মেয়রদের মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া না-দেওয়া by আলী ইমাম মজুমদার
আনিসুল হক, সাঈদ খোকন, আ জ ম নাছির উদ্দিন |
ঢাকা
ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর এই পুরোনো বিষয়টি নতুন করে
আলোচনায় এসেছে। কোনো কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে এসব মেয়র
মন্ত্রীর মর্যাদা পেতে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় মানক্রমে সিটি মেয়রদের স্থান
নির্ধারণ করা থাকলে সরকারি সভা, সমিতি বা কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর আসন
ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়। তাঁর পক্ষেও বিভিন্ন সভা আহ্বান ও পরিচালনা হয়
সহজতর। হয়তো বা এ বিবেচনাতেই অবিভক্ত ঢাকা মহানগরের পর পর দুজন নির্বাচিত
মেয়র মন্ত্রীর আর চট্টগ্রামের মেয়র প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করতেন সূচনা
থেকেই। এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রামের মনোনীত মেয়র বা প্রশাসকেরাও মন্ত্রী বা
প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেছেন আরও আগে থেকে। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল আর
সিলেটের সিটি মেয়ররাও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেছেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত।
তবে ২০১০ সালের জুনে নির্বাচিত চট্টগ্রামের সিটি মেয়রকে এ ধরনের কোনো
মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তা দেওয়া হয়নি নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার সিটি
মেয়রদেরও। এরপর রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুর আর রংপুরে
নবনির্বাচিত মেয়রদেরও কোনো মর্যাদা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। এখানে মনে করা
সংগত হবে যে সরকারের বৈরী বলে বিবেচিত হওয়ায় তাঁরা এটা থেকে বঞ্চিত হন।
এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি মেয়ররা সরকার-সমর্থিত বিধায় বিষয়টি নতুনভাবে
ভাবনায় এসেছে নীতিনির্ধারণী মহলে।
রাষ্ট্রীয় মানক্রম নির্ধারণের বিষয়টি পৃথিবীর অনেক দেশে আছে বলে জানা যায়। কোথাও তা নেই, এমন তথ্য পাওয়া যায় না। এই মানক্রম নির্ধারণের প্রক্রিয়া ও পদধারীদের অবস্থান অবশ্য অভিন্ন নয়। বিভিন্ন দেশের চলমান পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়েই এটা করা স্বাভাবিক। আমাদেরও তা–ই হয়েছে। সময়ে সময়ে এতে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নামে আমাদের রাষ্ট্রীয় মানক্রম রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে জারি ও সংশোধন করা হয়। এটা প্রধানত রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যই প্রযোজ্য। ব্যতিক্রম শুধু সাবেক রাষ্ট্রপতিদের এখানে স্থান দেওয়া হয়েছে। মানক্রম তালিকার শেষে উল্লেখ রয়েছে যে এটা সব আনুষ্ঠানিক ও সরকারি কাজে অনুসরণ করতে হবে। এর বাইরে থাকা বেসরকারি ব্যক্তিদের জন্য এটি প্রযোজ্য হবে না। তাঁরা প্রচলিত প্রথা অনুসরণে বিভিন্ন সভা বা অনুষ্ঠানে স্থান পাবেন; এমনটাও উল্লেখ রয়েছে।
পক্ষান্তরে ভারতে সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ভারতরত্ন পদকপ্রাপ্তদের এই তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনে মানক্রম তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছেন রাজপরিবারের অনেক সদস্য আর কেন্টারবেরির আর্চবিশপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই তালিকায় স্থান নিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ফার্স্টলেডি সবাই। সুতরাং বিষয়টিকে তুচ্ছ মনে করার কোনো কারণ নেই। আর সিটি মেয়ররা অতি মর্যাদাসম্পন্ন পদধারী এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে সংযুক্ত বলে তাঁদেরও অন্যদের সঙ্গে পারস্পরিক মর্যাদার বিষয়টি যতটা সম্ভব সুস্পষ্ট থাকা উচিত। মানক্রম তালিকায় সংশোধন না এনেও সরকার নির্বাহী আদেশে কোনো বিশিষ্ট পদধারীদের সময়ে সময়ে বিভিন্ন মর্যাদা দিয়েছেন। উল্লেখ্য, কয়েকজন রাষ্ট্রদূত আর ইউজিসির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যানকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। একাধিক রাষ্ট্রদূত এখনো তা ভোগ করছেন। এ নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি কেউ করেছিলেন, এমনটা দেখা যায়নি। সিটি মেয়রদের মর্যাদাও আগে এমনি নির্বাহী আদেশবলেই দেওয়া ছিল। তবে সেটি দেওয়া হয়েছিল তাঁদের নামে। পদের বিপরীতে নয়। আর সেই নামধারী ব্যক্তি নির্দিষ্ট পদে না থাকায় পদটি হারিয়েছে এ মর্যাদা। আবার হয়তো বা নির্বাহী আদেশেই তা দেওয়া হতে পারে। তবে সেটা শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামের জন্য না হয়ে সবগুলো সিটি করপোরেশনের জন্য হওয়া সংগত হবে। উল্লেখ করা যায়, সবগুলো মহানগরের আয়তন, জনসংখ্যা, রাজস্ব আয়, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পার্থক্য ব্যাপক বিধায় মেয়রদের মানক্রমেও কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক।
সিটি মেয়রদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কার্পণ্যে তাঁদের মাঝে কিছুটা হতাশা আতে পারে। সেই নগরের কাজকর্মেও পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব। এর ফলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রতি সরকারের অঙ্গীকারের অভাবও লক্ষণীয় হয়। কোনো মহানগরের মেয়র সম্মানিত একজন ব্যক্তি। সেই সম্মান ধরে রাখতে তাঁকেও সচেষ্ট থাকা দরকার। পাশাপাশি সরকারেরও এ বিষয়ে যত্নশীল হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। মহানগর ও সিটি মেয়র দুটি বিষয় সময়ে সময়ে অকারণে অতি উচ্চে তুলে ধরা, আবার তেমনি কথায় কথায় ধুলায় মেশানো প্রতিষ্ঠানটির যুগবাহিত মর্যাদার পরিপন্থী। মেয়র পদটি কোনো না কোনো নামে সব দেশেই আছে। আর তা আছে গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে। লন্ডন নগরের একটি ক্ষুদ্র কাউন্টি সিটি অব লন্ডনের প্রধান লর্ড মেয়র। নিজ অধিক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান রাজা বা রানির ঠিক নিচে। অধিক্ষেত্রের বাইরেও তাঁর মর্যাদা একজন কেবিনেট মন্ত্রী। আসন গ্রহণ করেন মন্ত্রীদের পর পর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানক্রম অনুসারে প্রেসিডেন্ট, অনুষ্ঠানে উপস্থিত সফরকারী রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেই রাজ্যের গভর্নর এবং এর পরপরই সংশ্লিষ্ট সিটি মেয়রের অবস্থান। ভারতীয় উপমহাদেশে ঠিক এ ধরনের কিছু না থাকলেও খুবই সম্মানিত ব্যক্তিরা মেয়রের পদ নিকট অতীতেও অলংকৃত করেছেন। দেশ বিভাগ-পূর্ব সময়ে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিধান চন্দ্র রায়ের মতো নেতারা। একপর্যায়ে ডেপুটি মেয়র ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেরেবাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুজনে পরবর্তী সময়ে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দেশ বিভাগের পরও একপর্যায়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও শেরেবাংলা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। বিধান চন্দ্র রায় হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। দেখা যায়, সেবামূলক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটি দেশের ভবিষ্যৎ নেতা গড়ায়ও গৌরবজনক ভূমিকা রাখতে পারে। এসব বিষয় আমাদের স্মরণে রাখা ও অনুসরণ করার আবশ্যকতা রয়েছে।
মেয়রদের পদমর্যাদা দেওয়ার বিপরীতেও কেউ কেউ যুক্তি দেখান। থাকতে পারে কোনো না কোনো যুক্তি। তবে কাজ করার সুবিধার্থে পদমর্যাদা অপরিহার্য না হলেও প্রয়োজনীয় বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। আর আমাদের তো অতীত ঐতিহ্যও রয়েছে। মাঝখানে কিছুটা ছেদ পড়েছে অযাচিত কারণে। বিভিন্ন দেশের নজিরও আছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধানের জন্য এরূপ পদমর্যাদা দেওয়ার বিধান সেই আইনে আছে কি নেই, তা অপ্রাসঙ্গিক। তা না থাকলেও সরকার ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রথম শ্রেণির পৌরসভার মেয়রদের একটি অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। একইভাবে উপযুক্ত স্থানে সিটি মেয়রদের দেখাতে আপত্তি থাকার কথা নয়। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন সময়সাপেক্ষ বা কিছু জটিলতা থাকলে আপাতত আগের মতো নির্বাহী আদেশে পদমর্যাদাটি নির্ধারণ করে দেওয়া যায়। তবে সেটা ব্যক্তির বরাতে না করে পদের বিপরীতে করাই যৌক্তিক হবে।
আলোচনা করা হয়েছে, মহানগরগুলোর গুরুত্বে ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। রাজধানী ঢাকা দুই ভাগে বিভক্ত হলেও এর প্রশাসনিক মর্যাদা অত্যন্ত বেশি। বিভক্ত হওয়ার পরও প্রতিটি সিটি করপোরেশনের আওতায় জাতীয় সংসদের বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকা রয়েছে। ঠিক তেমনি বন্দরনগর চট্টগ্রামকে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয়। অর্থনীতির বিবেচনায় এই মহানগরের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্য মহানগরগুলোকে ঠিক হয়তো একই স্তরে বিবেচনা করা যায় না। তা সত্ত্বেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়রদের মর্যাদা দিতে গিয়ে অন্যদের উপেক্ষা করা অবিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে। বরং বিষয়টি অপ্রিয় হলেও বলতে হয়, এ দুটি প্রধান নগরের তিনজন মেয়রের নির্বাচনের চেয়ে অবশিষ্টদের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কোনো অংশেই কম ছিল না। সেটা যা-ই হোক, সবগুলো নির্বাচনই হয়েছে বর্তমান কিংবা এর আগের মেয়াদের মহাজোট সরকারের সময়কালে। এসব নির্বাচনের সাফল্য ও ব্যর্থতা যা-ই থাকুক, এর অংশীদার এই সরকার। তাই তিক্ততা সামনে না এনে দেশের সব সিটি মেয়রের পদের বিপরীতে যথাযথ মর্যাদা নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবিটি সংগত।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
রাষ্ট্রীয় মানক্রম নির্ধারণের বিষয়টি পৃথিবীর অনেক দেশে আছে বলে জানা যায়। কোথাও তা নেই, এমন তথ্য পাওয়া যায় না। এই মানক্রম নির্ধারণের প্রক্রিয়া ও পদধারীদের অবস্থান অবশ্য অভিন্ন নয়। বিভিন্ন দেশের চলমান পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়েই এটা করা স্বাভাবিক। আমাদেরও তা–ই হয়েছে। সময়ে সময়ে এতে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নামে আমাদের রাষ্ট্রীয় মানক্রম রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে জারি ও সংশোধন করা হয়। এটা প্রধানত রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্যই প্রযোজ্য। ব্যতিক্রম শুধু সাবেক রাষ্ট্রপতিদের এখানে স্থান দেওয়া হয়েছে। মানক্রম তালিকার শেষে উল্লেখ রয়েছে যে এটা সব আনুষ্ঠানিক ও সরকারি কাজে অনুসরণ করতে হবে। এর বাইরে থাকা বেসরকারি ব্যক্তিদের জন্য এটি প্রযোজ্য হবে না। তাঁরা প্রচলিত প্রথা অনুসরণে বিভিন্ন সভা বা অনুষ্ঠানে স্থান পাবেন; এমনটাও উল্লেখ রয়েছে।
পক্ষান্তরে ভারতে সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ভারতরত্ন পদকপ্রাপ্তদের এই তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনে মানক্রম তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছেন রাজপরিবারের অনেক সদস্য আর কেন্টারবেরির আর্চবিশপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই তালিকায় স্থান নিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ফার্স্টলেডি সবাই। সুতরাং বিষয়টিকে তুচ্ছ মনে করার কোনো কারণ নেই। আর সিটি মেয়ররা অতি মর্যাদাসম্পন্ন পদধারী এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে সংযুক্ত বলে তাঁদেরও অন্যদের সঙ্গে পারস্পরিক মর্যাদার বিষয়টি যতটা সম্ভব সুস্পষ্ট থাকা উচিত। মানক্রম তালিকায় সংশোধন না এনেও সরকার নির্বাহী আদেশে কোনো বিশিষ্ট পদধারীদের সময়ে সময়ে বিভিন্ন মর্যাদা দিয়েছেন। উল্লেখ্য, কয়েকজন রাষ্ট্রদূত আর ইউজিসির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যানকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। একাধিক রাষ্ট্রদূত এখনো তা ভোগ করছেন। এ নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি কেউ করেছিলেন, এমনটা দেখা যায়নি। সিটি মেয়রদের মর্যাদাও আগে এমনি নির্বাহী আদেশবলেই দেওয়া ছিল। তবে সেটি দেওয়া হয়েছিল তাঁদের নামে। পদের বিপরীতে নয়। আর সেই নামধারী ব্যক্তি নির্দিষ্ট পদে না থাকায় পদটি হারিয়েছে এ মর্যাদা। আবার হয়তো বা নির্বাহী আদেশেই তা দেওয়া হতে পারে। তবে সেটা শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামের জন্য না হয়ে সবগুলো সিটি করপোরেশনের জন্য হওয়া সংগত হবে। উল্লেখ করা যায়, সবগুলো মহানগরের আয়তন, জনসংখ্যা, রাজস্ব আয়, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পার্থক্য ব্যাপক বিধায় মেয়রদের মানক্রমেও কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক।
সিটি মেয়রদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কার্পণ্যে তাঁদের মাঝে কিছুটা হতাশা আতে পারে। সেই নগরের কাজকর্মেও পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব। এর ফলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রতি সরকারের অঙ্গীকারের অভাবও লক্ষণীয় হয়। কোনো মহানগরের মেয়র সম্মানিত একজন ব্যক্তি। সেই সম্মান ধরে রাখতে তাঁকেও সচেষ্ট থাকা দরকার। পাশাপাশি সরকারেরও এ বিষয়ে যত্নশীল হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। মহানগর ও সিটি মেয়র দুটি বিষয় সময়ে সময়ে অকারণে অতি উচ্চে তুলে ধরা, আবার তেমনি কথায় কথায় ধুলায় মেশানো প্রতিষ্ঠানটির যুগবাহিত মর্যাদার পরিপন্থী। মেয়র পদটি কোনো না কোনো নামে সব দেশেই আছে। আর তা আছে গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে। লন্ডন নগরের একটি ক্ষুদ্র কাউন্টি সিটি অব লন্ডনের প্রধান লর্ড মেয়র। নিজ অধিক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান রাজা বা রানির ঠিক নিচে। অধিক্ষেত্রের বাইরেও তাঁর মর্যাদা একজন কেবিনেট মন্ত্রী। আসন গ্রহণ করেন মন্ত্রীদের পর পর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানক্রম অনুসারে প্রেসিডেন্ট, অনুষ্ঠানে উপস্থিত সফরকারী রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সেই রাজ্যের গভর্নর এবং এর পরপরই সংশ্লিষ্ট সিটি মেয়রের অবস্থান। ভারতীয় উপমহাদেশে ঠিক এ ধরনের কিছু না থাকলেও খুবই সম্মানিত ব্যক্তিরা মেয়রের পদ নিকট অতীতেও অলংকৃত করেছেন। দেশ বিভাগ-পূর্ব সময়ে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিধান চন্দ্র রায়ের মতো নেতারা। একপর্যায়ে ডেপুটি মেয়র ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেরেবাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুজনে পরবর্তী সময়ে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দেশ বিভাগের পরও একপর্যায়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও শেরেবাংলা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। বিধান চন্দ্র রায় হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। দেখা যায়, সেবামূলক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটি দেশের ভবিষ্যৎ নেতা গড়ায়ও গৌরবজনক ভূমিকা রাখতে পারে। এসব বিষয় আমাদের স্মরণে রাখা ও অনুসরণ করার আবশ্যকতা রয়েছে।
মেয়রদের পদমর্যাদা দেওয়ার বিপরীতেও কেউ কেউ যুক্তি দেখান। থাকতে পারে কোনো না কোনো যুক্তি। তবে কাজ করার সুবিধার্থে পদমর্যাদা অপরিহার্য না হলেও প্রয়োজনীয় বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। আর আমাদের তো অতীত ঐতিহ্যও রয়েছে। মাঝখানে কিছুটা ছেদ পড়েছে অযাচিত কারণে। বিভিন্ন দেশের নজিরও আছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধানের জন্য এরূপ পদমর্যাদা দেওয়ার বিধান সেই আইনে আছে কি নেই, তা অপ্রাসঙ্গিক। তা না থাকলেও সরকার ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রথম শ্রেণির পৌরসভার মেয়রদের একটি অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। একইভাবে উপযুক্ত স্থানে সিটি মেয়রদের দেখাতে আপত্তি থাকার কথা নয়। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন সময়সাপেক্ষ বা কিছু জটিলতা থাকলে আপাতত আগের মতো নির্বাহী আদেশে পদমর্যাদাটি নির্ধারণ করে দেওয়া যায়। তবে সেটা ব্যক্তির বরাতে না করে পদের বিপরীতে করাই যৌক্তিক হবে।
আলোচনা করা হয়েছে, মহানগরগুলোর গুরুত্বে ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। রাজধানী ঢাকা দুই ভাগে বিভক্ত হলেও এর প্রশাসনিক মর্যাদা অত্যন্ত বেশি। বিভক্ত হওয়ার পরও প্রতিটি সিটি করপোরেশনের আওতায় জাতীয় সংসদের বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকা রয়েছে। ঠিক তেমনি বন্দরনগর চট্টগ্রামকে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয়। অর্থনীতির বিবেচনায় এই মহানগরের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্য মহানগরগুলোকে ঠিক হয়তো একই স্তরে বিবেচনা করা যায় না। তা সত্ত্বেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়রদের মর্যাদা দিতে গিয়ে অন্যদের উপেক্ষা করা অবিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে। বরং বিষয়টি অপ্রিয় হলেও বলতে হয়, এ দুটি প্রধান নগরের তিনজন মেয়রের নির্বাচনের চেয়ে অবশিষ্টদের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কোনো অংশেই কম ছিল না। সেটা যা-ই হোক, সবগুলো নির্বাচনই হয়েছে বর্তমান কিংবা এর আগের মেয়াদের মহাজোট সরকারের সময়কালে। এসব নির্বাচনের সাফল্য ও ব্যর্থতা যা-ই থাকুক, এর অংশীদার এই সরকার। তাই তিক্ততা সামনে না এনে দেশের সব সিটি মেয়রের পদের বিপরীতে যথাযথ মর্যাদা নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবিটি সংগত।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments