যেখানে খুনিদের রাজত্ব by ওবায়েদ অংশুমান
খুনের দায়ে অভিযুক্ত (বাঁ থেকে ) আজগর, সোহরাব ও হাবিবুর |
যুগের পর যুগ বিচার হয়নি ছিটমহলে ৩৬ হত্যাকাণ্ডের পঞ্চায়েত কমিটির সালিশে জরিমানা দিয়েই মুক্ত
‘মানুষ
মারি ফেলেয়া ব্যাহে ছিটের লোকগুলা বুক ফুলিয়া বেড়াই। কাইও ওমাক কোনো কথা
কবার সাহস পায় না। হামার এদিক কোনো আদালতও নাই, বিচারও নাই। এটি কোনো বিচার
না থাকিয়া ব্যাহে ওমরা সারা জীবন হামাক হুমকি দিয়ে যাবার নাগছে। যারা
মানুষ মারে ফেলায় ছিটমহলে তামার দাপট বেশি। এখন বাংলাদেশ হইছে, হামার
স্বামীক যারা খুন করেছে তার বিচার চাই।’
কথাগুলো যুগান্তরের কাছে বলছিলেন কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা জোহরা বেগম। ১৫ মে এ ছিটমহলের নিজ বাসায় ক্ষোভের কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে জোহরা জানান, তার স্বামী শরীয়ত উল্লাহ ৪৩ বছর আগে খুন হন। কিন্তু বিচার পাননি।
শুধু শরীয়ত উল্লাহ নন, গত ৪৫ বছরে তার মতো আরও ৩৬টি খুনের ঘটনা ঘটে ছিটমহলে। অদ্যাবধি বিচার হয়নি একটি খুনেরও। বরং খুনিরা এলাকায় যুগ যুগ ধরে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি তারা নিহতদের নিকটাত্মীয়দের হুমকি দিয়ে ছিটমহলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বসবাস করছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘এ খুনগুলোর ব্যাপারে আমরা যখন নালিশ পাব তখন বিষয়টি খতিয়ে দেখব। কেননা কোনো ফৌজদারি অপরাধ তামাদি হয় না। এখানে দুটো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। মার্ডারগুলো সংঘটিত হয়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডে আবার আইনে যখন এটা বাংলাদেশের ভূখণ্ড হবে, তখন প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হবে। আমার মনে হয়, এ দুটো বিষয় চুক্তির মধ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে। তখন এ ব্যাপারটি আমরা দেখব।’
ছিটমহলবাসীর দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহলে সংঘটিত খুন-ডাকাতির কোনো ঘটনারই সরকারি তদন্ত হয়নি। ভারতের সরকারি কোনো তদন্ত সংস্থা এসব ঘটনার তদন্ত করেনি। আবার কাঁটাতারের বেড়ার কারণে ভুক্তভোগী ছিটমহলবাসীও ভারতের সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। তবে ছিটমহলের কথিত পঞ্চায়েত কমিটির চেয়ারম্যানরা খুনের ঘটনার বিচার করেছেন। নামমাত্র জরিমানা করে খুনিদের খালাস দেন তারা।
কয়েকটি খুনের ঘটনার বিচার করেছেন দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘ছিটমহলে খুনের ঘটনায় বাংলাদেশ কিংবা ভারতের কোনো থানায় কোনো মামলা হয় না। আমরা নিজেদের মতো করে তদন্ত করে বিচার করি। আমরা জানি, খুনের বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তারপরেও এলাকার শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে এসব বিচার করা হয়। বিচারে দোষী ব্যক্তিদের জরিমানাও করা হয়ে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমি মনে করি, ছিটমহলের খুনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। তাহলে ছিটমহলে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার অবসান হবে।’
গত ৪৫ বছরে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী এবং নীলফামারী জেলার ছয় ছিটমহলে খুন হয়েছেন ৩৬ জন। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলে খুন হয়েছেন ৯ জন, পঞ্চগড়ের শালবাড়ি, কাজলা দিঘী, নাটকটোকা ও বেলেডাঙ্গা ছিটমহলে খুন হয়েছেন ২২ জন, গরাতী সিট মহলে ১ জন, নীলফামারীর বড় খানকি ছিটমহলে ৩ জন এবং লালমনিরহাটের ভোটবাড়ী ছিটমহলে ১ জন খুন হয়েছেন। যারা খুন হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৪ জনকে ‘ডাকাত’ হিসেবে চিহ্নিত করে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়।
দাসিয়েরছড়া ছিটে যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ : যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছিটমহলের বাসিন্দাদের মৌলিক অধিকার না থাকায় খুনসহ যে কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা ঘটলেও কোনো মামলা হয়নি। খুন করেও খুনিরা নির্বিঘেœ যুগের পর যুগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ রয়েছে, তাদের অনেকেরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কথিত পঞ্চায়েত কমিটি জরিমানার মাধ্যমে তাদের খুনের দায় থেকে খালাস দিয়েছে। আর প্রসহনের এমন বিচারের কারণে খুনিরা রীতিমতো ছিটমহলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছে। কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলে খুন হয়েছেন- শরিয়ত, আজিম উদ্দিন, মোসলেম, আবদুল গনি, বনিজ, কামিনী, মকবুল, সফর ও সাবানা। উল্লেখিত আজিম উদ্দিন খুনের দায় যুগান্তরের কাছে স্বীকারও করে সোহরাব। বর্তমানে তার বয়স ৭০। কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা সে। স্বাধীনতার ৭ বছর পর প্রতিবেশী আজিমউদ্দিনকে খুন করে সে। খুনি সোহরাবের বিচার করেছিলেন দাসিয়েরছড়া পঞ্চায়েত কমিটির কথিত চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান। যুগান্তরকে এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আজিমউদ্দিনের স্ত্রী আলেয়ার সঙ্গে সোহরাবের পরকীয়া ছিল। এরই জেরে আলেয়া ও সোহরাবের পরিকল্পনা অনুযায়ী আজিমউদ্দিনকে খুন করে মনসার ও হাসমত। এরা বর্তমানে দিল্লিতে আছে। খুনের দায়ে সোহরাব, আলেয়া, মনসার ও হাসমতকে আর্থিক জরিমানা করেছিলাম।’ এক প্রশ্নের জবাবে ‘খুনি’ সোহরাব যুগান্তরকে জানায়, ‘আলেয়ার সঙ্গে আমার ভালোবাসা ছিল। আমি টাকা দিয়ে খুন করাই। পঞ্চায়েত কমিটি এর বিচার করেছে। এখন আবার কিসের বিচার।’
অন্যদিকে স্বাধীনতার আগের বছর খুন হন দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের ধনাঢ্য ব্যক্তি বনিজ উদ্দিন ব্যাপারী। নিহত বনিজের ছেলে রমিজ ব্যাপারী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার বাবা ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। আমার চোখের সামনে হারুন, গফুর, একাব্বর, বাছির, ছাত্তার ও কাইন্দরা গুলি করে বাবাকে হত্যা করে। ভয়ে এতদিন কিছুই বলার সাহস পাইনি।’
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, যারা খুনের শিকার হয়েছেন তাদের অধিকাংশই বিচার-সালিশের (স্থানীয়দের ভাষায় দেওয়ানি) সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে ‘খুনিরাই’ পঞ্চায়েতের দায়িত্ব পালন করেছে। এমন একজনের নাম আজগর আলী। দাসিয়েরছড়া ছিটের লোক যাকে আজগর চেয়ারম্যান হিসেবে চেনেন। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরপরই লোক দিয়ে প্রতিবেশী শরিয়ত উল্লাহকে খুন করান বলে দাবি করেন নিহতের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা। জানতে চাইলে নিহত শরিয়তের স্ত্রী জোহরা যুগান্তরকে বলেন, ‘মোর স্বামীক গোলঘরে মারে ফেলাইছে। মোর স্বামীর মারে ফেলার ব্যাপারে আজগর চেয়ারম্যান, হামিদ ডাক্তার, আনছার আলী, ছাত্তার মেম্বার ও নজরুলসহ ১২ জন জড়িত ছিল। পঞ্চায়েতে এর বিচার হয়ছে, এটা সগাই জানে। সেই সময় আজগর চেয়ারম্যান মোর স্বামী মারে ফেলার কথা স্বীকার করছিল। আর ৮ বিঘা জমি দিবার চাইছে, পরে আর দেয় নাই। ওমরা যখন হজত যাই তখন মোর কাছে মাপ নিবার আসছিল।’ তবে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা সরাসরি অস্বীকার করেন আজগর চেয়ারম্যান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি এ খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আর আমি কাউকে জমি দেয়ার কথাও বলিনি।’
জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে ছিটমহলে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর নিজের আপন ভাই আবদুল গনিকে ভাড়াটে লোক দিয়ে ২৫ বছর আগে খুন করান আবদুল মজিদ নামের এক ব্যক্তি। খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে কোবাত মেম্বার, হাবিবুর, লোকমান, আবদুল মজিদ, সিরাজউদ্দিনসহ অন্তত ১০ জনের সাজা দেয় পঞ্চায়েত। এ প্রসঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘গনি খুনের ঘটনায় চেয়ারম্যান আমাকেও দোষী সাব্যস্ত করে। আমাকে জরিমানা করা হয়। জরিমানা দিয়ে আমি খালাস পেয়েছি।’
গনিকে খুন করে ঘরের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যায় খুনিরা। অন্যদিকে মোসলেম নামের আরেক ব্যক্তির খুনের সঙ্গেও জড়িত ছিল কোবাত মেম্বার। নিহত মোসলেমের মেয়ে লাইলী যুগান্তরকে বলেন, ‘দেওয়ানি নিয়ে বাবার সঙ্গে কোবাত মেম্বারের বিরোধ ছিল। এ কারণে বাবাকে সে খুন করেছে বলে শুনিছি তার লোকজনের মুখে।’
শালবাড়ি-বেলেডাঙ্গা, ভোটবাড়ী ছিটমহলে যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ : কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের পর পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত শালবাড়ি, কাজলাদিঘী, নাটকটোকা ও বেলেডাঙ্গা ছিটমহলে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের ন্যায় এখানে জমি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা ঘটে। আর গত ৪৫ বছরে যারা খুনের শিকার হয়েছেন তারা হলেন, আজিমল হক, হামিদার রহমান, মোসাহার, মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল, ভবেন্দ্রনাথ রায়, আলাউদ্দিন ওরফে আলাল, মঈনুল ইসলাম ওরফে মঙ্গলু, আমিনুল, ইনসান চেয়ারম্যান, সাত্তার, ওমর ও দুলু ডাকাত। এদের মধ্যে ইনসান, সাত্তার, ওমর ও আলাল বাংলাদেশী নাগরিক ছিলেন।
উল্লিখিত চারটি ছিটমহলে গত ২২ বছর ধরে চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সিরাজুল ইসলাম। ছিটমহলে খুনের বিষয়ে জানতে চাইলে যুগান্তরকে তিনি জানান, ‘আমিনুল নামের ৩৫ বছরের যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে তার চাচা, চাচাতো ভাই ও ভাবী। আমিনুলের মা আমিনা ও তার স্ত্রী খালেদা যুগান্তরকে বলেন, ‘জমিতে সেচ দেয়ার জন্য ড্রেন কাটাকে কেন্দ্র করে আমিনুলকে খুন করে গমিজ, গনি ও সুন্দরী। এরা আমাদের আত্মীয়। বিচারে এরা দোষ স্বীকার করেছিল। আমরা আর এর বিচার চাই না।’
কয়েক বছর আগে পঞ্চগড়ের শালবাড়ি ছিটে দিনে দুপুরে খুন হন বোদা উপজেলার বাবনহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াসিন, সাত্তার ও ওমর। আর এ খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছিটের লোকজনই। জমির বিরোধের জের ধরে কাজলাদিঘীতে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম। এ বিষয়ে পঞ্চায়েত কমিটির চেয়ারম্যান সিরাজুল বলেন, ‘জমির দখল নিয়ে বিরোধের জেরে স্থানীয় নজরুল, মোবারক, অলিয়ার, মতিয়ার ও আবুলসহ ১৫ জন শহীদুলকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করে। পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে সহোদর দুই ভাই হামিদার রহমান ও মোসাহারকে খুন করে তার প্রতিবেশীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিহতদের ভাতিজা মো. মোস্তফা সরকার যুগান্তরকে অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ২৫ বছর আগে আমার দুই চাচাকে খুন করে মাটিতে পুঁতে রাখে লুৎফর, ছয়ফুল্লাহ, গুলজার ও দুলু। লুৎফর ও ছয়ফুল্লাহর পিতার নাম সবির উদ্দিন। খুনিরা প্রভাবশালী। এখন আমি নিজে পঞ্চায়েত কমিটির মেম্বার হলেও সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি।’
পঞ্চগড় জেলার বেলেডাঙ্গা ছিটমহলের বাসিন্দা ভবেন্দ্রনাথ রায় নামের এক ব্যক্তি কয়েক বছর আগে খুন হন। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান সিরাজুল বলেন, ‘ভবেন্দ্রনাথ একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। সেদিন তিনি স্থানীয় টেপরিগঞ্জ বাজার থেকে বাড়ির পথে আসছিলেন। ওই সময় তার পথরোধ করে খুনিরা অপহরণ করে খুন করে। আজ পর্যন্ত তার লাশ পাওয়া যায়নি।’ এ বিষয়ে ভবেন্দ্রনাথের ছেলে নৃপেন্দ্রনাথ রায় যুগান্তরকে বলেন, ‘ইধর নামের তার এক মামার পক্ষে আমার বাবা দেওয়ানিগিরি করেছিলেন। এতে তার প্রতিপক্ষরা আমার বাবার ওপর ক্ষিপ্ত হয়। স্থানীয় লোকমুখে জানতে পারি, স্থানীয় আরমান, রশিদ, ভোলা ও কাদেরসহ ৯ জন মিলে আমার বাবাকে খুন করে। এখন আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর স্থানীয় মজিবর রহমানরা মিলে আমাদের কাছ থেকে ১২ বিঘা জমি লিখে নেয়। সেই জমি এখন ভোগ-দখল করছে মজিবর।’
মঈনুল ইসলাম ওরফে মঙ্গলু নামের ১৭ বছরের কিশোরের খুনের কাহিনী সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। মঙ্গলুর বড় ভাই মুনজি যুগান্তরকে বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থে নিরীহ মঙ্গলুকে খুন করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসায় নাটকটোকা ছিটের সৈয়দ মেম্বার, সোহরাব তালুকদার, করিম তালুকদার, আসমত তালুকদার, লোকমান ও লেবুসহ ১১ জন। এরা আমার ভাইকে মার্ডার করিয়া কেস সাজাইল।’ যুগান্তরের কাছে খুনের কাহিনী বর্ণনার পুরো সময়টা হু হু করে কেঁদে ফেলেন মঙ্গলুর ওই বড় ভাই। এছাড়া দুলু নামের এক কথিত ডাকাত হত্যার কথা জানান তার নিজ মেয়ে আসমা। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘শুনেছি, আমার বাবাকে গ্রামবাসী ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। আমার বাবা নাকি বড় ডাকাত আছিল।’ লালমনিরহাটের ভোটবাড়ী ছিটমহলে সেলিনা নামের এক গৃহবধূকে খুন করে তার স্বামী রুবেল। গত বছর এ খুনের ঘটনা সংঘটিত হয়।
জমি দখলের প্রচেষ্টার জন্য ৩ খুন : নীলফামারী জেলায় চারটি ছিটের মধ্যে ২৯ নম্বর বড় খানকি ছিটমহলটি বড়। চার দশক আগে জমি দখল করতে আসায় এ ছিটে তিনজন বাংলাদেশী এনতাজ আলী, আবদুল গনি ও আব্বাস আলীকে পিটিয়ে খুন করে ছিটমহলের লোকজন। এ বিষয়ে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির স্থানীয় নেতা মতিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘জোরপূর্বক আমাদের ছিটের জমি দখল করতে এসেছিল এনতাজরা। এ কারণে এ ছিটের মধ্যে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়।’
০ তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি আহসান হাবীব নীলু, এসএ মাহমুদ সেলিম, আবিদ মোস্তফা এবং ফুলবাড়ী ও হাতিবান্ধা উপজেলা প্রতিনিধি আবদুল আজিজ মজনু ও মিজানুর রহমান দুলাল
কথাগুলো যুগান্তরের কাছে বলছিলেন কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা জোহরা বেগম। ১৫ মে এ ছিটমহলের নিজ বাসায় ক্ষোভের কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে জোহরা জানান, তার স্বামী শরীয়ত উল্লাহ ৪৩ বছর আগে খুন হন। কিন্তু বিচার পাননি।
শুধু শরীয়ত উল্লাহ নন, গত ৪৫ বছরে তার মতো আরও ৩৬টি খুনের ঘটনা ঘটে ছিটমহলে। অদ্যাবধি বিচার হয়নি একটি খুনেরও। বরং খুনিরা এলাকায় যুগ যুগ ধরে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি তারা নিহতদের নিকটাত্মীয়দের হুমকি দিয়ে ছিটমহলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বসবাস করছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘এ খুনগুলোর ব্যাপারে আমরা যখন নালিশ পাব তখন বিষয়টি খতিয়ে দেখব। কেননা কোনো ফৌজদারি অপরাধ তামাদি হয় না। এখানে দুটো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। মার্ডারগুলো সংঘটিত হয়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডে আবার আইনে যখন এটা বাংলাদেশের ভূখণ্ড হবে, তখন প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হবে। আমার মনে হয়, এ দুটো বিষয় চুক্তির মধ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে। তখন এ ব্যাপারটি আমরা দেখব।’
ছিটমহলবাসীর দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহলে সংঘটিত খুন-ডাকাতির কোনো ঘটনারই সরকারি তদন্ত হয়নি। ভারতের সরকারি কোনো তদন্ত সংস্থা এসব ঘটনার তদন্ত করেনি। আবার কাঁটাতারের বেড়ার কারণে ভুক্তভোগী ছিটমহলবাসীও ভারতের সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। তবে ছিটমহলের কথিত পঞ্চায়েত কমিটির চেয়ারম্যানরা খুনের ঘটনার বিচার করেছেন। নামমাত্র জরিমানা করে খুনিদের খালাস দেন তারা।
কয়েকটি খুনের ঘটনার বিচার করেছেন দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘ছিটমহলে খুনের ঘটনায় বাংলাদেশ কিংবা ভারতের কোনো থানায় কোনো মামলা হয় না। আমরা নিজেদের মতো করে তদন্ত করে বিচার করি। আমরা জানি, খুনের বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তারপরেও এলাকার শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে এসব বিচার করা হয়। বিচারে দোষী ব্যক্তিদের জরিমানাও করা হয়ে থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমি মনে করি, ছিটমহলের খুনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। তাহলে ছিটমহলে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার অবসান হবে।’
গত ৪৫ বছরে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী এবং নীলফামারী জেলার ছয় ছিটমহলে খুন হয়েছেন ৩৬ জন। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলে খুন হয়েছেন ৯ জন, পঞ্চগড়ের শালবাড়ি, কাজলা দিঘী, নাটকটোকা ও বেলেডাঙ্গা ছিটমহলে খুন হয়েছেন ২২ জন, গরাতী সিট মহলে ১ জন, নীলফামারীর বড় খানকি ছিটমহলে ৩ জন এবং লালমনিরহাটের ভোটবাড়ী ছিটমহলে ১ জন খুন হয়েছেন। যারা খুন হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৪ জনকে ‘ডাকাত’ হিসেবে চিহ্নিত করে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়।
দাসিয়েরছড়া ছিটে যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ : যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছিটমহলের বাসিন্দাদের মৌলিক অধিকার না থাকায় খুনসহ যে কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা ঘটলেও কোনো মামলা হয়নি। খুন করেও খুনিরা নির্বিঘেœ যুগের পর যুগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ রয়েছে, তাদের অনেকেরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কথিত পঞ্চায়েত কমিটি জরিমানার মাধ্যমে তাদের খুনের দায় থেকে খালাস দিয়েছে। আর প্রসহনের এমন বিচারের কারণে খুনিরা রীতিমতো ছিটমহলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছে। কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলে খুন হয়েছেন- শরিয়ত, আজিম উদ্দিন, মোসলেম, আবদুল গনি, বনিজ, কামিনী, মকবুল, সফর ও সাবানা। উল্লেখিত আজিম উদ্দিন খুনের দায় যুগান্তরের কাছে স্বীকারও করে সোহরাব। বর্তমানে তার বয়স ৭০। কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা সে। স্বাধীনতার ৭ বছর পর প্রতিবেশী আজিমউদ্দিনকে খুন করে সে। খুনি সোহরাবের বিচার করেছিলেন দাসিয়েরছড়া পঞ্চায়েত কমিটির কথিত চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান। যুগান্তরকে এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আজিমউদ্দিনের স্ত্রী আলেয়ার সঙ্গে সোহরাবের পরকীয়া ছিল। এরই জেরে আলেয়া ও সোহরাবের পরিকল্পনা অনুযায়ী আজিমউদ্দিনকে খুন করে মনসার ও হাসমত। এরা বর্তমানে দিল্লিতে আছে। খুনের দায়ে সোহরাব, আলেয়া, মনসার ও হাসমতকে আর্থিক জরিমানা করেছিলাম।’ এক প্রশ্নের জবাবে ‘খুনি’ সোহরাব যুগান্তরকে জানায়, ‘আলেয়ার সঙ্গে আমার ভালোবাসা ছিল। আমি টাকা দিয়ে খুন করাই। পঞ্চায়েত কমিটি এর বিচার করেছে। এখন আবার কিসের বিচার।’
অন্যদিকে স্বাধীনতার আগের বছর খুন হন দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের ধনাঢ্য ব্যক্তি বনিজ উদ্দিন ব্যাপারী। নিহত বনিজের ছেলে রমিজ ব্যাপারী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার বাবা ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। আমার চোখের সামনে হারুন, গফুর, একাব্বর, বাছির, ছাত্তার ও কাইন্দরা গুলি করে বাবাকে হত্যা করে। ভয়ে এতদিন কিছুই বলার সাহস পাইনি।’
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, যারা খুনের শিকার হয়েছেন তাদের অধিকাংশই বিচার-সালিশের (স্থানীয়দের ভাষায় দেওয়ানি) সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে ‘খুনিরাই’ পঞ্চায়েতের দায়িত্ব পালন করেছে। এমন একজনের নাম আজগর আলী। দাসিয়েরছড়া ছিটের লোক যাকে আজগর চেয়ারম্যান হিসেবে চেনেন। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরপরই লোক দিয়ে প্রতিবেশী শরিয়ত উল্লাহকে খুন করান বলে দাবি করেন নিহতের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা। জানতে চাইলে নিহত শরিয়তের স্ত্রী জোহরা যুগান্তরকে বলেন, ‘মোর স্বামীক গোলঘরে মারে ফেলাইছে। মোর স্বামীর মারে ফেলার ব্যাপারে আজগর চেয়ারম্যান, হামিদ ডাক্তার, আনছার আলী, ছাত্তার মেম্বার ও নজরুলসহ ১২ জন জড়িত ছিল। পঞ্চায়েতে এর বিচার হয়ছে, এটা সগাই জানে। সেই সময় আজগর চেয়ারম্যান মোর স্বামী মারে ফেলার কথা স্বীকার করছিল। আর ৮ বিঘা জমি দিবার চাইছে, পরে আর দেয় নাই। ওমরা যখন হজত যাই তখন মোর কাছে মাপ নিবার আসছিল।’ তবে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা সরাসরি অস্বীকার করেন আজগর চেয়ারম্যান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি এ খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আর আমি কাউকে জমি দেয়ার কথাও বলিনি।’
জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে ছিটমহলে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর নিজের আপন ভাই আবদুল গনিকে ভাড়াটে লোক দিয়ে ২৫ বছর আগে খুন করান আবদুল মজিদ নামের এক ব্যক্তি। খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে কোবাত মেম্বার, হাবিবুর, লোকমান, আবদুল মজিদ, সিরাজউদ্দিনসহ অন্তত ১০ জনের সাজা দেয় পঞ্চায়েত। এ প্রসঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘গনি খুনের ঘটনায় চেয়ারম্যান আমাকেও দোষী সাব্যস্ত করে। আমাকে জরিমানা করা হয়। জরিমানা দিয়ে আমি খালাস পেয়েছি।’
গনিকে খুন করে ঘরের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যায় খুনিরা। অন্যদিকে মোসলেম নামের আরেক ব্যক্তির খুনের সঙ্গেও জড়িত ছিল কোবাত মেম্বার। নিহত মোসলেমের মেয়ে লাইলী যুগান্তরকে বলেন, ‘দেওয়ানি নিয়ে বাবার সঙ্গে কোবাত মেম্বারের বিরোধ ছিল। এ কারণে বাবাকে সে খুন করেছে বলে শুনিছি তার লোকজনের মুখে।’
শালবাড়ি-বেলেডাঙ্গা, ভোটবাড়ী ছিটমহলে যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ : কুড়িগ্রামের দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের পর পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত শালবাড়ি, কাজলাদিঘী, নাটকটোকা ও বেলেডাঙ্গা ছিটমহলে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দাসিয়েরছড়া ছিটমহলের ন্যায় এখানে জমি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা ঘটে। আর গত ৪৫ বছরে যারা খুনের শিকার হয়েছেন তারা হলেন, আজিমল হক, হামিদার রহমান, মোসাহার, মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল, ভবেন্দ্রনাথ রায়, আলাউদ্দিন ওরফে আলাল, মঈনুল ইসলাম ওরফে মঙ্গলু, আমিনুল, ইনসান চেয়ারম্যান, সাত্তার, ওমর ও দুলু ডাকাত। এদের মধ্যে ইনসান, সাত্তার, ওমর ও আলাল বাংলাদেশী নাগরিক ছিলেন।
উল্লিখিত চারটি ছিটমহলে গত ২২ বছর ধরে চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সিরাজুল ইসলাম। ছিটমহলে খুনের বিষয়ে জানতে চাইলে যুগান্তরকে তিনি জানান, ‘আমিনুল নামের ৩৫ বছরের যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে তার চাচা, চাচাতো ভাই ও ভাবী। আমিনুলের মা আমিনা ও তার স্ত্রী খালেদা যুগান্তরকে বলেন, ‘জমিতে সেচ দেয়ার জন্য ড্রেন কাটাকে কেন্দ্র করে আমিনুলকে খুন করে গমিজ, গনি ও সুন্দরী। এরা আমাদের আত্মীয়। বিচারে এরা দোষ স্বীকার করেছিল। আমরা আর এর বিচার চাই না।’
কয়েক বছর আগে পঞ্চগড়ের শালবাড়ি ছিটে দিনে দুপুরে খুন হন বোদা উপজেলার বাবনহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াসিন, সাত্তার ও ওমর। আর এ খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছিটের লোকজনই। জমির বিরোধের জের ধরে কাজলাদিঘীতে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম। এ বিষয়ে পঞ্চায়েত কমিটির চেয়ারম্যান সিরাজুল বলেন, ‘জমির দখল নিয়ে বিরোধের জেরে স্থানীয় নজরুল, মোবারক, অলিয়ার, মতিয়ার ও আবুলসহ ১৫ জন শহীদুলকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করে। পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে সহোদর দুই ভাই হামিদার রহমান ও মোসাহারকে খুন করে তার প্রতিবেশীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিহতদের ভাতিজা মো. মোস্তফা সরকার যুগান্তরকে অভিযোগ করে বলেন, ‘গত ২৫ বছর আগে আমার দুই চাচাকে খুন করে মাটিতে পুঁতে রাখে লুৎফর, ছয়ফুল্লাহ, গুলজার ও দুলু। লুৎফর ও ছয়ফুল্লাহর পিতার নাম সবির উদ্দিন। খুনিরা প্রভাবশালী। এখন আমি নিজে পঞ্চায়েত কমিটির মেম্বার হলেও সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি।’
পঞ্চগড় জেলার বেলেডাঙ্গা ছিটমহলের বাসিন্দা ভবেন্দ্রনাথ রায় নামের এক ব্যক্তি কয়েক বছর আগে খুন হন। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান সিরাজুল বলেন, ‘ভবেন্দ্রনাথ একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। সেদিন তিনি স্থানীয় টেপরিগঞ্জ বাজার থেকে বাড়ির পথে আসছিলেন। ওই সময় তার পথরোধ করে খুনিরা অপহরণ করে খুন করে। আজ পর্যন্ত তার লাশ পাওয়া যায়নি।’ এ বিষয়ে ভবেন্দ্রনাথের ছেলে নৃপেন্দ্রনাথ রায় যুগান্তরকে বলেন, ‘ইধর নামের তার এক মামার পক্ষে আমার বাবা দেওয়ানিগিরি করেছিলেন। এতে তার প্রতিপক্ষরা আমার বাবার ওপর ক্ষিপ্ত হয়। স্থানীয় লোকমুখে জানতে পারি, স্থানীয় আরমান, রশিদ, ভোলা ও কাদেরসহ ৯ জন মিলে আমার বাবাকে খুন করে। এখন আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর স্থানীয় মজিবর রহমানরা মিলে আমাদের কাছ থেকে ১২ বিঘা জমি লিখে নেয়। সেই জমি এখন ভোগ-দখল করছে মজিবর।’
মঈনুল ইসলাম ওরফে মঙ্গলু নামের ১৭ বছরের কিশোরের খুনের কাহিনী সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। মঙ্গলুর বড় ভাই মুনজি যুগান্তরকে বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থে নিরীহ মঙ্গলুকে খুন করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসায় নাটকটোকা ছিটের সৈয়দ মেম্বার, সোহরাব তালুকদার, করিম তালুকদার, আসমত তালুকদার, লোকমান ও লেবুসহ ১১ জন। এরা আমার ভাইকে মার্ডার করিয়া কেস সাজাইল।’ যুগান্তরের কাছে খুনের কাহিনী বর্ণনার পুরো সময়টা হু হু করে কেঁদে ফেলেন মঙ্গলুর ওই বড় ভাই। এছাড়া দুলু নামের এক কথিত ডাকাত হত্যার কথা জানান তার নিজ মেয়ে আসমা। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘শুনেছি, আমার বাবাকে গ্রামবাসী ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। আমার বাবা নাকি বড় ডাকাত আছিল।’ লালমনিরহাটের ভোটবাড়ী ছিটমহলে সেলিনা নামের এক গৃহবধূকে খুন করে তার স্বামী রুবেল। গত বছর এ খুনের ঘটনা সংঘটিত হয়।
জমি দখলের প্রচেষ্টার জন্য ৩ খুন : নীলফামারী জেলায় চারটি ছিটের মধ্যে ২৯ নম্বর বড় খানকি ছিটমহলটি বড়। চার দশক আগে জমি দখল করতে আসায় এ ছিটে তিনজন বাংলাদেশী এনতাজ আলী, আবদুল গনি ও আব্বাস আলীকে পিটিয়ে খুন করে ছিটমহলের লোকজন। এ বিষয়ে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির স্থানীয় নেতা মতিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘জোরপূর্বক আমাদের ছিটের জমি দখল করতে এসেছিল এনতাজরা। এ কারণে এ ছিটের মধ্যে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়।’
০ তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি আহসান হাবীব নীলু, এসএ মাহমুদ সেলিম, আবিদ মোস্তফা এবং ফুলবাড়ী ও হাতিবান্ধা উপজেলা প্রতিনিধি আবদুল আজিজ মজনু ও মিজানুর রহমান দুলাল
No comments