বৃত্ত ভাঙার বাজেট আসছে by মিজান চৌধুরী
গতবারের আশাবাদের বাজেট থেকে এবার
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কঠিন স্বপ্নবিলাসী এক বাজেটের দিকে
যাত্রা শুরু করেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো ও
দারিদ্র্যের হার কমাতে প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়ানোর কৌশল নিয়েছেন। এজন্য মোট
দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের গত ৬ বছরের প্রচলিত ধারা বা ছক
কিংবা বৃত্ত ভেঙে নতুন চ্যালেঞ্জের পথে যাত্রার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। এই
লক্ষ্য নিয়েই আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের কাঠামো চূড়ান্ত
করেছেন। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদের ৫ বছরের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের
ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছরেও প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের
ঘর অতিক্রম করতে পারেনি। প্রবৃদ্ধির হারের গত দীর্ঘ সময়ের বৃত্ত ভেঙে আগামী
অর্থবছরে সরকার ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে
যাচ্ছে। এ লক্ষ্য যাতে অর্জিত হয় সেজন্য সব ধরনের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়ার
নির্দেশনাও মন্ত্রণালয়গুলোতে ইতিমধ্যে দেয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে সরকার গতানুগতিক বাজেটের কাঠামো থেকেও বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। তবে বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী হিসাবেই অনেকে মনে করছেন। কেননা বাজেটের আকার যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ঘাটতির পরিমাণ। এই বিশাল অংকের ঘাটতির বাজেট দিয়ে সরকার আগামী অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, পিপিপিকে আরও কার্যকর করা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পূর্ণ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিচ্ছে। চার বছর ধরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা হলেও বাস্তবে ৬ শতাংশের ছকেই রয়েছে। নতুন বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে।
পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ছক ভেঙে তিনি আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের উচ্চতর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিরূপণ করেছেন। ওই সময়ে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৫ শতাংশ ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ নির্ধারণ করে আশার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আগামী ৪ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করবেন। ইতিমধ্যে প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন প্রায় শেষ করেছেন। বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়ছে প্রায় পৌনে ১৮ শতাংশ। তবে গত শুক্রবার অর্থমন্ত্রী সিলেটে সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী বাজেটের আকার ৩ লাখ কোটি টাকার সামান্য বেশি হবে। বিশাল এ ব্যয় মেটাতে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই রাজস্ব আদায় করতে সরকারকে করের জাল আরও বাড়াতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকায় ঘাটতির পরিমাণও হচ্ছে রেকর্ড পরিমাণে। ্আগামীতে এই ঘাটতি বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮৬ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশের বেশি। বুধবার প্রস্তাবিত এ বাজেট প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদসহ বাজেট সংশ্লিষ্ট অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সম্ভাব্য এ বাজেটের তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ শতাংশ। টাকার মূল্যে জিডিপি হচ্ছে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। চলতি মূল্যের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পাওয়া ও দ্রব্যমূল্য কম থাকায় আগামী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় রাখতে বাজেটে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাাপক কর্মসংস্থান বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করা, বিনিয়োগ বাড়ানোর জটিলতা দূর করা, জমির অভাব মেটানো এবং ঋণের সুদের হার কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেট পরিসংখ্যান : অর্থমন্ত্রী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ২ লাখ ৯৫ হাজার ১৮ কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন। এ বাজেট জিডিপির ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। একই সঙ্গে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৯৮ হাজার ১৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে থাকছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৪২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, সরবরাহ ও সেবা খাতে ২০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা, ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ৩৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, সরকারি প্রণোদনা, ভর্তুকি ও নগদ ঋণ বাবদ ২৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে ৭৫ হাজার ৩১ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এছাড়া এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়নে এডিপি বাস্তবায়নের পক্ষে এর আকার আরও বেড়ে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
রাজস্ব আদায় : প্রস্তাবিত বাজেটে করের পরিমাণ বাড়ানো হবে না। তবে করের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সরকারের ব্যয় বাড়ার কারণে আয় বাড়াতে গিয়ে করের আওতা বাড়াতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সম্ভাব্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এ রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব হচ্ছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব হচ্ছে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব (এনবিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির এক দশমিক ৫ শতাংশ।
ঘাটতি বাজেট : বিশাল ঘাটতি রেখে আগামী বাজেটে তৈরি করা হয়েছে। সম্ভাব্য ঘাটতি অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৮৬ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা মোট জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি বাজেট চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা বেশি। এ ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ৩০ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে সরকার। বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা, বৈদেশিক অনুদান হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা এবং ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা।
ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হবে ৫৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হবে ৩৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নেয়া হবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি : প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি। নতুন এডিপিতে প্রকল্প সহায়তার পরিমাণ হচ্ছে ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হচ্ছে স্থানীয় মুদ্রায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এডিপিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে চলতি অর্থবছরের সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্প, পদ্মা সেতুসহ ফাস্ট ট্রাক মনিটরিং, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তি প্রকল্পগুলো।
অগ্রাধিকার পাচ্ছে যেসব খাত : প্রস্তাবিত বাজেটে মানবসম্পদ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। প্রথম অগ্রাধিকার থাকছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, রেলপথ ও বন্দরসহ সার্বিক ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন। কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানে থাকছে তৃতীয় অগ্রাধিকার খাত হিসেবে। চতুর্থ অগ্রাধিকার তালিকায় থাকছে সরকারি সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন। পর্যায়ক্রমে জলবায়ু মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন ও বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সুযোগ অধিকতর ব্যবহার ও প্রবাস আয় বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন রফতানির বাজার অনুসন্ধান।
উচ্চ প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন : কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বর্তমানে ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। আগামী ২০১৯-২০ সালে এ প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সময় শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী বাজেটে উচ্চ প্রবৃদ্ধির স্বপ্নের এই ঘোষণা অর্থমন্ত্রী দেবেন বলে জানা গেছে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে তিনি একটি রূপরেখা তৈরি করেছেন। এই রূপরেখায় বিনিয়োগের মাধ্যমে মূলধন মজুদ বৃদ্ধি, সরকারি বিনিয়োগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা, পরিবহন, যোগাযোগ, বন্দর উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইসিটি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এডিপি পূর্ণ বাস্তবায়ন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কার্যক্রমের গতিশীল আনয়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা দূর, শ্রমশক্তির দক্ষ উন্নয়ন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ, বহির্বাজার সম্প্রসারণ, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের কথা থাকছে।
এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীল বজায় রাখার ঘোষণা থাকছে প্রস্তাবিত বাজেটে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি সহনশীল রাখা, বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মুদ্রা বিনিময় হার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে রাখার কথা বলা হয়। পাশাপাশি পদ্মা সেতুসহ ফাস্ট ট্রাক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন, রাজস্ব খাতের পরিকল্পিত সংস্কার কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রফতানি বাড়ানোর প্রয়াস অব্যাহত ও জোরদার এবং সঠিক সময়ে এডিবি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে সরকার গতানুগতিক বাজেটের কাঠামো থেকেও বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। তবে বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী হিসাবেই অনেকে মনে করছেন। কেননা বাজেটের আকার যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ঘাটতির পরিমাণ। এই বিশাল অংকের ঘাটতির বাজেট দিয়ে সরকার আগামী অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, পিপিপিকে আরও কার্যকর করা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পূর্ণ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিচ্ছে। চার বছর ধরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা হলেও বাস্তবে ৬ শতাংশের ছকেই রয়েছে। নতুন বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে।
পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ছক ভেঙে তিনি আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের উচ্চতর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিরূপণ করেছেন। ওই সময়ে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৫ শতাংশ ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ নির্ধারণ করে আশার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আগামী ৪ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করবেন। ইতিমধ্যে প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন প্রায় শেষ করেছেন। বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়ছে প্রায় পৌনে ১৮ শতাংশ। তবে গত শুক্রবার অর্থমন্ত্রী সিলেটে সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী বাজেটের আকার ৩ লাখ কোটি টাকার সামান্য বেশি হবে। বিশাল এ ব্যয় মেটাতে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই রাজস্ব আদায় করতে সরকারকে করের জাল আরও বাড়াতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকায় ঘাটতির পরিমাণও হচ্ছে রেকর্ড পরিমাণে। ্আগামীতে এই ঘাটতি বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮৬ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশের বেশি। বুধবার প্রস্তাবিত এ বাজেট প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদসহ বাজেট সংশ্লিষ্ট অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সম্ভাব্য এ বাজেটের তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ শতাংশ। টাকার মূল্যে জিডিপি হচ্ছে ১৭ লাখ ১৬ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। চলতি মূল্যের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পাওয়া ও দ্রব্যমূল্য কম থাকায় আগামী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় রাখতে বাজেটে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাাপক কর্মসংস্থান বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করা, বিনিয়োগ বাড়ানোর জটিলতা দূর করা, জমির অভাব মেটানো এবং ঋণের সুদের হার কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেট পরিসংখ্যান : অর্থমন্ত্রী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ২ লাখ ৯৫ হাজার ১৮ কোটি টাকা বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন। এ বাজেট জিডিপির ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। একই সঙ্গে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৯৮ হাজার ১৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে থাকছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৪২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, সরবরাহ ও সেবা খাতে ২০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা, ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ৩৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, সরকারি প্রণোদনা, ভর্তুকি ও নগদ ঋণ বাবদ ২৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে ৭৫ হাজার ৩১ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এছাড়া এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়নে এডিপি বাস্তবায়নের পক্ষে এর আকার আরও বেড়ে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
রাজস্ব আদায় : প্রস্তাবিত বাজেটে করের পরিমাণ বাড়ানো হবে না। তবে করের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সরকারের ব্যয় বাড়ার কারণে আয় বাড়াতে গিয়ে করের আওতা বাড়াতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সম্ভাব্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এ রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব হচ্ছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব হচ্ছে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব (এনবিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির এক দশমিক ৫ শতাংশ।
ঘাটতি বাজেট : বিশাল ঘাটতি রেখে আগামী বাজেটে তৈরি করা হয়েছে। সম্ভাব্য ঘাটতি অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৮৬ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা মোট জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি বাজেট চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা বেশি। এ ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ৩০ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে সরকার। বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা, বৈদেশিক অনুদান হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা এবং ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা।
ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হবে ৫৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হবে ৩৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নেয়া হবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি : প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি। নতুন এডিপিতে প্রকল্প সহায়তার পরিমাণ হচ্ছে ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হচ্ছে স্থানীয় মুদ্রায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এডিপিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে চলতি অর্থবছরের সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্প, পদ্মা সেতুসহ ফাস্ট ট্রাক মনিটরিং, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তি প্রকল্পগুলো।
অগ্রাধিকার পাচ্ছে যেসব খাত : প্রস্তাবিত বাজেটে মানবসম্পদ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। প্রথম অগ্রাধিকার থাকছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, রেলপথ ও বন্দরসহ সার্বিক ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন। কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানে থাকছে তৃতীয় অগ্রাধিকার খাত হিসেবে। চতুর্থ অগ্রাধিকার তালিকায় থাকছে সরকারি সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন। পর্যায়ক্রমে জলবায়ু মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন ও বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সুযোগ অধিকতর ব্যবহার ও প্রবাস আয় বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন রফতানির বাজার অনুসন্ধান।
উচ্চ প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন : কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বর্তমানে ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। আগামী ২০১৯-২০ সালে এ প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সময় শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী বাজেটে উচ্চ প্রবৃদ্ধির স্বপ্নের এই ঘোষণা অর্থমন্ত্রী দেবেন বলে জানা গেছে।
উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে তিনি একটি রূপরেখা তৈরি করেছেন। এই রূপরেখায় বিনিয়োগের মাধ্যমে মূলধন মজুদ বৃদ্ধি, সরকারি বিনিয়োগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা, পরিবহন, যোগাযোগ, বন্দর উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইসিটি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এডিপি পূর্ণ বাস্তবায়ন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কার্যক্রমের গতিশীল আনয়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা দূর, শ্রমশক্তির দক্ষ উন্নয়ন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ, বহির্বাজার সম্প্রসারণ, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের কথা থাকছে।
এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীল বজায় রাখার ঘোষণা থাকছে প্রস্তাবিত বাজেটে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি সহনশীল রাখা, বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, মুদ্রা বিনিময় হার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে রাখার কথা বলা হয়। পাশাপাশি পদ্মা সেতুসহ ফাস্ট ট্রাক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন, রাজস্ব খাতের পরিকল্পিত সংস্কার কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রফতানি বাড়ানোর প্রয়াস অব্যাহত ও জোরদার এবং সঠিক সময়ে এডিবি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে।
No comments