আহবায়ক হলেন ডা. মো. আফসারুল আমীন। তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির আরেক সদস্য ছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। প্রতিবেদনে চার দফা সুপারিশ, পর্যালোচনাসহ এ ঘটনার সঙ্গে যাদের যোগসূত্র ছিল তাদের জবানবন্দি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম বর্তমানে এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এ প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হবে।
ক্রেস্টে স্বর্ণ কম দেয়ার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরে এ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়। সংসদ সদস্যদের দাবির মুখে ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম বৈঠকে বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। গত বছরের ২১ মে কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। এরপর ২৪ জুন দ্বিতীয় বৈঠক করেন তারা। পরে ওই বছরই ৬ জুলাই আরও এক দফা বৈঠক হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে প্রতিবেদনটি মূল কমিটির সভাপতির কাছে জমা হয়।
সংসদীয় তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনের অনুলিপি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছেও জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও তারা ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে চলমান আইনানুগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে তাদের প্রতিবেদনে।
এর আগে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংসদীয় তদন্ত কমিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী, অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফা, যুগ্ম সচিব মো. আবুল কাশেম তালুকদার ও মো. গোলাম রহমান মিয়াসহ অভিযুক্ত অন্য কর্মকর্তাদের বৈঠকে তলব করে তদন্ত কমিটি। কমিটির সদস্যরা এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য শোনেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদফতরের মহাপরিচালক একেএম জসীম উদ্দিন, ঢাকার সাবেক বিভাগীয় কমিশনার এবং ওই ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মো. জিল্লার রহমান, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহউদ্দীননেরও বক্তব্য নেন।
এছাড়াও বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মো. মজিবর রহমান আল মামুন, পুলিশ সুপার (সিআইডি) শেখ মো. রেজাউল হায়দার, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আশরাফুল ইসলাম, ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকনের প্রতিনিধি মীর দাউদ আহমেদ এবং মেসার্স মহসিনুল হাসানের মালিক মহসিনুল হাসানের বক্তব্য শোনেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এর বাইরে ক্রেস্ট বিতরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত, ক্রেস্ট তৈরির স্পেসিফিকেশন এবং প্রয়োজনী ফাইল ও ক্রেস্ট সম্পর্কিত যাবতীয় কাগজ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন।
সংসদীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিটিকে জানানো হয়, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তি এবং সংগঠনকে বাংলাদেশ জাতীয় সম্মাননা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাতটি পর্যায়ে তিনটি ক্যাটাগরিতে সর্বমোট ৩৩৮ জন বরেণ্য ব্যক্তি এবং সংগঠনকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের এ উদ্যোগ দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। শিল্পী মো. হাশেম খান এবং অধ্যাপক কাইয়ুম চৌধুরী কর্তৃক প্রণীত ডিজাইন/নকশা অনুযায়ী স্বর্ণ খচিত সম্মাননা স্মারক তৈরি করা হয়। প্রতিটি সম্মাননা স্মারকে ৩০ ভরি রুপা এবং ২২ দশমিক ৫ গ্রাম স্বর্ণ থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল।
বিষয়টি সম্পর্কে সংসদীয় তদন্ত কমিটিকে ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকনের প্রতিনিধি মীর দাউদ আহমেদ বলেন, ছয়টি অনুষ্ঠানের জন্য তারা মোট ২৬৭টি ক্রেস্ট সরবরাহ করেন। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিপত্র এবং মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া কার্যাদেশ প্রাপ্তির মাধ্যমে তারা ক্রেস্ট সরবরাহ করেন। তিনি তদন্ত কমিটিকে আরও বলেন, তারা নিজেরাই স্বর্ণ ক্রয় করেছেন। প্রতিটি ক্রেস্টের স্বর্ণের পরিমাণ চুক্তিপত্র এবং কোটেশনে উল্লেখ রয়েছে। তাদের সরবরাহ করা প্রতিটি ক্রেস্টের মূল্য সমান নয়। বিভিন্ন পর্বে এ মূল্যের পার্থক্য রয়েছে।
ক্রেস্ট সরবরাহকারী আরেক প্রতিষ্ঠান মেসার্স মহসিনুর রহমানের মালিক মহসিনুল হাসান তদন্ত কমিটিকে বলেন, তিনি সর্বশেষ পর্ব অর্থাৎ সপ্তম পর্বে ৬১টি ক্রেস্ট সরবরাহ করেন। ক্রেস্ট তৈরির জন্য তার নিজস্ব কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তিনি মূলত একজন সরবরাহকারী। সরকারি সরবরাহের কাজে তার অভিজ্ঞতা না থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্রেস্ট সরবরাহের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার সরবরাহ করা প্রতিটি ক্রেস্টের দাম ২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
এ ঘটনায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও যুগ্ম সচিব মো. মজিবর রহমান আল মামুন তদন্ত কমিটিকে বলেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকনের ক্রেস্ট তৈরির কারখানা রয়েছে। কিন্তু মেসার্স মহসিনুল হাসানের কোনো নিজস্ব কারখানা নেই। তার জুয়েলারি লাইসেন্সও নেই। তিনি একজন সরবরাহকারী। তিনি তদন্ত কমিটিকে আরও বলেন, প্রতিটি ক্রেস্টে ২২ দশমিক ৫ গ্রাম (প্রায় দুই ভরি) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা। বিএসটিআই তৃতীয় পর্বের একটি ক্রেস্ট পরীক্ষা করে। তাতে ২ দশমিক ৬৩ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনো রুপা পাওয়া যায়নি। নির্মিত ক্রেস্টে নির্ধারিত বিভিন্ন ধাতুর পরিমাণ নিশ্চিত হয়ে বিল পরিশোধের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিমাণ ও গুণগত মান সঠিক আছে উল্লেখ করে বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ওই ঘটনায় সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও ঢাকার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. জিল্লার রহমান কমিটিকে বলেন, সরকারের নির্দেশে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং প্রাপ্ত কাগজপত্রের আলোকে তারা রিপোর্ট দিয়েছেন।
সংসদয়ী তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়ে বলেন, তৃতীয় পর্বে অনুষ্ঠানের আগেই তিনি এ মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে যোগদান করেন। কার্যাদেশ প্রদানের মাধ্যমে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্রেস্ট সরবরাহ করা হয়েছে। চুক্তিপত্র ও কার্যাদেশ অনুসারে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী প্রতিটি ক্রেস্ট তৈরি করে দিতে বাধ্য। তিনি জানান, ক্রেস্টের বিল পরিশোধ তার সময়ে হয়েছে। বিএসটিআইয়ে ক্রেস্ট পরীক্ষার বিল বাবদ ৩ হাজার ৯৭৮ টাকা পরিশোধের বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মিজানুর রহমান তদন্ত কমিটিকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদানসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় বিদেশী নাগরিক ও সংস্থাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ সম্মাননা স্মারক জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। কার্যাদেশ ও চুক্তিপত্র অনুযায়ী প্রতিটি ক্রেস্টে প্রায় ২ ভরি স্বর্ণ ও ৩০ ভরি জার্মান রুপা দিয়ে নির্মাণ করার কথা। সময় স্বল্পতা এবং রাষ্ট্রীয় অতি জরুরি প্রয়োজনে পিপিআর অনুযায়ী সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্রেস্টগুলো সরবরাহ নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে একজন যুগ্ম-সচিব, একজন উপ-সচিব ও একজন সিনিয়র সহকারী সচিবের সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ছিল। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকন কর্তৃক একটি নমুনা ক্রেস্ট জাতীয় কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়, যা সম্পূর্ণ সঠিক মর্মে সবার নিকট প্রতীয়মান হয়।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম কমিটিকে বলেন, জাতীয় কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল যে, এমিকন ক্রেস্ট সরবরাহ করবে। বাকি কাজগুলো মন্ত্রণালয় করেছে।
সংসদীয় তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ : সংসদীয় তদন্ত কমিটির পর্যালোচনায় বলা হয়, সময় স্বল্পতার কারণে জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিপিআরের সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে ৩৪৪টি ক্রেস্ট প্রস্তুত করা হয়। জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সম্মাননা প্রাপ্ত বিদেশী বন্ধুদের চূড়ান্ত তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তুত করা হয়। চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের পর সম্মাননা প্রদানের প্রতিটি পর্বেই ৭ থেকে ১০ দিনের বেশি সময় না থাকায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ৩৪৪টি ক্রেস্টের মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট তৈরি করেছে এমিকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান। ক্রেস্টগুলো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. আবুল কাসেম তালুকদারের পিও, স্টোর-কিপার এবং অ্যাকাউন্টস অফিসার কর্তৃক বুঝে নেয়া হয়।
কমিটির পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, প্রতিটি ক্রেস্টে ২২ দশমিক ৫ গ্রাম, প্রায় দুই ভরি স্বর্ণ ও ৩০ ভরি জার্মান সিলভার (রুপা) থাকার কথা। বিএসটিআই তৃতীয় পর্বের ১টি ক্রেস্ট পরীক্ষা করে। তাতে মাত্র ২ দশমিক ৬৩ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া গেছে। তৃতীয় পর্বের কার্যাদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, স্বর্ণ এবং জার্মান সিলভারের (রুপা) সমন্বয়ে ক্রেস্ট তৈরি করার কথা। বিএসটিআইয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ক্রেস্টে স্বর্ণের পরিমাণ অনেক কম দেয়া হয়েছে। নির্মিত ক্রেস্টে নির্ধারিত বিভিন্ন ধাতুর পরিমাণ কম দেয়ার বিষয়টি একটি জঘন্য অপরাধ যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
কমিটি তাদের পর্যালোচনায় বলে, মন্ত্রণালয় কর্তৃক দাখিলকৃত নথিপত্র, কর্মকর্তাদের জবানবন্দি এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সরবারহকারীর কাছ থেকে ক্রেস্ট গ্রহণকারী, গ্রহণের পর বিদেশী অতিথিদের মধ্যে ক্রেস্ট বিতরণকারী এবং তৃতীয় পর্বের ১টি ক্রেস্ট বিএসটিআইতে পরীক্ষার জন্য প্রেরণকারী কর্মকর্তারা একই উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। ক্রেস্টে স্বর্ণের পরিমাণ সঠিক রয়েছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে বিএসটিআইর পরীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা একান্ত আবশ্যক। সংশ্লিষ্ট শাখার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ক্রেস্ট পরীক্ষার জন্য বিএসটিআইতে প্রেরণ করা হয়। এর অনুলিপি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বা কমিটির আহ্বায়ককে দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট শাখা বিএসটিআইর প্রতিবেদনটি পাওয়ার পর ২০১২ সালের ১ নভেম্বর শাখার সহকারী (ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা) মো. আবুল কাশেম উপস্থাপন করেন।
একই তারিখে শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপসচিব এসএম এনামুল কবির, যুগ্মসচিব ও জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব মো. আবুল কাসেম তালুকদার এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী নোটে স্বাক্ষর করেন। কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী নোটে প্রতিমন্ত্রীকে মার্ক করার জন্য ‘মাননী’ পর্যন্ত লিখে তা কেটে যুগ্মসচিবকে মার্ক করে নিচে পাঠিয়ে দেন। একই দিন যুগ্মসচিব উপসচিবকে মার্ক করেন এবং উপসচিব একই বছর ৫ নভেম্বর স্বাক্ষর করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে মার্ক করেন। বিএসটিআইর প্রতিবেদনটি যেহেতু ক্রেস্টের গুণগত মান ও পরিমাণ নির্ণয়ের মাপকাঠি, যা যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত অপরিহার্য এবং তাদের দায়দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
কমিটির সুপরিশ : সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখার পর সংসদীয় তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সচিবকে রেহাই দিয়ে প্রতিবেদন দেয়। সম্মাননা অনুষ্ঠানের মাত্র দুই দিন আগে ক্রেস্ট পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে এবং পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পরও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করে অনিয়মের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চার কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করেছেন বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। এজন্য মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী, যুগ্ম-সচিব মো. আবুল কাসেম তালুকদার (জাতীয় কমিটির সদস্য-সচিব), উপসচিব এসএম এনামুল কবির এবং শখা সহকারী (ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা) আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা, ক্রেস্ট পরীক্ষা রিপোর্ট গোপন করে যে গুরুতর অন্যায় করেছেন সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।
রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় সংসদীয় তদন্ত কমিটি। সংসদীয় তদন্ত কমিটির সদস্য ইকবালুর রহীম প্রতিবেদনটি জমা দেন। কমিটির আহবায়ক হলেন ডা. মো. আফসারুল আমীন। তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির আরেক সদস্য ছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। প্রতিবেদনে চার দফা সুপারিশ, পর্যালোচনাসহ এ ঘটনার সঙ্গে যাদের যোগসূত্র ছিল তাদের জবানবন্দি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম বর্তমানে এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এ প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হবে।
ক্রেস্টে স্বর্ণ কম দেয়ার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরে এ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়। সংসদ সদস্যদের দাবির মুখে ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম বৈঠকে বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। গত বছরের ২১ মে কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। এরপর ২৪ জুন দ্বিতীয় বৈঠক করেন তারা। পরে ওই বছরই ৬ জুলাই আরও এক দফা বৈঠক হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে প্রতিবেদনটি মূল কমিটির সভাপতির কাছে জমা হয়।
সংসদীয় তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনের অনুলিপি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছেও জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও তারা ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে চলমান আইনানুগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে তাদের প্রতিবেদনে।
এর আগে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংসদীয় তদন্ত কমিটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী, অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফা, যুগ্ম সচিব মো. আবুল কাশেম তালুকদার ও মো. গোলাম রহমান মিয়াসহ অভিযুক্ত অন্য কর্মকর্তাদের বৈঠকে তলব করে তদন্ত কমিটি। কমিটির সদস্যরা এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য শোনেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদফতরের মহাপরিচালক একেএম জসীম উদ্দিন, ঢাকার সাবেক বিভাগীয় কমিশনার এবং ওই ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মো. জিল্লার রহমান, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহউদ্দীননেরও বক্তব্য নেন।
এছাড়াও বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মো. মজিবর রহমান আল মামুন, পুলিশ সুপার (সিআইডি) শেখ মো. রেজাউল হায়দার, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আশরাফুল ইসলাম, ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকনের প্রতিনিধি মীর দাউদ আহমেদ এবং মেসার্স মহসিনুল হাসানের মালিক মহসিনুল হাসানের বক্তব্য শোনেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এর বাইরে ক্রেস্ট বিতরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত, ক্রেস্ট তৈরির স্পেসিফিকেশন এবং প্রয়োজনী ফাইল ও ক্রেস্ট সম্পর্কিত যাবতীয় কাগজ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন।
সংসদীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিটিকে জানানো হয়, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তি এবং সংগঠনকে বাংলাদেশ জাতীয় সম্মাননা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাতটি পর্যায়ে তিনটি ক্যাটাগরিতে সর্বমোট ৩৩৮ জন বরেণ্য ব্যক্তি এবং সংগঠনকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের এ উদ্যোগ দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। শিল্পী মো. হাশেম খান এবং অধ্যাপক কাইয়ুম চৌধুরী কর্তৃক প্রণীত ডিজাইন/নকশা অনুযায়ী স্বর্ণ খচিত সম্মাননা স্মারক তৈরি করা হয়। প্রতিটি সম্মাননা স্মারকে ৩০ ভরি রুপা এবং ২২ দশমিক ৫ গ্রাম স্বর্ণ থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল।
বিষয়টি সম্পর্কে সংসদীয় তদন্ত কমিটিকে ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকনের প্রতিনিধি মীর দাউদ আহমেদ বলেন, ছয়টি অনুষ্ঠানের জন্য তারা মোট ২৬৭টি ক্রেস্ট সরবরাহ করেন। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিপত্র এবং মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া কার্যাদেশ প্রাপ্তির মাধ্যমে তারা ক্রেস্ট সরবরাহ করেন। তিনি তদন্ত কমিটিকে আরও বলেন, তারা নিজেরাই স্বর্ণ ক্রয় করেছেন। প্রতিটি ক্রেস্টের স্বর্ণের পরিমাণ চুক্তিপত্র এবং কোটেশনে উল্লেখ রয়েছে। তাদের সরবরাহ করা প্রতিটি ক্রেস্টের মূল্য সমান নয়। বিভিন্ন পর্বে এ মূল্যের পার্থক্য রয়েছে।
ক্রেস্ট সরবরাহকারী আরেক প্রতিষ্ঠান মেসার্স মহসিনুর রহমানের মালিক মহসিনুল হাসান তদন্ত কমিটিকে বলেন, তিনি সর্বশেষ পর্ব অর্থাৎ সপ্তম পর্বে ৬১টি ক্রেস্ট সরবরাহ করেন। ক্রেস্ট তৈরির জন্য তার নিজস্ব কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তিনি মূলত একজন সরবরাহকারী। সরকারি সরবরাহের কাজে তার অভিজ্ঞতা না থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্রেস্ট সরবরাহের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার সরবরাহ করা প্রতিটি ক্রেস্টের দাম ২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
এ ঘটনায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও যুগ্ম সচিব মো. মজিবর রহমান আল মামুন তদন্ত কমিটিকে বলেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকনের ক্রেস্ট তৈরির কারখানা রয়েছে। কিন্তু মেসার্স মহসিনুল হাসানের কোনো নিজস্ব কারখানা নেই। তার জুয়েলারি লাইসেন্সও নেই। তিনি একজন সরবরাহকারী। তিনি তদন্ত কমিটিকে আরও বলেন, প্রতিটি ক্রেস্টে ২২ দশমিক ৫ গ্রাম (প্রায় দুই ভরি) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা। বিএসটিআই তৃতীয় পর্বের একটি ক্রেস্ট পরীক্ষা করে। তাতে ২ দশমিক ৬৩ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনো রুপা পাওয়া যায়নি। নির্মিত ক্রেস্টে নির্ধারিত বিভিন্ন ধাতুর পরিমাণ নিশ্চিত হয়ে বিল পরিশোধের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিমাণ ও গুণগত মান সঠিক আছে উল্লেখ করে বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ওই ঘটনায় সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও ঢাকার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. জিল্লার রহমান কমিটিকে বলেন, সরকারের নির্দেশে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং প্রাপ্ত কাগজপত্রের আলোকে তারা রিপোর্ট দিয়েছেন।
সংসদয়ী তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়ে বলেন, তৃতীয় পর্বে অনুষ্ঠানের আগেই তিনি এ মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে যোগদান করেন। কার্যাদেশ প্রদানের মাধ্যমে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্রেস্ট সরবরাহ করা হয়েছে। চুক্তিপত্র ও কার্যাদেশ অনুসারে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী প্রতিটি ক্রেস্ট তৈরি করে দিতে বাধ্য। তিনি জানান, ক্রেস্টের বিল পরিশোধ তার সময়ে হয়েছে। বিএসটিআইয়ে ক্রেস্ট পরীক্ষার বিল বাবদ ৩ হাজার ৯৭৮ টাকা পরিশোধের বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মিজানুর রহমান তদন্ত কমিটিকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদানসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় বিদেশী নাগরিক ও সংস্থাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ সম্মাননা স্মারক জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। কার্যাদেশ ও চুক্তিপত্র অনুযায়ী প্রতিটি ক্রেস্টে প্রায় ২ ভরি স্বর্ণ ও ৩০ ভরি জার্মান রুপা দিয়ে নির্মাণ করার কথা। সময় স্বল্পতা এবং রাষ্ট্রীয় অতি জরুরি প্রয়োজনে পিপিআর অনুযায়ী সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্রেস্টগুলো সরবরাহ নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে একজন যুগ্ম-সচিব, একজন উপ-সচিব ও একজন সিনিয়র সহকারী সচিবের সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি ছিল। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকন কর্তৃক একটি নমুনা ক্রেস্ট জাতীয় কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়, যা সম্পূর্ণ সঠিক মর্মে সবার নিকট প্রতীয়মান হয়।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম কমিটিকে বলেন, জাতীয় কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল যে, এমিকন ক্রেস্ট সরবরাহ করবে। বাকি কাজগুলো মন্ত্রণালয় করেছে।
সংসদীয় তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ : সংসদীয় তদন্ত কমিটির পর্যালোচনায় বলা হয়, সময় স্বল্পতার কারণে জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিপিআরের সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে ৩৪৪টি ক্রেস্ট প্রস্তুত করা হয়। জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সম্মাননা প্রাপ্ত বিদেশী বন্ধুদের চূড়ান্ত তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তুত করা হয়। চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের পর সম্মাননা প্রদানের প্রতিটি পর্বেই ৭ থেকে ১০ দিনের বেশি সময় না থাকায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ৩৪৪টি ক্রেস্টের মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট তৈরি করেছে এমিকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান। ক্রেস্টগুলো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. আবুল কাসেম তালুকদারের পিও, স্টোর-কিপার এবং অ্যাকাউন্টস অফিসার কর্তৃক বুঝে নেয়া হয়।
কমিটির পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, প্রতিটি ক্রেস্টে ২২ দশমিক ৫ গ্রাম, প্রায় দুই ভরি স্বর্ণ ও ৩০ ভরি জার্মান সিলভার (রুপা) থাকার কথা। বিএসটিআই তৃতীয় পর্বের ১টি ক্রেস্ট পরীক্ষা করে। তাতে মাত্র ২ দশমিক ৬৩ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া গেছে। তৃতীয় পর্বের কার্যাদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, স্বর্ণ এবং জার্মান সিলভারের (রুপা) সমন্বয়ে ক্রেস্ট তৈরি করার কথা। বিএসটিআইয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ক্রেস্টে স্বর্ণের পরিমাণ অনেক কম দেয়া হয়েছে। নির্মিত ক্রেস্টে নির্ধারিত বিভিন্ন ধাতুর পরিমাণ কম দেয়ার বিষয়টি একটি জঘন্য অপরাধ যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
কমিটি তাদের পর্যালোচনায় বলে, মন্ত্রণালয় কর্তৃক দাখিলকৃত নথিপত্র, কর্মকর্তাদের জবানবন্দি এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সরবারহকারীর কাছ থেকে ক্রেস্ট গ্রহণকারী, গ্রহণের পর বিদেশী অতিথিদের মধ্যে ক্রেস্ট বিতরণকারী এবং তৃতীয় পর্বের ১টি ক্রেস্ট বিএসটিআইতে পরীক্ষার জন্য প্রেরণকারী কর্মকর্তারা একই উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। ক্রেস্টে স্বর্ণের পরিমাণ সঠিক রয়েছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে বিএসটিআইর পরীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা একান্ত আবশ্যক। সংশ্লিষ্ট শাখার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ক্রেস্ট পরীক্ষার জন্য বিএসটিআইতে প্রেরণ করা হয়। এর অনুলিপি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বা কমিটির আহ্বায়ককে দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট শাখা বিএসটিআইর প্রতিবেদনটি পাওয়ার পর ২০১২ সালের ১ নভেম্বর শাখার সহকারী (ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা) মো. আবুল কাশেম উপস্থাপন করেন।
একই তারিখে শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপসচিব এসএম এনামুল কবির, যুগ্মসচিব ও জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব মো. আবুল কাসেম তালুকদার এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী নোটে স্বাক্ষর করেন। কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী নোটে প্রতিমন্ত্রীকে মার্ক করার জন্য ‘মাননী’ পর্যন্ত লিখে তা কেটে যুগ্মসচিবকে মার্ক করে নিচে পাঠিয়ে দেন। একই দিন যুগ্মসচিব উপসচিবকে মার্ক করেন এবং উপসচিব একই বছর ৫ নভেম্বর স্বাক্ষর করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে মার্ক করেন। বিএসটিআইর প্রতিবেদনটি যেহেতু ক্রেস্টের গুণগত মান ও পরিমাণ নির্ণয়ের মাপকাঠি, যা যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত অপরিহার্য এবং তাদের দায়দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
কমিটির সুপরিশ : সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখার পর সংসদীয় তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সচিবকে রেহাই দিয়ে প্রতিবেদন দেয়। সম্মাননা অনুষ্ঠানের মাত্র দুই দিন আগে ক্রেস্ট পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে এবং পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পরও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করে অনিয়মের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চার কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করেছেন বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। এজন্য মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকী, যুগ্ম-সচিব মো. আবুল কাসেম তালুকদার (জাতীয় কমিটির সদস্য-সচিব), উপসচিব এসএম এনামুল কবির এবং শখা সহকারী (ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা) আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা, ক্রেস্ট পরীক্ষা রিপোর্ট গোপন করে যে গুরুতর অন্যায় করেছেন সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।
No comments