মৃত্যু নিয়ে এ কেমন খেলা by মাসুদ মজুমদার
---- ১.
অভিজিতের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। এ ধরনের হত্যা কার
ব্যর্থতার পরিণতি কিংবা কাদের ইন্ধনের ফসল, আমরা জানি না। পুলিশ কু খুঁজে
পায়নি। একজন ফারাবিকে বারবার গ্রেফতার করে জনগণকে হয় বিভ্রান্ত করা হয়,
নয়তো দৃষ্টি ফেরানোর কসরত করা হয়। এবারো তাই দেখলাম। অথচ প্রমাণের আগে
অভিযুক্ত করার একটি মন্দ নজির এবারো আমাদের তাড়া করল। কেউ বলল,
মান্না-খোকার ফোনালাপের প্রথম লাশ। কারো অভিযোগের সস্তা ও গতানুগতিক আঙুলটি
ইসলামপন্থীদের দিকে। প্রমাণ মিলুক বা না মিলুক, আর দশটা হত্যার মতো এটিও
আড়ালে চলে যাক কিংবা রাজনীতির উপাত্ত হোক, এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। এ ধরনের
মৃত্যু মর্মান্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। নিন্দনীয় তো বটেই। সেই সাথে মুক্তমনা
সাজার নাম করে বিশ্বাসের ঘরে আগুন জ্বালানোর ধৃষ্টতাও সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা
অবশ্যই মুক্তমনা হবো- সেই সাথে অন্যের মত ও বিশ্বাসের প্রতি সহিষ্ণুও হবো।
প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসগুলো উপড়ে ফেলার সময় ভাবতে হবে মতের স্বাধীনতার পরিধি
কতটুকু। এর সীমা কে ঠিক করবেন, আপনি নিজেই! নিজের বিশ্বাস লালন করার
এখতিয়ার সবার আছে। কিন্তু অন্যের বিশ্বাসে হানা দেয়া, সুড়সুড়ি দিয়ে সমাজকে
বিষাক্ত করার অধিকার কারো নেই। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার এই নীতিগত অবস্থানটি
পাহারা দেয়ার কথা। বর্তমান সরকার এ দায়িত্ব শুধু অবজ্ঞা করছে না, একদল
বজ্জাতকে এ নীতি ভাঙতে প্রলুব্ধ করে চলেছে।
এই দেশে একত্ববাদীর বসবাস যুগ যুগ ধরে। আবার মূর্তিবাদের অবস্থানও পাশাপাশি। কেউ কারো জন্য কখনো বিড়ম্বনার কারণ হয়নি। ধর্মীয় কারণে বিদ্বেষ, এ দেশের মাটির ধর্ম নয়। মানুষের বিশ্বাসের অংশও নয়। তাই মুক্তমনা নামে যাদের পরিচিত করানো হচ্ছে, তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। নানা নামে ও ছদ্মবেশে তারা এ জাতির বিশ্বাস ও অর্জনগুলোর শিকড় কাটে। বাম রাজনীতির নামে এরা ভড়ং করে। অথচ এরা বাম-রাম কিছুই না। কুচিন্তার নর্দমায় থাকা এক ধরনের কীট। ব্লগার অভিজিৎ হত্যা অনেকগুলো বার্তা দিয়েছে। এই সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনী নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। অনেক বেশি নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা অবস্থায়ও মানুষ খুন হয়। তাই খুনের দায় সরকারের ওপর না চাপালেও ব্যর্থতার দায় এবং ব্লেমগেম খেলার অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। প্রত্যেক ধর্মের ধার্মিক মন বিশ্বাস করে কোথায় কিভাবে কখন কার মৃত্যু হবে, সেটা শুধু ওপরওয়ালা জানেন। এই ওপরওয়ালা সব ধর্মবিশ্বাসীদের সৃষ্টিকর্তা, প্রভু। আল্লাহ, গড ও ঈশ্বর নামে মানুষ জানে। যারা সৃষ্টিকর্তা মানে না, তারাও নিজেকে সৃষ্টিকর্তা মনে করে না। হয় সংশয়বাদী, নয়তো নাস্তিক নামের আড়ালে শক্তি ও প্রকৃতি পূজারী হয়ে ওঠে। অভিজিৎ ধর্ম অস্বীকার করতেন। সেটা তার একান্ত নিজের ব্যাপার। তা নিয়ে আমাদের কারো মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়। তবে মৃত্যুকেও অস্বীকার করতেন কি না জানি না। বিশ্বাস-অবিশ্বাস তার নিজস্ব ব্যাপার। আমরা কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে, আমাদের নষ্ট রাজনীতির শিকার হলেন কি না অভিজিৎ, সেটা চিন্তা করে। এখন দেশে নিজের নাক কেটেও পরের যাত্রাভঙ্গের অসংখ্য নজির দেখতে পাচ্ছি। অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়ে নিজে সেই গর্তে পড়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তগুলো নজরে পড়ে।
আমরা এমন একটা সময় পার করছি, এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজমান, যখন কোনো ব্যাপারেই প্রাণখুলে কথা বলা যায় না। সন্দেহ বাতিক ও সংশয়বাদী মন সবাইকে শাসন করে চলেছে। অজানা ভীতি ও নিরাপত্তাহীন অবস্থার শিকার প্রত্যেক নাগরিক। পরিস্থিতি ঘোলাটে ও কুয়াশাচ্ছন্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। সব কিছুর ভেতর সন্দেহ তাড়া করে চলেছে। তার পরও ভেবে দেখতে হচ্ছে, অভিজিৎ হত্যা নিয়ে ব্লেমগেমে কার লাভ, কার ক্ষতি। এটা ভেবে দেখতে হচ্ছে এ কারণে যে- অনেকেই বলছে জঙ্গিবাদের উপস্থিতি প্রমাণ করতে এবং পশ্চিমা বিশ্বের সেনসেশন সৃষ্টি করতেই অভিজিৎকে বলি দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মহল অতি উৎসাহী হয়ে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় না নামলে আঙুলটা আমাদেরও তুলতে হতো না। তারপরও বলি তদন্ত করে দ্রুত আসল অপরাধী শনাক্ত করুন। মৌলবাদের ভূত মাথা থেকে তাড়ান। চোখ বন্ধ করলেই জঙ্গি দেখার ভীতি আর প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। এক সময় এই মনের বাঘ আমাদের ঘাড় মটকালে কিছুই করার থাকবে না।
---- ২. বাংলাদেশের মানুষকে যত দূর জানি, তারা এমন গুমোট পরিবেশ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ সহ্য করতে অভ্যস্ত নয়। ছোটবেলায় শিক্ষা আন্দোলনে চাচাতো ভাইকে পুলিশি আঘাতে আহত হতে দেখেছি। তাকে দেখার জন্য হাসপাতালে গিয়েছি। সেই উনিশ শ’ বাষট্টি সালের কথা। উদ্বেলিত মনে ’৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করেছি, যদিও যুদ্ধহীন পরিস্থিতিতে। কারণ, পূর্বাঞ্চলে সে সময় কোনো যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের আবেগ-উচ্ছ্বাস বোঝার মতো বয়স না হলেও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে এ দেশবাসীর দেশপ্রেমের মাত্রাটি উপভোগ করেছিলাম। তার আগে আইয়ুব-ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনে বিরোধী দলের সম্মিলিত প্রার্থীকে জেতানোর মিছিলে উৎসাহ নিয়ে যোগ দিতাম। স্বৈরাচার ও একনায়ক আইয়ুববিরোধী মানসটি তখনই জন্ম নিয়েছিল। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের ভোজবাজির কারণে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে আবেগ-উচ্ছ্বাসসহ ঢেলে দিয়েও তাকে জেতাতে পারেনি। কারণ, একনায়ক আইয়ুব রাষ্ট্রযন্ত্রকে কব্জা করে নিয়ে জনগণের অধিকার অস্বীকার করে চলেছিল। সব দেশে সব কালে নষ্ট শাসনকর্তা ও ভণ্ড শাসকেরা জনমতকে ভয় পায় এবং সহ্য করতে চায় না। আইয়ুবের প্রতি কোনো ঘৃণা ছিল না, বরং পঁয়ষট্টি সালে তার যুদ্ধ ঘোষণার ভাষণ শুনে এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম, যা কল্পনা করতেও ভালো লাগে। কিন্তু তিনি ফাতেমা জিন্নাহর মতো মহীয়সী নারী, যিনি কিনা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একমাত্র বোন, পাকিস্তানের দুই অংশের গণমানুষ ও সব বিরোধী দল তাকে আইয়ুবের বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছিল। মাদারে মিল্লাত বলে আখ্যায়িত করেছিল। তাকে আইয়ুব খান সহ্য করতে চাননি। অথচ ফাতেমা জিন্নাহ সে সময়ে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হয়ে সব বিরোধী দলের আস্থা ও ভরসাকেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন। আইয়ুব তাকে নয়, গণতন্ত্রকে ও জনমতকে পদদলিত করেছিলেন। এটাই ছিল আইয়ুবের বিরুদ্ধে আমার বালকমনে বিরূপ ধারণা জন্ম নেয়ার আসল কারণ।
আইয়ুব উন্নয়নের ডুগডুগি বাজাতেন। অগ্রগতির দশ বছর পালন করেছিলেন। নিজে নিজে ফিল্ড মার্শাল খেতাবও গ্রহণ করেছিলেন। অথচ মানুষের ঘৃণার কারণে স্বৈরতন্ত্রের ধ্বজাধারী এই কলঙ্কিত ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একনায়কের পরিণতি ভালো হয়নি, মন্দের উপমা হয়ে ঊনসত্তরে তাকে ছিটকে পড়তে হলো। আইয়ুবের নাম এখন দুই দেশের মানুষ শ্রদ্ধাভরে নেয় না। তার দশ বছরের শাসন ঘৃণার উপমা। আইয়ুব গেট এখন আসাদ গেট। আইয়ুব নগর এখন শেরেবাংলা নগর।
এক সময় আইয়ুবের অবস্থান ছিল সিংহ সার্দুলের মতো। শহুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ভাতিজার কাছে চাচা জানতে চাইতেন- ‘এবার আইয়ুব খান কে হলো?’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষ আইয়ুব কারো নাম ভাবতে ভুলে গিয়েছিল, ভাবত শাসকের পদবি কিংবা প্রতিশব্দ। আইয়ুব যেসব উন্নয়ন করেছিলেন- সেটা আধুনিক ঢাকার গোড়াপত্তনের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু মানুষ মনে রাখার দায়বোধ করেনি।
পৃথিবীর ইতিহাসে ক্ষণস্থায়ী শাসন পরিচালনা করেও অমর হওয়ার অজস্র নজির আছে। আবার দীর্ঘ দিন জোরজুলুমের শাসন করেও কেউ মানুষের মনে স্থান পায়নি। আমরা যারা ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট পড়ার চেষ্টা করেছি, কুরআন-বাইবেলের খানিকটা ধারণা রাখি, বৈদিক যুগের ইতিহাস পড়েছি; তারা সুশাসক ও দুঃশাসনের হোতাদের কাহিনী জানি। আমরা সত্য, ত্রেতা, দাপর ও কলি যুগের খবর রাখি। ঘোর কালিও আমাদের তাড়া করছে। তাই দুর্বিনীত শাসকদের পতনও মনে দাগ কাটে। শাসকেরা যখন বাড়াবাড়ি করেন, তখনই ইতিহাসের দিকে তাকাই। পরিণতি ভেবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শরীর হিমশীতল হয়ে যায়।
আমরা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকেই অপাঙ্ক্তেয় ভাবি না। ভুঁইফোড়ও মনে করি না। কারো সমর্থন বেশি, কারো কম। কারো গণভিত্তি মজবুত, কারো দুর্বল। তাই প্রত্যেক দলের ইতিবাচক-নেতিবাচক ভূমিকাই বিবেচনায় রাখি। আমার নিজের মতকে যেমন লালন করি, তেমনি প্রত্যেকের একটা মত থাকার অধিকার ও এখতিয়ার স্বীকার করি। কারো দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলি না- কিন্তু শাসকদের ভুলকে ভুুল, বাড়াবাড়িকে বাড়াবাড়ি বলতে চাই। আমরা জাতিকে বিভক্ত করার ঘোরতর বিরোধী। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে, আদর্শকে আদর্শ দিয়ে, বক্তব্যকে বক্তব্য দিয়ে মোকাবেলায় বিশ্বাসী। আমরা মুক্তমনা বলে আগ্রাসীও নই, আবার বোবা শয়তানের মতো নির্লিপ্ত থাকারও পক্ষপাতী নই। আমরা বামেরও ডান, ডানেরও বাম। বামও আমরা, ডানও আমরা। আমরাই ধার্মিক। আমরাই রক্ষণশীল, আমরাই প্রগতিশীল।
বর্তমান শাসকেরা আমাদের সব ধরনের বিশ্বাসকে আহত করে চলেছেন। তারা আর পরিণামদর্শী অবস্থানে নেই। তারা ভাগ করো শাসন করো নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। তার সাথে খাটাচ্ছেন ক্ষমতার জোর। তাই শক্তির কাছে যুক্তি হেরে যাচ্ছে। মিথ্যার বেসাতির ভেতর সত্য হাবুডুবু খাচ্ছে। শাসকেরা ভাবছেন তারা জিতে যাচ্ছেন- কার্যত তারা হেরেই বসে আছেন। তাদের ক্ষমতা আড়ষ্ট। গতি শ্লথ, বক্তব্য আত্মঘাতী, পথচলা বিভ্রান্তির ভেতর। এটাই ভয়াবহ পরিণতিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে আনছে। পতনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়েও অতীত দুর্বিনীত শাসকেরা আস্ফালন প্রদর্শন করেছেন। ইতিহাস তাদের কাউকে ক্ষমা করেনি। সময় তাদেরকে সাহায্যও করেনি। রক্ষাও করেনি। বরং নিঃসঙ্গ হয়ে তারা নিজেকে অসহায়ের মতো পরিস্থিতির কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
তাই কার নির্দেশে কোথায় কার লাশ পড়ছে- এটা জনগণ গুনে গুনে হিসাব নেবে। শাসকেরা দায়মুক্তি চান- ইতিহাস ও জনগণ দায়মুক্তি দেয় না। অভিজিৎ থেকে বিশ্বজিৎ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেনী, ঢাকার রাজপথ থেকে ডোবা-নালা, খাল, বিল-ঝিলে যেসব লাশ পড়ছে; কোনোটির রক্ত-হাড়গোড় চুপ থাকবে না। নাই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও কথা বলে উঠবে। বিচারবহির্ভূত হত্যার মিছিল দীর্ঘতর হতে হতে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। হুকুমের গুলি থামছে না। দোহাই আল্লাহর। দোহাই আপনাদের অবিশ্বাসী মনের, দোহাই আপনাদের মানবিকবোধের। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মৃত্যু নিয়ে আর কোনো খেলা নয়।
এই দেশে একত্ববাদীর বসবাস যুগ যুগ ধরে। আবার মূর্তিবাদের অবস্থানও পাশাপাশি। কেউ কারো জন্য কখনো বিড়ম্বনার কারণ হয়নি। ধর্মীয় কারণে বিদ্বেষ, এ দেশের মাটির ধর্ম নয়। মানুষের বিশ্বাসের অংশও নয়। তাই মুক্তমনা নামে যাদের পরিচিত করানো হচ্ছে, তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। নানা নামে ও ছদ্মবেশে তারা এ জাতির বিশ্বাস ও অর্জনগুলোর শিকড় কাটে। বাম রাজনীতির নামে এরা ভড়ং করে। অথচ এরা বাম-রাম কিছুই না। কুচিন্তার নর্দমায় থাকা এক ধরনের কীট। ব্লগার অভিজিৎ হত্যা অনেকগুলো বার্তা দিয়েছে। এই সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনী নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। অনেক বেশি নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা অবস্থায়ও মানুষ খুন হয়। তাই খুনের দায় সরকারের ওপর না চাপালেও ব্যর্থতার দায় এবং ব্লেমগেম খেলার অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। প্রত্যেক ধর্মের ধার্মিক মন বিশ্বাস করে কোথায় কিভাবে কখন কার মৃত্যু হবে, সেটা শুধু ওপরওয়ালা জানেন। এই ওপরওয়ালা সব ধর্মবিশ্বাসীদের সৃষ্টিকর্তা, প্রভু। আল্লাহ, গড ও ঈশ্বর নামে মানুষ জানে। যারা সৃষ্টিকর্তা মানে না, তারাও নিজেকে সৃষ্টিকর্তা মনে করে না। হয় সংশয়বাদী, নয়তো নাস্তিক নামের আড়ালে শক্তি ও প্রকৃতি পূজারী হয়ে ওঠে। অভিজিৎ ধর্ম অস্বীকার করতেন। সেটা তার একান্ত নিজের ব্যাপার। তা নিয়ে আমাদের কারো মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়। তবে মৃত্যুকেও অস্বীকার করতেন কি না জানি না। বিশ্বাস-অবিশ্বাস তার নিজস্ব ব্যাপার। আমরা কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে, আমাদের নষ্ট রাজনীতির শিকার হলেন কি না অভিজিৎ, সেটা চিন্তা করে। এখন দেশে নিজের নাক কেটেও পরের যাত্রাভঙ্গের অসংখ্য নজির দেখতে পাচ্ছি। অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়ে নিজে সেই গর্তে পড়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তগুলো নজরে পড়ে।
আমরা এমন একটা সময় পার করছি, এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজমান, যখন কোনো ব্যাপারেই প্রাণখুলে কথা বলা যায় না। সন্দেহ বাতিক ও সংশয়বাদী মন সবাইকে শাসন করে চলেছে। অজানা ভীতি ও নিরাপত্তাহীন অবস্থার শিকার প্রত্যেক নাগরিক। পরিস্থিতি ঘোলাটে ও কুয়াশাচ্ছন্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। সব কিছুর ভেতর সন্দেহ তাড়া করে চলেছে। তার পরও ভেবে দেখতে হচ্ছে, অভিজিৎ হত্যা নিয়ে ব্লেমগেমে কার লাভ, কার ক্ষতি। এটা ভেবে দেখতে হচ্ছে এ কারণে যে- অনেকেই বলছে জঙ্গিবাদের উপস্থিতি প্রমাণ করতে এবং পশ্চিমা বিশ্বের সেনসেশন সৃষ্টি করতেই অভিজিৎকে বলি দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মহল অতি উৎসাহী হয়ে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় না নামলে আঙুলটা আমাদেরও তুলতে হতো না। তারপরও বলি তদন্ত করে দ্রুত আসল অপরাধী শনাক্ত করুন। মৌলবাদের ভূত মাথা থেকে তাড়ান। চোখ বন্ধ করলেই জঙ্গি দেখার ভীতি আর প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। এক সময় এই মনের বাঘ আমাদের ঘাড় মটকালে কিছুই করার থাকবে না।
---- ২. বাংলাদেশের মানুষকে যত দূর জানি, তারা এমন গুমোট পরিবেশ পরিস্থিতি বেশিক্ষণ সহ্য করতে অভ্যস্ত নয়। ছোটবেলায় শিক্ষা আন্দোলনে চাচাতো ভাইকে পুলিশি আঘাতে আহত হতে দেখেছি। তাকে দেখার জন্য হাসপাতালে গিয়েছি। সেই উনিশ শ’ বাষট্টি সালের কথা। উদ্বেলিত মনে ’৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করেছি, যদিও যুদ্ধহীন পরিস্থিতিতে। কারণ, পূর্বাঞ্চলে সে সময় কোনো যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের আবেগ-উচ্ছ্বাস বোঝার মতো বয়স না হলেও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে এ দেশবাসীর দেশপ্রেমের মাত্রাটি উপভোগ করেছিলাম। তার আগে আইয়ুব-ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনে বিরোধী দলের সম্মিলিত প্রার্থীকে জেতানোর মিছিলে উৎসাহ নিয়ে যোগ দিতাম। স্বৈরাচার ও একনায়ক আইয়ুববিরোধী মানসটি তখনই জন্ম নিয়েছিল। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের ভোজবাজির কারণে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে আবেগ-উচ্ছ্বাসসহ ঢেলে দিয়েও তাকে জেতাতে পারেনি। কারণ, একনায়ক আইয়ুব রাষ্ট্রযন্ত্রকে কব্জা করে নিয়ে জনগণের অধিকার অস্বীকার করে চলেছিল। সব দেশে সব কালে নষ্ট শাসনকর্তা ও ভণ্ড শাসকেরা জনমতকে ভয় পায় এবং সহ্য করতে চায় না। আইয়ুবের প্রতি কোনো ঘৃণা ছিল না, বরং পঁয়ষট্টি সালে তার যুদ্ধ ঘোষণার ভাষণ শুনে এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম, যা কল্পনা করতেও ভালো লাগে। কিন্তু তিনি ফাতেমা জিন্নাহর মতো মহীয়সী নারী, যিনি কিনা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একমাত্র বোন, পাকিস্তানের দুই অংশের গণমানুষ ও সব বিরোধী দল তাকে আইয়ুবের বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছিল। মাদারে মিল্লাত বলে আখ্যায়িত করেছিল। তাকে আইয়ুব খান সহ্য করতে চাননি। অথচ ফাতেমা জিন্নাহ সে সময়ে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হয়ে সব বিরোধী দলের আস্থা ও ভরসাকেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন। আইয়ুব তাকে নয়, গণতন্ত্রকে ও জনমতকে পদদলিত করেছিলেন। এটাই ছিল আইয়ুবের বিরুদ্ধে আমার বালকমনে বিরূপ ধারণা জন্ম নেয়ার আসল কারণ।
আইয়ুব উন্নয়নের ডুগডুগি বাজাতেন। অগ্রগতির দশ বছর পালন করেছিলেন। নিজে নিজে ফিল্ড মার্শাল খেতাবও গ্রহণ করেছিলেন। অথচ মানুষের ঘৃণার কারণে স্বৈরতন্ত্রের ধ্বজাধারী এই কলঙ্কিত ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একনায়কের পরিণতি ভালো হয়নি, মন্দের উপমা হয়ে ঊনসত্তরে তাকে ছিটকে পড়তে হলো। আইয়ুবের নাম এখন দুই দেশের মানুষ শ্রদ্ধাভরে নেয় না। তার দশ বছরের শাসন ঘৃণার উপমা। আইয়ুব গেট এখন আসাদ গেট। আইয়ুব নগর এখন শেরেবাংলা নগর।
এক সময় আইয়ুবের অবস্থান ছিল সিংহ সার্দুলের মতো। শহুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ভাতিজার কাছে চাচা জানতে চাইতেন- ‘এবার আইয়ুব খান কে হলো?’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষ আইয়ুব কারো নাম ভাবতে ভুলে গিয়েছিল, ভাবত শাসকের পদবি কিংবা প্রতিশব্দ। আইয়ুব যেসব উন্নয়ন করেছিলেন- সেটা আধুনিক ঢাকার গোড়াপত্তনের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু মানুষ মনে রাখার দায়বোধ করেনি।
পৃথিবীর ইতিহাসে ক্ষণস্থায়ী শাসন পরিচালনা করেও অমর হওয়ার অজস্র নজির আছে। আবার দীর্ঘ দিন জোরজুলুমের শাসন করেও কেউ মানুষের মনে স্থান পায়নি। আমরা যারা ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট পড়ার চেষ্টা করেছি, কুরআন-বাইবেলের খানিকটা ধারণা রাখি, বৈদিক যুগের ইতিহাস পড়েছি; তারা সুশাসক ও দুঃশাসনের হোতাদের কাহিনী জানি। আমরা সত্য, ত্রেতা, দাপর ও কলি যুগের খবর রাখি। ঘোর কালিও আমাদের তাড়া করছে। তাই দুর্বিনীত শাসকদের পতনও মনে দাগ কাটে। শাসকেরা যখন বাড়াবাড়ি করেন, তখনই ইতিহাসের দিকে তাকাই। পরিণতি ভেবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শরীর হিমশীতল হয়ে যায়।
আমরা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকেই অপাঙ্ক্তেয় ভাবি না। ভুঁইফোড়ও মনে করি না। কারো সমর্থন বেশি, কারো কম। কারো গণভিত্তি মজবুত, কারো দুর্বল। তাই প্রত্যেক দলের ইতিবাচক-নেতিবাচক ভূমিকাই বিবেচনায় রাখি। আমার নিজের মতকে যেমন লালন করি, তেমনি প্রত্যেকের একটা মত থাকার অধিকার ও এখতিয়ার স্বীকার করি। কারো দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলি না- কিন্তু শাসকদের ভুলকে ভুুল, বাড়াবাড়িকে বাড়াবাড়ি বলতে চাই। আমরা জাতিকে বিভক্ত করার ঘোরতর বিরোধী। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে, আদর্শকে আদর্শ দিয়ে, বক্তব্যকে বক্তব্য দিয়ে মোকাবেলায় বিশ্বাসী। আমরা মুক্তমনা বলে আগ্রাসীও নই, আবার বোবা শয়তানের মতো নির্লিপ্ত থাকারও পক্ষপাতী নই। আমরা বামেরও ডান, ডানেরও বাম। বামও আমরা, ডানও আমরা। আমরাই ধার্মিক। আমরাই রক্ষণশীল, আমরাই প্রগতিশীল।
বর্তমান শাসকেরা আমাদের সব ধরনের বিশ্বাসকে আহত করে চলেছেন। তারা আর পরিণামদর্শী অবস্থানে নেই। তারা ভাগ করো শাসন করো নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। তার সাথে খাটাচ্ছেন ক্ষমতার জোর। তাই শক্তির কাছে যুক্তি হেরে যাচ্ছে। মিথ্যার বেসাতির ভেতর সত্য হাবুডুবু খাচ্ছে। শাসকেরা ভাবছেন তারা জিতে যাচ্ছেন- কার্যত তারা হেরেই বসে আছেন। তাদের ক্ষমতা আড়ষ্ট। গতি শ্লথ, বক্তব্য আত্মঘাতী, পথচলা বিভ্রান্তির ভেতর। এটাই ভয়াবহ পরিণতিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে আনছে। পতনের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়েও অতীত দুর্বিনীত শাসকেরা আস্ফালন প্রদর্শন করেছেন। ইতিহাস তাদের কাউকে ক্ষমা করেনি। সময় তাদেরকে সাহায্যও করেনি। রক্ষাও করেনি। বরং নিঃসঙ্গ হয়ে তারা নিজেকে অসহায়ের মতো পরিস্থিতির কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
তাই কার নির্দেশে কোথায় কার লাশ পড়ছে- এটা জনগণ গুনে গুনে হিসাব নেবে। শাসকেরা দায়মুক্তি চান- ইতিহাস ও জনগণ দায়মুক্তি দেয় না। অভিজিৎ থেকে বিশ্বজিৎ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেনী, ঢাকার রাজপথ থেকে ডোবা-নালা, খাল, বিল-ঝিলে যেসব লাশ পড়ছে; কোনোটির রক্ত-হাড়গোড় চুপ থাকবে না। নাই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও কথা বলে উঠবে। বিচারবহির্ভূত হত্যার মিছিল দীর্ঘতর হতে হতে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। হুকুমের গুলি থামছে না। দোহাই আল্লাহর। দোহাই আপনাদের অবিশ্বাসী মনের, দোহাই আপনাদের মানবিকবোধের। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মৃত্যু নিয়ে আর কোনো খেলা নয়।
No comments