দমন-পীড়ন বেড়েছে গণমাধ্যম ও বিরোধীদের ওপর -এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন
সাম্প্রতিক
সপ্তাহগুলোতে বাংলাদেশ সরকার গণমাধ্যম ও বিরোধী দলগুলোর ওপর দমনপীড়ন
বৃদ্ধি করেছে। বিরোধী দলগুলোর সংবাদ ও দুর্দশা সেন্সর করতে দেশটির
গণমাধ্যমকে বাধ্য করা হচ্ছে। এর মধ্যে চলছে বিরোধী সমর্থকদের একচেটিয়া
গ্রেপ্তার, আটক করার হিড়িক। হংকংভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। রাজনৈতিক সংঘাত
ও সেন্সরশিপের ধারা ভেঙে দিতে তারা দেশী ও বিদেশীদের হস্তক্ষেপ করার
আহ্বান জানিয়েছে। বলেছে, যদি তারা বাংলাদেশের এ পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ না
করে তাহলে দেশটি রক্তপাতের দিকে এগিয়ে যাবে। এর প্রেক্ষিতে তারা দেশে
ক্রমবর্ধমান সহিংসতার আশঙ্কা করছে। ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গত ২৮শে
ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজ’-এর কার্যালয়ে কোন কারণ
ছাড়াই অভিযান চালায় পুলিশ। আর সাংবাদিকদের ‘করুণ পরিণতি’র হুমকি দেয় তারা।
গত ৭ই জানুয়ারি বেসরকারি টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আব্দুস
সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক ‘পর্নোগ্রাফি’ মামলায় এখন তাকে ৫ দিনের
রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। কোন অভিযোগকারী মি. সালামকে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত
করেন নি, এ পদক্ষেপের যথার্থতার পক্ষে পুলিশের কাছে কোন তথ্যপ্রমাণও নেই।
একই দিনে হাই কোর্টের একটি রুলিং লক্ষ্যণীয়। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সেদিন
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র এবং বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব
তারেক রহমানের কোন বিবৃতি প্রকাশ বা সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ২৭শে
ডিসেম্বর থেকে গাজীপুর জেলায় বিরোধী নেতাদের সকল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ
সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে সকল প্রকার সভা-সমাবেশ
নিষিদ্ধ করতে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮-এর ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
বিরোধীরা ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনটি জন-প্রতিবাদের
মাধ্যমে স্মরণ করতে চাইছিল। শুধু নিষেধাজ্ঞাই নয়, ৩রা জানুয়ারি রাত থেকে
পুলিশ এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তার গুলশান কার্যালয়ে
অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বিরোধী নেতাকে বেষ্টনী দিয়ে ঘেরাও করতে বালি, ইট আর
কাঠভর্তি ট্রাক জব্দ করে ভবনের চারপাশে রেখে দেয়া হয়েছে। খালেদাকে
জনসমাবেশে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার জন্য তার কার্যালয়ের প্রধান ফটক
তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। বাংলাদেশে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দল আর তাদের মিত্রদের
জনসমাবেশ করার অনুমতি আছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগকে ১২ই জানুয়ারি সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। পক্ষান্তরে সমাবেশ করতে
বিরোধীদের অধিকার বারবার প্রত্যাখ্যান করে আসছে পুলিশ। সভা-সমাবেশ আয়োজনের
অধিকার বারবার প্রত্যাখ্যাত হবার পর বিরোধীরা দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের
অবরোধের ডাক দিয়েছে। এ অবরোধ শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। এরপর থেকে
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহিংস সংঘাতের খবর আসছে। বিরোধী দলের
কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের বিচ্ছিন্ন লড়াইয়ের খবর এসেছে। কখনও পুলিশের
সঙ্গে যোগ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা। গত সপ্তাহে পুলিশের গুলিতে আর
অগ্নিসংযোগে কমপক্ষে এক ডজন মানুষ জীবন হারিয়েছেন। শ’ শ’ বিরোধী নেতাকর্মী ও
নিরপরাধ নাগরিককে ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধ মামলায়
তাদের জড়িত বলে দেখানো হয়েছে। জনগণের ম্যান্ডেট না থাকায় ক্ষমতাসীন সরকার
দেশের অনেক নাগরিকের দৃষ্টিতে অবৈধ। ২০১৪ সালের জানুয়ারির প্রহসনের
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে। বিশ্বাসযোগ্য ও স্বচ্ছ
একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে জনগণের
দাবির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ধরে রেখেছে সরকার। জনগণের দাবির জবাব দেয়ার
পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভর করে
আসছে। এসব সংস্থা রাজপথে প্রতিবাদকারীদের গুলি করে ধরাশায়ী করছে। শেখ
হাসিনার মন্ত্রিপরিষদের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ১১ই জানুয়ারি ঘোষণা
দিয়েছেন, ৭০ এর দশকে নকশালদের যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছিল, বিরোধীদের
সেভাবেই মোকাবিলা করবে সরকার। মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘১৯৭১ এ দেশ স্বাধীন হবার
পর নকশালদের পরিণতি যা হয়েছিল, বিএনপিরও একই পরিণতি হবে।’ তথাকথিত ওই
নকশাল, যাদের দিকে মন্ত্রী ইঙ্গিত করেছেন, তাদেরকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা
হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দিয়ে। বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী ও
ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সিনিয়র এ নেতার এমন বক্তব্য আজকের
বাংলাদেশে শীতল বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়। আভাস দেয় সামনে কি হতে চলেছে।
রাজনৈতিক সংঘাত আর সেন্সরশিপের ধারা ভেঙে দিতে দেশী ও বিদেশী
স্বার্থসংশ্লিষ্টরা যদি হস্তক্ষেপ না করেন, তাহলে দেশটি রক্তপাতের দিকে
এগুচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর হুমকির আলোকে এশিয়ান হিউম্যান
রাইটস কমিশন বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার আশঙ্কা করছে।
No comments