সিলেটের প্রবাসী অধ্যুষিত ৮ উপজেলায় ডাকাত আতঙ্ক, রাত জেগে পাহারায় জনতা by ওয়েছ খছরু
সিলেটের দক্ষিণ অংশের ৮ উপজেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে ডাকাত আতঙ্ক। প্রতি রাতেই প্রবাসীসহ ধর্নাঢ্যদের পরিবারে হানা দিচ্ছে সশস্ত্র ডাকাত দল। এতে করে ঘুম হারাম হয়ে গেছে গ্রামের মানুষের। ডাকাত রুখতে রাত জেগে পাহারা বসিয়েছে এলাকার মানুষ। গ্রামীণ এলাকায় যখন একের পর এক ডাকাতির ঘটনা ঘটছে তখন সিলেট শহরতলিতেও হানা দিতে শুরু করেছে ডাকাত দল। পুলিশের টহলের মুখেও সশস্ত্র ডাকাতরা হানা দিয়ে লুটে নিচ্ছে মালামাল। আবার কখনও ডাকাত সর্দাররা ধরা পড়লেও মামলা না থাকার অজুহাতে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিচ্ছে। এতে করে বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের। অনেক স্থানে গ্রামবাসী ডাকাতদের আটক করে গণধোলাই দিচ্ছে। পুলিশ বলছে, ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায় সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক, সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক, সিলেট-জগন্নাথপুর সড়কে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রাতের বেলা গাড়ি তল্লাশি চালানোও হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, বাস্তবে রাতে পুলিশের টহল তেমন নেই। এ কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ডাকাতির পর ডাকাত দল নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে। সিলেট জেলার মোট ১৩টি উপজেলা রয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের উত্তর অংশে রয়েছে ৫টি উপজেলা। আর দক্ষিণ অংশে রয়েছে ৮টি উপজেলা। এই উপজেলাগুলো হচ্ছে, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ। এই ৮টি উপজেলায় ডাকাত আতঙ্ক চরমভাবে দেখা দিয়েছে। সাধারণ বর্ষার মওসুমের সিলেটের নদী প্রবণ এলাকাগুলোতে ডাকাতি বাড়ে। আর শীত মওসুমে হাইওয়ে রুটের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ডাকাত আতঙ্ক দেখা দেয়। কিন্তু গেল কয়েক বছরের মধ্যে এবার দক্ষিণ সিলেটের প্রায় সব কটি উপজেলাতেই ডাকাতি বেড়েছে। ডাকাতরা হানা দিয়ে লুটে নিচ্ছে সর্বস্ব। ডাকাতের হামলায় আহত হয়েছেন অনেকেই। কোথাও কোথাও ডাকাতরা গুলিবর্ষণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ডাকাতি সংগঠিত করছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি দুই মাসে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২০টি ডাকাতি সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু পুলিশের খাতায় অধিকাংশ ঘটনাই ডাকাতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। আর ডাকাতে আক্রান্ত হওয়া পরিবারের সদস্যরা পুলিশি ঝামেলা এড়াতে মামলা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন না। ওসমানীনগরে ডাকাত আতঙ্কে অন্তত ৩০ গ্রামের মানুষ নির্ঘুম রাত্রীযাপন করে পাহারা দিচ্ছে। শুক্রবার মধ্য রাতে রশিদপুর এলাকায় এক প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে লোকজন প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এ সময় ধাওয়া খেয়ে ডাকাতরা ওসমানীনগরে প্রবেশ করে। খবর পেয়ে ওসমানীনগর থানা পুলিশ এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ সচেতন নাগরিকদের ফোন করে সতর্ক করে দিলে প্রতিটি এলাকার মসজিদে মাইকযোগে ডাকাত প্রবেশের বিষয়টি জানানো হয়। এতে এলাকার লোকজন সমবেত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং রাত জেগে পাহারা দেয়। গোয়ালাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মানিক বলেন, এলাকায় ডাকাত প্রবেশের বিষয়টি ফোন করে জানায় পুলিশ। এতে এলাকাবাসী সমবেত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং পাহারা দেয়। ওসমানীনগর থানার ওসি মুরসালিন বলেন, ডাকাতরা রশিদপুর এলাকায় ব্যর্থ হয়ে ওসমানীনগরে প্রবেশ করার বিষয়টি জানতে পেরে জনপ্রতিনিধিসহ সচেতনমহলকে অবগত করি। এদিকে চলতি বছরের ৫ মাসে ওসমানীনগরে ৭টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি মাসেই ২ দিনে তিনটি ঘটনা ঘটেছে। ১৬ই মে উপজেলার ব্রা?হ্মণশাসন গ্রামস্থ আজিজুর রহমান এবং একই এলাকার ধন মিয়ার বাড়িতে হানা দিয়ে ডাকাতরা স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকাসহ প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। ১৮ই মে নিজ কুরুয়া উত্তর পাড়া গ্রামের প্রবাসী নুরুল আম্বিয়া আওলাদের বাড়িতে হানা দিয়ে নগদ টাকাসহ দশ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে। এ তিনটি ডাকাতির ঘটনায় গৃহকর্তাসহ ৪ জন গুরুতর আহত হয়। ৭টি ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও ঘটনাগুলোকে ডাকাতি না বলে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছে পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত শনিবার ১৬ই মে ব্রাহ্মণশাসন এলাকার ঘটনায় একটি ডাকাতির মামলা রুজু করেছে বলে জানিয়েছেন ওসি মুরসালিন। এমনকি অভিযান চালিয়ে ডিবি পুলিশের সহায়তায় এক ডাকাতকে আটক করলেও রহস্যজনক কারণে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ওসমানীনগরের তালিকাভুক্ত অনন্ত ৩০ জন ডাকাত জামিনে রয়েছে। যার কারণে প্রায়ই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। বিশ্বনাথে ডাকাত আতঙ্ক : প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের বিশ্বনাথে ডাকাতি আতঙ্কে রয়েছেন মানুষ। বেশির ভাগই ডাকাত দলের নজরে পড়ছে প্রবাসী-ব্যবসায়ীদের বাড়ি। শুক্রবার রাতে বিশ্বনাথের ধর্মদা গ্রামের সাহেদ আহমদের বাড়ি ও বিশ্বনাথের রশিদপুর এক প্রবাসীর বাসায় ডাকাত দল হানা দেয়। তবে এলাকাবাসীর প্রতিরোধে ডাকাত দল পালিয়ে যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য ইজার আলী। তিনি বলেন, ডাকাত দল ওই দুই বাড়িতে হানা দেয়। এ সময় স্থানীয় মসজিদে মাইকিং করা হলে শ’শ মানুষ বের হয়ে আসলে ডাকাত দল পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বলে তিনি জানান। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ডাকাতরা অত্যাধুনিক যন্ত্র দিয়ে ঘরের সামনের গেটের তালা ও দরজা লকার ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে পরিবারের সদস্যদের অস্ত্রেমুখে জিম্মি করে হাত-পা বেঁধে লুটপাট চালায়। অনেক বাড়িতে ডাকাতির সময় ডাকাতরা দেশীয় অস্ত্রসহ আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে থাকতে দেখেছেন বলে গৃহকর্তারা জানান। ডাকাতদের হামলায় অনেকেই আবার আহতও হচ্ছেন। রাতে অনেক বাড়িতে ডাকাতির খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন এগিয়ে এলে ডাকাতরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে ফাঁকা গুলি চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথাও শোনা গেছে। উদ্ধার করা হচ্ছে না ডাকাতদের ব্যবহৃত হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রও। গত কয়েক মাসের ভেতরে উপজেলায় বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে । সদর ইউনিয়নের ইমিদপুর গ্রামের লন্ডন প্রবাসী জিতু মিয়া, জানাইয়া গ্রামের ব্যবসায়ী আকবর হোসেন কিসমত, দেওকলস ইউনিয়নের আলাপুর গ্রামের লন্ডন প্রবাসী আবদুল মতিন, রামপাশা ইউনিয়নের চকরামপ্রসাদ (লামারচক) গ্রামের সৌদি আরব প্রবাসী জামাল হোসেন, খাজান্সি ইউনিয়নের নোয়ারাই গ্রামের লন্ডন প্রবাসী ছমক আলী, বাওয়ানপুর গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী আবদুল হাই বাবুল, গুমরাগুল গ্রামের সৌদি প্রবাসী আলাউদ্দিন ও সর্বশেষ গত বুধবার উপজেলার হিমিদপুর গ্রামের বাবুল খানের বাড়িতে ডাকাতি সংগঠিত হয়েছে। এ ব্যাপারে সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা শহিদুল ইসলাম সাহিদ বলেন, ডাকাত আতঙ্কে এলাকায় প্রতি রাতে আমরা কয়েকজন ডাকাত প্রতিরোধ করার জন্য পাহারা দিচ্ছি। উপজেলা শাখার মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি ছয়ফুল হক বলেন, পুলিশি তৎপরতা না থাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলা সদরের পুরান বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মনির হোসেন বলেন, বিগত দিনের চেয়ে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। উপজেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি শাহ আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে চুরি-ডাকাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এলাকাবাসী আতঙ্কে রয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল ভোররাতে ডাকাতরা উপজেলার ধর্মদা শফিক মিয়ার বাড়ি, রশিদপুরে এক প্রবাসী বাসার, মুফতি গাওয়ে প্রবাসীর বাসায় হানা দেয়। এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে যায়। তবে, রশিদপুরের পার্শ্ববর্তী জনমঙ্গল হাই স্কুলের সব’কটি সিলিং ফ্যান নিয়ে পালিয়েছে। জকিগঞ্চে গণপিটুনি : শুক্রবার সকালে জকিগঞ্জে এক ডাকাতকে আটকে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয়রা। পরে আটককৃত ডাকাত জামাল হোসেন (৪০) কে জকিগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। গত দুই মাস আগে উপজেলার বাটইশাইল গ্রামে ডাকাতিকালে ডাকাত সর্দার গুলি করে দুজনকে আহত করে। শুক্রবার সকাল ৯টায় উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রাম থেকে তাকে জনতা ধাওয়া করে আটক করে পিটুনি দিয়ে জকিগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে ডাকাত জামালকে হস্তান্তর করে। আটককৃত জামাল শরিফাবাদ গ্রামের মখলিছুর রহমানের ছেলে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ডাকাত সর্দার জামাল এলাকার জনসাধারণের জন্য আতঙ্ক। তার ভয়ে রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিতেন অনেকে। শুক্রবার জামাল ডাকাত আটকের খবরে এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তি নেমে এসেছে। জকিগঞ্জ থানার ওসি সফিকুর রহমান খান জানান, আটক জামালের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টসহ সিলেটের বিভিন্ন থানায় বেশ কয়েকটি ডাকাতির মামলা রয়েছে। গত ২ মাস আগে উপজেলার বাটইশাইল গ্রামে ডাকাতিকালে তার গুলিতে দুই ব্যক্তি আহত হন। শহরতলীতেও ডাকাতি: গত এক মাসে সিলেট শহরতলীর আশপাশ এলাকায়ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার রাতে সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আশিক আহমদের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতরা নগদ টাকাসহ প্রায় ৪০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়েছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ইলাশপুর গ্রামে ডাকাতরা হানা দিয়ে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় ৭ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। বাড়ির মালিক শিক্ষক আবদুল হাই বলেন, রাত ৩টার দিকে সশস্ত্র একদল ডাকাত তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাড়ির পুরুষদের বেঁধে একটি কক্ষে আটকে রাখে। এ সময় তারা নগদ ৬০ হাজার টাকা, ১০ ভরি স্বর্ণ, ৪টি মোবাইল ও অন্যান্য জিনিসপত্রসহ প্রায় ৭ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এদিকে, সিলেট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডাকাতির বিষয়টি পুলিশ সিরিয়াস নিয়েছে। এ কারণে সড়ক মহাসড়কগুলোতে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। তল্লাশিও করা হচ্ছে বিভিন্ন রুটে।
No comments