সাগরে ও বন্দিশিবিরে আমাদের ‘মানবসম্পদ’! by মশিউল আলম
বাংলাদেশ
ও মিয়ানমারের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরে ভাসছে।
তাদের এই ভাসার বিবরণ হৃদয়বিদারক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাদের
নিয়ে হাহাকার পড়ে গেছে। খোদ জাতিসংঘ পর্যন্ত আবেগ সংবরণ করতে পারছে না।
তারা এই ভাসমান মানুষগুলোকে কূলে ভিড়তে দেওয়ার জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া
ও ইন্দোনেশিয়ার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এই তিনটি দেশের
সরকার সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। তারা বলছে, এসব মানুষকে তারা নিজেদের দেশে
ঢুকতে দেবে না। ইতিমধ্যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমান ও বাংলাদেশি নাগরিক
অবৈধভাবে ওই সব দেশে ঢুকে পড়েছে। তাদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বন্দিশিবির,
যেখানে তারা শ্রমদাসের জীবন অতিবাহিত করছে, অনেকের স্থান হয়েছে গণকবরে।
অনেককে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য জড়ো করা হয়েছে অস্থায়ী শরণার্থী
শিবিরগুলোতে।
এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হয়েছে, তা অজানা নয়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা সীমাহীন জাতিগত বর্বরতার শিকার হচ্ছে; অস্তিত্ব রক্ষার মরিয়া চেষ্টায় তারা মাছ ধরার ট্রলার কিংবা নৌকায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় যেতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশের যেসব মানুষ রোহিঙ্গাদের মতো একই রকমের ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের সমস্যা কী? এ দেশে তো কোনো জাতিগত সহিংসতা চলছে না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের এসব মানুষ ঘর ছাড়ছে দারিদ্র্যের কারণে। কিন্তু এই মানুষগুলোর প্রিয় মাতৃভূমি তো দারিদ্র্য বিমোচনে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীকে! ছিনিয়ে এনেছে নোবেল পুরস্কার! বাংলাদেশ তো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে! অচিরেই মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে এ দেশ! তাহলে কেন এই মানুষগুলো স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হচ্ছে?
এই প্রশ্নের সোজা উত্তর হলো, এই মানুষগুলো জীবিকার সন্ধানে ঘর ছাড়ছে, অধিকাংশই ভালো উপার্জনের প্রলোভনে মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, এমনকি প্রাণও হারাচ্ছে। তার মানে, স্বদেশে তাদের কর্মসংস্থানের প্রকট অভাব। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সংগতভাবেই তাদের বলা হচ্ছে ইকোনমিক মাইগ্রেন্ট বা অর্থনৈতিক অভিবাসী। কিন্তু সমস্যা হলো, এই জীবিকার সন্ধানী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সামনে স্বাভাবিক, বৈধ ও নিরাপদ পথ নেই, বা থাকলেও তা অত্যন্ত সংকুচিত।
বৈধ ও নিরাপদ উপায়ে বিদেশে গিয়ে উপার্জন করার সুযোগ বন্ধ বা সীমিত হয়ে গেলে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ পথে তা করার প্রবণতা যে বাড়ে, তার একটা প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত বর্তমানের এই পরিস্থিতি। বাংলাদেশের যেসব মানুষ এখন সাগরে ভাসছে, তাদের গন্তব্য মালয়েশিয়া—আমাদের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। সেখানে অভিবাসী শ্রমিকের অনেক চাহিদা রয়েছে, কিন্তু বৈধ পথে শ্রমিক যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। গত তিন বছরে এ দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছে মাত্র ৭ হাজার ১৯০ জন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক। অথচ ২০০৭ সালে গিয়েছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার, তার পরের বছর ১ লাখ ৩১ হাজার। তখন মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো হতো বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয়। তিন বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালে মালয়েশিয়ার সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি হয় যে বাংলাদেশ বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের বাদ দিয়ে শুধু সরকারিভাবে শ্রমিক পাঠাবে। মালয়েশিয়ার সরকার বলে, তারা প্রথম দফায় বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার শ্রমিক নেবে, পরে এই সংখ্যা বাড়বে। আর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হয়েছিল যে বছরে অন্তত এক লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়া পাঠানো যাবে। এ জন্য মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের নিবন্ধন শুরু হলে সাড়ে ১৪ লাখ আগ্রহী যুবক নিজের নাম নিবন্ধন করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত তিন বছরে যেতে পেরেছে মাত্র সাত হাজার।
কিন্তু কেন? মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে গত তিন বছরে মাত্র সাড়ে আট হাজার শ্রমিকের চাহিদাপত্র এসেছে; অর্থাৎ সে দেশের সরকার বাংলাদেশের সরকারকে বোঝাতে চেয়েছে যে মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকের চাহিদা তেমন নেই। কিন্তু বাস্তবে এটা সত্য নয়; চাহিদা অবশ্যই রয়েছে, তবে সরকারিভাবে শ্রমিক আমদানিতে মালয়েশিয়ার সরকারের আগ্রহ ফুরিয়ে গেছে। কারণ, অবৈধভাবে ওই দেশে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক যেতে পারছে, যাদের খাটানো যাচ্ছে অত্যন্ত অল্প মজুরিতে। যে সময় সরকারিভাবে গেছে মাত্র সাত হাজার শ্রমিক, সেই একই সময়ে অবৈধভাবে গেছে প্রায় দেড় লাখ। আর অবৈধভাবে শ্রমিক যাওয়া ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের হিসাবে এ বছরের প্রথম তিন মাসেই ২৫ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ ও বিপজ্জনক পথে সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশে নৌকায় উঠেছে।
আর স্বাভাবিক ও বৈধ পন্থা সংকুচিত বা বন্ধ হলে যা হয়, অবৈধ পথটি হয়ে ওঠে ভীষণ অস্বাভাবিক: অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় যেতে আগ্রহী বাংলাদেশিরা পড়ে গেছে মানব পাচারের বিরাট এক আন্তর্জাতিক চক্রের কবলে। তাদের দালালেরা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের এমন সব অঞ্চলে, যেখানকার মানুষের মধ্যে দেশ ছাড়ার প্রবণতা আগে ছিল না। দালালেরা স্বল্প খরচে ভালো উপার্জনের লোভ দেখিয়ে অজ্ঞ ও দরিদ্র বেকার যুবকদের পাচার করছে, যে পাচার কিনা একপর্যায়ে পরিণত হচ্ছে অপহরণের মতো ব্যাপারে। তাদের নৌকায় তুলে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে, বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে শ্রমদাস হিসেবে। টাইম সাময়িকী ও লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ান লিখেছে, থাইল্যান্ডের চিংড়ি ও সি ফুড শিল্পে কাজ করে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ শ্রমিক, যাদের অর্ধেকই ক্রীতদাস এবং এই ক্রীতদাসদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। তাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে থাইল্যান্ডের উপকূলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার অনেক অঞ্চলে মানব পাচারকারীরা গড়ে তুলেছে বন্দিশিবির, সেগুলোর ৮০ শতাংশই মালয়েশিয়ায়। ওই দেশটি বাস্তবে পরিণত হয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের দাসের মতো খাটানোর এক স্বর্গরাজ্যে। তাই দেশটির সরকার বৈধ পন্থায় বিদেশ থেকে শ্রমিক নিতে আগ্রহী নয়, অবৈধ পন্থাই তাদের জন্য বেশি লাভজনক।
স্বাভাবিক, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ভালো মজুরির নিশ্চয়তাসহ বৈধ পন্থায় জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের কোনো সরকারের সাফল্যের তেমন কোনো রেকর্ড নেই। বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানি খাতে রয়েছে নানা রকমের অন্যায্য, প্রতারণামূলক প্রবণতা, যেটা নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্যও কোনো সরকার দেখাতে পারেনি। কিন্তু এই ছোট্ট ভূখণ্ডের দেশটিতে জনসংখ্যার চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে। আমাদের সরকার সম্ভবত সেই চাপ অনুভব করতে পারে না, অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সরকার বোঝা মনে করে না, মনে করে সম্পদ, মূল্যবান ‘মানবসম্পদ’। কিন্তু এই মানবসম্পদের এই চাপ এমন অপ্রতিরোধ্য যে কর্মসংস্থানের খোঁজে মানুষের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা সম্ভবত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে শত শত মারা পড়া কিংবা গণকবর থেকে শত শত কংকাল উদ্ধার হওয়ার রোমহর্ষক খবরগুলোও সম্ভবত এ দেশের বেকার তরুণ-যুবকদের বিদেশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দমাতে পারবে না। কিন্তু তারা যেন স্বাভাবিক ও নিরাপদ পন্থায় যেতে পারে, সেই চেষ্টা করা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সরকার এ পর্যন্ত মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের ব্যর্থতা কিছুটা কমতে পারে যদি এখন বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে নিয়ে বৈধ পথে শ্রমশক্তি রপ্তানির পথ খোলা হয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হয়েছে, তা অজানা নয়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা সীমাহীন জাতিগত বর্বরতার শিকার হচ্ছে; অস্তিত্ব রক্ষার মরিয়া চেষ্টায় তারা মাছ ধরার ট্রলার কিংবা নৌকায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় যেতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশের যেসব মানুষ রোহিঙ্গাদের মতো একই রকমের ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের সমস্যা কী? এ দেশে তো কোনো জাতিগত সহিংসতা চলছে না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের এসব মানুষ ঘর ছাড়ছে দারিদ্র্যের কারণে। কিন্তু এই মানুষগুলোর প্রিয় মাতৃভূমি তো দারিদ্র্য বিমোচনে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীকে! ছিনিয়ে এনেছে নোবেল পুরস্কার! বাংলাদেশ তো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে! অচিরেই মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে এ দেশ! তাহলে কেন এই মানুষগুলো স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হচ্ছে?
এই প্রশ্নের সোজা উত্তর হলো, এই মানুষগুলো জীবিকার সন্ধানে ঘর ছাড়ছে, অধিকাংশই ভালো উপার্জনের প্রলোভনে মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, এমনকি প্রাণও হারাচ্ছে। তার মানে, স্বদেশে তাদের কর্মসংস্থানের প্রকট অভাব। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সংগতভাবেই তাদের বলা হচ্ছে ইকোনমিক মাইগ্রেন্ট বা অর্থনৈতিক অভিবাসী। কিন্তু সমস্যা হলো, এই জীবিকার সন্ধানী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সামনে স্বাভাবিক, বৈধ ও নিরাপদ পথ নেই, বা থাকলেও তা অত্যন্ত সংকুচিত।
বৈধ ও নিরাপদ উপায়ে বিদেশে গিয়ে উপার্জন করার সুযোগ বন্ধ বা সীমিত হয়ে গেলে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ পথে তা করার প্রবণতা যে বাড়ে, তার একটা প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত বর্তমানের এই পরিস্থিতি। বাংলাদেশের যেসব মানুষ এখন সাগরে ভাসছে, তাদের গন্তব্য মালয়েশিয়া—আমাদের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি। সেখানে অভিবাসী শ্রমিকের অনেক চাহিদা রয়েছে, কিন্তু বৈধ পথে শ্রমিক যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। গত তিন বছরে এ দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছে মাত্র ৭ হাজার ১৯০ জন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক। অথচ ২০০৭ সালে গিয়েছিল ২ লাখ ৭৩ হাজার, তার পরের বছর ১ লাখ ৩১ হাজার। তখন মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো হতো বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয়। তিন বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালে মালয়েশিয়ার সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি হয় যে বাংলাদেশ বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের বাদ দিয়ে শুধু সরকারিভাবে শ্রমিক পাঠাবে। মালয়েশিয়ার সরকার বলে, তারা প্রথম দফায় বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার শ্রমিক নেবে, পরে এই সংখ্যা বাড়বে। আর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হয়েছিল যে বছরে অন্তত এক লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়া পাঠানো যাবে। এ জন্য মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের নিবন্ধন শুরু হলে সাড়ে ১৪ লাখ আগ্রহী যুবক নিজের নাম নিবন্ধন করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত তিন বছরে যেতে পেরেছে মাত্র সাত হাজার।
কিন্তু কেন? মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে গত তিন বছরে মাত্র সাড়ে আট হাজার শ্রমিকের চাহিদাপত্র এসেছে; অর্থাৎ সে দেশের সরকার বাংলাদেশের সরকারকে বোঝাতে চেয়েছে যে মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকের চাহিদা তেমন নেই। কিন্তু বাস্তবে এটা সত্য নয়; চাহিদা অবশ্যই রয়েছে, তবে সরকারিভাবে শ্রমিক আমদানিতে মালয়েশিয়ার সরকারের আগ্রহ ফুরিয়ে গেছে। কারণ, অবৈধভাবে ওই দেশে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক যেতে পারছে, যাদের খাটানো যাচ্ছে অত্যন্ত অল্প মজুরিতে। যে সময় সরকারিভাবে গেছে মাত্র সাত হাজার শ্রমিক, সেই একই সময়ে অবৈধভাবে গেছে প্রায় দেড় লাখ। আর অবৈধভাবে শ্রমিক যাওয়া ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের হিসাবে এ বছরের প্রথম তিন মাসেই ২৫ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ ও বিপজ্জনক পথে সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশে নৌকায় উঠেছে।
আর স্বাভাবিক ও বৈধ পন্থা সংকুচিত বা বন্ধ হলে যা হয়, অবৈধ পথটি হয়ে ওঠে ভীষণ অস্বাভাবিক: অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় যেতে আগ্রহী বাংলাদেশিরা পড়ে গেছে মানব পাচারের বিরাট এক আন্তর্জাতিক চক্রের কবলে। তাদের দালালেরা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের এমন সব অঞ্চলে, যেখানকার মানুষের মধ্যে দেশ ছাড়ার প্রবণতা আগে ছিল না। দালালেরা স্বল্প খরচে ভালো উপার্জনের লোভ দেখিয়ে অজ্ঞ ও দরিদ্র বেকার যুবকদের পাচার করছে, যে পাচার কিনা একপর্যায়ে পরিণত হচ্ছে অপহরণের মতো ব্যাপারে। তাদের নৌকায় তুলে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে, বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে শ্রমদাস হিসেবে। টাইম সাময়িকী ও লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ান লিখেছে, থাইল্যান্ডের চিংড়ি ও সি ফুড শিল্পে কাজ করে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ শ্রমিক, যাদের অর্ধেকই ক্রীতদাস এবং এই ক্রীতদাসদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। তাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে থাইল্যান্ডের উপকূলে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার অনেক অঞ্চলে মানব পাচারকারীরা গড়ে তুলেছে বন্দিশিবির, সেগুলোর ৮০ শতাংশই মালয়েশিয়ায়। ওই দেশটি বাস্তবে পরিণত হয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের দাসের মতো খাটানোর এক স্বর্গরাজ্যে। তাই দেশটির সরকার বৈধ পন্থায় বিদেশ থেকে শ্রমিক নিতে আগ্রহী নয়, অবৈধ পন্থাই তাদের জন্য বেশি লাভজনক।
স্বাভাবিক, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ভালো মজুরির নিশ্চয়তাসহ বৈধ পন্থায় জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের কোনো সরকারের সাফল্যের তেমন কোনো রেকর্ড নেই। বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানি খাতে রয়েছে নানা রকমের অন্যায্য, প্রতারণামূলক প্রবণতা, যেটা নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্যও কোনো সরকার দেখাতে পারেনি। কিন্তু এই ছোট্ট ভূখণ্ডের দেশটিতে জনসংখ্যার চাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে। আমাদের সরকার সম্ভবত সেই চাপ অনুভব করতে পারে না, অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সরকার বোঝা মনে করে না, মনে করে সম্পদ, মূল্যবান ‘মানবসম্পদ’। কিন্তু এই মানবসম্পদের এই চাপ এমন অপ্রতিরোধ্য যে কর্মসংস্থানের খোঁজে মানুষের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা সম্ভবত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে শত শত মারা পড়া কিংবা গণকবর থেকে শত শত কংকাল উদ্ধার হওয়ার রোমহর্ষক খবরগুলোও সম্ভবত এ দেশের বেকার তরুণ-যুবকদের বিদেশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দমাতে পারবে না। কিন্তু তারা যেন স্বাভাবিক ও নিরাপদ পন্থায় যেতে পারে, সেই চেষ্টা করা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সরকার এ পর্যন্ত মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের ব্যর্থতা কিছুটা কমতে পারে যদি এখন বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে নিয়ে বৈধ পথে শ্রমশক্তি রপ্তানির পথ খোলা হয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments