বিএনপি যাবে কোন পথে? by আব্দুল কাইয়ুম
সামনে
ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি মেয়র নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বিএনপি কি এই সুযোগ
হাতছাড়া করবে? তারা কি মেয়র নির্বাচনে গিয়ে বাজিমাত করতে পারে না?
জানি, এটা হবে না। অনেকের কাছেই একটা অসম্ভব কথা বলে মনে হবে। কারণ খালেদা জিয়াকে সরকার এই ধরে তো সেই ধরে অবস্থা, তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে এই বুঝি তল্লাশি শুরু হলো! তা ছাড়া চলছে পেট্রলবোমার সহিংস আন্দোলন। এর মধ্যে মেয়র নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের কথাটা একেবারেই বেমানান শোনায়, তাই না? বিএনপি ধনুর্ভঙ্গপণ করেছে, যেভাবেই হোক ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচন আদায় করতেই হবে। যত দিন এ দাবি আদায় না হয়, অবরোধ চলতেই থাকবে। প্রতি রোববার থেকে প্রথমে ৭২ ঘণ্টা, তারপর সেটা বাড়িয়ে শুক্রবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত হরতাল। মানুষ কথা না শুনলে গাড়ি-বাসে চোরাগোপ্তা হামলা চালাও, আগুন জ্বালাও, ককটেল-পেট্রলবোমা মারো। এই তো? সরকারও ধনুর্ভঙ্গপণ করেছে, যেভাবেই হোক সবকিছু ঠান্ডা করে দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলবে। গাড়ি-বাস চলবে। তারপর কে কোথায় মরল, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের নির্বাচন আদায় না করে ছাড়বে না। আর সরকার এখন নির্বাচনই দেবে না। মানুষও চোরাগোপ্তা হামলার মধ্যে কেনাকাটা, অফিস—সবকিছু চালিয়ে যাবে। এর তো একটা শেষ চাই। কীভাবে সেটা সম্ভব?
বিএনপি নিশ্চয়ই তাদের আপসহীন ভাবমূর্তি খুইয়ে আন্দোলন থামাতে পারে না। আর সরকার তো ভাবছে সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থায় সরকার একটা চাল দিয়েছে। হঠাৎ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। এরপর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও হবে। সরকার তো ধরেই নিয়েছে যে বিএনপি আসবে না। এই ফাঁকে দু-চারজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হারিয়ে তাদের সমর্থিত প্রার্থীকে অনায়াসে জিতিয়ে আনা যাবে।
এখন বিএনপিকে ভাবতে হবে, সরকারের ইচ্ছামতো সবকিছু চলতে দেওয়া হবে কি না। সংসদ নির্বাচন না-হয় ‘নির্দলীয়’ সরকারের অধীনে ছাড়া ওরা করবে না। কিন্তু মেয়র নির্বাচনে তো সেই প্রশ্ন ওঠে না। স্থানীয় নির্বাচন সব সময় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই হয়। এ নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই।
বিএনপি কি কৌশল হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে না? এটা বিএনপির পূর্ব অনুসৃত নীতির বাইরে কিছু হবে না। গত বছরের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন বর্জনের পরিষ্কার ঘোষণার মধ্যেও কিন্তু বিএনপি একের পর এক সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে জিতেছিল। কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল এবং সর্বশেষ একেবারে রাজধানী ঢাকার নাকের ডগায় গাজীপুরে নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের একেবারে ধরাশায়ী করে দিয়েছিল।
সে সময় মানুষের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার হয় যে বিএনপি হয়তো জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে একইভাবে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে ক্ষমতায় পরিবর্তন আনবে, যা তখন দেশবাসী একান্তভাবে কামনা করছিল। কিন্তু বিএনপি সে পথে যায়নি। হয়তো ভেবেছিল, চারদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে বিপুল বিজয়ের শক্তিতে নির্বাচন ছাড়াই ওরা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে।
সাদামাটা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে ক্ষমতাসীন সরকারকে তুলার বস্তার মতো ছুড়ে ফেলে ক্ষমতায় যাওয়ার একটা সুবিধা আছে। তাতে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। বিএনপির মধ্যে হয়তো সে রকম একটা নেশা পেয়ে বসেছিল। কারণ, অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া ক্ষমতায় গিয়ে তাদের লাভ নেই। আওয়ামী লীগ যেভাবে সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলেছে, তাতে পরিবর্তন আনতে না পারলে তাদের ১৯৭২-এর সংবিধানে চলতে হবে। এটা তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যায় না। তাই হয়তো ওরা মেয়র নির্বাচনে বিপুল সাফল্য লাভ করলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। আশা ছিল, জনরোষের কবলে পড়ে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে।
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। খুব অদ্ভুত ব্যাপার যে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং বাকি প্রায় সব আসনে ‘আমরা আর মামারা’ প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এ রকম অস্বাভাবিক নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি তেমন কিছুই করতে পারেনি। এবং বিএনপিকে ঠান্ডা করার জন্য সে সময় সরকারকেও খুব বেশি ডান্ডাবাজি করতে হয়নি, যেমন এখন করছে।
এখানে বিএনপি রাজনীতিতে বিরাট মার খেয়েছে। সরকারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু বাস্তবে সরকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন করেও দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। এ আকাশ-পাতাল পার্থক্য কেন হলো, তা বিএনপিকে খুব ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখতে হবে।
এর একটা কারণ এই হতে পারে যে বিএনপি ভাবছিল মানুষ সনাতন রাজনীতির ধারায় ‘উৎখাতের’ লাইনে আছে। আর মানুষ ভাবছিল, নির্বাচনের মাধ্যমেই যখন সরকার পরিবর্তন সম্ভব, তাহলে বর্জনের ঝামেলায় কেন যাচ্ছে বিএনপি। এখানে মানুষের চিন্তার সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলের খুব বড় রকমের পার্থক্য হয়ে গেছে।
বিএনপির যুক্তি ছিল, সিটি করপোরেশন আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক নয়। সরকার চালাকি করে সিটি করপোরেশনে বিএনপিকে জিতিয়ে তাদের জাতীয় নির্বাচনের ফাঁদে ফেলতে চায়। আর বিএনপি সেই ফাঁদে পা দিলেই ভরাডুবি হবে। নির্বাচনে সরকারি প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ সব আসন হাতিয়ে নেবে। কিন্তু গত বছর বিএনপির বিজয়োল্লাসের মাঝে সরকারের পক্ষে নির্বাচন ছিনতাই করা বাস্তবে কতটা সম্ভব ছিল, তা ভেবে দেখা দরকার।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি বিএনপি অংশগ্রহণ করলে যদি আওয়ামী লীগ শুধু সরকারের জোরেই নির্বাচন ছিনতাই করার বিষয়ে নিশ্চিত হতো, তাহলে ওরা কেন তখন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেয়নি? গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভরাডুবির পরই আওয়ামী লীগ নিশ্চিত হয় যে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের পরাজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই আইনের মারপ্যাঁচে রাজধানী ঢাকার মেয়র নির্বাচন সে সময় সরকার হতে দেয়নি। যদি হতো, তাহলে তাদের নিশ্চিত পরাজয় ঠেকানো কঠিন ছিল। আর রাজধানী ঢাকায় মেয়র নির্বাচনে হারলে কোন মুখে আওয়ামী লীগ সংসদ নির্বাচন করত? নির্বাচনে ভোটারদের সামনে দাঁড়ানোর পথই তো থাকত না।
গত বছর সংসদ নির্বাচনের আগে সব কটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল এই যুক্তিতে যে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনে তাদের বাধা নেই। সেদিন যদি সরকার ঢাকায় মেয়র নির্বাচন দিত, তাহলে বিএনপি অবশ্যই অংশগ্রহণ করত। সেদিন বিএনপির বাধা না থাকলে আজ থাকবে কেন? আজ যদি বিএনপি ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে তাদের নীতিবিচ্যুতির কোনো আশঙ্কা নেই।
বরং নির্বাচন করলে তাদের দুটি লাভ। প্রথমত, পেট্রলবোমা মেরেও যে মানুষকে বিএনপি রাস্তায় নামাতে পারছে না, সেই মানুষই পিলপিল করে বিএনপির পেছনে এসে দাঁড়াবে, তাদের প্রার্থীর জন্য ভোটের সংগ্রামে নামবে। রাজপথে বিএনপির হরতালে সক্রিয় জনসমর্থনের যে ভাটা এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা কেটে যাবে। মানুষ বিএনপির প্রার্থীদের পক্ষে ঢাকঢোল নিয়ে নামবে। তাদের জন্য এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কী হতে পারে?
আর দ্বিতীয়ত, যদি বিএনপি প্রার্থী দেয়, তাহলে নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা শতভাগ। এটা তো তারাই দাবি করে এবং এই দাবি একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। বিএনপি মেয়র নির্বাচন করলে মানুষ খুশি হবে। কারণ, বোমা-আগুন দিয়ে মানুষ মেরে সরকার হটানোর বদ চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপি নির্বাচনী রাজনীতির ধারায় যুক্তিসংগত উপায়ে জোরেশোরে নামতে পারবে। এর ফলে তাদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আরও শক্তি ও জনসম্পৃক্তি অর্জন করবে।
যেহেতু সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন করছে, তাই নির্বাচনী সভা-সমাবেশে বিএনপিকে তাড়া করার সুযোগ সরকারের থাকবে না। খালেদা জিয়াকে গুলশানের অফিসে আটকা পড়ে থাকতে হবে না। তিনি মানুষের কাতারে এসে দাঁড়াবেন। সমাবেশের অনুমতি না দিলে তিনি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ঐতিহাসিক সমাবেশ করবেন। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?
বিএনপির সামনে আজ স্বর্ণসুযোগ এসেছে। মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে জোরেশোরে নেমে পড়া উচিত। এতে সহিংস রাজনীতির একটি যুক্তিপূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটবে। রাজনীতি গণতন্ত্রের ধারায় ফিরে আসবে। মানুষ বাঁচবে। দেশ বাঁচবে।
বিএনপির আর এক মুহূর্ত দেরি করা উচিত নয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
জানি, এটা হবে না। অনেকের কাছেই একটা অসম্ভব কথা বলে মনে হবে। কারণ খালেদা জিয়াকে সরকার এই ধরে তো সেই ধরে অবস্থা, তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে এই বুঝি তল্লাশি শুরু হলো! তা ছাড়া চলছে পেট্রলবোমার সহিংস আন্দোলন। এর মধ্যে মেয়র নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের কথাটা একেবারেই বেমানান শোনায়, তাই না? বিএনপি ধনুর্ভঙ্গপণ করেছে, যেভাবেই হোক ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচন আদায় করতেই হবে। যত দিন এ দাবি আদায় না হয়, অবরোধ চলতেই থাকবে। প্রতি রোববার থেকে প্রথমে ৭২ ঘণ্টা, তারপর সেটা বাড়িয়ে শুক্রবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত হরতাল। মানুষ কথা না শুনলে গাড়ি-বাসে চোরাগোপ্তা হামলা চালাও, আগুন জ্বালাও, ককটেল-পেট্রলবোমা মারো। এই তো? সরকারও ধনুর্ভঙ্গপণ করেছে, যেভাবেই হোক সবকিছু ঠান্ডা করে দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলবে। গাড়ি-বাস চলবে। তারপর কে কোথায় মরল, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের নির্বাচন আদায় না করে ছাড়বে না। আর সরকার এখন নির্বাচনই দেবে না। মানুষও চোরাগোপ্তা হামলার মধ্যে কেনাকাটা, অফিস—সবকিছু চালিয়ে যাবে। এর তো একটা শেষ চাই। কীভাবে সেটা সম্ভব?
বিএনপি নিশ্চয়ই তাদের আপসহীন ভাবমূর্তি খুইয়ে আন্দোলন থামাতে পারে না। আর সরকার তো ভাবছে সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থায় সরকার একটা চাল দিয়েছে। হঠাৎ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। এরপর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও হবে। সরকার তো ধরেই নিয়েছে যে বিএনপি আসবে না। এই ফাঁকে দু-চারজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হারিয়ে তাদের সমর্থিত প্রার্থীকে অনায়াসে জিতিয়ে আনা যাবে।
এখন বিএনপিকে ভাবতে হবে, সরকারের ইচ্ছামতো সবকিছু চলতে দেওয়া হবে কি না। সংসদ নির্বাচন না-হয় ‘নির্দলীয়’ সরকারের অধীনে ছাড়া ওরা করবে না। কিন্তু মেয়র নির্বাচনে তো সেই প্রশ্ন ওঠে না। স্থানীয় নির্বাচন সব সময় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই হয়। এ নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই।
বিএনপি কি কৌশল হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে না? এটা বিএনপির পূর্ব অনুসৃত নীতির বাইরে কিছু হবে না। গত বছরের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন বর্জনের পরিষ্কার ঘোষণার মধ্যেও কিন্তু বিএনপি একের পর এক সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে জিতেছিল। কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল এবং সর্বশেষ একেবারে রাজধানী ঢাকার নাকের ডগায় গাজীপুরে নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের একেবারে ধরাশায়ী করে দিয়েছিল।
সে সময় মানুষের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার হয় যে বিএনপি হয়তো জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে একইভাবে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে ক্ষমতায় পরিবর্তন আনবে, যা তখন দেশবাসী একান্তভাবে কামনা করছিল। কিন্তু বিএনপি সে পথে যায়নি। হয়তো ভেবেছিল, চারদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে বিপুল বিজয়ের শক্তিতে নির্বাচন ছাড়াই ওরা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে।
সাদামাটা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে ক্ষমতাসীন সরকারকে তুলার বস্তার মতো ছুড়ে ফেলে ক্ষমতায় যাওয়ার একটা সুবিধা আছে। তাতে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। বিএনপির মধ্যে হয়তো সে রকম একটা নেশা পেয়ে বসেছিল। কারণ, অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া ক্ষমতায় গিয়ে তাদের লাভ নেই। আওয়ামী লীগ যেভাবে সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলেছে, তাতে পরিবর্তন আনতে না পারলে তাদের ১৯৭২-এর সংবিধানে চলতে হবে। এটা তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যায় না। তাই হয়তো ওরা মেয়র নির্বাচনে বিপুল সাফল্য লাভ করলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। আশা ছিল, জনরোষের কবলে পড়ে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হবে।
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। খুব অদ্ভুত ব্যাপার যে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং বাকি প্রায় সব আসনে ‘আমরা আর মামারা’ প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এ রকম অস্বাভাবিক নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি তেমন কিছুই করতে পারেনি। এবং বিএনপিকে ঠান্ডা করার জন্য সে সময় সরকারকেও খুব বেশি ডান্ডাবাজি করতে হয়নি, যেমন এখন করছে।
এখানে বিএনপি রাজনীতিতে বিরাট মার খেয়েছে। সরকারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু বাস্তবে সরকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন করেও দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। এ আকাশ-পাতাল পার্থক্য কেন হলো, তা বিএনপিকে খুব ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখতে হবে।
এর একটা কারণ এই হতে পারে যে বিএনপি ভাবছিল মানুষ সনাতন রাজনীতির ধারায় ‘উৎখাতের’ লাইনে আছে। আর মানুষ ভাবছিল, নির্বাচনের মাধ্যমেই যখন সরকার পরিবর্তন সম্ভব, তাহলে বর্জনের ঝামেলায় কেন যাচ্ছে বিএনপি। এখানে মানুষের চিন্তার সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলের খুব বড় রকমের পার্থক্য হয়ে গেছে।
বিএনপির যুক্তি ছিল, সিটি করপোরেশন আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক নয়। সরকার চালাকি করে সিটি করপোরেশনে বিএনপিকে জিতিয়ে তাদের জাতীয় নির্বাচনের ফাঁদে ফেলতে চায়। আর বিএনপি সেই ফাঁদে পা দিলেই ভরাডুবি হবে। নির্বাচনে সরকারি প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ সব আসন হাতিয়ে নেবে। কিন্তু গত বছর বিএনপির বিজয়োল্লাসের মাঝে সরকারের পক্ষে নির্বাচন ছিনতাই করা বাস্তবে কতটা সম্ভব ছিল, তা ভেবে দেখা দরকার।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি বিএনপি অংশগ্রহণ করলে যদি আওয়ামী লীগ শুধু সরকারের জোরেই নির্বাচন ছিনতাই করার বিষয়ে নিশ্চিত হতো, তাহলে ওরা কেন তখন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেয়নি? গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভরাডুবির পরই আওয়ামী লীগ নিশ্চিত হয় যে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের পরাজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই আইনের মারপ্যাঁচে রাজধানী ঢাকার মেয়র নির্বাচন সে সময় সরকার হতে দেয়নি। যদি হতো, তাহলে তাদের নিশ্চিত পরাজয় ঠেকানো কঠিন ছিল। আর রাজধানী ঢাকায় মেয়র নির্বাচনে হারলে কোন মুখে আওয়ামী লীগ সংসদ নির্বাচন করত? নির্বাচনে ভোটারদের সামনে দাঁড়ানোর পথই তো থাকত না।
গত বছর সংসদ নির্বাচনের আগে সব কটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল এই যুক্তিতে যে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনে তাদের বাধা নেই। সেদিন যদি সরকার ঢাকায় মেয়র নির্বাচন দিত, তাহলে বিএনপি অবশ্যই অংশগ্রহণ করত। সেদিন বিএনপির বাধা না থাকলে আজ থাকবে কেন? আজ যদি বিএনপি ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে তাদের নীতিবিচ্যুতির কোনো আশঙ্কা নেই।
বরং নির্বাচন করলে তাদের দুটি লাভ। প্রথমত, পেট্রলবোমা মেরেও যে মানুষকে বিএনপি রাস্তায় নামাতে পারছে না, সেই মানুষই পিলপিল করে বিএনপির পেছনে এসে দাঁড়াবে, তাদের প্রার্থীর জন্য ভোটের সংগ্রামে নামবে। রাজপথে বিএনপির হরতালে সক্রিয় জনসমর্থনের যে ভাটা এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা কেটে যাবে। মানুষ বিএনপির প্রার্থীদের পক্ষে ঢাকঢোল নিয়ে নামবে। তাদের জন্য এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কী হতে পারে?
আর দ্বিতীয়ত, যদি বিএনপি প্রার্থী দেয়, তাহলে নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা শতভাগ। এটা তো তারাই দাবি করে এবং এই দাবি একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। বিএনপি মেয়র নির্বাচন করলে মানুষ খুশি হবে। কারণ, বোমা-আগুন দিয়ে মানুষ মেরে সরকার হটানোর বদ চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপি নির্বাচনী রাজনীতির ধারায় যুক্তিসংগত উপায়ে জোরেশোরে নামতে পারবে। এর ফলে তাদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আরও শক্তি ও জনসম্পৃক্তি অর্জন করবে।
যেহেতু সরকার সিটি করপোরেশন নির্বাচন করছে, তাই নির্বাচনী সভা-সমাবেশে বিএনপিকে তাড়া করার সুযোগ সরকারের থাকবে না। খালেদা জিয়াকে গুলশানের অফিসে আটকা পড়ে থাকতে হবে না। তিনি মানুষের কাতারে এসে দাঁড়াবেন। সমাবেশের অনুমতি না দিলে তিনি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ঐতিহাসিক সমাবেশ করবেন। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?
বিএনপির সামনে আজ স্বর্ণসুযোগ এসেছে। মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে জোরেশোরে নেমে পড়া উচিত। এতে সহিংস রাজনীতির একটি যুক্তিপূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটবে। রাজনীতি গণতন্ত্রের ধারায় ফিরে আসবে। মানুষ বাঁচবে। দেশ বাঁচবে।
বিএনপির আর এক মুহূর্ত দেরি করা উচিত নয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments