বদলে গেল বনকিশোর by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
রাজশাহীর চারঘাটে ‘শিক্ষা সেতু’ পার হয়ে বনকিশোর গ্রামের বিদ্যালয়ে যাচ্ছে খোর্দগোবিন্দপুর গ্রামের শিক্ষার্থীরা l ছবি: শহীদুল ইসলাম |
বাড়ি
থেকে বের হলেই বিদ্যালয়। দেখা যায়, কিন্তু সরাসরি যাওয়া যায় না। কারণ,
মাঝখানে বড়াল নদ। নদের পশ্চিম পারে খোর্দগোবিন্দপুর আর পূর্ব পারে বনকিশোর
গ্রাম। বনকিশোরের ১১ যুবক এবার এই দুই গ্রামের ব্যবধান ঘুচিয়েছেন। তাঁদের
উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি হয়েছে সেতু। নাম ‘শিক্ষা সেতু’।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্টুডেন্টস ক্রিয়েটিভ ভেঞ্চার। ১১ জন মিলে সংগঠনটি করায় এটি ‘ওরা ১১ জন’ নামেই বেশি পরিচিত। ২০০৫ সালে গড়ে তোলা হয় সংগঠনটি। গত ২৪ এপ্রিল নানা আয়োজনে হয়ে গেল তার ১০ বছর পূর্তি উৎসব। ওরা ১১ জনের কাজের বিবরণ এক লাইনে বললেন বনকিশোর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল ইসলাম—‘শুধু এই সেতু নয়, ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার তৈরি, গ্রামবাসীর রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, ডায়াবেটিস পরীক্ষা, পাঠাগার গড়া, মাদকবিরোধী আন্দোলন, নদী দখলমুক্ত করাসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে গ্রামের মানুষকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলেছে সংগঠনটি।’
বছর দশেক আগেও কিন্তু বনকিশোরের পরিস্থিতি ছিল বেশ উদ্বেগের। সেই উদ্বেগ থেকেই গড়ে ওঠে ‘স্টুডেন্টস ক্রিয়েটিভ ভেঞ্চার’। সংগঠন গড়ে তোলার কাহিনি শোনালেন উদ্যোক্তারা। শুরুটা করলেন সংগঠনটির প্রধান জাহিদুল ইসলাম। জানালেন, বেশির ভাগ বাড়িতে শৌচাগার ছিল না। লোকজন যেখানে-সেখানে মলত্যাগ করত।
অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত গ্রামবাসীর। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা ১১ জন যুবক বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, গ্রামের এই চিত্র বদলে দিতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে। জাহিদুল বলেন, ‘কাজটা শুরুর করার পর বুঝলাম এটা বেশ কঠিন। শুরুতে কেউ আমাদের কথায় কান দিচ্ছিল না! কিন্তু হাল ছাড়িনি। ভাবলাম, শৌচাগারের জন্য রিং-স্ল্যাব হাতের কাছে পেলে গ্রামবাসী সহজেই সেটা গ্রহণ করবে। তাই একপর্যায়ে রিং-স্ল্যাব তৈরির কথা চিন্তা করলাম।’
কিন্তু এ জন্য তো তহবিল দরকার। তহবিল গড়ার গল্পটাও শোনালেন জাহিদুল, ‘নিজেদের হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে সেই টাকায় গ্রামের একটি হাট ইজারা নেওয়া হলো। ধীরে ধীরে তহবিলটা বড় হলো। তারপর নিজেরাই রিং-স্ল্যাব তৈরি করা শুরু করলাম।’
কিন্তু গ্রামের সবার পক্ষে রিং-স্ল্যাব কিনে নিয়ে তো আর শৌচাগার বসানো সম্ভব নয়! সংগঠনের আরেক সদস্য ফারুক হোসেন জানালেন, একেবারেই সহায়-সম্বলহীন মানুষের বাড়িতে নিজেদের খরচে শৌচাগার বসিয়ে দেওয়া হলো। আর সচ্ছল পরিবারগুলোতে গিয়ে শৌচাগার তৈরি করে নেওয়ার জন্য বোঝাতে থাকলেন তাঁরা।
একপর্যায়ে শতভাগ বাড়িতে শৌচাগার হলেও তা ব্যবহার করানোর জন্যও ঝক্কি পোহাতে হয়েছে সংগঠনের সদস্যদের। শৌচাগার থাকলেও সবাই তা ব্যবহার করত না। মানুষের মধ্যে শৌচাগার ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সকালে উঠে সংগঠনের সদস্যদের রাস্তা পাহারা পর্যন্ত দিতে হয়েছে, যাতে কেউ বাইরে মলত্যাগ না করে। জানালেন সংগঠনের সদস্য শামীম পারভেজ। ধীরে ধীরে সবাই শৌচাগার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই খবর তখন প্রথম আলো, বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয় ।
বনকিশোর গ্রাম বদলের এই খবর জেনে চারঘাট উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হামিদুর রহমান ওই যুবকদের পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেন। সেই টাকা দিয়ে পাঠাগার গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনটি। বর্তমানে যশোর সেনানিবাসে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত হামিদুর রহমান বললেন, ‘সংগঠনটিকে পাঁচ হাজার টাকা দিই। ওই টাকা দিয়ে পাঠাগার গড়তে তখনই তারা বই কিনে ফেলে। তখন আমি নিজের বেশ কিছু পুরাতন বইও তাদের দিই।’
এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদিতে’ বনকিশোর গ্রাম ও সংগঠনটিকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার হলে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের সৌজন্যে তাদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয় বই কেনার জন্য। তারা গ্রামের পুরোনো একটি ক্লাবঘর সংস্কার করে সেখানেই পাঠাগার চালু করে। পাঠাগারটিতে এখন দেড় হাজারের মতো বই আছে। পাঠাগার থেকে সবাই বই নিয়ে পড়তে পারে। যারা পাঠাগারে আসতে পারে না, বিশেষ করে গৃহবধূদের জন্য সপ্তাহে একবার বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া হয়। সপ্তাহ শেষে আবার তা বদলে দেওয়া হয়। সংগঠনের সদস্য রফিকুল ইসলাম এই কাজ করে যাচ্ছেন।
গৃহবধূ জেসমিন নাহার বলেন, ওরা বই পড়ার নেশা তৈরি করে দিয়েছে। ভালো লাগা বেশ কিছু বই তিনি দুবার করে পড়ে ফেলেছেন।
সম্প্রতি একদিন পাঠাগারে গিয়ে দেখা যায়, চমৎকারভাবে সাজানো বইপত্র। তাদের একটি প্রদর্শনী বোর্ড রয়েছে। তাতে ছবি ও পত্রিকার ক্লিপিংস রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর একটি ছবি আছে। তাঁরা এই গ্রাম দেখতে এসেছিলেন। আছে এ রকম আরও বেশ কিছু ছবি।
সংগঠনের সদস্য রফিকুল ইসলাম জানালেন, গ্রামের আরেক সমস্যা ছিল মাদক। দীর্ঘদিন মাদকাসক্ত থাকায় অসুস্থ হয়ে গ্রামের অকুমার দাস মারা গেলেন। তার তিন শিশুর কান্না সবার মনে দাগ কাটে। এরপর তাঁরা শুরু করলেন গ্রামে মাদকবিরোধী আন্দোলন। তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে পাশের গ্রামের একটি মদের ভাটি উচ্ছেদ করেন ও গ্রামে প্রকাশ্যে মাদক সেবন নিষিদ্ধ করেন। এ আন্দোলন পুরোপুরি সফল হয়। ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল গ্রামে মাদকবিরোধী উৎসবের আয়োজন করা হয়।
২০১২ সালের ১৬ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী জেলা বন্ধুসভার সদস্যরা বনকিশোর গ্রামে যান। তাঁরা সবাইকে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁদের আহ্বানে সেদিন ধূমপান ছেড়ে দেওয়া ৩০ জন গ্রামবাসীকে একটি করে গোলাপ দেওয়া হয়। ‘আমাদের আহ্বানে যাঁরা ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার শপথ নেন, পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি কেউ আর ধূমপান করেন না’, বললেন রাজশাহী বন্ধুসভার সহসভাপতি সাহানারা জেসমিন।
ওরা ১১ জনের সর্বশেষ প্রচেষ্টার ফল হলো সেতুটি। এই সেতু নির্মাণের পেছনের গল্পটা শোনালেন সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা আবদুল লতিফ, ‘খোর্দগোবিন্দপুর গ্রামের শিশু শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে সেতু তৈরির উদ্যোগ নেয় সংগঠনটি। মোসাদ্দারুল, শামীমুল, শিহাবুল, আরিফুজ্জামান, আদনান মারুফ, বজলুর ও মাজহারুলসহ ওরা ১১ জনের সবাই একদিন এসে আমার কাছে ওই প্রস্তাব দেন। পরে বৈঠক ডেকে গ্রামের সবাইকে বিষয়টি জানানো হয়। গ্রামবাসী এক বাক্যে রাজি। প্রশ্ন উঠল খরচ নিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো, যে যা পারে তাই দিয়ে সহায়তা করবে।’
গ্রামের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন জানালেন, গ্রামবাসীর এই একতাই বড় শক্তি। এই একতার জন্যই এবার সেতুর জন্য মানুষ মুষ্টিচাল পর্যন্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছে। যিনি কিছু দিতে পারেননি, তিনি শ্রম দিয়েছেন।
গত ২ এপ্রিল বনকিশোর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বড়াল নদীর ওপরে ১২০ হাত লম্বা ও সাড়ে চার হাত প্রস্থ সেতু হয়ে গেছে। সেদিন সেতুর দুই পাশের রাস্তার মাটি কেটে হাঁটার উপযোগী করা হচ্ছিল। সেই সেতু পার হয়ে চলে এল খোর্দগোবিন্দপুরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শিক্ষার্থী মিনারুল ইসলাম। সে বলে, তাকে আর কষ্ট করে আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যেতে হবে না। সেতু হওয়ায় এখন সে বনকিশোর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হবে।
সেতুর সুবিধা বর্ণনা করলেন গৃহবধূ শামসুন্নাহার (৬০), ‘আগে বনকিশোর থাইকি বাঁ দিক দিয়া খোর্দগোবিন্দপুর যাইতে সাত কিলোমিটার আর ডাইন দিক দিয়া যাইতে পাঁচ কিলোমিটার ঘাঁটা (পথ) হাঁটতে হচ্ছিলি। অ্যাকুন খালি ১২০ হাত লম্বা একটা সাঁকো পার হলেই হচ্ছে।’
‘শিক্ষা সেতু’ নাম হওয়ার মর্মার্থ জানালেন বনকিশোর গ্রামের কলেজশিক্ষক ইসহাক আলী, ‘এত দিন খোর্দগোবিন্দপুর গ্রামের শিশুরা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বনকিশোর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের ভবন দেখেছে, কিন্তু আসতে পারেনি। দুই আড়াই কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে পড়েছে। এই সেতু হওয়ার কারণে এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের হাতের মুঠোয় এসেছে। এ জন্যই মুখে মুখে সেতুটির নাম শিক্ষা সেতু হয়ে গেছে।’
এই গ্রামের বাসিন্দা বাদশা হোসেন রাজশাহী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বলেন, সংগঠনটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামের চিত্র পাল্টে দিয়েছে।
‘স্টুডেন্টস ক্রিয়েটিভ ভেঞ্চারের’ প্রধান জাহিদুল ইসলাম বললেন, এটা একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। গ্রামবাসীসহ সংগঠনের সব সদস্যের ঐকান্তিক চেষ্টায় এসব কাজ সম্ভব হয়েছে।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর গ্রামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্টুডেন্টস ক্রিয়েটিভ ভেঞ্চার। ১১ জন মিলে সংগঠনটি করায় এটি ‘ওরা ১১ জন’ নামেই বেশি পরিচিত। ২০০৫ সালে গড়ে তোলা হয় সংগঠনটি। গত ২৪ এপ্রিল নানা আয়োজনে হয়ে গেল তার ১০ বছর পূর্তি উৎসব। ওরা ১১ জনের কাজের বিবরণ এক লাইনে বললেন বনকিশোর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল ইসলাম—‘শুধু এই সেতু নয়, ঘরে ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার তৈরি, গ্রামবাসীর রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, ডায়াবেটিস পরীক্ষা, পাঠাগার গড়া, মাদকবিরোধী আন্দোলন, নদী দখলমুক্ত করাসহ নানা কর্মসূচি দিয়ে গ্রামের মানুষকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলেছে সংগঠনটি।’
বছর দশেক আগেও কিন্তু বনকিশোরের পরিস্থিতি ছিল বেশ উদ্বেগের। সেই উদ্বেগ থেকেই গড়ে ওঠে ‘স্টুডেন্টস ক্রিয়েটিভ ভেঞ্চার’। সংগঠন গড়ে তোলার কাহিনি শোনালেন উদ্যোক্তারা। শুরুটা করলেন সংগঠনটির প্রধান জাহিদুল ইসলাম। জানালেন, বেশির ভাগ বাড়িতে শৌচাগার ছিল না। লোকজন যেখানে-সেখানে মলত্যাগ করত।
অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত গ্রামবাসীর। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা ১১ জন যুবক বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, গ্রামের এই চিত্র বদলে দিতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে। জাহিদুল বলেন, ‘কাজটা শুরুর করার পর বুঝলাম এটা বেশ কঠিন। শুরুতে কেউ আমাদের কথায় কান দিচ্ছিল না! কিন্তু হাল ছাড়িনি। ভাবলাম, শৌচাগারের জন্য রিং-স্ল্যাব হাতের কাছে পেলে গ্রামবাসী সহজেই সেটা গ্রহণ করবে। তাই একপর্যায়ে রিং-স্ল্যাব তৈরির কথা চিন্তা করলাম।’
কিন্তু এ জন্য তো তহবিল দরকার। তহবিল গড়ার গল্পটাও শোনালেন জাহিদুল, ‘নিজেদের হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে সেই টাকায় গ্রামের একটি হাট ইজারা নেওয়া হলো। ধীরে ধীরে তহবিলটা বড় হলো। তারপর নিজেরাই রিং-স্ল্যাব তৈরি করা শুরু করলাম।’
কিন্তু গ্রামের সবার পক্ষে রিং-স্ল্যাব কিনে নিয়ে তো আর শৌচাগার বসানো সম্ভব নয়! সংগঠনের আরেক সদস্য ফারুক হোসেন জানালেন, একেবারেই সহায়-সম্বলহীন মানুষের বাড়িতে নিজেদের খরচে শৌচাগার বসিয়ে দেওয়া হলো। আর সচ্ছল পরিবারগুলোতে গিয়ে শৌচাগার তৈরি করে নেওয়ার জন্য বোঝাতে থাকলেন তাঁরা।
একপর্যায়ে শতভাগ বাড়িতে শৌচাগার হলেও তা ব্যবহার করানোর জন্যও ঝক্কি পোহাতে হয়েছে সংগঠনের সদস্যদের। শৌচাগার থাকলেও সবাই তা ব্যবহার করত না। মানুষের মধ্যে শৌচাগার ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সকালে উঠে সংগঠনের সদস্যদের রাস্তা পাহারা পর্যন্ত দিতে হয়েছে, যাতে কেউ বাইরে মলত্যাগ না করে। জানালেন সংগঠনের সদস্য শামীম পারভেজ। ধীরে ধীরে সবাই শৌচাগার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই খবর তখন প্রথম আলো, বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয় ।
বনকিশোর গ্রাম বদলের এই খবর জেনে চারঘাট উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হামিদুর রহমান ওই যুবকদের পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেন। সেই টাকা দিয়ে পাঠাগার গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনটি। বর্তমানে যশোর সেনানিবাসে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত হামিদুর রহমান বললেন, ‘সংগঠনটিকে পাঁচ হাজার টাকা দিই। ওই টাকা দিয়ে পাঠাগার গড়তে তখনই তারা বই কিনে ফেলে। তখন আমি নিজের বেশ কিছু পুরাতন বইও তাদের দিই।’
এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদিতে’ বনকিশোর গ্রাম ও সংগঠনটিকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার হলে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের সৌজন্যে তাদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয় বই কেনার জন্য। তারা গ্রামের পুরোনো একটি ক্লাবঘর সংস্কার করে সেখানেই পাঠাগার চালু করে। পাঠাগারটিতে এখন দেড় হাজারের মতো বই আছে। পাঠাগার থেকে সবাই বই নিয়ে পড়তে পারে। যারা পাঠাগারে আসতে পারে না, বিশেষ করে গৃহবধূদের জন্য সপ্তাহে একবার বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া হয়। সপ্তাহ শেষে আবার তা বদলে দেওয়া হয়। সংগঠনের সদস্য রফিকুল ইসলাম এই কাজ করে যাচ্ছেন।
গৃহবধূ জেসমিন নাহার বলেন, ওরা বই পড়ার নেশা তৈরি করে দিয়েছে। ভালো লাগা বেশ কিছু বই তিনি দুবার করে পড়ে ফেলেছেন।
সম্প্রতি একদিন পাঠাগারে গিয়ে দেখা যায়, চমৎকারভাবে সাজানো বইপত্র। তাদের একটি প্রদর্শনী বোর্ড রয়েছে। তাতে ছবি ও পত্রিকার ক্লিপিংস রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর একটি ছবি আছে। তাঁরা এই গ্রাম দেখতে এসেছিলেন। আছে এ রকম আরও বেশ কিছু ছবি।
সংগঠনের সদস্য রফিকুল ইসলাম জানালেন, গ্রামের আরেক সমস্যা ছিল মাদক। দীর্ঘদিন মাদকাসক্ত থাকায় অসুস্থ হয়ে গ্রামের অকুমার দাস মারা গেলেন। তার তিন শিশুর কান্না সবার মনে দাগ কাটে। এরপর তাঁরা শুরু করলেন গ্রামে মাদকবিরোধী আন্দোলন। তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে পাশের গ্রামের একটি মদের ভাটি উচ্ছেদ করেন ও গ্রামে প্রকাশ্যে মাদক সেবন নিষিদ্ধ করেন। এ আন্দোলন পুরোপুরি সফল হয়। ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল গ্রামে মাদকবিরোধী উৎসবের আয়োজন করা হয়।
২০১২ সালের ১৬ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী জেলা বন্ধুসভার সদস্যরা বনকিশোর গ্রামে যান। তাঁরা সবাইকে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁদের আহ্বানে সেদিন ধূমপান ছেড়ে দেওয়া ৩০ জন গ্রামবাসীকে একটি করে গোলাপ দেওয়া হয়। ‘আমাদের আহ্বানে যাঁরা ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার শপথ নেন, পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি কেউ আর ধূমপান করেন না’, বললেন রাজশাহী বন্ধুসভার সহসভাপতি সাহানারা জেসমিন।
ওরা ১১ জনের সর্বশেষ প্রচেষ্টার ফল হলো সেতুটি। এই সেতু নির্মাণের পেছনের গল্পটা শোনালেন সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা আবদুল লতিফ, ‘খোর্দগোবিন্দপুর গ্রামের শিশু শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে সেতু তৈরির উদ্যোগ নেয় সংগঠনটি। মোসাদ্দারুল, শামীমুল, শিহাবুল, আরিফুজ্জামান, আদনান মারুফ, বজলুর ও মাজহারুলসহ ওরা ১১ জনের সবাই একদিন এসে আমার কাছে ওই প্রস্তাব দেন। পরে বৈঠক ডেকে গ্রামের সবাইকে বিষয়টি জানানো হয়। গ্রামবাসী এক বাক্যে রাজি। প্রশ্ন উঠল খরচ নিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো, যে যা পারে তাই দিয়ে সহায়তা করবে।’
গ্রামের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন জানালেন, গ্রামবাসীর এই একতাই বড় শক্তি। এই একতার জন্যই এবার সেতুর জন্য মানুষ মুষ্টিচাল পর্যন্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছে। যিনি কিছু দিতে পারেননি, তিনি শ্রম দিয়েছেন।
গত ২ এপ্রিল বনকিশোর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বড়াল নদীর ওপরে ১২০ হাত লম্বা ও সাড়ে চার হাত প্রস্থ সেতু হয়ে গেছে। সেদিন সেতুর দুই পাশের রাস্তার মাটি কেটে হাঁটার উপযোগী করা হচ্ছিল। সেই সেতু পার হয়ে চলে এল খোর্দগোবিন্দপুরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শিক্ষার্থী মিনারুল ইসলাম। সে বলে, তাকে আর কষ্ট করে আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যেতে হবে না। সেতু হওয়ায় এখন সে বনকিশোর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হবে।
সেতুর সুবিধা বর্ণনা করলেন গৃহবধূ শামসুন্নাহার (৬০), ‘আগে বনকিশোর থাইকি বাঁ দিক দিয়া খোর্দগোবিন্দপুর যাইতে সাত কিলোমিটার আর ডাইন দিক দিয়া যাইতে পাঁচ কিলোমিটার ঘাঁটা (পথ) হাঁটতে হচ্ছিলি। অ্যাকুন খালি ১২০ হাত লম্বা একটা সাঁকো পার হলেই হচ্ছে।’
‘শিক্ষা সেতু’ নাম হওয়ার মর্মার্থ জানালেন বনকিশোর গ্রামের কলেজশিক্ষক ইসহাক আলী, ‘এত দিন খোর্দগোবিন্দপুর গ্রামের শিশুরা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বনকিশোর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের ভবন দেখেছে, কিন্তু আসতে পারেনি। দুই আড়াই কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে পড়েছে। এই সেতু হওয়ার কারণে এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের হাতের মুঠোয় এসেছে। এ জন্যই মুখে মুখে সেতুটির নাম শিক্ষা সেতু হয়ে গেছে।’
এই গ্রামের বাসিন্দা বাদশা হোসেন রাজশাহী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বলেন, সংগঠনটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামের চিত্র পাল্টে দিয়েছে।
‘স্টুডেন্টস ক্রিয়েটিভ ভেঞ্চারের’ প্রধান জাহিদুল ইসলাম বললেন, এটা একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। গ্রামবাসীসহ সংগঠনের সব সদস্যের ঐকান্তিক চেষ্টায় এসব কাজ সম্ভব হয়েছে।
No comments