কাশ্মিরিদের হিরো by হামিদ মীর

১৯৮২ সালের কথা। তখন জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতায়। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ইসলাম ও পাকিস্তান ভাবধারা সংরণের দায়িত্ব ছিল ধর্মীয় নেতাদের ওপর। গণতন্ত্রের কথা বললে গাদ্দার ও ভারতীয় এজেন্ট আখ্যায়িত করা হতো। ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বৈরুতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। তিনি সেখানে ‘লোটাস’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। গরমের ছুটিতে পাকিস্তান এসে একদিন ইসলামাবাদে বেগম সরফরাজ ইকবালের কাছে উঠলেন। ওই সময় ইসলামাবাদ থেকে ‘দ্য মুসলিম’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা বের হতো। মুশাহিদ হুসাইন এর সম্পাদক ছিলেন। আর আমি তখন ওই পত্রিকায় স্টুডেন্টস ডায়েরি লিখতাম। ২৮ জুন ১৯৮২ ওই পত্রিকায় ফয়েজ আহমদ ফয়েজের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, যা আনওয়ার ইকবাল নিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে এমন কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল জিয়ার সরকারের প থেকে ফয়েজ আহমদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগের জবাব নেয়া। একটা প্রশ্ন এটাও ছিল যে, আপনি ভিয়েতনাম ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার কথা তো বলেন, কিন্তু আপনি কাশ্মিরের স্বাধীনতার কথা কেন বলেন না? ফয়েজ আহমদ উত্তরে বললেন, ‘পাকিস্তান টাইমসের’ অফিসে যান, কাশ্মির সম্বন্ধে আমি যা লিখেছি সেখানে গিয়ে তা পড়ুন।
কয়েক দিন আগে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবালের ভূমিকার ওপর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে জানা গেল, ফয়েজ আহমদ ফয়েজেরও কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে বেশ গভীর সম্পর্ক ছিল। ইকবাল ও ফয়েজের ওপর অনেক কিছুই লেখা হয়েছে, কিন্তু কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে এ দু’জন মহান কবির সংশ্লিষ্টতার ওপর গবেষণা খুব কমই হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্র কুমার গুজরাল কেন্দ্রীয় ইকবাল কমিটির প্রেসিডেন্ট ও আলী সরদার জাফরি সেক্রেটারি ছিলেন। ওই কমিটি জামেয়া মিল্লিয়া দিল্লির সাথে যৌথভাবে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল, যেখানে ইকবাল ও কাশ্মিরের কিছু প্রসঙ্গ আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এর ওপর আর কোনো গবেষণা হয়নি। গোপি চান্দ নারাঙ্গ পরবর্তীকালে সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধগুলো সঙ্কলন করে ‘ইকবাল কা ফান’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ওই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ। ভূমিকায় আছে, ১৯২৪ সালে শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ লাহোর ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। ওই সময় কাশ্মিরের স্বাধীনতা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা তার ছিল না। ওই সময় শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ লাহোরে আল্লামা ইকবালের সাথে পরিচিত হন। ইকবাল যখন জানতে পারলেন শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ শ্রীনগরের মানুষ, তখন তিনি তার মধ্যে স্বাধীনতার আকাক্সাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ লিখেছেন, ১৯৩১ সালে তিনি কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য রীতিমতো রাজনৈতিক আন্দোলন করলে সমাবেশগুলোতে ইকবালের কবিতা আওড়াতেন। ওই সময় ইকবাল শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর নামে কিছু পত্রও লিখেছেন।
ফতেহ মুহাম্মদ মালিকের গ্রন্থ ‘তাহরিকে আজাদিয়ে কাশ্মির : উর্দু আদাব কে আয়েনে মে’ (কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলন : উর্দু সাহিত্যের দর্পণে) বলছে, আল্লামা ইকবাল কাশ্মিরিদের স্বাধিকারের জন্য কার্যত লড়াইয়ের সূচনা করেন ১৯০৯ সালে। ১৪ আগস্ট ১৯৩১ সালে লাহোরে প্রথমবারের মতো কাশ্মির দিবস পালন করা হয় এবং ইকবাল সেখানে বক্তব্য রেখে তার কয়েকটি বিখ্যাত কবিতাও পাঠ করেন। তৎকালীন জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের ডোগরা শাসক আল্লামা ইকবালের তৎপরতার ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করে। কাশ্মির পণ্ডিত গাশ লাল কোল অপপ্রচার চালান যে, শ্রীনগরে ছড়িয়ে পড়া বিদ্রোহের মাস্টারমাইন্ড আল্লামা ইকবাল। পুনের মারাঠা পত্রিকায় গাশ লাল কোল তার এক প্রবন্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেন, আল্লামা ইকবাল জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের মুসলমানদের বোমা বানানোর উৎসাহ দিচ্ছেন। মাওলানা আব্দুল মজিদ সালেক তার পত্রিকা ‘ইনকিলাবে’ এ অপপ্রচার ও মিথ্যা অভিযোগ নাকচ করে দেন। শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল্লামা ইকবালকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তার পরও তিনি কংগ্রেসের কাছের মানুষ হয়ে যান। তিনি মুসলিম কনফারেন্স ছেড়ে দিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স গঠন করেন। শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ তার বক্তৃতায় রীতিমতো ইকবালের এই কবিতা বেশ ব্যবহার করেন-
জিস খাক কে জমির মে হো আতশে চানার
মুমকিন নেহি কে সারদ হো ওহ খাকে আরজুমান্দ।
যে মাটির গভীরে রয়েছে চানার গাছের আগুন
সম্ভব নয় সে মহান মাটি শীতল হবে।

শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর উর্দু সাহিত্যপ্রীতি তাকে ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে। ১৯৪১ সালে শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আলিসের সাথে ফয়েজের বিয়ে দেন। ১৯৪৪ সালে শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের জন্য কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করেন। ওই প্রস্তাবনা তৈরিতে ফয়েজ আহমদ ফয়েজও অংশ নেন। ওই প্রস্তাবনার শিরোনাম দেয়া হয়েছিল- ‘নয়া কাশ্মির’। এরপর ১৯৪৭ সাল চলে এলো। শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন। ওই সময় ফয়েজ আহমদ মিয়া ইফতেখারুদ্দিনকে সাথে নিয়ে শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর সাথে দেখা করেন এবং তাকে কংগ্রেস থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর সহযোগিতায় ভারত কাশ্মির দখল করলে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ওই দখলদারির পূর্ণ বিরোধিতা করেন। ওই সময় ফয়েজ আহমদ ‘পাকিস্তান টাইমসের’ সম্পাদক ছিলেন। ৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ ‘পাকিস্তান টাইমসে’ বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক ও নামীদামি ব্যক্তির যৌথ বিবৃতি প্রকাশ হয়েছিল, যাতে কাশ্মিরের ওপর ভারতের দখলদারিত্বের তীব্র নিন্দা করা হয়। ওই বিবৃতি ফয়েজ আহমদ ও প্রফেসর এ এ বুখারি উভয়ে মিলে তৈরি করেছিলেন। ওই বিবৃতিতে তারা দু’জন ছাড়াও শেখ আব্দুল কাদির, হাফিজ জলান্ধরি, ড. এম ডি তাসির, আব্দুর রহমান চুগতাই ও আরো অনেকেই স্বাক্ষর করেন। ১ জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে ভারত নিজেই কাশ্মির সমস্যা নিয়ে জাতিসঙ্ঘে হাজির হয় এবং একতরফা অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দেয়। পাকিস্তান ওই অস্ত্রবিরতি মেনে নেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার মেজর জেনারেল আকবর খান ওই অস্ত্রবিরতির পে ছিলেন না। তার মতে, কাশ্মির স্বাধীনতা নস্যাৎ করার জন্য ভারত অস্ত্রবিরতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ফয়েজ আহমদ ফয়েজও মেজর জেনারেল আকবর খানের সমমনা ছিলেন। সেনাবাহিনীর যে অফিসার অস্ত্রবিরতির বিরোধী ছিলেন, তাকে ১৯৫১ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের নির্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে ফেলা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ ফয়েজও ছিলেন। কাশ্মির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তার ভালোবাসাকে গাদ্দারির অভিযোগে রূপান্তর করা হলো। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-
শত্রুর ষড়যন্ত্রের কিসসা বলব নাকি বলব না?
প্রিয় বন্ধুর অভিযোগ করব নাকি করব না?

পাকিস্তানের সেনাশাসক ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মতো বেশ কয়েকজন দেশপ্রেমিককে গাদ্দার আখ্যায়িত করে ফেলে। আর কিছু গাদ্দারকে দেশপ্রেমিক বানিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযান শুরু হলে ফয়েজ ও জালিবের মতো ব্যক্তিরা ওই সেনা অভিযানের বিরোধিতা করেন। সেনাশাসকদের তোষামোদকারীরা ফয়েজ ও জালিবকে আবার গাদ্দার বলে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ফয়েজ, জালিব এবং আরো কিছু পাকিস্তানিকে ১৯৭১ সালের সেনা অভিযানের বিরোধিতার ওপর বিশেষ পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রদান করে। যাতে বাংলাদেশের নিউ জেনারেশনকে বলা যায় যে, পুরো পাকিস্তান ওই অভিযানের জন্য দায়ী ছিল না। ফয়েজ ও জালিবকে গাদ্দার বলত যারা, আজ পাকিস্তানে তাদের কেউ কোনো খোঁজখবরই নেয় না। অথচ অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বক্তৃতামালা আল্লামা ইকবালের কবিতা দিয়ে শুরু হয়ে ফয়েজ, জালিব, ফারাজ ও আহমদ নাদিম কাসেমির কবিতায় গিয়ে শেষ হয়। অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে ২৬ জানুয়ারির কালো দিবস বা ৫ ফেব্রুয়ারির কাশ্মির দিবস পালনকালে সভা-সমাবেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়, বরং ইকবাল ও ফয়েজের কবিতা পাঠ করা হয়। জালিব ও ফারাজের নাম উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানে গাদ্দার আখ্যায়িত ব্যক্তিরাই যে কাশ্মিরিদের হিরো।
সূত্র : পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
উর্দু থেকে ভাষান্তর : ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

* হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

No comments

Powered by Blogger.