সুপ্রিমকোর্ট-মন্ত্রণালয় টানাপোড়েন by কবির হোসেন
বিচারকদের
পদোন্নতি, বদলি, শৃংখলাসহ অন্যান্য ইস্যুতে সুপ্রিমকোর্ট ও আইন
মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী
বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃংখলাসংক্রান্ত বিষয়গুলো আইন মন্ত্রণালয়ের
বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় প্রায়শই এ ধরনের কাজগুলো
নিজেদের মতো সম্পন্নের চেষ্টা করে থাকে। তাদের প্রত্যাশামতো না হলে
সুপ্রিমকোর্টের কাছে পরামর্শ পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করছে। এতে বিচার
বিভাগের স্বাধীনতা কার্যত ব্যাহত হচ্ছে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে এক অতিরিক্ত
জেলা জজকে জেলা জজ পদে পদোন্নতির প্যানেলে অন্তর্ভুক্তের জন্য সিদ্ধান্ত
হয়। সুপ্রিমকোর্টের ফুলকোর্ট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বিষয়টি
দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এছাড়া সাবেক জেলা ও দায়রা জজসহ
৫ বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে
না। এছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিবকে জেলা ও দায়রা জজ পদে বদলির ঘটনায়
সুপ্রিমকোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ
ধরনের আরও অনেক ঘটনা আছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন।
এ প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হককে শুক্রবার টেলিফোনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’
জানা গেছে, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণসংক্রান্ত মামলার রায়ের সপ্তম নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলা বিধানে নির্বাহী বিভাগের মতামতের ওপরে সুপ্রিমকোর্টের মতামত প্রাধান্য পাবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা পালিত হচ্ছে না। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃংখলা বিধানের বিষয়টি হাতে রেখেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে পুরো বিচার বিভাগকে। তাদের মতে, বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে, কিন্তু এখনও স্বাধীন হয়নি। বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হলে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ১৯৭২ সালের আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনতে হবে। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃংখলা বিধানের ওপর সুপ্রিমকোর্টের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ ব্যাপারে যুগান্তরকে বলেন, ‘বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, শৃংখলা বিধানের ব্যাপারে দ্বৈত শাসন চলছে। দ্বৈত শাসনের অবসান দরকার। দুনিয়ার সব দেশেই এসব প্রশাসনিক দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রারের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সুপ্রিমকোর্টে অধস্তন আদালতের জন্য পৃথক সচিবালয় করার কথা বহু বছর ধরে বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। যতদিন দ্বৈত প্রশাসন চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের আদেশ বাস্তবায়িত হবে না।’ ড. মালিক আরও বলেন, ‘সরকার চাচ্ছে না পৃথকীকরণের আদেশ বাস্তবায়িত হোক। দুনিয়ার কোথাও এটা চায় না। পৃথকীকরণের আদেশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে সুপ্রিমকোর্টকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সাবেক সিনিয়র লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান (যুগ্ম জেলা জজ) বর্তমানে শেরপুরের অতিরিক্ত জেলা জজ মো. মনসুর আলম। ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। মামলা নং ২৬/২০১০। ওই বিভাগীয় মামলার তদন্ত করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক (জেলা জজ) মো. রেজাউল ইসলাম। কিন্তু তদন্ত করে অভিযোগের কোনো সত্যতা না পেয়ে মনসুর আলমকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন। সে অনুযায়ী মনসুর আলমকে অব্যাহতির জন্য ২০১৩ সালের ১৫ মার্চ আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চাওয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টও তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির পরামর্শ দেন।
এরপর ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই ও ২১ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের ফুলকোর্ট (প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্ট বিভাগের সব বিচারপতির সভা) সভায় মনসুর আলমকে অতিরিক্ত জেলা জজ থেকে জেলা জজ পদে পদোন্নতির প্যানেলে অন্তর্ভুক্তের জন্য সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্ত একই বছরের ২৩ জুলাই মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। কিন্তু ফুলকোর্ট সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে ৮ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভাগীয় মামলাটির পুনঃতদন্তের প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়।
১৬ মে সুপ্রিমকোর্টের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএ) কমিটি তাকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে পদায়ন না করে এতদিন পরে পুনঃতদন্তের প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। তাকে পদোন্নতি না দিয়ে তার কনিষ্ঠদের পদোন্নতি দেয়াকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায় মনসুর আলমের জ্যেষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ রেখে পদোন্নতিমূলে পদায়নের প্রস্তাব ৭ দিনের মধ্যে অত্র কোর্টে প্রেরণের জন্য আইন ও বিচার বিভাগকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
অপর এক ঘটনায় জানা গেছে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জিনাত আরা ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত পরিদর্শনে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে ঢাকার সাবেক জেলা ও দায়রা জজসহ ৫ বিচারক এবং ওই আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়মের বিষয় তুলে ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন। হাইকোর্টের এ বিচারপতির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত বছরের ২৮ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের জিএ কমিটি ওই ছয়জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।
ওই ৫ বিচারকের মধ্যে বর্তমানে সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ইফতেখার বিন আজিজকে ৯ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পদে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় ১৬ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন ওই প্রস্তাব নাকচ করে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভাগীয় মামলায় কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা জানতে চান। এ অবস্থায় আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে জানিয়েছে, বিধি মোতাবেক তার কাছে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী পাঠিয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এ বিষয়ে তিনি জবাব দাখিল করেছেন এবং ব্যক্তিগত শুনানি প্রদান করেছেন। তার জবাব ও ব্যক্তিগত শুনানি সন্তোষজনক হওয়ায় মন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে তাকে বিভাগীয় মোকদ্দমার অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ইফতেখার বিন আজিজকে উপ-সচিব পদে বদলির প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার জন্য আবারও জিএ কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে।
আলাদা আরও একটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মিজানুর রহমান খানকে মন্ত্রণালয় থেকে নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ পদে বদলির প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়। ২৫ ফেব্র“য়ারি জিএ কমিটি রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক হিসেবে তাকে বদলির পরামর্শ দেয় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এরপর সুপ্রিমকোর্টের এই পরামর্শ পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠায় মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে মিজানুর রহমান খানকে গাজীপুরের জেলা ও দায়রা জজ পদে বদলি করতে মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করে। সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন এবার তাকে বাগেরহাটের জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে বদলির পরামর্শ দেয়। ১৫ এপ্রিল ওই পরামর্শ দেয়া হলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এভাবে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ আইন মন্ত্রণালয় উপেক্ষা করছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ মন্ত্রণালয়ের প্রত্যাশা মতো না হলে তা পুনর্বিবেচনা চাওয়া হচ্ছে। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিচার বিভাগে এসব হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর ১২ দফা নির্দেশনার আলোকে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য মাসদার হোসেন মামলার রায় দেন।
জানা গেছে, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ১২ দফা নির্দেশনা বিচার বিভাগের বঞ্চনার ফসল। এ ১২ দফার মূল তাৎপর্য হল বিচার বিভাগকে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এ ১২ দফার প্রধান প্রধান দফাগুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। নির্দেশনাগুলোর প্রথম দফায় জুডিশিয়াল সার্ভিসকে ১৫২(১) অনুচ্ছেদের আওতায় সার্ভিস অব দ্য রিপাবলিক বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, এ সার্ভিসকে সরকারের অন্যান্য নির্বাহী ও প্রশাসনিক সার্ভিসের সঙ্গে কোনোভাবেই সামন্তরাল করা যাবে না, মিশ্রণ ঘটানো যাবে না, এক সঙ্গে বাঁধা যাবে না। কিন্তু এখনও এই আদেশটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বিচার বিভাগকে এখনও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে একীভূত করে রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয় দফার অর্ধেক পূরণ হয়েছে। এ দফায় জুডিশিয়াল সার্ভিস ও এর নিয়োগ বিধি তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিচারকদের শৃংখলা বিধি এখনও হয়নি। আশার কথা হচ্ছে, এ শৃংখলা বিধি তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট। সে অনুযায়ী একটি খসড়াও তৈরি হয়েছে। পিএসসির অধীনে থাকা বিসিএস (জুডিশিয়াল) ক্যাডার বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তাই তৃতীয় দফার বাস্তবায়ন হয়েছে। চতুর্থ দফায় জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূরণ হয়েছে।
পঞ্চম দফায় সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের আওতায় বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থর নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃংখলা বিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্তাবলী) বিধিমালা-২০০৭ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এ বিধিমালায় কয়েকটি ক্ষেত্রে বিচারকদের সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে একীভূত করে রাখা হয়েছে। এ বিধিমালায় বলা হয়েছে, ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (আইন মন্ত্রণালয়) কার্যকরভাবে পরামর্শ গ্রহণের জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং কোনো ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব ও সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শে ভিন্নতা থাকলে, তখন সুপ্রিমকোর্টর পরামর্শ প্রাধান্য পাবে।’ কতদিনের মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে জুডিশিয়াল সার্ভিস বিধিমালায় তা নির্ধারণ করা হয়নি। যে কারণে আইন মন্ত্রণালয় হরহামেশাই সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ দিনের পর দিন ফেলে রাখছে। বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, আলাদা বিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ (আইন মন্ত্রণালয়) সরকারের একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ১৯৮৫ সালের শৃংখলা বিধিমালার প্রয়োজনীয় অভিযোজন সহকারে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের শৃংখলা বিধান করবে। এ রকম ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বিচারকদের অবসর গ্রহণ, পেনশন, ভবিষ্যৎ তহবিল ইত্যাদি ক্ষেত্রেও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিচার বিভাগ পৃথক ঘোষণার পরও বিচারকদের শৃংখলা বিধানের বিষয়টি এক প্রকার সরকারের হাতে রেখে দেয়া হয়েছে। যখনই কারও বিরুদ্ধে শৃংখলা বিধানের প্রশ্ন উঠবে, সেই প্রশ্ন ১৯৮৫ সালের শৃংখলা ও আপিল বিধিমালা বলে সরকারের হাতে। শৃংখলা বিধানের উপলব্ধি হতে হবে সরকারের। সরকার এটা অনুভব করলে সে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবে, না হলে করবে না। এ বিধানের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সরকার। এ বিধান সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তাই পঞ্চম দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হককে শুক্রবার টেলিফোনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’
জানা গেছে, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণসংক্রান্ত মামলার রায়ের সপ্তম নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলা বিধানে নির্বাহী বিভাগের মতামতের ওপরে সুপ্রিমকোর্টের মতামত প্রাধান্য পাবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা পালিত হচ্ছে না। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃংখলা বিধানের বিষয়টি হাতে রেখেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে পুরো বিচার বিভাগকে। তাদের মতে, বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে, কিন্তু এখনও স্বাধীন হয়নি। বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হলে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ১৯৭২ সালের আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনতে হবে। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃংখলা বিধানের ওপর সুপ্রিমকোর্টের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ ব্যাপারে যুগান্তরকে বলেন, ‘বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, শৃংখলা বিধানের ব্যাপারে দ্বৈত শাসন চলছে। দ্বৈত শাসনের অবসান দরকার। দুনিয়ার সব দেশেই এসব প্রশাসনিক দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রারের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সুপ্রিমকোর্টে অধস্তন আদালতের জন্য পৃথক সচিবালয় করার কথা বহু বছর ধরে বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। যতদিন দ্বৈত প্রশাসন চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের আদেশ বাস্তবায়িত হবে না।’ ড. মালিক আরও বলেন, ‘সরকার চাচ্ছে না পৃথকীকরণের আদেশ বাস্তবায়িত হোক। দুনিয়ার কোথাও এটা চায় না। পৃথকীকরণের আদেশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে সুপ্রিমকোর্টকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সাবেক সিনিয়র লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান (যুগ্ম জেলা জজ) বর্তমানে শেরপুরের অতিরিক্ত জেলা জজ মো. মনসুর আলম। ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। মামলা নং ২৬/২০১০। ওই বিভাগীয় মামলার তদন্ত করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক (জেলা জজ) মো. রেজাউল ইসলাম। কিন্তু তদন্ত করে অভিযোগের কোনো সত্যতা না পেয়ে মনসুর আলমকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন। সে অনুযায়ী মনসুর আলমকে অব্যাহতির জন্য ২০১৩ সালের ১৫ মার্চ আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চাওয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টও তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির পরামর্শ দেন।
এরপর ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই ও ২১ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের ফুলকোর্ট (প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে হাইকোর্ট বিভাগের সব বিচারপতির সভা) সভায় মনসুর আলমকে অতিরিক্ত জেলা জজ থেকে জেলা জজ পদে পদোন্নতির প্যানেলে অন্তর্ভুক্তের জন্য সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্ত একই বছরের ২৩ জুলাই মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। কিন্তু ফুলকোর্ট সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে ৮ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভাগীয় মামলাটির পুনঃতদন্তের প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়।
১৬ মে সুপ্রিমকোর্টের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএ) কমিটি তাকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে পদায়ন না করে এতদিন পরে পুনঃতদন্তের প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। তাকে পদোন্নতি না দিয়ে তার কনিষ্ঠদের পদোন্নতি দেয়াকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থায় মনসুর আলমের জ্যেষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ রেখে পদোন্নতিমূলে পদায়নের প্রস্তাব ৭ দিনের মধ্যে অত্র কোর্টে প্রেরণের জন্য আইন ও বিচার বিভাগকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
অপর এক ঘটনায় জানা গেছে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জিনাত আরা ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত পরিদর্শনে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে ঢাকার সাবেক জেলা ও দায়রা জজসহ ৫ বিচারক এবং ওই আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়মের বিষয় তুলে ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন। হাইকোর্টের এ বিচারপতির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত বছরের ২৮ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের জিএ কমিটি ওই ছয়জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।
ওই ৫ বিচারকের মধ্যে বর্তমানে সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ইফতেখার বিন আজিজকে ৯ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পদে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় ১৬ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন ওই প্রস্তাব নাকচ করে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভাগীয় মামলায় কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা জানতে চান। এ অবস্থায় আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনকে জানিয়েছে, বিধি মোতাবেক তার কাছে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী পাঠিয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এ বিষয়ে তিনি জবাব দাখিল করেছেন এবং ব্যক্তিগত শুনানি প্রদান করেছেন। তার জবাব ও ব্যক্তিগত শুনানি সন্তোষজনক হওয়ায় মন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে তাকে বিভাগীয় মোকদ্দমার অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ইফতেখার বিন আজিজকে উপ-সচিব পদে বদলির প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার জন্য আবারও জিএ কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে।
আলাদা আরও একটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মিজানুর রহমান খানকে মন্ত্রণালয় থেকে নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ পদে বদলির প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়। ২৫ ফেব্র“য়ারি জিএ কমিটি রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক হিসেবে তাকে বদলির পরামর্শ দেয় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। এরপর সুপ্রিমকোর্টের এই পরামর্শ পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠায় মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে মিজানুর রহমান খানকে গাজীপুরের জেলা ও দায়রা জজ পদে বদলি করতে মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করে। সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন এবার তাকে বাগেরহাটের জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে বদলির পরামর্শ দেয়। ১৫ এপ্রিল ওই পরামর্শ দেয়া হলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এভাবে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ আইন মন্ত্রণালয় উপেক্ষা করছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ মন্ত্রণালয়ের প্রত্যাশা মতো না হলে তা পুনর্বিবেচনা চাওয়া হচ্ছে। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিচার বিভাগে এসব হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর ১২ দফা নির্দেশনার আলোকে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য মাসদার হোসেন মামলার রায় দেন।
জানা গেছে, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ১২ দফা নির্দেশনা বিচার বিভাগের বঞ্চনার ফসল। এ ১২ দফার মূল তাৎপর্য হল বিচার বিভাগকে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এ ১২ দফার প্রধান প্রধান দফাগুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। নির্দেশনাগুলোর প্রথম দফায় জুডিশিয়াল সার্ভিসকে ১৫২(১) অনুচ্ছেদের আওতায় সার্ভিস অব দ্য রিপাবলিক বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, এ সার্ভিসকে সরকারের অন্যান্য নির্বাহী ও প্রশাসনিক সার্ভিসের সঙ্গে কোনোভাবেই সামন্তরাল করা যাবে না, মিশ্রণ ঘটানো যাবে না, এক সঙ্গে বাঁধা যাবে না। কিন্তু এখনও এই আদেশটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বিচার বিভাগকে এখনও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে একীভূত করে রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয় দফার অর্ধেক পূরণ হয়েছে। এ দফায় জুডিশিয়াল সার্ভিস ও এর নিয়োগ বিধি তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিচারকদের শৃংখলা বিধি এখনও হয়নি। আশার কথা হচ্ছে, এ শৃংখলা বিধি তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট। সে অনুযায়ী একটি খসড়াও তৈরি হয়েছে। পিএসসির অধীনে থাকা বিসিএস (জুডিশিয়াল) ক্যাডার বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তাই তৃতীয় দফার বাস্তবায়ন হয়েছে। চতুর্থ দফায় জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূরণ হয়েছে।
পঞ্চম দফায় সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের আওতায় বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থর নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃংখলা বিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্তাবলী) বিধিমালা-২০০৭ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এ বিধিমালায় কয়েকটি ক্ষেত্রে বিচারকদের সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে একীভূত করে রাখা হয়েছে। এ বিধিমালায় বলা হয়েছে, ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (আইন মন্ত্রণালয়) কার্যকরভাবে পরামর্শ গ্রহণের জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং কোনো ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব ও সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শে ভিন্নতা থাকলে, তখন সুপ্রিমকোর্টর পরামর্শ প্রাধান্য পাবে।’ কতদিনের মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে জুডিশিয়াল সার্ভিস বিধিমালায় তা নির্ধারণ করা হয়নি। যে কারণে আইন মন্ত্রণালয় হরহামেশাই সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ দিনের পর দিন ফেলে রাখছে। বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, আলাদা বিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ (আইন মন্ত্রণালয়) সরকারের একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ১৯৮৫ সালের শৃংখলা বিধিমালার প্রয়োজনীয় অভিযোজন সহকারে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের শৃংখলা বিধান করবে। এ রকম ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বিচারকদের অবসর গ্রহণ, পেনশন, ভবিষ্যৎ তহবিল ইত্যাদি ক্ষেত্রেও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিচার বিভাগ পৃথক ঘোষণার পরও বিচারকদের শৃংখলা বিধানের বিষয়টি এক প্রকার সরকারের হাতে রেখে দেয়া হয়েছে। যখনই কারও বিরুদ্ধে শৃংখলা বিধানের প্রশ্ন উঠবে, সেই প্রশ্ন ১৯৮৫ সালের শৃংখলা ও আপিল বিধিমালা বলে সরকারের হাতে। শৃংখলা বিধানের উপলব্ধি হতে হবে সরকারের। সরকার এটা অনুভব করলে সে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবে, না হলে করবে না। এ বিধানের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সরকার। এ বিধান সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তাই পঞ্চম দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে।
No comments