যেভাবে রসু সিরিয়াল কিলার by মির্জা জাকির
বাংলাদেশের
প্রথম সিরিয়াল কিলার চাঁদপুরের রসু খাঁকে একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন
আদালত। বুধবার বেলা ১টায় চাঁদপুর আদালতে সহকারী জজ অরুনাথ চক্রবর্তী এ রায়
দেন। রায় ঘোষণার পর আদালতে রসু খাঁকে ভাবলেশহীন দেখা যায়।
রসু খাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা ১০টি মামলার মধ্যে একটি মামলার রায় দেয়া হল। বাকি ৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ থানায় মোট ১০টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ১টি হত্যা ও অন্যগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা।
চাঁদপুরের মদনা গ্রামের ছিঁচকে চোর রসু খাঁ ভালোবাসায় পরাস্ত হয়ে এক সময় সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়। ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তার লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের চিত্র বেরিয়ে আসে। নিজের মুখে স্বীকার করে ১১ নারী হত্যার কথা। টার্গেট ছিল ১০১টি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর। কিন্তু চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তার সেই আশা পূরণ হয়নি। রসু যাদের হত্যা করেছে তারা সবাই ছিল গার্মেন্ট কর্মী।
রসু খাঁ ভালোবাসার অভিনয় করে নিুবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ঢাকার সাভার ও টঙ্গী এলাকা থেকে চাঁদপুরে এনে প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করত। হত্যার শিকার ওইসব হতভাগ্য মেয়ের অধিকাংশেরই সঠিক নাম-ঠিকানা বা পরিচয় আজও জানা যায়নি।
তার মামলাগুলো বিচারের জন্য চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হলে সেখানে একটি মামলার রায়ে রসু খাঁ খালাস পেয়ে যায়। এ অবস্থায় তার বাদবাকি মামলাগুলো চাঁদপুর আদালতে পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দেয় ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১টি এবং অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে ৮টি মামলার বিচার চলছে। এর মধ্যে টঙ্গীর গার্মেন্ট কর্মী শাহিদা বেগম হত্যা মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল।
কে এই রসু খা? : এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেয় খুনি রশিদ খাঁ ওরফে রসু খাঁ (৩৮)। বাবা আবুল হোসেন ওরফে মনু খাঁ ছিলেন একজন ক্ষেতমজুর। ফরিদগঞ্জ থানার সীমানা এলাকায় অবস্থিত মদনা গ্রামের খাঁ বাড়ি তাদের। এ গ্রামটি চাঁদপুর সদর উপজেলার অন্তর্গত। গত ১৪-১৫ বছর আগে তার বাবা মারা যান। এতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে তার পরিবার। কিছুদিন পর বাবার রেখে যাওয়া ৩০-৩৫ শতক জমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে। সে দাবি করে, প্রতিপক্ষরা তাকে কারণে-অকারণে ‘চোর-চোট্টা’ বলে গালাগাল দিতে থাকে। তবে এলাকাবাসী জানায়, টুকিটাকি চুরিতে সে নিজেও জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বাবার মৃত্যুর ২-৩ বছর পর তার মা কিছু জমি বিক্রি করে ঢাকার টঙ্গীতে বসবাসরত বড় মেয়ে হাফছা বেগমের কাছে চলে যান। ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে রসু খাঁ দ্বিতীয়। অপর ভাই বসু খাঁ নিরুদ্দেশ। ছোট বোন জান্নাত বেগম জর্ডান প্রবাসী। টঙ্গী চলে যাওয়ার পর ভবঘুরে দিন কাটে তার। গত ১৫-১৬ বছর আগে সে বিয়ে করে পার্শ্ববর্তী লাড়–য়া গ্রামের বেপারি বাড়িতে। বিয়ের আগে ঘটক তাকে পাত্রী দেখতে দেয়নি। রসু খাঁ বলেন, বাসর ঘরে ঢুকে দেখি বউয়ের ডান চোখ কানা। ২ বছর পর বউ গর্ভবতী হয়। এরপর ওই বউকে শ্বশুরবাড়ি রেখে শ্যালিকা রীনা বেগমকে নিয়ে চলে যাই টঙ্গী। দ্বিতীয় বিয়ের পর স্ত্রী রীনাকে নিয়ে বসবাস শুরু করে টঙ্গীর নিরসপাড়ায়। সেখানকার বাবু কমিশনারের এলাকায় জনৈক বাবলু মিয়ার বাড়িতে ৫শ’ টাকায় বাসা ভাড়া নেয়। পরে স্ত্রী রীনাকে গার্মেন্টে চাকরি করতে দেয়। রসু খাঁ জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতের সঙ্গে। চুরিদারি করাই ছিল তার প্রধান পেশা। টঙ্গীর বিভিন্ন স্থানসহ মাঝে মধ্যে নিজ এলাকায় এসে চুরিদারি করে আবার টঙ্গী ফিরে যেত।
রসু খাঁর বর্ণনা মতে, স্ত্রীর গার্মেন্টে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন গার্মেন্ট কর্মী মেয়েদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এরই একপর্যায়ে এক নারী কর্মীর সঙ্গে প্রেম হয় তার। ওই কর্মী তার সঙ্গে প্রতারণা করে এলাকার অন্য এক ছেলের সঙ্গে প্রেমে জড়ায়। এতে রসু খাঁ বাদসাধলে ওই কর্মী তার প্রেমিকের সহযোগিতায় ৫-৬ জন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী দ্বারা ১টি পাঁচতলা ভবনের ছাদে তুলে বেদম মারধর করে তাকে। সেদিনই সে প্রতিজ্ঞা করে, ১০১ জন নারীকে ধর্ষণ শেষে খুন করবে বলে। সে অনুযায়ী সে নারীদের সঙ্গে প্রেমের ভাব গড়া শুরু করে। এদের মধ্যে গার্মেন্ট কর্মীই বেশি। একপর্যায়ে সে টাকার বিনিময়ে ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবেও কাজ করতে থাকে। খুনের আগে সে ধর্ষণ করত তাদের। পরে সুযোগ দিত সহযোগীদের। তবে তার দ্বারা ধর্ষণ ও খুনের শিকার প্রায় প্রত্যেকটি লাশেরই পরিচয় অজ্ঞাত রয়ে গেছে। তার দ্বারা খুন-ধর্ষণের শিকার ১১টি লাশই উদ্ধার করা হয় নদী, খাল বা ডোবার পাশ অথবা পানি থেকে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের আগে অথবা পরে সে ওই নারীদের হাত ও পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিত। কখনও মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে তাদের পানিতে চেপে ধরে রাখত। কোনো গৃহবধূর পারিবারিক বিরোধের ফলে অথবা অন্য কোনো নারী/মেয়েকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে এমনি প্রস্তাব বা সুযোগ পেলেই সে ওই সুযোগ গ্রহণ করত। খুনের বিনিময়ে সে টাকাও নিয়েছে। এমনি খুনের হাত থেকে তার শালার বউও বাঁচতে পারেনি। তার শালা আ. মান্নান তাকে বলে যে, তার গার্মেন্ট কর্মী বউ (নাম বলেনি) অন্য ছেলেদের সঙ্গে দৈহিক মেলামেশা করে। এদের মধ্যে একটি হিন্দু ছেলেও আছে। এ জন্য শালার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এরপর দুজনে মিলে ফরিদগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে আসার নাম করে ২০০৭ সালের ১৯ জুন শালার বউকে ফরিদগঞ্জের ৯নং ইউনিয়নের ভাটিয়া গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে একটি হিন্দু বাড়ির কাছে নিয়ে যায়। তারপর দুজনে মিলে ফুঁসলিয়ে নদীর পাড়ে তাকে ধর্ষণ শেষে মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে হাত-পা বেঁধে নদীর পানিতে চুবিয়ে ও গলা টিপে হত্যা করে। হত্যা শেষে দুজনে ফিরে যায় ঢাকায়।
টঙ্গীর জনৈক বাড়িওয়ালা শাহীন ও সহযোগী ইউনুছের প্ররোচনায় ও সহযোগিতায় এক পতিতাকে টঙ্গী থেকে এনে ফরিদগঞ্জের হাঁসা গ্রামে একইভাবে ধর্ষণ শেষে দু’পায়ের সঙ্গে দু’হাত বেঁধে গলাটিপে হত্যা করে খালের পানিতে ফেলে দেয় রসু। ঘটনাটি একই বছরের ফেব্র“য়ারি মাসের ৯ তারিখ গভীর রাতের।
অপর এক ঘটনায় টঙ্গী নিরসপাড়ার মানিক নামে রসুর এক মুদি ব্যবসায়ী বন্ধুর বউ মিলে টঙ্গীর এক গার্মেন্ট কর্মীকে ফরিদগঞ্জের হাঁসা গ্রামের একটি বিলে এনে ধর্ষণ শেষে একইভাবে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী ডোবায় লাশ ফেলে দেয় সে। এ জন্য বন্ধুর বউ তাকে নগদ ৫ হাজার টাকাও পুরস্কার দেয়। সে এভাবে কখনও কোনো মেয়ের সঙ্গে নিজে প্রেম করে অথবা ভাড়ায় খেটে একের পর এক খুন করে ১১ নারীকে। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে সে হয়ে ওঠে এক দুর্ধর্ষ কুখ্যাত খুনি। যা এরশাদ শিকদারের নৃশংসতাকেও হার মানায়। প্রবাদ আছে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অথবা দশ দিন চোরের একদিন গেরস্তের। এমনিভাবে গত ৭ জুলাই ২০০৯ তারিখে তার সর্বশেষ খুনের শিকার তিন সন্তানের জননী পারভিন আক্তার। এই খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই থেমে যেতে হয় তাকে। অবসান হল এক লোমহর্ষক ও দুঃখজনক অধ্যায়ের।
রসু খাঁর বর্ণনায় জানা যায়, গাজীপুর বাজারে পারভিনের সঙ্গে পরিচয় হয় কুখ্যাত খুনি রসু খাঁর। এতে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়। রসু খাঁ তাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন সময় মেলামেশা করে তার সঙ্গে। একপর্যায়ে ৭ জুলাই ২০০৯ তারিখে রাত ১০টায় পারভিনকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যায় ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১০নং গোবিন্দপুর ইউনিয়নের হাঁসা গ্রামে। পথে দেখা হয় ওই ইউনিয়নের সিংহেরগাঁ গ্রামের আপন ভাগ্নে জহির ও গোবিন্দপুর গ্রামের সঙ্গী ইউনুছের সঙ্গে। এরপর তারা তিনজনে মিলে পারভিনকে ধর্ষণ করে। পারভিন ওই রাতে তাকে বিবাহ করতে হবে বলে চাপ দেয়। নচেৎ সে পুলিশকে জানিয়ে মামলার হুমকি দেয় এবং চেঁচামেচি শুরু করে। এতে ভাগ্নে জহির ও সঙ্গী ইউনুছ পারভিনের হাত ও পা চেপে ধরে মাটিতে শুইয়ে দেয়। রসু খাঁ পারভিনের মুখে পরনের কাপড় গুঁজে দিয়ে গলা টিপে হত্যা শেষে হাত-পা বেঁধে পার্শ্ববর্তী খালের পানিতে ফেলে দেয়। পরের দিন নিজেকে রিকশাচালক পরিচয় দিয়ে নিজ বাড়িতে বিরোধ আছে এমন দুজনের নাম বলে পারভিনের খুনের সঙ্গে তারা জড়িত বলে ফরিদগঞ্জ থানার ওসিকে জানায়। সে পরে মোবাইল থেকে সিম কার্ড খুলে ফেলে। পরে পুলিশ ওই দুজনকে ধরলেও মামলার কোনো ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি। ওই দু’ব্যক্তিকে কোর্টেও চালান করা হয়। তারা ২-৩ মাস হাজত বাস করে জামিনে বেরিয়ে আসে।
এদিকে রসু খাঁ ওই বছরের জুলাই মাসে স্থানীয় গাজীপুর বাজারে রাতের বেলা একটি মসজিদের ১২টি ফ্যান চুরির মামলায় হাজত খেটে জামিনে বেরিয়ে যায়। ফ্যান চুরিতে ধরা খেলে এক ব্যক্তি তার কাছ থেকে মোবাইল ও ওই সিম কার্ডটি রেখে দেয়। পরে সেটি জনৈক যুবক ব্যবহার শুরু করলে পারভিনের মামলার তদন্তকারী এসআই মীর কাশেম ওই সিম নম্বরে কল দিয়ে কথা বলতে শুরু করে। এরপর সিম কার্ডের সূত্র উদ্ঘাটন পূর্বক শনাক্ত হয় কুখ্যাত খুনি রসু খাঁ। পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে ৮ অক্টোবর ঢাকা টঙ্গীর বাসা থেকে রসু খাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে ফরিদগঞ্জ থানায়। এরপর কৌতূহলবশত ফরিদগঞ্জের গত প্রায় ২ বছরের অজ্ঞাতনামা অপর ৫টি খুনের সঙ্গে তাকে দায়ী করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। সেও অবলীলায় ফরিদগঞ্জের ৬টি, হাইমচরের ৩টি ও চাঁদপুরের ২টি ঘটনার স্থান ও সময়ের বর্ণনা দেয়। এ বর্ণনার সঙ্গে ৩টি থানার অজ্ঞাতনামা ১০টি লাশের রেকর্ড হুবহু মিলে যায়।
রসু খাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা ১০টি মামলার মধ্যে একটি মামলার রায় দেয়া হল। বাকি ৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ থানায় মোট ১০টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ১টি হত্যা ও অন্যগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা।
চাঁদপুরের মদনা গ্রামের ছিঁচকে চোর রসু খাঁ ভালোবাসায় পরাস্ত হয়ে এক সময় সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়। ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তার লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের চিত্র বেরিয়ে আসে। নিজের মুখে স্বীকার করে ১১ নারী হত্যার কথা। টার্গেট ছিল ১০১টি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর। কিন্তু চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তার সেই আশা পূরণ হয়নি। রসু যাদের হত্যা করেছে তারা সবাই ছিল গার্মেন্ট কর্মী।
রসু খাঁ ভালোবাসার অভিনয় করে নিুবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ঢাকার সাভার ও টঙ্গী এলাকা থেকে চাঁদপুরে এনে প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করত। হত্যার শিকার ওইসব হতভাগ্য মেয়ের অধিকাংশেরই সঠিক নাম-ঠিকানা বা পরিচয় আজও জানা যায়নি।
তার মামলাগুলো বিচারের জন্য চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হলে সেখানে একটি মামলার রায়ে রসু খাঁ খালাস পেয়ে যায়। এ অবস্থায় তার বাদবাকি মামলাগুলো চাঁদপুর আদালতে পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে দেয় ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১টি এবং অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে ৮টি মামলার বিচার চলছে। এর মধ্যে টঙ্গীর গার্মেন্ট কর্মী শাহিদা বেগম হত্যা মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল।
কে এই রসু খা? : এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেয় খুনি রশিদ খাঁ ওরফে রসু খাঁ (৩৮)। বাবা আবুল হোসেন ওরফে মনু খাঁ ছিলেন একজন ক্ষেতমজুর। ফরিদগঞ্জ থানার সীমানা এলাকায় অবস্থিত মদনা গ্রামের খাঁ বাড়ি তাদের। এ গ্রামটি চাঁদপুর সদর উপজেলার অন্তর্গত। গত ১৪-১৫ বছর আগে তার বাবা মারা যান। এতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে তার পরিবার। কিছুদিন পর বাবার রেখে যাওয়া ৩০-৩৫ শতক জমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে। সে দাবি করে, প্রতিপক্ষরা তাকে কারণে-অকারণে ‘চোর-চোট্টা’ বলে গালাগাল দিতে থাকে। তবে এলাকাবাসী জানায়, টুকিটাকি চুরিতে সে নিজেও জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বাবার মৃত্যুর ২-৩ বছর পর তার মা কিছু জমি বিক্রি করে ঢাকার টঙ্গীতে বসবাসরত বড় মেয়ে হাফছা বেগমের কাছে চলে যান। ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে রসু খাঁ দ্বিতীয়। অপর ভাই বসু খাঁ নিরুদ্দেশ। ছোট বোন জান্নাত বেগম জর্ডান প্রবাসী। টঙ্গী চলে যাওয়ার পর ভবঘুরে দিন কাটে তার। গত ১৫-১৬ বছর আগে সে বিয়ে করে পার্শ্ববর্তী লাড়–য়া গ্রামের বেপারি বাড়িতে। বিয়ের আগে ঘটক তাকে পাত্রী দেখতে দেয়নি। রসু খাঁ বলেন, বাসর ঘরে ঢুকে দেখি বউয়ের ডান চোখ কানা। ২ বছর পর বউ গর্ভবতী হয়। এরপর ওই বউকে শ্বশুরবাড়ি রেখে শ্যালিকা রীনা বেগমকে নিয়ে চলে যাই টঙ্গী। দ্বিতীয় বিয়ের পর স্ত্রী রীনাকে নিয়ে বসবাস শুরু করে টঙ্গীর নিরসপাড়ায়। সেখানকার বাবু কমিশনারের এলাকায় জনৈক বাবলু মিয়ার বাড়িতে ৫শ’ টাকায় বাসা ভাড়া নেয়। পরে স্ত্রী রীনাকে গার্মেন্টে চাকরি করতে দেয়। রসু খাঁ জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতের সঙ্গে। চুরিদারি করাই ছিল তার প্রধান পেশা। টঙ্গীর বিভিন্ন স্থানসহ মাঝে মধ্যে নিজ এলাকায় এসে চুরিদারি করে আবার টঙ্গী ফিরে যেত।
রসু খাঁর বর্ণনা মতে, স্ত্রীর গার্মেন্টে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন গার্মেন্ট কর্মী মেয়েদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এরই একপর্যায়ে এক নারী কর্মীর সঙ্গে প্রেম হয় তার। ওই কর্মী তার সঙ্গে প্রতারণা করে এলাকার অন্য এক ছেলের সঙ্গে প্রেমে জড়ায়। এতে রসু খাঁ বাদসাধলে ওই কর্মী তার প্রেমিকের সহযোগিতায় ৫-৬ জন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী দ্বারা ১টি পাঁচতলা ভবনের ছাদে তুলে বেদম মারধর করে তাকে। সেদিনই সে প্রতিজ্ঞা করে, ১০১ জন নারীকে ধর্ষণ শেষে খুন করবে বলে। সে অনুযায়ী সে নারীদের সঙ্গে প্রেমের ভাব গড়া শুরু করে। এদের মধ্যে গার্মেন্ট কর্মীই বেশি। একপর্যায়ে সে টাকার বিনিময়ে ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবেও কাজ করতে থাকে। খুনের আগে সে ধর্ষণ করত তাদের। পরে সুযোগ দিত সহযোগীদের। তবে তার দ্বারা ধর্ষণ ও খুনের শিকার প্রায় প্রত্যেকটি লাশেরই পরিচয় অজ্ঞাত রয়ে গেছে। তার দ্বারা খুন-ধর্ষণের শিকার ১১টি লাশই উদ্ধার করা হয় নদী, খাল বা ডোবার পাশ অথবা পানি থেকে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের আগে অথবা পরে সে ওই নারীদের হাত ও পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিত। কখনও মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে তাদের পানিতে চেপে ধরে রাখত। কোনো গৃহবধূর পারিবারিক বিরোধের ফলে অথবা অন্য কোনো নারী/মেয়েকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে এমনি প্রস্তাব বা সুযোগ পেলেই সে ওই সুযোগ গ্রহণ করত। খুনের বিনিময়ে সে টাকাও নিয়েছে। এমনি খুনের হাত থেকে তার শালার বউও বাঁচতে পারেনি। তার শালা আ. মান্নান তাকে বলে যে, তার গার্মেন্ট কর্মী বউ (নাম বলেনি) অন্য ছেলেদের সঙ্গে দৈহিক মেলামেশা করে। এদের মধ্যে একটি হিন্দু ছেলেও আছে। এ জন্য শালার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এরপর দুজনে মিলে ফরিদগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে আসার নাম করে ২০০৭ সালের ১৯ জুন শালার বউকে ফরিদগঞ্জের ৯নং ইউনিয়নের ভাটিয়া গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে একটি হিন্দু বাড়ির কাছে নিয়ে যায়। তারপর দুজনে মিলে ফুঁসলিয়ে নদীর পাড়ে তাকে ধর্ষণ শেষে মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে হাত-পা বেঁধে নদীর পানিতে চুবিয়ে ও গলা টিপে হত্যা করে। হত্যা শেষে দুজনে ফিরে যায় ঢাকায়।
টঙ্গীর জনৈক বাড়িওয়ালা শাহীন ও সহযোগী ইউনুছের প্ররোচনায় ও সহযোগিতায় এক পতিতাকে টঙ্গী থেকে এনে ফরিদগঞ্জের হাঁসা গ্রামে একইভাবে ধর্ষণ শেষে দু’পায়ের সঙ্গে দু’হাত বেঁধে গলাটিপে হত্যা করে খালের পানিতে ফেলে দেয় রসু। ঘটনাটি একই বছরের ফেব্র“য়ারি মাসের ৯ তারিখ গভীর রাতের।
অপর এক ঘটনায় টঙ্গী নিরসপাড়ার মানিক নামে রসুর এক মুদি ব্যবসায়ী বন্ধুর বউ মিলে টঙ্গীর এক গার্মেন্ট কর্মীকে ফরিদগঞ্জের হাঁসা গ্রামের একটি বিলে এনে ধর্ষণ শেষে একইভাবে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী ডোবায় লাশ ফেলে দেয় সে। এ জন্য বন্ধুর বউ তাকে নগদ ৫ হাজার টাকাও পুরস্কার দেয়। সে এভাবে কখনও কোনো মেয়ের সঙ্গে নিজে প্রেম করে অথবা ভাড়ায় খেটে একের পর এক খুন করে ১১ নারীকে। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে সে হয়ে ওঠে এক দুর্ধর্ষ কুখ্যাত খুনি। যা এরশাদ শিকদারের নৃশংসতাকেও হার মানায়। প্রবাদ আছে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অথবা দশ দিন চোরের একদিন গেরস্তের। এমনিভাবে গত ৭ জুলাই ২০০৯ তারিখে তার সর্বশেষ খুনের শিকার তিন সন্তানের জননী পারভিন আক্তার। এই খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই থেমে যেতে হয় তাকে। অবসান হল এক লোমহর্ষক ও দুঃখজনক অধ্যায়ের।
রসু খাঁর বর্ণনায় জানা যায়, গাজীপুর বাজারে পারভিনের সঙ্গে পরিচয় হয় কুখ্যাত খুনি রসু খাঁর। এতে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়। রসু খাঁ তাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন সময় মেলামেশা করে তার সঙ্গে। একপর্যায়ে ৭ জুলাই ২০০৯ তারিখে রাত ১০টায় পারভিনকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যায় ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১০নং গোবিন্দপুর ইউনিয়নের হাঁসা গ্রামে। পথে দেখা হয় ওই ইউনিয়নের সিংহেরগাঁ গ্রামের আপন ভাগ্নে জহির ও গোবিন্দপুর গ্রামের সঙ্গী ইউনুছের সঙ্গে। এরপর তারা তিনজনে মিলে পারভিনকে ধর্ষণ করে। পারভিন ওই রাতে তাকে বিবাহ করতে হবে বলে চাপ দেয়। নচেৎ সে পুলিশকে জানিয়ে মামলার হুমকি দেয় এবং চেঁচামেচি শুরু করে। এতে ভাগ্নে জহির ও সঙ্গী ইউনুছ পারভিনের হাত ও পা চেপে ধরে মাটিতে শুইয়ে দেয়। রসু খাঁ পারভিনের মুখে পরনের কাপড় গুঁজে দিয়ে গলা টিপে হত্যা শেষে হাত-পা বেঁধে পার্শ্ববর্তী খালের পানিতে ফেলে দেয়। পরের দিন নিজেকে রিকশাচালক পরিচয় দিয়ে নিজ বাড়িতে বিরোধ আছে এমন দুজনের নাম বলে পারভিনের খুনের সঙ্গে তারা জড়িত বলে ফরিদগঞ্জ থানার ওসিকে জানায়। সে পরে মোবাইল থেকে সিম কার্ড খুলে ফেলে। পরে পুলিশ ওই দুজনকে ধরলেও মামলার কোনো ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি। ওই দু’ব্যক্তিকে কোর্টেও চালান করা হয়। তারা ২-৩ মাস হাজত বাস করে জামিনে বেরিয়ে আসে।
এদিকে রসু খাঁ ওই বছরের জুলাই মাসে স্থানীয় গাজীপুর বাজারে রাতের বেলা একটি মসজিদের ১২টি ফ্যান চুরির মামলায় হাজত খেটে জামিনে বেরিয়ে যায়। ফ্যান চুরিতে ধরা খেলে এক ব্যক্তি তার কাছ থেকে মোবাইল ও ওই সিম কার্ডটি রেখে দেয়। পরে সেটি জনৈক যুবক ব্যবহার শুরু করলে পারভিনের মামলার তদন্তকারী এসআই মীর কাশেম ওই সিম নম্বরে কল দিয়ে কথা বলতে শুরু করে। এরপর সিম কার্ডের সূত্র উদ্ঘাটন পূর্বক শনাক্ত হয় কুখ্যাত খুনি রসু খাঁ। পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে ৮ অক্টোবর ঢাকা টঙ্গীর বাসা থেকে রসু খাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে ফরিদগঞ্জ থানায়। এরপর কৌতূহলবশত ফরিদগঞ্জের গত প্রায় ২ বছরের অজ্ঞাতনামা অপর ৫টি খুনের সঙ্গে তাকে দায়ী করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। সেও অবলীলায় ফরিদগঞ্জের ৬টি, হাইমচরের ৩টি ও চাঁদপুরের ২টি ঘটনার স্থান ও সময়ের বর্ণনা দেয়। এ বর্ণনার সঙ্গে ৩টি থানার অজ্ঞাতনামা ১০টি লাশের রেকর্ড হুবহু মিলে যায়।
No comments